আগুন, আগুন বলে চিৎকার করছে কেউ একজন অথবা অনেকে। কাছাকাছি জায়গায় থেকেই। কান খাড়া করে শব্দের উৎস খুঁজতে থাকে মইরুমি। তার কান ঠিক স্থানটি আবিষ্কার করতে পারছে না। এরপরও উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু এদিক ওদিক তাকিয়ে কী দেখবে! ঘুটঘুটে অন্ধকারে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না! মাথা-চোখ আর মনের দরজা-জানালা খুলে শব্দের উৎস বের করার চেষ্টা করে। চৌচালা ঘরের মধ্য থেকে মইরুমির বড় ভাই বাবুল হাক দেয়, কি রে মইরুমি কোমনে আগুন লাগজে?
মইরুমি উঠোনের মাঝ বারবার দাঁড়িয়ে আবার কান খাঁড়া করে। কিছুক্ষণ পরই সে জবাব দেয়, কিচ্ছু তো বোঝতে পারছি না মেবাই।
ঘর থেকে উঠানে বের হয়ে আসে বাবুল। সেও কান খাঁড়া করে শব্দের উৎস খুঁজতে থাকে। এরপর নিজে নিজেই বলে, মনে অয় পুব কান্দায়ই অইবে। ওই দিক গোনোই চিল্লানি আইতাছে।
বাবুল পরনের লুঙ্গি গুটিয়ে দো’কাছা দেয়। তার এই প্রস্তুতি দেখে মইরুমি জানতে চায়, কই যাইবা মেবাই? এই আন্ধারে তো তুমি কিচ্ছু দেকপা না। আর তুমি এলহা যাইয়া কী করবা? মালেক কাক্কুরেও ভোলাও—দেহো ঘুমাছেনি?
মইরুমির কথায় পাত্তা দেয় না বাবুল। সে আবার ঘরের মধ্যে ঢোকে। রাতের চলার তার একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী টর্চলাইটটা খুঁজতে থাকে। এই লাইটটা সিথানের কাছেই সবসময় রাখে সে। রাতে বাইরে প্রসাব করতে বের হলেও সে এই দুই ব্যাটারির টর্চলাইটটা নিয়েই বের হয়। কিছুক্ষণ হাতড়ে লাইটটা নিয়ে আবার উঠানের দিকে বের হয় বাবুল।
মইরুমি এতক্ষণে শব্দের উৎস বের করতে পেরেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, মেবাই মনে কয় শুক্কুর বাইয়ের ঘরেই আগুন লাকছে। ওই দিক গোনেই শব্দ আহে।
বাবুল লাইট নিয়ে অন্ধকারে পথ বের করার মতো এলামেলো আলো ফেলে। পাশের ঘরের ষাটোর্ধ্ব একমাত্র চাচা মালেক ঘরামীকে ডাক দেয়—কাক্কু, ও কাক্কু, ঘুমাইছেন? ওই কান্দায় দিহি আগুন লাকছে। ওডেন এট্টু দেইক্কা আহি।
দুই-তিন ডাকের পর মালেক ঘরামি উঠলো। কোমড়ে লুঙ্গির প্যাচ শক্ত করতে করতে বের হয় সে—কি রে বাবুল! কী অইছে? ডাকতাছো ক্যা?
মালেক ঘরামী প্রশ্ন করে আবার নিজের জাবাবের মতো বলে যায়, বাবুল ওই কান্দা গোনো চিল্লাচিল্লির আওয়াজ আইতেছে না?
