ক.
‘দুধচিনিনারয়েলের ব্রয়েফ একটানাটা করে।’—প্রতিদিন এই এনাউন্স শোনা যেত গ্রামগুলোর সরু পথে। মুখলেশ এ অঞ্চলের বিখ্যাত বরফওয়ালা। উক্ত উক্তিটি অর্থবোধক ছিল গ্রামের মানুষের কাছে। বাইরে থেকে কেউ এসে হঠাৎ শুনলে বুঝতে পারবে না। তখন গ্রামের লোকেরা তাদের কাঁধে থাকা অন্য দায়িত্বের বস্তাটা নামিয়ে রেখে বাইরে থেকে আসা লোকটাকে বোঝানোর দায়িত্ব নিত। হাসতে হাসতে বলত—‘আরে ভাই বুঝলেন না? ও বলছে দুধ-চিনি-নারকেলের বরফ একটাকা-আট আনা করে১।’ কেউ কেউ আরও বিস্তারিত বলত— ‘ওর কাছে দু’রকম বরফ আছে যার মধ্যে একগুলোর দাম একটাকা এবং অন্যগুলো আট আনা করে।’ মুখলেশের মতো কালো কুচকুচে মানুষ দুতিন গাঁ জুড়ে আর একটাও নাই। লম্বা, লিকলিকে। যখন একফিট-দেড়ফিট-দু’ফিট কাঠের বাক্সটা মাথায় করে হাঁটত, একটা লাউলতার মতোই মনে হতো তাকে অথবা তালগাছ। একইসঙ্গে তালগাছ আর লাউগাছ হতো সে। কেউ বরফ নিতে চাইলে মাথা থেকে নামানোর জন্য, যে বরফ নেবে তাকেই কাজে লাগাত। ক্রেতা শিশু হলে অন্য কাউকে দিয়ে মাথা থেকে নামাত বরফের বাক্স আর ওখানেই বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকত বিক্রির জন্য। বাক্সের ঢাকনাটা বাক্সের সঙ্গে মেরে ‘ঢাপ ঢাপ’ করে শব্দ করত আর ডাক দিত— ‘আতেন আতেন, দুধচিনিনারয়েলের…।’ ‘ঢাপ ঢাপ’ শব্দ আগে আগে আর ‘আতেন আতেন, দুধচিনিনারয়েলের…’ এই বাক পরে পরে দৌড়ে মানুষের জানালা গলে ঢুকে শিশুদের টেনে আনত। মোহিত হয়ে তার বরফের মধুপান করত গ্রামের শিশুরা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য বয়সীরাও। গ্রামের ধুলার রাস্তায় গনগন করত সূর্যের তাপ, ধুলাও আগুনের কণার মতো, বাতাসে ঝলসাতো। মুখলেশের বরফ একটু স্বস্তি দিত। মুখলেশের কোমরে একটা টাকার থলি ঝুলত, ওতে বেশির ভাগই খুচরো পয়সা। হাঁটার তালের সঙ্গে তাল রেখে শব্দ হতো ‘ঝনাক’ করে। ঘাড়ে একটা ছোট কাপড়ের ব্যাগ, ওতে যাদের টাকা নেই তাদের চালের বিনিময়ে বরফ দিত—সেই চাল। তার শেষ গন্তব্য ছিল প্রাইমারি স্কুল। স্কুলের কাছে নিমগাছের নিচে বসত। ছেলে মেয়েরা ভিড় করে বরফ কিনত২। কখনো কখনো গান ধরত আর হাত দিয়ে বরফের বাক্সে বোল তুলত। সিকি আধুলিগুলো ঢপের ওপর ঘোরাতো বেশ নিপুণভাবে। বোঁ বোঁ করে পয়সা ঘুরত। ছেলে মেয়েরা তাকে ঘিরে গান৩ শুনত আর অবাক হয়ে সিকি আধুলির ঘূর্ণি দেখত। বিক্রি শেষে একজায়গাতে বসে ঢপের ওপর মুদ্রাগুলো ছড়িয়ে দিয়ে গুনত বেশ আয়েশ করে। দশ পয়সা, পাঁচ পয়সা, সিকি, আধুলির আলাদা আলাদা থাম্বা করত, তালগাছের মতো লাগত দেখতে। মুদ্রাবৃক্ষ। মুখলেশের তৈরিকৃত এ পয়সাবৃক্ষও শিশুদের প্রচুর আনন্দ দিত।
খ.
