আজ তিনি ভালো আছেন। খোশ মেজাজে আছেন। অন্যসব দিনের চেয়ে একটু আলাদা রকম ভালো আছেন আওলাদ হোসেন। বড় কাঠের আলমারি খুলে অ্যালবামটা হাতে নিলেন। পাতা উল্টাচ্ছেন সেই ছবিটার খোঁজে। চশমাটা হাতড়ে নিলেন বিছানা থেকে। মরিয়মের মা থাকলে ঘড়ি,চশমা, পাঞ্জাবি, ছড়ি—এসব নিজেকে খুঁজে বের করতে হতো না। সাদাকালো ছবিটা পেলেন অ্যালবামের শেষের পাতায়। রঙ কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে। কতটা বছর পেরিয়ে গেছে। হাজী সাহেবের বয়স আশি। সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে যায়। কী রূপবতী না ছিল আকলিমা বেগম!নারিন্দায় দুইকামরার একটা বাড়িতে নতুন বউকে তুলেছিলেন আওলাদ হোসেন। বিয়ের পর এই ছবিটা নিউমার্কেটের আক্স স্টুডিও থেকে তোলা। সেদিন রিক্শা করে নিউমার্কেটে গিয়েছিলেন দুজন। দুটো লবঙ্গ তার হাতে দিয়েছিলেন আকলিমা বেগম। রূপবতী আকলিমা বেগমের ঘোমটা টানা মুখটা তার মনে পড়ে যায়। ছবিটার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। কত কথা জমা হয়ে আছে আকলিমা জন্যে। স্বল্পভাষী আকলিমা। আওলাদ হোসেন বলতেন, তুমি কথা কওনা ক্যান? আমি তোমার লগে কত কথা কই!
আমি আপনার কথা শুনি হাজি সাব, আমার শুনতে ভালা লাগে।
হাজি আওলাদ হোসেন এখন একা। বাড়িভর্তি লোকজন, বড় ছেলে জুম্মন, ছেলের বউ লাভলি, ছোটছেলে মজনু। জুম্মনের দশ বছরের ছোট মজনু। মেয়ে মরিয়ম জুম্মনের দুবছরের ছোট। সুজন আর শিল্পী তার দুই আদরের নাতি নাতনি।
তিনি একা। বিছানায় শুয়ে আছেন। সিলিঙ ফ্যানটা বন বন ঘুরছে। কাঠের রিমগুলো গুনে দেখেন তিনি। বকশিবাজারের এই বাড়িটা অনেক পুরনো। বড় মেয়ে মরিয়ম হওয়ার আগে এক হিন্দুপরিবারের থেকে কিনেছিলেন। নতুন বাড়িতে এসেই একটা মেহেদিগাছ লাগিয়েছিলেন আকলিমা। দুহাত ভরে মেহেদি লাগাতেন তিনি। ঈদের সময় দুহাত মেলে দিয়ে বলতেন, দেখসেন, হাজিসাব! আমার মেন্দি কত লাল হইসে!
আওলাদ হোসেনের সামনে তখন একফালি চাঁদ,আকলিমা বেগম। তিনি চেয়ে আছেন। অ্যালবামের পাতা উল্টান। কথা বলেন আকলিমা সঙ্গে। বিবাহবার্ষিকীর এই বিশেষ দিনটিতে ভালো থাকতে চান আওলাদ হোসেন। দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। সবুজরঙের কাঠের দরজা পেরিয়ে লম্বা রাস্তা। দুধারে গাছ, ডালিম, আতাফল আর মেহেদি।
তারপর খোলামাঠ। মাঠের একধারে এল শেইপের দোতলা বাড়ি। বাড়িটি সাদা রঙের ছিল। এখন কোন রঙ নেই। আওলাদ হোসেনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটিরো বার্ধক্য শুরু হয়েছে। নাতি নাতনিরা সব এই মাঠে খেলা করে।
আজ শুক্রবার। স্কুল ছুটির দিনে পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা মাঠে এসে ভিড় করে। আজকাল ঢাকায় খেলার জায়গা নেই বললেই চলে। পাড়ার ছেলেবুড়োদের ক্রিকেট ম্যাচ হয় তার বাড়িতে। ছোট নাতি সুজন ঝড়ের গতিতে খেলে। নড়াইল এক্সপ্রেসের পর বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতের ঢাকা তুফানমেইল সুজনের জন্য। আওলাদ হোসেন তাই মনে করেন। নাতিকে নিয়ে গর্ব করেন, অনেক স্বপ্ল দেখেন। আজকাল সুজনের শরীরটা ভালো না। খেলাধুলা কমিয়ে দিয়েছে সে। তার উপর মজনু সিঙ্গাপুর থেকে কী এক ভিডিওগেম এনে বাড়ির ছেলেমেদের সর্বনাশ করেছে। দৌড়ঝাঁপ করা ছেলেমেয়েগুলো এখন টিভি, কম্পিউটার আর ভিডিওগেমে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