হয় কাক্কু হেই জইন্যেই আফনেরে ডাইক্কা উঠাইছি। লন এট্টু দেইক্কা আহি।
মালেক বাবুলের কথায় সমর্থন দিয়ে বলে—খাড়া হারিকেনডা জ্বালাইয়া লইয়া আহি।
কাক্কু হারিকেন জ্বালাইন্না লাগবে না। মোর ধারে লাইড আছে।
বাড়ির পেছনে পুকুর পাড় দিয়ে খোলা ক্ষেতের দিকে নেমে যাওয়ার রাস্তা। শীতের শেষ দিক। ফাল্গুন মাসের আজ ১৯ তারিখ। শীত অনেকটাই কমে এসেছে। ক্ষেতের কলুই তোলার পর মাঠটা এখন সবুজ ঘাসের রাজ্য।
পুকুরের পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় বাবুল গলা উঁচু করে মইরুমিকে বলে, তুই ঘরে যাইয়া ঘুমা। বাইরে এলহা খাড়াইয়া থাহিস না।
বাবুল আর মালেক ঘরামী আগুন লাগা বাড়ির দিকে চলে যায়। মইরুমি অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবুলের মা নকিতুন নেছা প্যারালাইসিসের রোগী ঘরে অভ্যাস মতোই গোঁঙাতে থাকে। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই মইরুমির।
ঘরামী বাড়িটায় মাত্র দু’টি ঘর। একঘরে বাবুল-মইরুমি ভাইবোন আর তাদের বৃদ্ধ মা নকিতুন নেছা থাকে, অন্য ঘরে মালেক ঘরামী আর তার বউ রফিয়া। পুরো নাম হলো রফিউন বেগম। এটা যদিও কোনো তথ্য সংগ্রহকারীরা এলে কিংবা ভোটার আইডি কার্ডে লিখিত আছে। যেমন মইরুমির ভোটার আইডি কার্ডে নাম হলো মরিয়ম বেগম। কিন্তু সবাই মইরুমি বলে ডাকে। স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ার সময় থেকেই গ্রামের সহপাঠীদের মধ্যে তার এই নাম প্রচার হয়ে যায়। সেই থেকে মরিয়ম বেগম হয়ে যায় মইরুমি। যদিও চার ক্লাস পড়া মইরুমি কোনো প্রয়োজনে নিজের নাম বলতে হলে শুদ্ধ করে মরিয়ম বেগমই বলে।
মইরুমিকে বিয়ের জন্য যখন দেখতে এসে বরপক্ষ জিজ্ঞেস করেছিলো—‘মা তোমার নামটা কও তো?
মইরুমি ঘোমটার মধ্যে লুকিয়ে রাখা মুখ হালকা উঁচু করে বলেছিল, আমার নাম মরিয়ম বেগম।
তুমি কোরান শরিফ পড়তে জানো মা?
হয় জানি।
কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়চো?
ক্লাস ফোর।
অজুর দোয়াটা কও তো?
মক্তবে শেখা বিদ্যা দিয়ে মইরুমি মাথা নিচু করে বলে, বিসমিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম ওয়ালহামদু লিল্লাহি আলা দিনিল ইসলাম আল ইসলামু হাক্কুন ওয়াল কুফরু বাতিলুন আল ইসলামু নুরুন ওয়াল কুফরু জুলমাতুন।
বরপক্ষ খুব খুশি হয়। হাসি মুখে ছেলের এইট পাস করা চাচা কাগজ কলম দিয়ে বলে, তোমার নাম-ঠিকানাডা লেহো তো মা।
মইরুমি ক্লাস ফোরে ফেল করা বিদ্যা নিয়ে নিজের ঠিকানা লেখে—
মোসা. মরিয়ম বেগম।
পিতা: সফিজদ্দিন ঘরামী (মৃত)
গ্রাম: কড়ই তলা
পো: মদনপুর
থানা: মুলাদি
জেলা: বরিশাল।
বিয়ের এক সপ্তাহের মাথাই মরিয়ম বেগম আবার মইরুমি হয়ে যায়। জামাই, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই মইরুমি বলেই ডাকতে থাকে। লিখিত নামের মতোই সামজিক সুখের জীবনেও ফিরতে পারে না মইরুমি। তার মধ্যে সাপের দল জমা হতে থাকে। সেই সাপ পর্যায়ক্রমে দংশন করতে থাকে তাকে। বিষের থলিতে জমা হতে থাকে সহ্যের পাপগুলো। এরপরও শৈশবে বাবা হারানো মইরুমি স্বামীর কিল, ঘুষি খেয়ে একটা বাচ্চার জন্য অপেক্ষা করে। যে সন্তান এলে তার মধ্যেই সুখ খুঁজে নেবে। তার ভবিষ্যৎ তৈরি করবে। কিন্তু এক বছর দুই বছর তিন বছর যায়, মইরুমি গর্ববতী হয় না। শুরু হয় ওঝা-ফকিরের কাছে দৌড়াদৌড়ি। কোনো কিছুতেই কোনো ফল হয় না। শুরু হয় নানা ধরনের কথা। মইরুমি হয়ে ওঠে বাজা মইরুমি। অবশ্য এ নামে তাকে সামনে না আড়ালে আবডালে খাটো করে বাড়ির ঝি-বউরা।
