পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের সঙ্গে নিবারণ মাঝির দেশত্যাগের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা কে বলবে সেই কথা! সে ছিল বিরাট এক রাজনৈতিক ঘটনা। দেশের রাজাকে রাতের অন্ধকারে সপরিবারে হত্যা করা বলে তো শুধু নয়, সেই হত্যাকান্ডের সঙ্গে সঙ্গে লাখো প্রাণের মূল্যে স্বাধীন এই দেশটার গতিমুখ পাল্টে দেবার যে আয়োজন তাকে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন বলে মানতেই হয়। এত বড় রাজনীতির কী বোঝে নিবারণ মাঝি? এ তল্লাটের কেউ কখনো নিবারণ মাঝি কিংবা তার সাতপুরুষের কাউকে কোনো প্রকার রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে দেখেছে? ভৈরব তীরবর্তী এই সীমান্তঘেঁসা গ্রাম ভাতখোলায় তারা বাস করছে বংশপরম্পরায় বছরের পর বছর। এর মধ্যে ভারত ভেঙে ভাগ হলো, সেই ভাগেও শান্তি নেই স্বস্তি নেই, একাত্তরে আবার ভাগাভাগি, কত রক্ত কত প্রাণক্ষয়, কত মানুষের এপার ওপার ওলোটপালোট হলো ; নিবারণ মাঝির তাতে কী আসে যায়! তার হিসেব নিকেশ খুব সহজ সরল, অন্তর্গত বিশ্বসের গভীর থেকেই সে চিরদিন অকপটে উচ্চারণ করে এসেছে — শেকড় উপড়ালে গাছ বাঁচে! মাথা খারাপ! জন্মমাটি ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
তর্ক করার জন্য নয়, তার সমবয়সী দু’একজন ইচ্ছে করে চিমটি কেটে দেখেছে, মুখ ভেঙচিয়ে বলেছে,
কেন একাত্তরে তুমি যাওনি ওপারে?
প্রাণ বাঁচানোর জন্যি কে যায়নি বলো, হিন্দু মুসলমান সবাই গিয়িচে।
তা বটে। বর্বর পাকিস্তানি আর্মি এ গ্রামে দু’ দু’বার হামলা চালিয়েছে একেবারে গোড়ার দিকেই। হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামের অনেকে প্রথম ধাক্কাতেই বর্ডার টপকে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। নিবারণ মাঝি সে-দফা ভৈরবপারের পুটুশকাঁটার জঙ্গলের মধ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে মাথা গুঁজে নিজেকে রক্ষা করেছে, কিন্তু পরের দফায় আর্মির সঙ্গে রাজাকারেরা এসে সারা গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, ইচ্ছে মতো লুটপাট করে, তিনজন গৃহবধুকে ধরে নিয়ে যায় আর্মিক্যাম্পে ; সত্যিকারের কথায় সেইবার একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়ে ভাতখোলা গ্রাম। নিবারণ মাঝির গোঁয়ার্তুমি আর কতক্ষণ! তাকেও চোখের জলে ছাড়তে হয় জন্মমাটি। শুধু মাটি নয়, চূড়ান্ত দুর্যোগময় সেই দুঃসময়ে নিজের আত্মজা পারুলকেও ছেড়ে যেতে হয় সেদিনের চিতাপ্রান্তরে। না, ঠিক সেদিন নয়, তার আগের দিন আগের দিন সন্ধ্যায় পঙ্খিরাজে চেপে আসে দেবদূতেরা, চিলের চেয়ে দ্রুত ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় পারুলচম্পাকে। একমাত্র মেয়েকে এই রকম যমকনামেই ডাকে বাবা। কিন্তু থাক সে প্রসঙ্গ, নিবারণ মাঝি নিজেকে সম্বরণ করে অবলীলায় জানায়, স্বাধীন হবার পরে তো একদিনও দাঁড়াইনি ওপারে, দৌড়িয়ি চইলি এয়িচি এই মাটির টানে।
শৈশব থেকে এই বংশধারার সবাই সেই ঠাকুরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে শেখে।
সে তো আমরা জানি দাদা। শুধু মাটির টান হবে কেন, তুমার মেয়ির টানের কতাও সবাই জানে। তুমি সিডা ঢাকলি কি হবে!