মুখলেশ খুব কালো, বউটিও খুব কালো কিন্তু তাদের মেয়েটি ছিল ফুটফুটে ফর্সা। লোকে বলত, ‘বাপের মতো ফর্সা হয়েছে’। ‘বাপের মতো ফর্সা হয়েছে’—এ কথা বলার সময় গাঁচিপাড়ার মজাদুলের৪ কথায় বলত লোকজন। মুখলেশ খুব ভালোবাসত মেয়েটিকে। প্রতিদিন দুপুরে বরফ বিক্রি করে এসে যে চাল পেত সে চাল বউটা বারান্দায় বসে কুলা দিয়ে ঝাড়ত রান্না করার জন্য। মুখলেশ লুঙ্গি গামছা নিয়ে ছোট পুকুরে ডুব দিতে যেত। সেদিনও তাই হয়েছে। চাল ঝাড়তে বসেছে মুখলেশের বউ আর বেশি দুপুর করে মুখলেশের ফেরার কারণে মেয়েটার পেট থেকে একটা ক্ষিধে বের হয়ে এসে তার হাতে ভর করে। দু’মুঠে চাল কুলার ওপর হতে নিয়ে মুখে পুরে সে। অন্যপক্ষে বেশি দুপুর করে মুখলেশের ফেরা আর চাল কম ছিল বলে মেজাজটা খিঁচড়ে গেছিল বউটার। মেজাজটা বউটার হাতের ওপর ভর করে, সে উঠেই মেয়েটার পিঠে চাল নেওয়ার অপরাধে গম গম শব্দে কিল বসায়। চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। মুখলেশ তখন বের হচ্ছে মাত্র গোসলে। মেয়েকে মারতে দেখে মেজাজটা ভীষণ চড়ে যায় মুখলেশের। তার মেজাজটা শুধু চড়ে গিয়ে থেমে থাকে না, মেজাজটা তার হাতের ওপরও ভর করে। সে রেগে গিয়ে বউকে মারতে লাগল আর বলতে লাগল— ‘এমন ছোট মেয়েটাকে কেন মারলি দু’মুঠা চালের লাইগ্যা।’ মর্মাহত বউটা বলল— ‘কী? হামার কি ময়া নাই বেটির ওপর’ বলেই কাঁদতে থাকে। মুখলেশ গোসলে চলে যায় ছোট পুকুরে, বউটা অভিমান করে মেয়েকে নিয়ে বড় পুকুরের দিকে হেঁটে যায়। মুখলেশের পেছনের দিকে চোখ না থাকার কারণে দেখতে পায় না তাদের হেঁটে যাওয়া।
লোকজন বহুক্ষণ খুঁজে প্রথমে বাচ্চাটাকে তুলতে পারল জলের তলা থেকে। জলকে সে ধরে ছিল,জল তাকে ধরে ছিল। জলের তলে সে মাটি কামড়ে ছিল। কে একজন বলল— ‘মাথায় নিয়ে ঘুরা।’ মাথায় নিয়ে কেউ একজন ঘুরালো। ঘোরানোর ফলে কিছু পানি বেরুল মেয়েটার মুখ দিয়ে। সঙ্গে বেরুলো জীর্ণ কিছু চাল। পৃথিবীর চাল পৃথিবীতে ফিরে এলো বাচ্চাটার পেট থেকে মুখ থেকে। মেয়েটা পৃথিবীতে ফিরল না। বাঁচল না মেয়েটা। সকল ঘূর্ণি ফিরে গেল জলে, মেয়েটা ফিরে গেল জলে। মুখলেশ চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। মেয়েটার মুখে চুমু দিয়ে, কান্না দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে চাইছে। বউটাকেও তোলা গেল জলের তলা থেকে। সে বাঁচল। কিন্তু জ্ঞান ফিরে যখন জানতে পারল মেয়েটা বেঁচে নেই তখন বার বার মুর্ছা যেতে লাগল আর পুকুরের দিকে বার বার ছুটে যেতে লাগল বিলাপ করতে করতে— ‘তোমরা মেয়েটাকে না বাঁচাতে পেরে আমাকে বাঁচাতে পারলে কেন?’ লোকজন পূর্বের সকল কথা, মজাদুলের কথা ভুলে গিয়ে বলতে লাগল— ‘এ, এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য।’ ‘এ, এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য’ টা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল জল, পৃথিবীতে ফিরে আসা জীর্ণ চাল, মুখলেশ আর তার বউয়ের হৃদয়। মানুষ দেখতে চাইছিল ‘এ, এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য’ টা মজাদুলকে নিয়ে কী করে।
গ.
