আমি যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছি, সেটি একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে। ল্যাম্পপোস্টে আলো নেই। শহরের বেশির ভাগ ল্যাম্পপোস্টের একই অবস্থা। দিনের বেলায় জ্বলে আর রাত হলে নিভে থাকে।
চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে— চাঁদকে আজ মেঘেরা সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলেছে। অথচ গতকালই চন্দ্রগ্রহণ গেছে। মেঘেরা চাঁদকে গিলে ফেললে কি গ্রহণ হয়? আমার জানা নেই। তবে আজ সারারাতেও অন্ধকার কাটে কি না সন্দেহ!
আমি দাঁড়িয়ে আছি ঘণ্টা তিনেক হবে। প্রথমে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম বর্তমানে সেখান থেকে একটু দূরে সরে এসেছি। প্রচণ্ড মশা আর লাল পিঁপড়েরা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। আমাকে মনে করেছিল সদ্য মৃত কোনো প্রাণী। কিন্তু না। ওরা আসলে যা ভেবেছে তা সম্পূর্ণ ভুল। আমি মুহূর্তে ওদের ফাঁকি দিয়ে, বোকা বানিয়ে, এই অদূর স্থানে চলে এসেছি।
দু’পায়ে ভর করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। আমি কখনো কারও অপেক্ষায় এতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকিনি। অন্য মানুষ হলে এতক্ষণে নিশ্চই পায়ে খিল এঁটে যেত। আমার কিন্তু সে রকম কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
শুনেছি—পৃথিবীতে মানুষের জীবনে কখনো কখনো এ রকম নির্ভার সময় অতি-বাহিত হয়, যখন আর তার কাছে কোনো কিছুই অসহ্য লাগে না, অস্বস্তিকর মনে হয় না। যারা ধ্যান কিংবা সাধনা করেন তাদের নাকি ধৈর্য ক্ষমতা অপরিসীম।
হালকা শীত শীত। বাতাস বইছে। শরীরে ঈষৎ কাঁপুনি। মুহূর্তে টের পাই শরীরের সমস্ত রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠছে। আমি শীতার্ত ক্ষুধিত মানুষের মতো একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে নিরুপায় দাঁড়িয়ে থাকি।
আকাশের মেঘগুলো দ্রুত পৃথিবীর এক কোন থেকে আরেক কোনে স্থানান্তরিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও দীর্ঘক্ষণ পর পর বিজলী চমকাচ্ছে। আমি ফুল শার্টের হাতের বোতামটি ভালো করে লাগিয়ে নেই। শীত মনে হচ্ছে একটু বেশিই লাগছে। পরনে নীল রঙের জিন্স ভেদ করে শীতটা সম্ভবত শরীরে ঢুকছে। পায়ে কালো চপ্পল। তাই শীতের প্রকোপ থেকে পায়ের আঙুলগুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে না।
গাছের পাতারা মনে হচ্ছে এই মাত্র প্রাণ ফিরে পেয়েছে। তারা প্রত্যেকে বাতাসের হালকা দোল পেয়ে নব আনন্দে দুলতে শুরু করেছে। রাস্তার ওপরের কড়ই গাছগুলো থেকে অবিরাম রিমঝিম আওয়াজ আসছে। আমি বোকার মতো ওপরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যেন এসব কী হচ্ছে—আমি এর কিছুই বুঝতে পারছি না। বৃক্ষের অগ্রভাগের শাখাগুলো মুহুর্মুহু বাতাসে ভেঙে যেতে চাইছে। যেন বা আমারই ওপরে ভেঙে পড়তে চাইছে। আমার উচিৎ এখান থেকে সরে পড়া। কিন্তু আমি সরছি না। এখানে আমার আর একদণ্ড ও থাকা উচিত নয়। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আমি নড়তে পারছি না। সম্ভবত আমি দু’একবার চেষ্টাও করলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে কে বা কারা যেন আমাকে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়েও ছুটতে পারলাম না।
