রওনক, দ্যাখ বৃষ্টির পর ফকফকা আসমান। পাই-ধইরা বাতাস আইতাছে। টাটকা অক্সিজেন। শহরে পাইবি এইসব?
তা পাওয়া যাইবো না, ঠিক পয়েন্টে টোপ ফালাইছস, মাহিন। আমরা তো ফরমালিন খায়া বাঁইচা থাকা মানুষ।
তুই খালি শক্ত শক্ত কথা কছ। হালকা কর।
হালকা হইলো, আমরা যে মানুষগুলারে দেখি অ্যাগোর প্যাঁচ খুলবার গেলে বাইর হয় কাউয়ার বাসা।
কাউয়ার বাসায় কি কোকিল ডিম পাড়ছে?
না, সময় বদলানির কারণে কাউয়ার বাসায় কাউয়াই ডিম পাড়ে।
টিভি-টুবি দেখছ? না খালি ফেসবুক পড়ছ?
দুইটাতেই আছি। ক্যান?
গোবিন্দগঞ্জের খবর-টবর জানোছ?
জানি। আমি গেছিলাম ওইখানে। ম্যালা চাইল।
মানে?
চাইল হইলো সরল বিশ্বাস নিয়া।
খুইলা বল।
খুলতে গেলে তো অনেক ভাঁজ খুলুন লাগে, তা তো জানোছই।
মজা না নিয়া ঘটনার ভাঁজ খুল।
এই ঘটনার পিছনে আছে ভোটের রাজনীতি।
ক্লিয়ার কর।
সাঁওতাল পুত্রের ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়। আশা রাখছি ক্লিয়ার হবি।
কী লিখছে?
নিজে পইড়া দেখ, কী লিখছে।
খ.
জলে ভাসা পদ্ম আমরা।
আমি সাঁওতাল পুত্র। সুশীলরা বলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। আমার কলেজের বন্ধুরা জানতে চায়, কী এমন ঘটেছিল সেদিন, যার জন্য নিজ দেশেও উদ্বাস্তুর জীবন যাপন করতে হচ্ছে? আমিও উত্তর খুঁজি। কারমাইকেল কলেজের পাশ দিয়ে যাওয়া রেললাইনে হাঁটি আর ভাবি। পথ অন্ধকার হয়ে আসে কিন্তু চিন্তা আলো পায় না। আমরা তো সহজ পথে দিন পার করে তৃপ্তি পাই। আমাদের কঠিন আর জটিল হিসাবের প্রয়োজন নাই। আমাদের জোর-জবরদস্তি করার মতো ক্ষমতা নাই। আমরা নিরীহর থেকেও বেশি নিরীহ। সারাদিন মাঠে কাজ করার পর যা পাই, তা দিয়েই আমাদের দিন চলে যায়, চালিয়ে নেই। একদিন স্যার ক্লাসে বলেছিলেন, এদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত। নির্যাতিতও। বলেছিলেন দেশের যেকোনো ইস্যুর প্রভাব তাদের ওপর পড়ে। ভোট কিংবা অভোট নিয়ে জাতীয় ক্যাচালের প্রভাবও পড়ে। আগুন লাগাও। ঘর পোড়াও। জমি দখল করো। বড় একটা প্রক্রিয়া চলতেই থাকে ক্ষুদ্রের ওপর। আঘাতের পুরনো চিহ্ন না শুকাতেই নতুন চিহ্ন যোগ হয়। সেদিন স্যারের কথা শুধুই শুনেছি। তখন স্কুলে ছিলাম তো, অতটা বুঝিনি। এখন তো আরও দুইধাপ পার হয়েছি। এখন বুঝি। এখন তো আমি অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমি নিজেই বিশ্রী এক ঘটনার প্রমাণ। গ্রামে ভোট শুরু হলে চেয়ারম্যান মঈনুল হাসান