তারপর একদিন আগুন! আগুন বাঁচিয়ে দিয়েছিল মইরুমিকে। আগুনের আগেও অনেকবার গলায় দড়ি দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে সে। ভয়ের মাত্রা অতিক্রম করতে পারেনি। জাহান্নামে যাওয়ার ভয়ে বিষ খেতে পারেনি। কিন্তু জীবনের নিকটতম রাক্ষসরূপ থেকে প্রতিমুহূর্তে পালানোর জন্য কোনো জানালা খুঁজতে থাকতো। সেই জানালা—না জানালা নয়, একেবারে দরজা দিয়েই এসেছিল নতুন পথের ডাক। এক আগুন অন্য আগুন থেকে মুক্তি দিয়েছিল মইরুমিকে।
একদিন মধ্য রাতে কিভাবে যেন মইরুমির ঘরে আগুন লেগে যায়। তখন মইরুমির স্বামী বজলু জ্বরের রোগী। চরের মধ্যে প্যাদা বাড়িতে মাত্র চারটা গেরস্ত থাকে। মইরুমির চিল্লাচিল্লিতে সবাই যখন ছুটে বের হলো তখন খড়ের ঘর পুড়ে ছাই হওয়ার পথে। আগুন, আগুন চিৎকার দিতে দিতে মইরুমি বের হয়ে এসেছিল। তার পাশে শোয়া জ্বরের রোগী স্বামীকে সে কেমন করে নিয়ে বের হবে! সে চেষ্টাও অবশ্য মইরুমি করেনি। তার সেই খেয়াল তখন ছিল না। কিন্তু যখন খেয়াল হলো, তখন সবাই মিলে চেষ্টা করে বজলুকে আধপোড়া অবস্থায় বের করলো। পরের দিন হাসপাতাল। তার দুই দিন পর হাসপাতালেই মইরুমিকে মুক্তি দিয়ে বজলু না ফেরার দেশে চলে গেলো।
বজলুর জন্য তার একবারও কান্না পায়নি। বারবার মনে হয়েছে, এতদিন ধরে আল্লাহর কাছে বলা কথাটা আল্লাহ শুনেছে। বাঁচিয়ে দিয়েছে মইরুমিকে।
তারপর থেকে মইরুমি ভাইয়ের বাড়িতে। কাঠ মিস্ত্রির কাজ করা বাবুলকে আর বিছানায় পড়া অসুস্থ মাকে রান্না করে খাওয়ানো-যত্ন করেই মইরুমির দিন কাটে। বাবুল অনেক দিন মইরুমিকে বলেছে বিয়ের জন্য। কিন্তু মইরুমির সোজা কথা, মেবাই আপনে আমারে না রাকলে কইবেন। গারমেনছে যাইয়া কাম কইরা খামু। কিন্তুক বিয়ার কতা কইবেন না।
এরপর আর কোনো কথা খুঁজে পায় না বাবুল। বাবুলও জানে ছোট বোন মইরুমির দুঃখের কারণ। সেই জন্য এখন আর মইরুমিকে সে কিচ্ছু বলে না। মইরুমি যখন বলে, মেবাই আফনে এইবার এট্টা বিয়া করেন।
তখন কোনো কথা না বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বাবুল। বাবুল মইরুমির থেকে বছর তিনেকের বড়। এখনো তার বয়স ত্রিশ পার করেনি। কিন্তু ছোট সময় বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সংসারের চাকা সচল রাখতে চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই কাঠমিস্ত্রির কাজ করে যাচ্ছে বাবুল। হাতেখড়িটা অবশ্য বাবুলের বাবা শফিজউদ্দিন ঘরামী বেঁচে থাকতেই তার কাছে হয়েছিল। কিন্তু মাথার ওপর বাবা বেঁচে থাকার সময় বাবুলের কোনো কাজ তেমন করতে হয়নি। দুই ক্লাসে স্কুল ছাড়ার পর থেকে সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বড়ানো, ডাংগুলি, মার্বেল, সাতচারা খেলেই বাবুলের দিন কাটতো। হঠাৎ করে ডাইরিয়ায় সফিজউদ্দিন মারা যায়। তারপর থেকে তার আপন চাচা মালেক ঘরামরি সঙ্গে জোগালিয়া হিসেবে কাজ শুরু করে। চার পাঁচ বছরের মধ্যেই বাবুল হেডমিস্ত্রি হয়ে যায়। চাচার থেকে আলাদা হয়ে দুই জন জোগালিয়া নিয়ে কাজ শুরু করে।
ঘরের সামনে পিঁড়িতে বসে গাছের মথায় তাকিয়ে আছে মইরুমি। অসুস্থ নকিতুন নেছাকে বলে, মা মুই এহেনে আছি। মেবাই ইট্টু ওই কান্দায় গ্যাছে! পোড়ামোল্লাবাড়ি আবার আগুন লাকছে মনে অয়!