আসলে এটা আমার মতিভ্রম। আমি আসলে খুব স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে এক-টানা দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই এমনটা হয়েছে। আমি একা একা দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছিলাম। কিন্তু আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
আমি আসলে একজনের অপেক্ষায় আছি। খুব কাছের একজন আমাকে মধ্যরাতে কল করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে। তাই আমি দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু যার আসার কথা সে এখনো আসছে না। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়েই আছি। আমি আমার কথা রেখেছি কিন্তু সে তার কথা রাখছে না। আদৌ রাখবে কি না, সে না আসা পর্যন্ত আমি বুঝতে পারছি না। বর্তমান পৃথিবীতে এ রকম কথা না রাখার মানুষের সংখ্যা অনেক।
মেঘগুলো ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। তবু যেন আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে না। মাঝে মাঝে নিশুতি পাখিরাও ডেকে যাচ্ছে বিরামহীন। বৃক্ষের পাতারা আবারও ঝনঝন শব্দ করে বেজে উঠছে। আমি বাতাসের মধ্যে গুটিসুটি হয়ে শক্ত চোখে পাতাদের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছি। সহসা আমার মনে হলো আমার প্রয়াত স্ত্রী অর্থাৎ গত সপ্তাহে রাতের আঁধারে ব্রিজের ওপর নিয়ে ধাঁরালো অস্ত্রের আঘাতে যাকে খুন করেছি, সেই। হ্যাঁ তন্নী-ই তো। কেমন করে বসে আছে। আবার বাঁকা করে হাসছে। মনে হচ্ছে আমার অসহায়ত্ব সে দারুনভাবে উপভোগ করছে। খুব মজা পাচ্ছে। ঘন বাতাসের কারণে আমার শরীর হালকা কাঁপছে। যার ফলে এখন আমি গুটিসুটি হয়ে বসে আছি। তাই বলে কি সে হাসবে? একদিন তো সে আমার স্ত্রী ছিল। প্রতিটি কাজে আমাকে সহযোগিতা করত। আমার সামান্য ব্যথায় সে কুঁকড়ে উঠত। আমার অসুস্থতায় সে কেঁদে-কেটে একসার হতো। আমার গভীর রাতে বাড়ি ফেরা নিয়ে প্রায়শ ই সে মন খারাপ করত। না খেয়ে না খেয়ে বহু রাত ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি ভালোবাসত সে আমাকে। তবু কেন আমি তাকে খুন করেছি জানতে চান? আচ্ছা পরে বলছি।
নিজের জীবনের চেয়ে যে আমাকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসতো সে আজ আমাকে দেখে বক্র দৃষ্টিতে হাসছে। এখন আমি এটা কিভাবে সহ্য করি। আমি নির্বিকারভাবে তার হাসির দিকে তাঁকিয়ে আছি। তন্নীর হাসি দেখে আমি মোটেও বিচলিত হই না। মোটেও কষ্ট পাই না। একটু খারাপও লাগে না। কারণ, পূর্বের চেয়ে এখন আমার হৃদয় অনেক বেশি শক্ত। আরও বেশি কঠিন। আরও বেশি পাথর। কোনো স্পর্শকাতর দৃশ্যই এখন আর আমার হৃদয়কে টলাতে পারে না। মন গলাতে পারে না। আমার চোখের পানি ঝরাতে পারে না। আমার হৃদয় বুক এখন শুষ্ক মরুভূমি।
আমি খুব কঠিনভাবে তন্নীর দিকে তাঁকিয়ে আছি। কারণ, একদিন তাকেও আমি অনেক ভালোবাসতাম। যদিও সে আমার থেকে বেশি ভালোবাসতো। কিন্তু একদিন আমিও তাকে নিজে না খেয়ে খাইয়েছি। নিজে না ঘুমিয়ে রাত জেগে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি। তার চুলে বিলি কেটে দিয়েছি। নিজে পায়ে হেঁটে তাকে রিকশা করে চড়িয়েছি। তার পছন্দের আইসক্রিম চকলেট আর মিষ্টি কিনে দিয়েছি। দামি দামি জামা জুতো কিনে দিয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আমার সাথে বেঈমানি করেছে। আজ সেই তন্নী আমাকে দেখে কেমন হাসছে। ইচ্ছে করছে তার জিভ আমি আরেকবার টেনে ছিঁড়ে দেই। শয়তান কোথাকার!