আসে, ভোট চায়। কী মিনতি! হাতে ধরবে না পায়ে পড়বে তার ঠিক নাই। ওয়াদা করে চেয়ারম্যান মঈনুল হাসান। বলে, আপনাদের জমি আমি ফিরিয়ে দেব। আপনারা বাংলাদেশের নাগরিক না? আপনারা বাপ-দাদার সম্পত্তি পাবেন। আমি আপনাদের সাথে আছি। প্রয়োজনে রক্ত দিব। জীবন দিব। আর আমি যদি বিশ্বাস ভাঙি, তাহলে আপনারা আমার গলায় জুতার মালা পরাবেন। আমরা গাইবান্ধায় লং মার্চ করেছি, আপনারা জমি পাবেন। মঈনুল আমাদের মা-চাচিদের মধ্য থেকে একজনকে ধর্ম মা বানালেন। আহারে, ভোট পাবার লোভে কত কিছুই না করতে চাইলেন। বোঝাতে সক্ষম হলেন তিনি বেশ ভালো মানুষ। বঞ্চিত আমাদের জন্য কাজ করবেন। তার মন্ত্রে অবশ হয়ে আমরা মঈনুলের পক্ষ থেকে প্রচারণা করি মুখে মুখে, মাইকে মাইকে। বলি ভোট যেন মঈনুল হাসানকেই দেয়।
আমাদের এলাকার সব ভোটারকে কেন্দ্রে নিয়ে যাই। আমারাই পাহারা দেই কেন্দ্র। সকাল থেকে কোনো রকমে দুপুর হয়। সময় আর আগাতে চায় না। আমরা অপেক্ষা করতেই থাকি। মোবাইল বের করে দেখতে থাকি। না যাওয়া সময় পার হওয়ার পর সেন্টার থেকে খবর আসে মোরগ মার্কা জিতেছে। চেয়ারম্যান হয়েছে মঈনুল হাসান। আমরা আনন্দ মিছিল বের করি। মঈনুল হাসানের গলায় ফুলের মালা পরাই। সেও খুশিতে আমাদের সাথে বুক মেলায়। হোটেল রিজার্ভ করে। বলে, যার যতখুশি খাও। বেয়ার নিয়ে আসে তার সাঙ্গপাঙ্গরা। আমরা খাই পেটখুলে। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত অনেক হয়। আমরা ঘুমাই। পড়শীর চিৎকারে ঘুম ভাঙে।
বুঝলি কিছু মাহিন?
পুরাটাই জানা লাগবে।
জানাবো। অর পরের স্ট্যাটাস আছে, পাবি পড়তে। তারপর বল, কেমন আগাচ্ছে দিনকাল?
আগায় না রে রওনক। খালি পিছায় আর ভাবায়।
কী এমন ভাবনা? বলতো শুনি।
আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে টিএসও পোস্টে চাকরি করি। ওইখানে আমার অধীনে থাকে দশজন লোক। দশজনে সারাদিন এইখানে ওইখানে ঘুইরা মাল ব্যাচা-বিক্রি করে। আমি হিসাব লই। মাঝে মধ্যে ফিল্ডে খোঁজ নিতে যাই। তাতেই পাই ত্রিশ হাজার। আর হ্যারা পায় মাত্র আঠারো হাজার টাকা। আমি লাঞ্চ আর যাতায়াত খরচ পাই। হ্যাগোর আঠারো হাজার থাইকাই সব কিছু করা লাগে। ক, এই শহরো আঠারো হাজারে কিছু হয়? চলে?
না। চলে না। এইটাই তো নিয়ম। জীবন চলবো কিন্তু শান্তি আসবো না, যেরকম আমরা চাই।
রওনক, আজ উঠতে হবে রে। রাত হয়ে গেছে অনেক।
তুই আমার বাসাতেও থেকে যেতে পারিস।
না রে। আজ যাই। কাল দেখা হবে।
গ.