মজনুর সঙ্গে তেমন বেশি কথা বলেন না তিনি। আয়েসি এই ছেলেটার সবুজ স্পোর্টিং ক্লাবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। আকলিমা বেঁচে থাকলে ও এতটা বখে হতো না এ কথা প্রায়ই ভাবেন আওলাদ হোসেন। গতবছর হঠাৎ করেই বিদেশে চাকরি নিয়ে চলে যায় মজনু। দুমাস না পেরুতেই আবার ফিরে আসে সিঙ্গাপুর থেকে। মাঝখানে বেশ কিছু টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছে আর কি! মজনুর সব আবদার বড়ভাবী লাভলির কাছে। জুম্মনের দুই ছেলেমেয়েও মজনুর খুব ভক্ত। ছোটবেলায় ছোটচাচ্চুর হাত ধরে ওরা মহরমের মিছিল দেখতে যেত।
জুম্মার নামাজ থেকে ফিরে গেটের ধারে বসে আছেন তিনি। ইত্তেফাকের পাতা উল্টাচ্ছেন। আজকের তাজা খবর হলো ঢাকার শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে! এ আর নতুন কী? জুম্মন হোসেন কি কারও কথা শোনে! এত টাকা শেয়ার মার্কেটে রাখারই বা কী আছে? ছেলেটাকেই কী বা বলবেন তিনি। হোসেন পরিবারের ব্যবসা বাণিজ্য জুম্মনই একা দেখাশোনা করে। সপ্তাহে শুধু একবার ছেলের সঙ্গে চকবাজার যান আওলাদ হোসেন। পুরোনো লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগে।
বড় গেইটটা খোলাই আছে। পাঞ্জাবি পরা রোগামতো একটা লোক বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। আওলাদ হোসেনের চোখ পড়ে। আগে কি দেখেছেন কোথাও? লোকটা আবারও উঁকিঝুঁকি দেয়! হাতে লালরঙের একটা ফাইল।গ্যাসের মিটার চেক করতে এসেছে কি?
আপনি কারে খুঁজেন সাব?
সালাম হাজি সাব।
লোকটা আর তেমন কিছু বলে না। দ্রুত হেঁটে চলে যায়। পাড়ার কেউ হবে হয়তো।
দোতলায় উঠে আসেন তিনি। মনটা অস্থির লাগছে। তৈরি হচ্ছেন তিনি। বড়মেয়ে মরিয়মকে দেখতে যাবেন। শিল্পীও দাদুর সঙ্গে যাবে। মরিয়ম মেয়েকে তৈরি করে। ফুপুর বাড়ি যেতে ওর খুশির সীমা নেই।
সুজন, ফুপ্পিগো বাড়ি যাবি আমার লগে?
দাদ্দু, আপনে যান শিল্পীরে লইয়া।ভিডিওগেম খেলতে খেলতে মাথা নাড়ে সুজন।
বউ, তোমার পোলা সারাদিন ঘর থিকা বাইর হয় না। চোখ নষ্ট হইয়া যাইবো। মজনু যে কী গেমের নেশা ধরায়া দিসে!
সুজন, তুই মাঠে নামোস না কেন? তগো ক্রিকেট ম্যাচ না সামনে?
সুজন কিছু বলে না। টিভির স্ক্রিন থেকে চোখ ফেরানোর সময় নেই তার।
আওলাদ হোসেন বেরিয়ে পড়েন শিল্পীকে নিয়ে। সাদা পাঞ্জাবির পকেট থেকে কড়কড়ে নোটগুলো বের করে ড্রাইভারের হাতে দেন। সাতরোজার আনন্দ বেকারি থেকে তিনটি বাক্স গাড়িতে তুলে আনে রবিউল।
গাড়ি আস্তে চালাও রবিউল। শুক্রবারে রাস্তায় জাম নাই। তাড়াহুড়া কইরো না তুমি।
লোকটা রিকশায় বসে আছে। গাড়ির পাশাপাশি রিকশাটাও চলছে। হাতে লাল ফাইল। সকালের সেই লোকটাকে আবার দেখলেন তিনি। আওলাদ হোসেনের দিকে তাকিয়ে আছেন। এটাই কি সেই লোক?
