অবসর সময়গুলো যাপন সবসময় তার কাছে সমস্যার, যদিও কিছুই তার করার থাকে না অধিকাংশ সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সকাল-সন্ধ্যায় দুটো টিউশনির পর অফুরন্ত সময়, স্রোতের মতো একঘেঁয়ে তাল-লয়হীন। এক্ষণ, এ মুহূর্তে সময় হত্যার অপবাদ ঘোচানোতে ব্যাপৃত সে, অপেক্ষা করছে একটি মেয়ের জন্যে এবং ভাবছে কর্মকারকের সংজ্ঞা মতো সম্পাদিত হচ্ছে একটি ক্রিয়া। তার ভাবনার অনুকূলে খুব কম সময় ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়। আজ যখন দিবানিদ্রা ভেঙে দেখে ঘুমটা তার ইচ্ছে মতো ঘড়ির কাঁটা মানেনি, তখনই বুঝতে পেরেছিল যথাসময় থেকে একটু দেরি হয়ে যাবে পৌঁছতে; পর্ণাকে কিভাবে ম্যানেজ করবে ভাবতে ভাবতে অতিদ্রুত সেভ করায় এখন থুঁতনির নিচে হাতের স্পর্শে দাঁড়ির ছোঁয়া অনুভূত হচ্ছে। পর্ণার পছন্দের তার স্কাইলেট রঙের শার্টটি পরেছে আজ এবং জিনসের প্যান্ট, বহু ব্যবহারে জীর্ণ কেডগুলো পরতে অস্বস্ত লাগছে ভীষণ। বাসা থেকে বেরিয়ে দরদাম না করেই একটা রিকশায় চড়ে বসেছে, পারত যে কাজটি সে করে না। পর্ণার সামনে সিগারেট খাওয়া যাবে না বলে রিকশা দাঁড় করিয়ে সিগারেট কিনে ধরিয়েছে একটা এবং ভেবেছে রিকশা থেকে নেমে বলবে, স্যরি, তুমি আজ হারিয়ে দিলে আমাকে।
এখন এই সোহাগী রোদ্দুরে বেলী ফুলের ওপর প্রজাপতির ওড়াওড়ি দেখে দেখে পর্ণার কথাই ভাবছে। পর্ণার চারিত্র্যিক ঐতিহ্য দেরি করা, দেরি করে আসা। সে জানে, ভালো করেই জানে, তার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তানজিন। তবু সে দেরি করে। অপেক্ষার শুরু এবং শেষ হয়ে যাওয়ার মাঝখানের সময়গুলোয় তানজিনের ভীষণ বিরক্তিকর এবং ওজনবাহী মনে হয়। ভেবেছিল রিকশা থেকে নেমেই দেখবে পর্ণা ঠোঁট কামড়াচ্ছে বিরক্তি চেপে। তার ইচ্ছের মতো ঘটনাটা ঘটে না যাওয়ায় বিরক্ত হচ্ছে কিন্তু স্থির করতে পারছে না পর্ণার ওপর না নিজের ওপরই। সময়টাকে উপভোগ্য করার প্রয়াস চালায় সে, ফুলের ওপর প্রজাপতির ওড়াওড়িতে মুগ্ধতা তৈরি করতে চায়, গ্লিডিয়া, দোপাট্টা, মোচন্ডা, স্বর্ণকোটি, জিনিয়া,হাস্নুহেনা, গন্ধরাজ, সূর্যমুখী, গোলাপ আরও সব নাম না জানা ফুল। প্রতিটি ফুলের সঙ্গে সে পর্ণাকে উপমায়িত করতে চায়, পর্ণা এক একটি ফুল-ফুলের সমগ্রতা। পর্ণা কেমন সুন্দর অনেকবার ভেবেছে সে, সাদামাটা ধরনের ঘরোয়া, চোখগুলো যে তার অতিসুন্দর তাতে তানজিন নিঃসংশয়। কিন্তু মিশতে মিশতে একসময় তার মনে হলো পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্যের প্রতিভূ পর্ণা—যা কিছু তার ভালোলাগা, পাহাড়-নদী-সমুদ্র সবকিছু পর্ণার সমান্তরাল। ফলত, সে সিন্ধান্তে আসে সৌন্দর্য একটি নির্মাণ প্রকল্প, অনুভবের, আবিষ্কারের। পর্ণাকে সে সুন্দর ভেবেছে বলে পর্ণা সুন্দর। অবশ্য তার ভাবনার অনুকূলে ক্রিয়াশীল ছিল পর্ণার মননশীলতা। সে ভাবে পর্ণা সুন্দর, কবিতার মতো, কবিতার আলো ছায়ার রহস্যের মতো, বোধের অন্তর্লীনে কার্যকর এক অনুভূতির মতো।