রওনক, সাঁওতাল পুত্রের আরেকটা স্ট্যাটাসের কথা বলছিলি।
বলেছিলাম, কিন্তু মনটা খারাপ। খালি খারাপ না, খারাপের ওপর স্কয়ার।
আমি তো জানতাম তুই বাংলাদেশের সবচায়া সুখি মানুষ। তাইলে তরও এমন হয়? কারণ কী?
বাইরে থাইকা দেখা মানুষ আর ভেতরের মানুষ কিন্তু এক না, এইটা তো জানা কথা।
হুম। মন খারাপের কারণটা বলবি তো।
বাবা অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। নতুন প্রোডাকশন নামানোর লাইগা কাজ আগাইবার চাই। কিন্তু শক্তি পাই না। বাপের অসুখ হওয়ার সংবাদ শক্তিরে উয়িক কইরা দিছে।
তর ওই কবিতাটার কথা মনে আছে?
কোনটা?
দুঃখ করো না, বাঁচো।
বল।
অইখানের একটা লাইন এমন, ‘দুঃখকে স্বীকার করো না, সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
গুণের?
হুম, নির্মলেন্দু গুণের।
বুঝতে পারছি।
রওনক, তুই তো জানিস, জীবন একটা আজব জিনিস। কত কিছুর লগে মানায়া-চিনায়া জীবন তার নাউ কিনারে পৌঁছাইবার চায়। মাঝে মধে কিনারের দেখা পায়, আবার পায় না। অ্যার মধ্যে ব্যস্ততা, নাগালের বাইরে থাকা সময় প্যারা আর পীড়া তো দেয়ই।
আজ দেখছি তুই কঠিনভাবের ডিকশনারি খুইলা দিলি।
না রে দোস্ত। তা না। একটা চাকরি করি জানোস তো। ওইখানে যায়ুন লাগে সকাল সাড়ে সাতটায়। ফিরতে ফিরতে রাইত আটটা-নয়টা বাজে। সারাদিন অফিসের প্যারায় কাইটা যায়। টাকা কামাই করি নিজের ভালোর লাইগা। ভালোটা কই থাইকা আসে? বউরে সময় দিবার পাই না। বাপ-মায়ের লগে তো মাসে একবার আলাপ হয়। এই যদি হয় জীবন, তাইলে এত কামাই কইরা হইতাছে কিছু?
মাহিন, সময় আর ব্যস্ততারে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এইটা করতে পারলে দেখবি সব ঠিকঠাক। আপসেট হইছ না। সাঁওতালপুত্রের স্ট্যাটাসের কথা বলছিলি। পড়বি আজ?
আজ, না, থাক। কালকে পড়ি।
আচ্ছা।
ঘ.
আগুন আর বন্দুকের নলে দম।
সাঁওতালপুত্র বলছি। দ্বিতীয় পোস্ট। তারপর চোখ কচলাতে কচলাতে বাইরে বেরুলে দেখতে পাই জমিনে আগুন দেওয়া হচ্ছে। সেখানে যাওয়ার পর দেখি ঘরে আগুন দিচ্ছে। সঙ্গে র্যাব, পুলিশ, ইউএনও, আমাদের এমপি আর চেয়ারম্যান মঈনুল হাসান। মঈনুলের চরিত্র বোঝার চেষ্টা করি। গতরাতেও যে আমাদের লোক ছিল, সে আজ ওই দলে। চিন্তায় খোঁচা দিতে থাকি। না, কিছু বের হচ্ছে না। আমার পাশের একজন বললো, আমরা যখন খাচ্ছিলাম, তখন চেয়ারম্যান ফিসফিসিয়ে বলছিল খায়া নাও আজকাই, পরে আবার সুযোগ পাও না, না পাও। তার ফিসফিসানির মানে বুঝতে পারলাম। আগুনে জ্বলছে ঘর আর আবাদের জমিনে। আমরা নেভাতে যাই। নিভে না আগুন। দুনিয়ার সমস্ত আগুনের তেজ নিয়ে জ্বলছে। ক্ষমতার চাপে বেরুচ্ছে আর জ্বলছে। আমাদের