তন্নীর কাছে সম্ভবত আমাকে কোনো উন্মাদ কিংবা পাগল মনে হচ্ছে। যেন আমি রাত্তিরে বাইরে তুমুল ঝড় হাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে তারা গোনার চেষ্টা করছি। তন্নী যদি এটা মনে করে থাকে, তাহলে আমি বলব সে ভুল করছে। মৃত্যুর পরও যে সে আমাকে চিনতে পারেনি আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ বড় কষ্ট হয়তো এখানেই। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যে মানুষ তার স্ত্রীকে খুন করতে পারে সে আর যাই হোক সামান্য কোনো মানুষ নয়—তন্নীর এটা বোঝা উচিত ছিল। আমাকে এখন তার অন্য রকম মানুষ ভাবাই উচিত।
অথচ—এই আমি বা আমরা কিংবা আমার বাবা, ভাইয়েরা মানুষের ক্ষেতে মজুরি খাটতে গিয়ে নানা রকম অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি। দেখেছি ওমর মস্তকের ক্ষেতে মজুরি খাটতে গিয়ে চৌকিদারদের হাতে মার খাওয়ার দৃশ্য। নদীতে মাছ ধরা নিয়ে দেওয়ান এবং মালদের সাথে হাতা-হাতি। কী একটা ঠুনকো বিষয় নিয়ে কাজিদের সাথে বাক-বিতণ্ডার কারণে আয়নাল হক আর সোহরাব ধারালো অস্ত্র নিয়ে জানে মেরে ফেলতে চেয়েছিল আমার ভাইদের। সে খবর আমি হামেদ মোল্লার কাছে দৌড়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়েছি। এতসব ঘটনা সব আমার সামনে ঘটে যাওয়া। এই সব এখন আর আমি মনে করতে চাই না। ক’দিন আগে নিজের হাতে যাকে খুন করেছি তাকেও এখন আর মনে করতে চাই না। আমি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
আমি একটি সোজা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু কে যেন সহসা আমার পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে বললো, রমিজ না?
হঠাৎ পেছন থেকে ধাক্কা খেয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভেতরে ভেতরে ভয়ও পেলাম কিছুটা। মনে মনে ভাবলাম— এত রাতে এখানে আমাকে কেউ চেনার কথা না। তাছাড়া এখানে আমার তেমন কোনো আত্মীয়ও নেই। আমি ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি আফাজ।
আফাজ আমার আপন খালাত ভাই। বছর কয়েক আগে সেন্ট মার্টিনে বেড়াতে গিয়ে যে আর মায়ের বুকে ফিরে আসেনি। বড় ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। সেই আফাজ। আমরা সবাই ধরে নিয়েছি আফাজ এখন সাগর তলে প্রাণীদের সাথে নিত্যদিন হা-ডু-ডু খেলছে। কিন্তু সেই আফাজ এখানে এলো কী করে? আমার মাথায় যেন কিছুতেই কাজ করছে না। আমি বিব্রত হয়ে আফাজের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
আফাজ বলল, কিরে, আমাকে চিনতে পারিসনি? বোকা কোথাকার। এত দ্রুত ভুলে গেলি?
আমি বোকা যেন সত্যিই চিনতে পারিনি। এমন ভাব করে আফাজকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম।
আফাজ আমাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল, কিরে, বলদের মতো কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে তোর? এত রাতে এখানে কী করিস তুই?