‘এ, এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য’ সম্পর্কিত বিষণ্ন মন নিয়ে মুখলেশ সৎকারের ব্যবস্থা করছে। কেউ কেউ বার বার চেয়ে দেখছে মজাদুলের দিকে। তাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে এমনই মনে হচ্ছে৫। তার হাতের মূল আঙুল ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলে। জানাজাতে সামনের কাতারে কাঁদ কাঁদ মুখে দাঁড়িয়ে আছে মুখলেশ৬। তারপাশে মজাদুল লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে জানাজার নামাজ পড়ছে, পাশে, পেছনে আরও মানুষ জানাজার নামাজ পড়ছে।
ক’টি কথার নাড়ি ভুঁড়ি:
১. তার কাছে গাঢ় ইটরঙের চার আনা দামের বরফও থাকত। এই বরফগুলো ইটের মতোই শক্ত ছিল, চুষে চুষে সহজে ক্ষয় করা যেত না। জিভ ক্ষয় হয়ে যেত। বরফ শেষ হয়ে গেলে বাচ্চাদের আবারও জিভ ক্ষয় করার সাধ চাগিয়ে উঠত। একটাকা, আট আনা, চার আনা সবগুলোই ছিল কাঠি বরফ। এসব বরফের মধ্যে চার আনা দামের বরফ বেশি থাকলেও সে এ বরফের ঘোষণা দিত না। এ বরফ স্কুলের বাচ্চারাই বেশি কিনত।
২. সবাই যে বরফ কিনত এমন নয়, কেউ কেউ এমনিই দাঁড়িয়ে থাকত আর অন্যের বরফ খাওয়া দেখে নিজের জিভ নাড়ত। সুড়ুৎ-সুড়ুৎ করে টেনে নিত জিভের ঝোল। অন্যরা যে বরফ খেত সে বরফটা সে নিজেই খাচ্ছে ধরে নিয়ে ঢোক গিলত। কেউ কেউ সুর ধরত— ‘ওই মুখলেশ দ্যাও না একটা বরফ বাঁকি, কাইল্ পায়স্যা দিয়্যা দিব। ওই মুখলেশ দ্যাও না… দেখিও কাইল্ই দিয়্যা দিব।’ মুখলেশ বিরক্ত হতো— ‘যাতো যাতো, জ্বালাইসন্যা কহছি, যা পালা।’ কিছুক্ষণ সব চুপ থাকার পর আবার শুরু করতো— ‘ওই মুখলেশ…।’ এক সময় মুখলেশের আরো বিরক্তি বাড়ত বা ভালোবাসা জন্মাত শিশুদের ওপর। যারা বরফ চাইছিল তাদেরকে তো বটেই যারা বরফ না চেয়ে অন্যের বরফ খাওয়া দেখে জিভ নাড়ছিল তাদের হাতেও একটা করে বরফ ধরিয়ে দিত আর বলত— ‘কাইল্ই কিন্তু পায়স্যা দিয়্যা দিবি।’ হাতে বরফ নিয়ে কেউ আর কথা বলত না, মাথাটাকে ‘হ্যাঁ’ সূচক দুলিয়ে হাঁটতে শুরু করত। এ পয়সা কেউ আর দিত না। মুখলেশও চাইত না কারো কাছে, ইচ্ছে করেই অথবা ভুলে গিয়ে। প্রতিদিন ঘটত এই সকল দৃশ্য। হিসেব করলে দেখা যাবে এ গাঁয়ের প্রতিটা বাড়িই মুখলেশের কাছে ঋণি।