রবিউল দেখোতো? এই ব্যাটারে চিনো?
না হাজিসাব। ক্যান কী হইসে?
কিসু না।
শিল্পী দাদুর কথা শোনে। গাড়িতে রেডিওফুর্তির গান বাজে।
নারিন্দা পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়।
মরিয়ম বাবাকে দেখে খুশি হয়। মেয়ের জামাই আব্বাস শেখ শ্বশুরের সঙ্গে নতুন ব্যবসার আলাপ জুড়ে দেয়। সাইকেলের ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে বলে মন খারাপ করে মরিয়মের বড় ভাসুর।
নারিন্দা মোড়ের ঝুনুর মোরগপোলাউ কাচের প্লেটে তুলে দিতে মরিয়ম বলে, আব্বা, আপনে একটা ফোন কইরা দিতেন। আপনের পছন্দের ভুনা কলিজা রানতে পারতাম। আমি আম্মির মতো অত ভালো রানতে পারি না!
তুইতো ভালো রান্দোস মরিয়ম। তোর মার মতোই। আক্কাস কই, আমাগো লগে খাইবো না? আমার নাতিরা কই?
নাসির আর ইমন নানার সঙ্গে টেবিলে এসে বসে। নানাজানের গ্লাসে বোরহানি ঢেলে দেয় নাসির।
শিল্পী, খাস না কেন? খা, মজা আসে। মরিয়ম তার প্লেটে মুরগির রান তুলে দেয়।
ইমন তোমরা আমাগো বাড়ি যাও না কেন? আগে না সুজনগো লগে কিরিকেট খেলতা ?
নানাজান কেমন আছে আপনের তুফানমেল?
ভালা আছে সুজন। আমগো বাড়িতে আইসো তোমরা, আবার কিরিকেটমেচ হইবো।
ও বাড়ি থেকে বেরুতে বেরুতে রাত হয়ে যায়। গাড়িতে উঠেই ঝিমুনি পায় আওলাদ হোসেনের। পানের খিলিটা হাতেই রয়ে যায়।
গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দরজায় পা রাখতেই তার সঙ্গে আবার দেখা হলো। হাতে লালফাইল।রোগামতো কালো লোকটা। এত রাতে কী করছে তার বাড়ির সামনে?
রবিউল গ্যারেজ থেকে ফিরলেই লোকটার সঙ্গে কথা বলবেন তিনি।
শিল্পীকে ওপরে পাঠিয়ে দিলেন।
রবিউল, ঐ ব্যাটা এত রাতে কী করে আমাগো বাড়ির গেটে?
কে হাজিসাব? কই এখানেতো কেউ নাই।
দোতলায় উঠে আসেন তিনি। টেবিলের ওপর একটা বিয়ের কার্ড আর একটা সাদা খাম। ঘুমের সময় হয়েছে তার। কাল সকালে উঠে দেখবেন।
খুব সকালে উঠে পড়েন তিনি। চিরতার রস খেয়ে হাঁটতে চলে যান। লাভলি শ্বশুরের নাস্তা টেবিলে দেয়। সকালে সবার সঙ্গে দেখা হয়। সাদা খামটা হাতে নিয়ে জুম্মনের হাতে দেয় আওলাদ হোসেন। ইংরেজিতে লেখা একটা চিঠি। জুম্মন চা খেতে-খেতে দুবার পড়ে।
আব্বা ডেভলপার কোম্পানি এই বাড়িটা চায়। ২৮ টা ফ্ল্যাট হইবো। টাকাও দিবো অনেক।
আমি এইসব বুঝি না। তোমরা কী কও?
মজনুরে ডাকেন, সবাই মিলাই ঠিক করি। আইজকাইল সবাইতো ফ্ল্যাট বানাইতাসে।
বিকালে আলাপ করুম, চিনতা কইরা দেখি।
আব্বু আপনে যা কইবেন তাই হইবো। লাভলি শ্বশুরের পাশে এসে দাঁড়ায়।
সারাদিন ভেবেছেন তিনি। মরিয়মকে ফোন করেছেন দুবার। লাভলি আর মজনুর সঙ্গেও কথা বলেছেন। সবাই রাজি। মাথাটা ভন ভন করছে। সুজনের পাশে গিয়ে বসেন তিনি।
সুজন কী কও, বাড়িটা দিয়া দিমু ওগোরে?