বুক-পাঁজর পুড়তে থাকে আগুনের তাপে। ভেতরে শক্তি জোগাড় হতে থাকে। একসাথে হতে থাকি আমরা। নিজেদের নিরাপদ রাখতে বর্শা, ফলা ঢেলাতে থাকি। আবার এটাও ভাবি ঘরে মা-চাচি-বোন, ছোট বাচ্চারা আছে। তাদের কথা মনে আসায় আমরা ক্ষ্যান্ত দেই। অনুরোধ করি আগুন না দিতে। দ্বিজেন দা স্যারেন্ডারে ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়। তারা এ ভঙ্গি বোঝা সত্ত্বেও গুলি চালায়। বৃষ্টির মতো করে শরীরে লাগতে থাকে ছররা গুলি। চোখ-মাথায় গুলি লাগার পর দাদা মাটিতে পড়ে যায়। এরপরও তার পিঠ আর কোমর বরাবর গুলি করা হয়। গুলি করে তো একজনের মাথার খুলিই উড়িয়ে নিয়েছে।
মাইকে ঘোষণা চলছে, আগুন লাগাইছে, লুট করো। জঙ্গী, ভূমিদস্যু, আলবদর, আলকায়দা এখানে ঢুকে পড়েছে। তাদের উচ্ছেদ করা হোক। আমাদের ওপর কত বড় মিথ্যা তকমা লাগানো হয়েছে। এদেশের নাগরিক হয়েও আমরা জঙ্গি খেতাব পাই। তাদের সঙ্গে আসা মানুষেরা সাধ্য মতো লুট করেছে। একটা সংসারে জিনিস কি কম থাকে? গরু-ছাগল-ভেড়াও বাঁচেনি। আগুন দেওয়া আর গোলাগুলি চলে পরেরদিন সকাল এগারোটা পর্যন্ত। আগেরদিন যেগুলো পুড়েনি পরেরদিন সেগুলো পুড়িয়েছে। ভিটার কোনো চিহ্নই রাখবে না। এই মতলবে ট্রাকটার দিয়ে জমিন চাষ করে। অন্য জায়গায় তারা চাষ করতে পারতো, কিন্তু করেনি। আমাদের ভিটামাটিই আগে চাষ করে। তারা চেয়েছিল জয়ের ফুঁতেই নিশ্চিহ্ন করে দিবে আমাদের। ওই রাতে চেয়ারম্যান মঈনুল পায় কোটি টাকা। টাকার ঘোরেই দলবলসহ আসে পরেরদিন। যুক্ত করে নিজেকে মহৎ কাজে। তারা বড় বড় গাছেও আগুন দিয়েছে। পুকুরের ওপর কয়েকটা সাদা বক ওড়াউড়ি করছিল, তাদেরকেও সাঁওতাল মনে করে একজন বন্দুক উঠিয়েছিল। ঘটনার দিন ছোট ভাই অর্ধেক খাওয়া অবস্থায় দৌড় দেয়। আগুনের দলা তার বুক বরাবর পড়ছিল। দাদী বিছানা থেকে উঠতে পারে না, এদিকে ঘরে আগুন দিয়েছে, সে ভয় পেয়ে ঝাপ দেয় নিজেকে বাঁচাতে। ভেঙে যায় তার পা। আমাদের কান্নার আওয়াজ আশপাশের কয়েক গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছালে মানুষ জড়ো হয়। তারাও উপায়হীন। আমরা দেখছি, কাঁদছি আর ঈশ্বরকে ডাকছি; যা গরিবের শেষ সম্বল।
আমরা যেখানে ঘর তুলেছিলাম, আবাদ করেছিলাম সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলে। দেখে মনে হয়েছে এ যেন দেশের ভেতরেই আরেক দেশ। গোবিন্দগঞ্জের ইউএনও মন্নাফ বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে গুলি ছোড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কী এমন উদ্ভূত পরিস্থিতি হয়েছিল? পরিস্থিতি তো সামাল দেওয়ার ছিল, কিন্তু তারা সামাল দেয়নি। এটাও ছিল তাদের পরিকল্পনার অংশ।