আফাজকে আমি সত্যি কথাটা না বলে বানিয়ে বানিয়ে একটা মিথ্যা কথা বললাম। আফাজ আমার কথার প্যাঁচ বুঝতে পারল না। বলল, চল বাসায় যাই?
কিন্তু আমার কেমন যেন সন্দেহ হলো ওর কথায়। একজন মরা মানুষ আমাকে বাসায় যাওয়ার জন্য তাড়া করছে। এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার বটে! কিন্তু আমি তো এসেছি একটা কাজে। তার জন্য আমি এখানে অপেক্ষা করছি। চলে গেলে তো আমার সেই কাজটা হবে না।
আফাজ আমাকে অনেক পীড়াপীড়ি করতে লাগল। তবু আমি তার কথায় কর্ণপাত করলাম না দেখে সে একা একাই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। আমার তখন ১২-১৩ বছরের কথা মনে পড়ে গেল।
আমরা তখন পদ্মার চরে সারাদিন একসাথে গরু চরাতাম। সমস্ত কাঁশবন দৌড়ে দৌড়ে ফড়িং ধরতাম। নাইলন সুতা দিয়ে ফাঁদ বানিয়ে ধরতাম কবুতর। গরু কিংবা ঘোড়ার লেজের চুল দিয়ে বানাতাম আরেক রকমের ফাঁদ। সেই ফাঁদ দিয়ে চড়ুঁইয়ের মতো ছোট এক ধরনের পাখি ধরতাম। মানুষের ক্ষেতের বাদাম তুলতাম। কলুইয়ের বিচি তুলতাম। আরও কত কি যে করতাম আমি আর আফাজ।
আমি মাথা থেকে আফাজের স্মৃতি পুরোপুরি ডিলেট করার আগেই মেয়েলি কণ্ঠের হাসি শোনা গেল। তখন ঝড় বইছে। আমি ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটছি। শীতে একটু একটু করে কাঁপছে শরীর। বারবার মেয়েলি কণ্ঠের হাসির শব্দে আফাজের চিন্তা আমার মাথা থেকে পুরোপুরি ডিলেট হয়ে গেল।
আমি একবার তন্নীর দিকে বাঁকা চোখে তাঁকালাম। বৃষ্টিতে ভিজে ওর লিকলিকে ফর্সা শরীর অদ্ভুদ রকমের উচ্ছ্বল আর প্রাণবন্ত লাগছে। আমি যেন আবারও স্মৃতি জাগানিয়া ব্যথায় ভারাক্রান্ত হলাম।
এমন-ই এক বৃষ্টি ভেজা রাতে তন্নী আমার বুকের ওপর শুয়ে বলেছিল, জান, বলোতো, ঠিক এই মুহূর্তে তুমি আমার কাছে কী চাও?
কী চাই মানে?
না মানে আমাদের বাবুটা ছেলে না কি মেয়ে?
আমার কোনো চাওয়া নেই।
তুমি এমন নিরামিশাসী জবাব দাও কেন?
আমি জানি তন্নীর মেয়ে পছন্দ। অন্য সবার ছেলে। আমি দু’টোতেই আছি। কিন্তু আমার মেয়ে পছন্দ বললে ও যেমন সাময়িক খুশি হবে আবার ছেলে বললে বিবর্ণ মুখও দেখতে হতে পারে!
আমাকে নিশ্চুপ দেখে তন্নী বলল, আচ্ছা যাই হোক। তুমি কার মতো চাও? তোমার না আমার?