দাদ্দু, আপনার কি খারাপ লাগতাসে?
নাহ্, বুঝতাসি না কী করুম।
বিকেলে সবাই ড্রইংরুমে এসে বসে। মজনু, জুম্মন, সুজনরা পাশাপাশি বসে আছে। মরিয়ম নাসিরকে নিয়ে এসেছে দুপুরে। মেয়ের জামাই আক্কাস আসবে সন্ধ্যার পরে। পৌনে সাতটা বাজে। দুঘণ্টায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অনেক কথাই বললেন তিনি। আক্কাসদের বাড়িটাও ফ্ল্যাট হবে। জানুয়ারি মাসে ভাড়াবাড়িতে চলে যাবে মরিয়মরা। রবিবারে ডেভেলপার কোম্পানির লোকজন আসবে। আকলিমা মঞ্জিলের কাগজপত্র দেখতে।
নানাজান আমরা যাই।
কিরিকেট মেচ কবে হইবো সুজন? ইমনগোরে জানায়া দাও!
২৫ তারিখে ইমন, নাসিরভাইয়ারে কয়া দিও। দাদ্দু আমগো মাঠে এইটাইতো শেষ মেচ। আপনেও খেলবেন আমাগো লগে!
মেয়ে জামাইকে বিদায় দিতে গেট পর্যন্ত আসেন তিনি। লালফাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। কেন সে দাঁড়িয়ে থাকে এখানে? মনটা ভালো নেই। এসব নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না। তিনি ঘরে চলে যান।
আজ রবিবার আলমারি খুলে দলিল বের করেন আওলাদ হোসেন। শরীরটা ভালো লাগছেনা। মজনু, জুম্মন কেউই বাড়ি নেই। লাভলি রান্না ঘরে। শিল্পী আর সুজন স্কুল থেকে ফিরেছে কেবল। তিনি ঘরে পায়াচারি করছেন।মেয়ে মরিয়মকে ফোনে পাচ্ছেন না। মোবাইল বন্ধ। ‘এই …’—ভদ্রমহিলার ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা শুনতে আর ভালো লাগছে না।
ড্রইংরুমে লোকজন বসে আছে। আওলাদ হোসেনের হাতে দলিল। জুম্মন, মজনু আক্কাস সবাই আজ খুব হাসিখুশি। মরিয়ম আসেনি। ঘরে ঢোকেন তিনি। চোখের চশমাটা শ্বশুরের হাতে দেয় লাভলি বেগম। সবাই কথা বলছে। ঘরের এককোনে সেই লোকটা বসে আছে। ঠোঁটের মুচকি হাসি। হাতে লালফাইল। সামনে এসে দাঁড়ায়। একটা কাগজ আওলাদ হোসেনের হাতে দেয় সে। আকলিমা মঞ্জিলের নামটা বদলে যাবে। অরকিড ভিউ। ২৮ টা ফ্ল্যাট। মাটির নিজে পার্কিং। এক কোটি টাকার একটা চেক।
আপনি এখানে কী করেন?
লোকটা নিরুত্তর।
২৫ তারিখে কিরিকেট মেচ আছে, দেখতে আইসেন। মহল্লার সবচেয়ে বড় মাঠে খেলা হইবো।
জি, হাজিসাব।
বাবার সামনে কলম এগিয়ে দেয় মজনু। জুম্মন আর আক্কাস পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আওলাদ হোসেন তাকিয়ে আছেন লোকটার দিকে।
সুজন কই? সুজন? নাসির আর ইমনগোরে আনোনাই আক্কাস?
সুজন ঘরে ঢোকে।
দেখছেন? এইটা আমাগো তুফানমেল।কিরিকেট খেলায় চাম্পিয়ান। দোয়া কইরেন। আমাগো মহল্লায় অনেক ভালো পেলেয়ার আছে। এখন থেইকা প্রতিমাসের ২৫ তারিখে মেচ হইবো। শুনছোস তোরা! মহল্লার সবাইরে জানায়া দে।
আপনারা চা-নাস্তা খায়া যাইবেন কিন্তু।
কলম হাতে নেননি তিনি। কেউ কোনো কথা বলে না।
দলিলটা হাতে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন হাজি আওলাদ হোসেন। স্ত্রী আকলিমার মেহেদি রাঙা হাত দুটোর কথা মনে পড়ে যায়। আকলিমা মঞ্জিলের মেহেদিগাছে নতুনপাতার কুঁড়ি এসে ভিড় করে।