মঈনুনের কথামতো বাপ-দাদার জমি ফেরত পাবার আশায় ধার-দেনা করে চালা ঘর তুলেছিলাম। আবার তার হুকুমেই চলে উচ্ছেদ। পুলিশ ছিল, তারপরও ঘরে আগুন দেওয়া ঠেকায় নাই। কী আজব কাণ্ড! আমরা সরল বলে আমাদের বিশ্বাস নিয়ে অতীতে তারা ছ্যাঁচড়ামি করেছে। করছে এখনও। পুলিশ, র্যাব আমাদের সহযোগিতা না করে তারাও আগুন দেওয়া শুরু করলো। আশপাশের নেতারা আসছে, ছবি উঠাচ্ছে, দেখাচ্ছে তারা আমাদের সঙ্গে আছে। আল্টিমেটলি তারা আমাদের সঙ্গে নাই। তারা নিজেদের প্রচারণা বাড়াচ্ছে, র্যাংক আগাচ্ছে। বড় নেতাদের দেখাচ্ছে তারা সঙ্গে আছে। পরেরদিন পত্রিকায় বড় করে ছবি ছাপাবে। মিডিয়া কাভারেজ পাবে। আহা রে নেতা, উপনেতা, পাতি নেতা। আহারে চেয়ারম্যান, এমপি। তোমরা দীর্ঘজীবী হও। তোমাদের তো আরো অনেক সময় বাঁচতে হবে। এই সাঁওতালদের আবার ছলনায় হারাতে হবে। সাঁওতাল না হোক অন্যদের জায়গা-জমিন থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। এসব তো তোমাদেরই করতে হবে। তোমরাই করবা। নইলে কোটিপতি হবে কেমন করে? বড়নেতা হবে কেমন করে?
আমাদের ঘর পুড়েছে, মন পুড়েছে। পোড়া মনে শান্তি আসে না। আমরা বাড়ি ফিরি না, গ্রামে ফিরি না, ফিরি এক অন্ধকার ভবিষ্যতের ঘেরাটোপে। মা হাসে না, বাবা হাসে না, গ্রাম হাসে না। এ যেন ভূতের দেশ। ঘটনার পর ভিকটিমরা কিছুদিন চিকিৎসা আর ওষুধ পেয়েছে, কিন্তু এখন আর কেউ খোঁজ-খবর নেয় না। সময়টাই এমন। একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে, আর মানুষ তাদের মনোযোগ নতুনটার দিকেই বাড়াচ্ছে। আগেরটা হারিয়ে ফেলে গুরুত্ব। হামলার পর অনেকে সুষ্ঠু বিচার, জমি উদ্ধারসহ হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সুষ্ঠু তদন্তের জন্য উচ্চ আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি হবে। সেই কমিটি আমাদের বেদনার্ত চিত্র দেখে, যারা ঘটনাটা দেখেছে তাদের স্বাক্ষর নেয়। পরে তদন্ত প্রতিবেদন উচ্চ আদালতে গেলে পুলিশসহ জেলা প্রশাসককে সরিয়ে নেওয়া হয়। বিচার এটুকুই। কিন্তু যে বা যারা এই ঘটনা ঘটালো এবং হামলা করলো তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। এটাই তো আমাদের দেশ। এটাই তো হবার কথা। আর কিছু লিখতে পারছি না। আগুন আর বন্দুকের নলে আটকে গেছে দম। কষ্টরা ফাল দেয়। জেগে উঠে। ছটফটায়। কিন্তু নিভিয়ে রাখতে হয়। সাঁওতাল পুত্রের মন ভালো নেই। শরীর ভালো নেই। সে হেঁটেই যাচ্ছে রেললাইন ধরে।
রওনক, সাঁওতালপুত্র প্রথম স্ট্যাটাসে যে লিখলো, ‘আপনারা বাপ-দাদার সম্পত্তি পাবেন’, ব্যাপারটা ক্লিয়ার করবি?