জোরের ওপর বলা কথাগুলো মইরুমির মা নকিতুন নেছা শুনতে পেলে কিনা, সেটা বোঝা গেলো না। নকিতুন নেছা প্যারালাইসেস হওয়ার পর থকেই ভালো ভাবে কথা বলতে পারে না। কিছু বলতে চেষ্টা করেন কেবল গোঙানির আওয়াজ বের হয়। তখন তার চোখ কাঁপতে থাকে। এই দৃশ্য দেখলে মইরুমির খুব কষ্ট হয়।
কিন্তু কিচ্ছু করতে পারে না সে। আল্লাহর এই শাস্তি কেনো যে তার মা নকিতুন নেছার ভোগ করতে হচ্ছে সেটাও সে জানে না। মাঝে মাঝে বিকেলের বিদায়ী লাল ডিমের মতোন সূর্যের প্রতি তাকিয়ে ভাবে আল্লাহকে পেলে কয়েকটা প্রশ্ন করবে। তার মধ্যে প্রথম প্রশ্ন হলো, মরিয়ম বেগমের কী দোষ ছিল যে, শরীরে বর্ষার কদমের মতো যৌবন নিয়ে তার এই বৃদ্ধ কলা গাছের মতো জীবন কাটাতে হচ্ছে? আর অল্প বয়সে বিধবা হওয়া নতিকুন নেছারই বা কী দোষ যে, আল্লাহ তার দেখা এই ফেরেস্তার মতো মহিলাকে বিছানায় প্রায় মৃত করে শুইয়ে রেখেছে! কিন্তু তার মনের প্রশ্ন মনেই থাকে; বের হয় না। আল্লাহর সঙ্গে তার কখনোই দেখা হয় না। সে ছোট বেলায় মক্তবে হুজুরের কাছে শুনেছে মুসা নবী আল্লাহকে দেখতে চেয়েছিল। তারপর আল্লাহ মুসা নবীর আবদারের কারণে তার সত্তর পর্দার এক পর্দা তুলে দিয়ে মুসার সামনে দেখা দিতে যাওয়ায় তুর পাহাড় পুড়ে গিয়েছিল। সেই কথা মনে করে আবার ভয়ও পায় মাইরুমি। কিন্তু তার এই খোলসবদ্ধ যৌবন নিয়ে ঠেলাগাড়ির মতো ঠেলে ঠেলে চালানো প্রতিটি দিন অসহ্য লাগে। কাউকেই বলতে পারে না সে কথা। সে ভেতরে পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একটা মন নিয়ে ক্ষয়ে যেতে থাকে।
ছাব্বিশ বছর পাঁচ মাস এগারো দিন বয়সী মইরুমীর কী কমতি আছে! নিজেকে প্রশ্ন করলে কোনো জবাব পায় না সে। অন্য মেয়েদের বিয়ের এক দেড় বছরের মধ্যেই স্তনের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে নিম্নমুখী হয়ে যায়। আর সন্তান হলে তো পুরো শরীরটাই ভেঙে নতুন একটা রূপের মধ্যে নির্বাসিত হয়। কিন্তু এত বছর সংসার করেও মইরুমির স্তন এখনো ঈর্ষণীয় উন্নত। তলপেটে একটু মেদ আছে ঠিকই কিন্তু সেটাকে ভুড়ি বলা যায় না। আর তার বিরুদ্ধে যে বাজা মেয়ের অভিযোগ! সেটাকে মইরুমি কোনো ক্রমেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না। কোনো রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই যে তার শরীরের সঙ্গে এই দুর্নাম লেগেছে, সেটা তাকে কষ্ট দেয়। সমস্যাটা তো পুরুষেরও হতে পারে! তার মৃত স্বামীরও তো সমস্যাটা থাকতে পারে! মইরুমি শুনেছে এখন অনেক রকম চিকিৎসা বের হয়েছে, যেন কার সমস্যা সেটা জানা যায়। কিন্তু সেই পরীক্ষা পর্যন্ত যাওয়ার কোনো পথ তার জানা নেই। সে জানে এই দুর্গম গ্রামে থাকা তারমতো মেয়ের অসুখ হলে বড় জোর কষ্ট করে ইউনিয়ন পরিষদ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার আপার কাছে যাওয়া। কিন্তু মইরুমিরা যাকে ডাক্তার আপা মনে করে, পুরা গ্রামের মহিলারা যাকে ডাক্তার মনে করে, সে যে স্বাস্থ্যকর্মী সে কথাও তাদের কেউ জানিয়ে দেয় না। সে কারণে মইরুমির শরীর থেকে এই দুর্নাম মুছে ফেলারও কোনো রাস্তা আবিষ্কার হয় না।