৩. মুখলেশের কণ্ঠস্বরে অনেক পাখি বাস করত। পাখি তার গলার ভেতর থেকে বের হয়ে মানুষের কানের ভেতর ঢুকে যেত। মানুষ মোহিত হয়ে তার দিকে চেয়ে তার পাখি উৎপাদন দেখত, উৎপাদিত বিভিন্ন পাখির উড়ে যাওয়া দেখত। সে যে পথ দিয়ে হেঁটে যেত, সে পথে পড়ে থাকত পাখির পালক। পাখির পালকগুলো এক সময় গলে গলে মিলে যেত পথের সাথে। এ পথের সব ধুলোতে মিশে আছে মুখলেশের গানপাখিদের পালক। সে বিভিন্ন গানই গাইত কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে গাইত—‘পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানায়া আমি রই/আমিতো ভাই ঘরের কেহ নই’
৪. একবার বিচারও বসে গ্রামের ভেতর। মুখলেশের বউ এর সাথে মজাদুলের গভীর পরিচয়ের জন্য। পরকীয়া সম্পর্কিত বিচার যেন বিচার নয়, পদ্মমধুর চাক। সকল মানুষ বেশ আগ্রহ করে বিচারে মৌমাছি হয়। মৌমাছিগুলো এই পরকীয়া দম্পত্তিফুলের ওপর উল্লাসে বসে পড়ে। কিন্তু মজাদুল, মুখলেশের বউ কেউই এটা স্বীকার করেনি। বাচ্চাটা হবার পরে চেহারা মিলে যাবার কারণে সকলে বুঝতে পারে ‘এই বাচ্চাটা মজাদুলেরই।’ এ ব্যাপারে মাথা ব্যথা দেখা যায়নি মুখলেশেরও। অনেকে বলে— ‘বাচ্চা পয়দা করতে পেয়ে মুখলেশ মনে মনে মজাদুলের ওপর খুশিই হয়েছিল।’ কারণ অনেক চেষ্টা করেও তাদের বাচ্চা হচ্ছিল না।
৫. মজাদুলের দিকে তাকিয়ে দেখছিল ম্যালা মানুষই কিন্তু সবচেয়ে বেশি খেয়াল করে দেখছিল বেদু হোকমা। জানাজা শেষে লোকজন একটু এগিয়ে গেলে, মজাদুলকে ধরে গিয়ে বেদু হোকমা— ‘হ্যাঁরে মজাদুল তোর বেটিটা যে মরে গেল ডুবে, তোরতো চোখে এতটুকু কান্না নেই!’ বেদু হোকমার কথার লালা ধুয়ে ফেলতে মজাদুল মুখটা লজ্জা রাঙা করে, লাজুক হেসে সরে যায়।
৬. জানাজা শুরুর পর দুই তকবিরের সময় ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মুখলেশ। এরপর তার কান্নার গতি বেড়ে যায় আর জানাজার নামাজের ভেতরেই কান্নায় লুটিয়ে পড়ে। নামাজ ভেঙে যায়। সে ছুটে যায় মেয়েটার লাশের দিকে। লোকজন তাকে টেনে ধরে। সে বার বার বলতে থাকে— ‘মেয়েটাকে আর একবার দেখতে দাওগো লোকেরা’। লোকজন তাকে আবার মেয়েটার মুখ খুলে দেখায়। আবার নতুন করে জানাজা শুরু করে ঈমাম সাহেব।