ছেলেটার মাথা কাটা গেছে। মুণ্ডুহীন ধড়টা পড়ে আছে। একবিন্দু রক্ত পড়েনি। চাকায় চাকায় ঘষড়াতে ঘষড়াতে মাথাটা নিখোঁজ। এ রকম বডি আইডেন্টিফাই করা খুব মুশকিল হয়। রেল পুলিশ এসেছে ডোম নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বাঁশে হাত-পা বেঁধে চ্যাংদোলা করে ঝুলিয়ে নিয়ে চলে যাবে।
এরপর গাদা ঘরে। শনাক্ত করতে এলে ভালো, না হলে বেওয়ারিশ লাশের ট্রিটমেন্ট হবে। মুখে ওড়না চাপা দিয়ে একটা মেয়ে এগিয়ে এলো। চোখ থেকে টস টস করে জল পড়ছে।
—ছেলেটা কি আপনার পরিচিত?
—না!
সম্পর্ক-পরিচয় সবারই এই পৃথিবীর প্ল্যাটফর্মের ওপর এসে হয়। আবার কেটেও যায়। মেয়েটা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো। কেউ বলছে প্রেমে বিফলতায়; কেউ বলছে বেকারত্বের জ্বালায়; কেউ আবার বলছে কঠিন অসুখ। ধড়টা দেখে খুব বয়স্ক মনে হয় না—জিন্স আর টি-শার্ট গায়ে। আত্মহত্যার তৃতীয় সম্ভাবনাটা খুব একটা টেকে না। মাথার দুই পাশে কামানো; মোরগের ঝুঁটির মতো চুল; লক্কা পায়রার মতো পোশাক! দুই কানে গোঁজা তেঁতুল বীচির মতো হেড ফোন।
ছেলেটা বললো—বোকাচোদা! একটা মাল গেছে আরেকটা আসবে। মালের কি ক্রাইসিস পড়েছে নাকি? ছবি হয়ে গেলি! কার বাপের ইয়েটা ছেঁড়া গেলো।
শুনে বললাম—হয়তো এমন কিছু হারিয়েছিল, যা আর ফিরে পাওয়া যেতো না। এমন আমরা রোজই হারাচ্ছি। টাকা হারাচ্ছি, সম্মান হারাচ্ছি, বোধ বুদ্ধি হারাচ্ছি, সময় হারাচ্ছি, স্মৃতিশক্তি হারাচ্ছি, আত্মীয় পরিজন—সর্বোপরি নিজেকে হারাচ্ছি। হারানোর শেষ নেই
কেউ ঘা সয়ে নেয়, কেউ পারে না।
ছেলেটা হা করে আমার দিকে তাকালো! যেন ভিনগ্রহের কোনো জন্তু দেখছে।
—আরিব্বাস! হেব্বি কথা বলেন তো মাইরি। শের শায়েরি করেন না কি? আপনারা হেব্বি নেকু মাইরি। যা হারিয়ে ছিল, তা বেশ্যা পড়ায় ক’টা ব্লু-পাত্তি ফেললেই মেলে। খুব আঘাত পেয়েছিস, একটু সান্টু খেয়ে টান্টু হয়ে হর্স-রাইডিং করে নে! দুধ না খেলে হবে না ভালো ছেলে।
হুড়মুড়িয়ে ট্রেন এলো। বডি সরে গেছে লাইন ক্লিয়ার। লোকেরও ভিড় গেলো কমে। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বললো, ছেলেটা লাইন পার হচ্ছিল। কানে ছিল হেডফোন! ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পায়নি। তাহলে হাত পা কাটা যেতে পারতো। পারতো দেহটা দুই খণ্ড হয়ে যেতে। তাতো হয়নি; মাথা কাটা গেছে। আর মাথা কাটা যায় সজ্ঞানে।
ছোট একটা বাক্সের মধ্যে তাবিজ, মাদুলি, কবজ নিয়ে বসা সুডডা মার্কা চোখে সুরমা দেওয়া লোকটা বললো—আমি বারবার বলেছিলাম ছেলেটাকে, শনির দশা চলছে তোর; আমার একটা মাদুলি ব্যবহার কর; করলো না। খামাখা প্রাণ হারালো! নিয়তি। বুঝলে?
কৌতূহলী একজন বললো—তুমি চিনতে ছেলেটাকে?
—মন মরা হয়ে ভিজে পায়রার মতো বসে থাকতো স্টেশনে।
আর একজন বললো—এজন্য আমি শনিকে তুষ্ট রাখতে প্রতি শনি সন্ধ্যায় শনি মন্দিরে পুজো দেই। শনির রোষানল বড় খারাপ। যে কারো জীবনটাই ছারখার হয়ে যেতে পারে।
তাবিজ ওয়ালা লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ছলে বলতে শুরু করলো—কিন্তু, জানেন কি কিসে খুশি রাখা যায় শনি কে? কী করলে শনি চটে গিয়ে আপনাকে রাজা থেকে ফকির বানিয়ে দিতে পারে?