নিজের সমস্ত দোষগুলো মইরুমি একরকম মেনেই নিয়েছে। শুধু মাঝে মধ্যে আল্লাহর ওপর খুব রাগ করে। রাতে বিছানায় ঘুমহীন চোখে বালিশ বুকে নিয়ে এপাশ-ওপাশ করতে করতে আল্লাহর ওপর তার খুব অভিমান হয়। ভাবে, কাল থেকে আর নামাজ পড়বে না। কী হবে এই নামাজ-রোজা করে! বুঝ হওয়ার পর থেকেই তো নিজের সাধ্যমতো নামাজ-রোজা করে আসছে; তাহলে আল্লাহ তাকে এত শাস্তি দিচ্ছে কেন! কিন্তু এই চিন্তা মইরুমির মনে বেশিক্ষণ স্থায়ীত্ব লাভ করে না। মক্তবের হুজুর রশিদ মুন্সীর ভয়াবহ দোজখের বর্ণনা থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। সে কারণে শেষ রাতে ফজরের আজান শোনার পরই আবার উঠে যায়। ওজু করে নামাজ আদায় করতে পশ্চিমমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে হাত তুলে কান্না করে গ্যাঁড়াকলের এই জীবন থেকে রেহাই চায়।
ভালোবাসা বলতে যে একটা জিনিসি আছে, সেটার স্বাদ জীবনে কখনো ঠিকমতো নেওয়া হয়নি মইরুমির। বিয়ের আগের বছর বাড়ির দক্ষিণ পাশের গোয়াল ঘরে খড়ের গাদার পাশে ধর্ষণের শিকার হতে হতে বেঁচে গিয়েছিল সে। সেই রবিউল এখন তিন সন্তানের বাবা। মাঝে মধ্যে মইরুমির মনে প্রশ্ন জাগে, রবিউল কি তাকে পছন্দ করতো! যদি পছন্দ করে, তাহলে তো বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতো। সুযোগ পেয়ে জোর করে শরীরের ক্ষিধে মিটাতে চাইবে কেন! এই প্রশ্নের জবাব জানা হয় না মইরুমির।
ছয় মাস আগে সেই গোয়াল ঘরের পাশে খড়ের মধ্যেই নতুন করে বাসর হয় মইরুমির। এবার তাকে কেউ জোর করেনি। ভেতর থেকেই যেন অনেক দিন থেকে প্রস্তুত হয়ে ছিল মইরুমি। বছর খানেক ধরে পেছনে ঘুরতে থাকা পাশের বাড়ির রতন জয় করে নেয় মইরুমির স্বাধীন রাজ্য। রতনের চাষের গতির কাছে মইরুমি নিজের রাজ্যে নিজেই ক্রমেই পরাধীন হয়ে যেতে থাকে। ঘরামী বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে গ্রামের সরব মুদি দোকান। সন্ধ্যার পর যখন বাবুল আর তার চাচা মালেক ঘরামি সরকারি উন্নয়নের খবর নিতে থাকে তখন মইরুমিও খবর নেয় রতনপুর রাজ্যের। তারপর নিয়মিত বিরতিতে চলতে থাকে তাদের আবিষ্কার। গতিময় হয়ে ওঠে মইরুমির শরীর। রতনের অনুপস্থিতিতে মইরুমির মধ্যে অনেক রকম ভয় বাসা বাঁধতে চায়। অবার শারীরিক অস্থিরতায় ভেঙেও যায়। মইরুমি যখন একা থাকে, তখন বারবার তওবা পড়ে ঠিক করে, না আর না। তার মধ্যে তখন জেনার ভয়। জাহান্নামের আগুনের ভয় জাগতে থাকে। কিন্তু যখন আবার রতনের হাত তার উন্নত বুকের উঁচু-নিচু জমিতে সাঁতার কাটতে থাকে, তখন মইরুমির ভেতরটায় আপনা আপনিই জোয়ার ওঠা শুরু করে। তখন সে আর তাকে কোনো ক্রমেই থামিয়ে রাখতে পারে না।