আমি কিছু বলি না। শুধু তন্নীর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি।
তন্নী বলে, ছেলে-মেয়ে যাই হোক, তোমার চোখের ভ্রূর মতো যেন ভ্রূ আর দাঁতের পাটির মতো যেন দাঁত হয়। বাকিটা আমার মতো হলেই চলবে।
তন্নীর কথাগুলো আমার কাছে বড় বেশি আবেগী মনে হলেও এর বাস্তব ভিত্তি প্রখর। কারণ পৃথিবীর সব মেয়েই ওর মতো স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন রচনা করতে ভালোবাসে মেয়েরা।
বৃষ্টির গতি আগের চেয়ে কিছুটা বেশি। আমার আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যেতেও ইচ্ছে করছে না। তন্নী যেন আবারও হাসছে। ওর হাসিটাকে আমার কাছে বোকা বোকা লাগছে। কারণ, বোকারাই একমাত্র কারণ ছাড়া হাসে। তন্নীকে খুব সুন্দর লাগছে আজ। সবুজ রঙের শাড়ি আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। কানে ঝালরঅলা লম্বা দুল। যদ্দুর মনে পড়ে দুলগুলো আমি ওকে নিউ মার্কেট থেকে কিনে দিয়েছিলাম। তন্নী আগে ঠোঁটে খুব একটা লিপস্টিক দিত না। লজ্জবোধ করত। তবে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে সে আমাকে সারপ্রাইজ দিত। এই মুহূর্তে ওকে খুব করে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু যে জীবন থেকে তাকে সরিয়ে দিয়েছি সেই জীবনের আঙিনায় কী করেই বা প্রস্থান সম্ভব?
আজ কোনো বিশেষ দিন কি না আমার মনে পড়ে না। হাঁটতে হাঁটতে আমি মনে করার চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু শরীর এত হিম হয়েছে যে কিছু মনে করতে পারছি না। শরীর আমার থরথর করে কাঁপছে। যে আমাকে এখানে আসতে বলেছিল মনে মনে তাকে অভিসম্পাত দিচ্ছি। এই নিশিথ অন্ধকার রাতের বেলা ঝড় বাদলের মধ্যে আমাকে ডেকে এনে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানেই হতে পারে না। আমি নিশ্চই তার কাছে এমন কোনো অপরাধ করিনি যে এ জন্য সে আমাকে এমন ভাবে কষ্ট দেবে।
সহসা পেছন থেকে কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, কিরে, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কী ভাবছিস?
আমি বুকের ওপর থুতু ছিটিয়ে পেছন ফিরে দেখি আফাজ। কিরে, তুই না চলে গেলি?
একা একা ভালো লাগছিল না তাই আবার তোর কাছে চলে এলাম।
আফাজের কথা আমার কাছে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। রাগের চোটে ওকে থাপ্পড় মারতে গেলে ও সহসা সরে যায়। ঝাঁঝালো গলায় বললাম, ফাজলামি করিস? তুই এত রাতে বাড়ি থেকে একা একা বের হয়ে আসলি আর কেউ তোকে কিছু বলল না? মনে হয় বাড়িতে বুঝি কেউ নেই?
আফাজ আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিল। তারপর সহসা হাসি থামিয়ে বলল, বিশ্বাস করছিস না? আয় দেখে যা আমার সাথে।
আমি দেখলাম, আফাজ আমাকে টেনে টেনে খালের মধ্যে পানির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কিছুতেই যেন ওর শক্তির সাথে পারছিলাম না। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বললাম, তুই আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
আফাজ বলল, কেন তুই না দেখতে চাইলি বাড়িতে কেউ আছে কি না?
কিন্তু বাড়ি তো এদিকে। তুই আমাকে জলের দিকে নিয়ে যাচ্ছিস কেন?
আমার কথায় আফাজ আবারও একগাল হেসে বলল, তুই পাগল হয়ে গেছিস। তাই তোকে জল খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি অনেক কষ্টে প্যান্টের পকেট থেকে গ্যাস লাইটটা বের করে আগুন জ্বালাতেই আফাজ জলের ভেতর লাফিয়ে পড়ল। পেছনে তাকিয়ে দেখি তন্নীও নেই। আমি জলের সামনে দাঁড়িয়ে আফাজ আফাজ বলে ডাকতে লাগলাম।