অপেক্ষার অস্থিরতা ধীরে ধীরে কমে এলে ফুল আর প্রজাপতির সৌন্দর্যে মুগ্ধতায় আক্রান্ত হয়, যেমন সে চেয়েছিল। রঙ আর ফুল দেখে, যদিও সব রঙের নাম তার জানা নেই, সব ফুল চেনা নেই। খুব ছোটবেলায় তার বাড়ির উঠোনে সুন্দর একটা বাগান করতে চেয়েছিল। তার হাতে রোয়া কোন ফুলের চারা বাঁচেনি। বালকবেলার না হওয়া সেই বাগানটার কথা ভাবতে গিয়ে বুকের ঠিক মাঝখানটায় এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভূত হয়—এ যন্ত্রণার কী নাম হতে পারে, সে জানে না। পর্ণার সঙ্গে পরিচয়ের কিছুদিন পরে প্রথম এ যন্ত্রণাটা টের পেয়েছিল ভালোবাসা নামক এক যুক্তিহীনতার অধীনতায়। অথচ বৃষ্টির এক দুপুরে সে স্থির করেছিল পর্ণার সঙ্গে কথা বলবে না কখনো। পর্ণার অসামাজিকায় সে বিব্রত হয়েছিলে সেদিন। তখনো তানজিন মেয়েটার নাম জানত না। একই ক্লাসে পড়ার সূত্রে মুখচেনা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে সেই দুপুরে রেলস্টেশনে আটকা পড়েছিল ওরা। পর্ণা দাঁড়িয়েছিল একা, একাকি ছিল তানজিনও। পরিচিতের হাসি হেসে সে যখন পর্ণার পাশে দাঁড়ালো, বৃষ্টি উপেক্ষা করে পর্ণা একটা রিকশায় চড়ে বসেছিল।
এই সমস্ত টুকরো ঘটনা সেলুলয়েডের মতো চোখের সামনে ভাসতে থাকলে নির্ভাবনার শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। প্রজাপতি আর ফড়িঙ ধরার দিন—অবিমিশ্র ভালো লাগার দিন। দুরন্ত কৈশোর ছিল তার। সাঁতরে পার হয়ে যাওয়ার ভালোলাগা, ভালোবাসার এক নদী ছিল। শৈশব-কৈশোরের ভাবনাও তাকে আবার পর্ণাতে ফিরে আনে। কখনো কখনো পর্ণা তাকে বলে, অমন ছেলেমি করো কেন? কেমন বাচ্চাদের মতো কথা বল তুমি। এ সমস্ত টুকরো টুকরো সংলাপ তাকে বিচলিত করতে করতে পর্ণার সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী, এ রকম ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। একবার সমুদ্র-পাড়ে বেড়াতে গিয়ে তার মনে হয়েছিল এ সমুদ্রে একাকি নামা যায় না। এই অনুভূতি তাকে তাড়িত করেছিল পর্ণাকে কিছু বলতে। পর্ণাকে সে বলেছে, কী বলেছিল এখন আর মনে নেই। তবে তার মনে হয়েছিল একদিন হয়ত এমন হবে, সে ভাববে, যাকে চাইবার ছিল তাকে পেলাম না, যাকে চাইবার ছিল তার কাছে না বলা থেকে গেল আমার চাওয়া। পর্ণাকে সে চেয়েছে প্রবলভাবে, তার চাওয়ার প্রবলতায় ভেঙে গেছে পর্ণার নিজস্ব অবরোধ, জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ যেন। তবু পর্ণা অবরোধ তৈরি করে। রক্তাক্ত হয় তানজিন। সে পিছিয়ে আসতে চায় এবং মনের টানাপড়েন শেষ করতে না পেরে বলে ভাসিয়ে দিলাম নিজেকে, পর্ণা যেখানে নিয়ে যাও তুমি। ভাবনারা মাথায় ঘুরতে থাকলে রক্তক্ষরণের প্রাবল্য দেখা দেয় বুকের ভেতর।
__________________________________________________________________________________
পর্ণা অসুস্থ একথা সে ভাবতেও পারছে না অথচ এমন ভাবতেই ইচ্ছে করছে তার। আসলে পর্ণা তানজিনের কোনো অপেক্ষাই রাখতে চায়নি তার জন্যে। সব অপেক্ষার অবসান করেছে কি না পর্ণা, ভাবতে ভাবতে পশ্চিমে হেলেপড়া সূর্যমুখী ফুলগুলোর দিকে তাকায়। রোদ-বৃষ্টি মাখামাখি করে ঝরছে এখন। হঠাৎ তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সুদর্শন যুবকের পাশের মেয়েটিকে মনে হয় পর্ণা, আশে-পাশে আরও অনেক পর্ণাকে আবিষ্কার করে সে এগিয়ে আসা হুটতোলা রিকশায় বসা মেয়েটিকেও তার মনে হয় পর্ণা।