একিদন নিজের নামের সঙ্গে লেগে থাকা বাজা অভিধা ঘুচে যায়। রতনের চাষে নিজ জমিনের উর্বরতা বুঝতে পারে সে। মইরুমি আবিষ্কার করতে পারে তার ভেতরে আরেকটা রতনপুর তৈরি হচ্ছে।
মইরুমি শুকনো মুখে রতনকে ভেতরবাড়ির খবর জানায়। রতন খুব খুশি হয়ে তাকে বিয়ের জন্য তৈরি হতে বলে। মইরুমি নতুন আকাশে উড়তে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই কালবৈশাখী ঝড়ের ঝাপটায় ডানা ভেঙে যায় তার। গত পনেরো দিনে রতনের কোনো খবর পায়নি মইরুমি। রতনের খবর নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে সে। তারপর জানতে পারে রতন শ্বশুরবাড়ি গেছে। সেখান থেকে বউ নিয়ে ঢাকা যাবে। এখন থেকে বউ নিয়ে ঢাকাতেই থাকবে। এই খবর জানার পর মইরুমি সমুদ্রের মধ্যে ডুবতে যেতে থাকে। না কোনো কলা গাছ, না পায়ের নিচে মাটি; কিছুরই নাগাল পায় না সে। আবার তার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে। পুড়ে যেতে থাকে সব গুছিয়ে উঠতে থাকা ঘর-বাড়ি। সেই আগুনকে লুকিয়ে রেখে বেঁচে আছে! কিন্তু মইরুমির ভেতরে বেড়ে উঠতে থাকা রতনপুরের আগুন কোথায় লুকিয়ে রাখবে।
পুব কান্দায় আগুন আগুন চিৎকারটা এখন আর শোনা যাচ্ছে না। মইরুমি কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে। রাতের নিরবতায় উড়ে আসা মানুষের ব্যস্ত হইচইয়ে সে বুঝতে পারে যে এখন আগুন হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মইরুমি মনে মনে সান্ত্বনার বাণী আওড়ায়—যাউক তাইলে এইবার বাঁইচ্যা গ্যালো।
দরজার সামনে পিঁড়িতে বসে আগুন নিভাতে যাওয়া সহোদর বাবুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে মইরুমি।
বাবুল আর তার চাচা মালেক ঘরামী পুব কান্দায় যেতে যেতে আগুন অনেকটাই নিভিয়ে ফেলেছিল পড়শি বাড়ির লোকজন। এখন উঠানের মাঝে চলছে নিভাতুর আগুন নিয়ে গবেষণা। আগুন কেমনে লেগেছে, কিভাবে ছড়িয়ে পড়লো, কী কী পুড়েছে আর কিভাবে নিভানো হলো; তার ওপর উপস্থিত পড়া-পড়শীরা গল্প বাড়িয়ে চলছে। হয়তো রাত পার হয়ে সকাল হতে হতে তৈরি হওয়া নতুন গল্পে সত্যি গল্পটা হারিয়ে যাবে। তখন বিভিন্ন রঙে রাঙানো গল্পটা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হতে থাকবে। যতদিন না তারা গল্প করার মতো নতুন আর কিছু না পায়।
গতবছরও একবার আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল শাকুরের ঘরের একাংশ। আর এই বাড়িতে আগুন লাগাও যেন কেমন একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। সেই জন্য এই বাড়ির নাম হয়ে গেছে পোড়ামোল্লা বাড়ি। খালি মোল্লা বাড়ি বলে তার যতটা পরিচিত ছিল পোড়া শব্দটা যোগ হয়ে এই বাড়ির প্রচার অনেক বৃদ্ধি করেছে। গত বিশ বছরে কম করে হলেও ছয়-সাত বার এই বাড়িতে আগুন লেগেছে। সে জন্য আগুন আগুন শব্দ কানে এলেই গ্রামের মানুষ প্রথমেই পোড়ামোল্লা বাড়ির কথা চিন্তা করে।