গুটি গুটি ভিড় জমতে শুরু করে। একজন কপালে হাত ছুঁয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকে–শনি শনি শনি…
তাবিজওয়ালা লোকটা সমবেতদের ভয় ধরিয়ে দিয়ে বলে—আমার কথা না শুনে এই ছেলেটা রেলে কাটা পড়লো। কদিন আগে এক গাড়ল শনি দেবতার কথা না শুনে চলে যেতে গিয়ে
মুখ থুবড়ে পড়েছে প্লাটফর্মে।
শ্রোতারা আরও আড়ষ্ট মেরে গেলো। পা আর কারও সরছে না একইঞ্চিও। মুখ থুবড়েপড়া কেসটা আমি দেখেছি। হার্ট অ্যাটাক! কেতাবি নাম মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন। দিব্যি শনি দেবতার রোষানল বলে চালাচ্ছে লোকটা।
—প্রতি শনিবার শনি মন্দিরে গিয়ে যতই ধূপধুনো দিন, এমন কিছু দৈনন্দিন জিনিস আছে, যা শনিবার কিনলে নিশ্চিতভাবেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনবেন। আপনাকে পথে বসাবে শনি। শনিবারে কী কী কিনবেন না?
এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে লাগল লোকটা—নুন, লোহা, কাঠ, সরষে, বেগুন, কালো শস্য বা কালো ডাল, জুতো বা কালো জামা, কালো ছাতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
অবশেষে প্রতিদিনের মতো তার ঝোলা থেকে বিড়াল বের হলো। লোকটা বলেই চললো—পথে-ঘাটে-বাজারে-দোকানে এত কিছু মেনে চলা রোজকার ব্যস্ত জীবনে সম্ভব নয়। তাই প্রতিটি মানুষের সুবিধার কথা মাথায় রেখে আমি বানিয়েছি ‘শনির চর কবজ’! যা ধারণ করলে শনির বাবারও ক্ষমতা নেই আপনার ধারে কাছে ঘেঁষার। কিভাবে? সূর্যের রোদ এড়াতে আপনারা কী করেন? সূর্য ঢাকেন, না মাথা ঢাকেন ছাতা দিয়ে? সেভাবে বর্ম হয়ে;
এই রক্ষাকবজও আপনাকে শনির কু-দৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করবে। মূল্য মাত্র একটাকা, একটাকা, একটাকা। একটাকায় আজকাল কী হয়? একটা সিগারেটও হয় না। আমি আপনার সাথে আপনার ইস্তিরির কথা মাথায় রেখে ফিরিতে দিচ্ছি আর একটি কবজ। একটাকায় পাচ্ছেন দুটি নির্ভরযোগ্য ‘শনির চর কবজ’। আপনার সন্তানও বাদ যাবে কেন, চলুন তার জন্যও রইলো ‘শনির চর এসপেশাল কবজ’। একটাকায় পাচ্ছেন একটি নয়, দুটি নয়, তিন-তিনটি কবজ। নেওয়া, না নেওয়া আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। দেখাশোনা ফিরি।
ভিড়ের মধ্যে থেকে বেশিরভাগ মানুষই হাত বাড়িয়ে দেয়। বোঝা গেলো শনির দৃষ্টি মিহি। ভরসংখ্যক মানুষই তার কবলে। ক্রমে ক্রমে ভিড় কমলে লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এলো—কই আপনি তো নিলেন না স্যার। বুঝেছি বিশ্বাস নেই। আপনিও বাঁচবেন না দেখছি।
শুনে চমকে উঠলাম। লোকটা বলে চললো—খুব বোকা ছাড়া এদেশে কেউ বেকার থাকে না আর মরে না। টাকা রোজগারটা কি কোনো ব্যাপার? শুধু বুদ্ধি খাটিয়ে একটি লাইন খুঁজে বের করতে হবে। এই দেখুন রেললাইনের পাশের শিয়ালকাঁটা গাছের ঝোপ; সেই ডাল তুলে কুচি কুচি করে কেটে মাদুলি বানিয়ে বেচছি। একটা মাদুলি একটাকা। একপয়সা মূলধন লাগে না।
একলক্ষ লোকের কাছে বেচতে পারলেই কতগুলো টাকা। লোকের কি অভাব এদেশে? সত্যিই একশ ত্রিশ কোটির দেশ। একটাকা করে প্রত্যেকের কাছ থেকে সংগৃহীত হলেও একশ ত্রিশ কোটি টাকা। ভাবতে পারা যায়! No investment. নেতা, অভিনেতা, দেবতা হয়ে ওঠা ধর্ম গুরু সবাই তো এই পলিসি কাজে লাগাচ্ছে। আর যে নিজেকে বেচতে পারছে না? মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী, পুত্র, দেশ, জাতি কিছুই বেচার মতো পাচ্ছে না, সে আত্মহত্যা করছে!
আমি ভাবি—তা কী করে হবে! আত্মহত্যা মানে আত্মহনন। শরীরের হত্যা নয়; আত্মার হত্যা। Not killing the body. Soul murder. মানুষ যেদিন বিকোয়, সেদিনই তো হয়ে যায় তার আত্মার মৃত্যু।
একটা তিরিশের ডায়মন্ড হারবার লোকাল ঢুকলো; প্ল্যাটফর্মে লোকে গিজগিজ করছে। এরা যে সবাই জীবিত, এমনটা ভাবার কোনো কারণ দেখি না!