__________________________________________________________________________________
তার সচেতন মন পর্ণাকে যত এড়িয়ে আসতে চেয়েছে অবচেতন মন তত সমর্পিত হয়েছে। পর্ণা তার কাছে এলে অদ্ভুত এক গন্ধ পায় সে। এ গন্ধ পর্ণার গায়ের না তার নিজস্ব আবিষ্কার বোঝে না। মাঝেমাঝে ভীষণ ইচ্ছে করে পর্ণাকে জড়িয়ে ধরতে। তার শরীরের ডালপালা উন্মোচিত করতে। পারে না পর্ণার নিরাপত্তার জন্য। সুন্দর এ বিকালে সে তার যাপিত সময়গুলোকে নেড়ে-চেড়ে দেখল, একদিনও তাকে ভালোলাগা, ভালোবাসার কোনো কথা বলেনি। একদিনও বলেনি তোমাকে না দেখতে হয় আমার, এসো কিন্তু। সে নিজেই সব সময় পর্ণাকে আসতে বলেছে, বলেছে অপেক্ষার সময়গুলো যেন দীর্ঘতর না হয়। পর্ণা এসেছে তবে কোনোদিনই সময়ের পরে ছাড়া নয়। তার সঙ্গে থেকেছে, তার কথা শুনেছে কিন্তু ঝর্ণার মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেনি কখনো। সে ভেবেছে পর্ণা এমনই, পর্ণার সহজাত প্রবণতাগুলো নিয়েই সে তার ভালোলাগা ভালোবাসা। কিন্তু আজ এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর হঠাৎ তার মনে হলো, পর্ণা তাকে ভালোবাসে না, শুধু তার ভালোবাসার দায় বহন করে।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করলে পার্কের গেট ছেড়ে একটা বড়গাছের নিচে দাঁড়ায় সে। পর্ণার না আসাটা নিশ্চিত হলো বৃষ্টিতে। প্রকৃতির এই অনাকাঙ্ক্ষিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় রাগ করে সে, বর্ষার ওপর বৃষ্টির ওপর। শৈশব-কৈশোরের ভীষণ ভালো লাগার দিন ছিল বর্ষা। বৃষ্টির দিনে বর্ষার জলে ছোটাছুটিতে কি আনন্দ ছিল তার, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ মধুর এক আমেজ তৈরি করত মনে; নিয়ে যেত ঘুমপুরীতে। ঘুমুতে ঘুমুতে হারিয়ে যেত অজানা স্বপ্নের এক দেশে। এখন আবার সেই দেশে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। পর্ণা তার কোনো স্বপ্নের সাথী হবে না। পর্ণা কি শুধু তার জন্যে অবরোধ তৈরি করে, না নিজেও অবরুদ্ধ নিজস্ব মনোজটিলতায়?
গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টির জল মাথায় পড়তে থাকলে রুমাল দিয়ে মাথা ঢাকে তানজিন। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে উড়ছে প্রজাপতিরা। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে প্রজাপতিরা কোথায় যাবে তার জানতে ইচ্ছে করে। ঘড়ি দেখে সে, পর্ণার জন্যে অপেক্ষা করছে দুঘণ্টা ধরে। একবার ভাবে চলে যাবে। যাবে কি যাবে না—এমন দ্বন্দ্বের শেষ করতে না পেরে ক্লান্তিতে গাছের গুঁড়িতে বসে পড়ে। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে ঘড়ির দিকে, পাগলা ঘোড়ার মতো প্রতিটি সেকেন্ড তার মাথার বনেটে হাজার বজ্রপাতের মতো শব্দ করতে থাকে। পর্ণা অসুস্থ একথা সে ভাবতেও পারছে না অথচ এমন ভাবতেই ইচ্ছে করছে তার। আসলে পর্ণা তানজিনের কোনো অপেক্ষাই রাখতে চায়নি তার জন্যে। সব অপেক্ষার অবসান করেছে কি না পর্ণা, ভাবতে ভাবতে পশ্চিমে হেলেপড়া সূর্যমুখী ফুলগুলোর দিকে তাকায়। রোদ-বৃষ্টি মাখামাখি করে ঝরছে এখন। হঠাৎ তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সুদর্শন যুবকের পাশের মেয়েটিকে মনে হয় পর্ণা, আশে-পাশে আরও অনেক পর্ণাকে আবিষ্কার করে সে এগিয়ে আসা হুটতোলা রিকশায় বসা মেয়েটিকেও তার মনে হয় পর্ণা।