মাথা নুইয়ে বসে আছে শাকুর। একটু আগে পুড়ে স্বর্গে চলে যাওয়া ঘরের পুনঃনির্মাণ বিষয়ক জটিলতাই হয়তো তার মাথাকে নুইয়ে রেখেছে। সেই ওজন থেকে মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। শাকুরের মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। মাথার ওপর গার্জিয়ান না থাকায় তার বিয়ে করা হয়নি এখনো। বয়স বাবুলের থেকে কমপক্ষে দশ বছরের বড়। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হবে শাকুরের বয়স পঞ্চাশ পার করেছে। শাকুরের কাছে গিয়ে বাবুল আর তার চাচা মালেক ঘরামি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। শাকুর একবার মাথা তুলে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে করে আবার মাথা নুইয়ে কোথায় যেন ডুবে যায়। বাবুল আর কথা বাড়াতে পারে না। উদাস হয়ে পোড়া ঘরটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাত বাড়তে থাকে। আর রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘর পোড়ার গল্প বড় হতে থাকে।
পুকুর পার দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকার জন্য যখন বাবুলের পা চলছে, তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছড়িয়ে গেছে অনেক দূর। চাচা-ভাতিজাও পোড়া ঘরের উড়ো গল্পের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের গল্প তৈরি করতে করতে থেমে গেছে এখন। কখনো মনে মনে আবার কখনো চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ গাছদের শুনিয়ে কথা বলেছে এতক্ষণ। টর্চ লাইটের আলোয় ছোট ছোট পা ফেলে এগুচ্ছে বাবুল। এখন আর তাদের কোনো তাড়া নেই। আগুনের গল্প পেছনে ফেলে এসে এখন তারা অনেকটাই শান্ত। হালকা বাতাসে তড়িঘড়ি করে ছুটে যাওয়ার ফলে ঘাম হওয়া শরীরটাও অনেকটা গ্রীষ্মের সকালের মাটির মতো নীরব হয়ে আছে। পুকুরঘাটে পা ধুয়ে নিতে নিতে বাবুল মইরুমিকে ডাক দেয়।
ঘরের মধ্যে কোনো কুপি জ্বলতে না দেখে বাবুল মনে করে মইরুমি ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপরও বাবুল ডাক দেয়, কি রে মইরুমি ঘুমাইয়া গ্যাছো? শুক্কুইরার ঘরডা আবার পুইড়্যা গ্যাছে।
কোনো জবাব না পেয়ে বাবুল নিজের মতো করেই নিজে বলে যায়।
হালার শুক্কুরার ভাইগ্যই খারাফ। পোড়া মোল্লা বাড়ি আগুন লাগলেই ওর ঘরডা পুড়বেই। হালার কফালে এট্টা বউ।
বাবুল বাক্যটা আর শেষ করতে পারলো না। চোখের সামনে মইরুমির অন্য চেহারা দেখে বাবুলের হাত থেকে টর্চ লাইটটা পড়ে গেলো। তার চিৎকারে বের হয়ে আসলো মালেক ঘরামি আর চাচী রাফিয়া। তাদের মাতমে দুই গেরস্তের এই ঘরাম বাড়ি ও ঘরের মধ্যে নিজস্ব নিয়মে কাতরাতে থাকা নকিতুন নেছার অস্ফুট কণ্ঠস্বর ঢাকা পড়ে যায়। উঠানের দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পেয়ারা গাছের ডালে তখন অনেক আগুন! সেই আগুনের সুখে অজানা জগতে উড়ছে মইরুমি।