শিউর। ওই এলাকার মঈনুল হাসানরা একটা কমিটি করে ‘সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ইক্ষু খামার ভূমি উদ্ধার সংহতি কমিটি’ নামে। যার সভাপতি হইলো মঈনুল। শাহজাহান মিয়া সাধারণ সম্পাদক। সহ-সভাপতি ফিলিমন বাস্কে। এই কমিটি বোঝায়, চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণের সময় জমির মালিকদের সঙ্গে যে চুক্তি করে সেখানে উল্লেখ ছিল, কখনও ওইসব জমিতে আখ ছাড়া অন্য ফসলের চাষ হলে প্রকৃত মালিকদের জমি ফেরত দেওয়া হবে। আর ওই জমির মালিক আছিলো এই প্রজন্মের সাঁওতালদের বাপ-দাদারা। এইদিকে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ কয়, ১৯৬২ সালে জমি অধিগ্রহণের সময় চুক্তিনামায় আছে, কখনো চিনিকল বা খামার বন্ধ হলে সেক্ষেত্রে ওই জমি সরকারের কাছে চলে যাবে। খামারে আবাদ হইত আখ। কয়েক বছর থাইকা আবাদ করে ধান আর তামাক। ভোটের সুবিধা পাইবার লাইগা মঈনুল তাদের উস্কায়া দেয় ওই কথার লগে আরও অনেক কথা যোগ কইরা। চেয়ারম্যান ২০১৪ সাল থাইকা সাঁওতালগোর আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়া আইতাছে। ভোটে জিতার পর অয় পাশকাটে। যা মারা খাওয়ার খায় সাঁওতালরা।
লোকটা তো সত্য সত্যই বদ।
তা কইবার পারছ। অবশ্য প্রতিবেশী দেশেও এসবই তো চলতাছে। ভারতে তো প্রত্যেকদিন এইসব ঘটতাছে। মিয়ানমার তো ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাস থাইকা আলাদা হউনের লাইগা রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেশ থাইকাই বাইর কইরা দিলো। আঙ্গোর নেতা-কর্মীরা মনে হয় এইখান থাইকা ধারণা পাইয়া নিজেগর পুংডামি আরও মজবুত করতাছে। দেখবি ১৯৪৭ সাল থাইকা ২০১৪; এই ৬৭ বছরে সাঁওতালগোর ৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হইছে। আর এই উচ্ছেদে ১৬টা আইটেম চালু রাখছে ওইসব সুবিধা আদায়কারি বদেরা। এইহানো যেমন করলো চেয়ারম্যান। এই আগুন, লুটপাট আর গুলির তলে কত আশা, কত স্বপ্ন, কত ইচ্ছা, কত সম্ভাবনা যে চাপা পড়লো এইটা উপলব্ধির বাইরেই রইলো চেয়ারম্যান মঈনুল হাসান, এমপি আর প্রশাসনের।
হ।
ঙ.
মাহিন, তর কেস ডিসমিস্ড হইলো?
চেষ্টা করতাছি সময়রে নিজের মতো ভাগ করার। ওইদিন তুই কিন্তু ভালোই বলছিলি। সময়রে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। জীবনের লাইগা ব্যস্ততা। ব্যস্ততাই যদি জীবনরে আহত কইরা তুলে তাইলে তো হইবো না।
বাহ্, মনে হইতাছে ব্যাপক অগ্রগতিত আছস। গ্রেট ম্যান।
তর ইম্প্রুভ হইলো?
হালকা-পাতলা। বাপ সুস্থ হওয়ার পথে।
রওনক, সামনে চল। চা খাই।
আচ্ছা, চল।