নিবারণ মাঝি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকে অপলক। তারপর চোখের পাতা নামিয়ে আনে, বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে, কোনো রকমে উচ্চারণ করে,
মেয়ি আর মাটি একই কতারে ভাই, একবার হাত ফসকালিই মুশকিল।
একজন দেঁতো হাসি ছড়িয়ে রক্ত ঝরানো মন্তব্য করে,
সবই হয়ি যায় শত্রুসম্পত্তি, মানে ইনিমি প্রপার্টি।
প্রকৃতপক্ষে জমিজায়গা নিয়ে এই সব হাঙ্গামার ভয়ে হাতখোলার হিন্দুদের বেশ কযেকজন স্বাধীনতার পরও দেশে ফেরেনি, ওপারেই থেকে গেছে কষ্টেসৃষ্টে। আবার দেশে ফেরার পরও অনেকে নিজের ভিটেমাটির স্বত্ব আগলে রাখতে পারেনি, একটু আগে হোক বা পরে হোক সমূলে উৎখাত হতেই হয়েছে। এনিমি প্রপার্টির দিকে তাকায়নি নিবারণ মাঝি, শেকড় আঁকড়ে পড়ে থাকতে চেয়েছে। ঠাকুরডোবার মাঠের পাঁচ বিঘের দাগ বাপ ঠাকুর্দার আমল থেকে নির্বিবাদে বুকের ফসল উজাড় করে দিয়ে আসছে, স্বাধীন দেশে সেই জমি হয়ে গেল শত্রসম্পত্তি। নিবারণ মাঝি প্রথমে বুঝতে চেষ্টা করে শত্রুসম্পত্তি কাকে বলে, স্বল্প বুদ্ধির কারণে সে বুঝতেই পারে না—সাতপুরুষেরসম্পত্তি কেমন করে আইনি মারপ্যাঁচে পড়ে শত্রুসম্পত্তি হয়ে যায়। যে-ব্যাখ্যা সে নিজেই বোঝে না, দুর্বোধ্য সেই তথ্য আর কাকে বুঝাবে! সুবল-সুদাম বাবার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে,বিষয়বিরাগী নিবারণ মাঝি ছেলেদের সান্ত্বনা দেয়– জমিজাগা চিরকাল মুঠোয় থাকে না বাবা, তুমরা কাজ কইরি খাও, অন্য পেশা দ্যাখ।
বাবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে দুই ভাই। কোন পেশায় যাওয়া যায় তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে। গভীর আস্থার সাথে বাবা আস্বস্ত করে, ভাবনার কিছু নাই। ভাতের অভাব কুনুদিন হবে না তুমাগের।
সুবল ফিক করে হেসে ওঠে, বাবার মুখের ওপর সে বলে, কাজ না করলি তুমার দেবী আমাগের কি খেতি দেবে?
নিবারণ মাঝি প্রতিবাদ করে, আমার দেবী বুলচিস ক্যানে, এ্যাঁ! কত দিন বুইলিচি– মা অন্নদা সবারই মঙ্গল চায়। অন্নদা হচ্ছে সব্বার দেবী।
এবার সুদামও হাসে দাঁত বের করে। নিবারণ মাঝি তবু রাগ করে না। পরম ধৈর্যের সঙ্গে বুঝাতে চেষ্টা করে,
দেবীর নামে হাসাহাসি ভালো না বাবা। ভক্তিতে মিলায় বস্তু। সবই হচ্ছে মা- অন্নদার কৃপা।
সুদাম একটুখানি এগিয়ে এসে সরেশ ভঙ্গিতে বলে, মা-অন্নদা যদি আমাগের এই ভৈরবে আবার জোয়ার-ভাটা এইনি দিতু তাহলি আমরা দু’ভাই আবার খেয়াঘাটের পাটনি হতাম!
ছোটভাইয়ের মুখে অভিনব প্রস্তাব শুনে বড্ড আনন্দ পায় সুবল। খিক খিক করে হেসে সে যোগ করে,
অন্নদা দেবী এইসি আমাগের নৌকায় উঠতু, তাই না বাবা?
নিবারণ মাঝি এতক্ষণে ভেতরে ভেতরে রেগে ওঠে। কিন্তু সেই রাগের প্রকাশ সোজাসুজি না ঘটিয়ে সে মন খারাপ করে মুখ ঘুরিয়ে বসে। মন খারাপ হবারই কথা। অন্নদা দেবীর দৈব ক্ষমতা এবং মহার্ঘ্য আশির্বাদের কথা তাহলে তার সন্তানেরা বিশ্বাসই করে না! বরং তাদের একমাত্র বোন পারুলের অন্তর্ধান রহস্যের সঙ্গে অন্নদা-মাহাত্ম্যের যোগ ঘটিয়ে তারা নির্মম কটাক্ষ করে বাবাকে— মুসলমানের ঘরে গিয়িচে তাতে কী, আমাগের পারুল দেখো একদিন অন্নদা দেবী হয়ি ফিরি আসবে, হ্যাঁ।
কটাক্ষের হলাহলে নিবারণ মাঝির অন্তর জর্জরিত হয়, দু’চোখ বেয়ে নিরবে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু শক্তভাবে প্রতিবাদ করতে পারে না। সেই সুযোগে দুই ভাই আরো স্হূল রসিকতায় মেতে ওঠে। সুদাম জানতে চায়– দেবীর বাহন কী হবে, জানো দাদা, কীসে চইড়ি আসবে দেবী?
সুবল জবাব দেয়,
ভৈরবে জলও নেই, ঈশ্বর পাটনির নৌকাও নেই ; তাহলি আসবে কেমুন কইরি!
সুদাম হা হা করে হাসে,
দেবীর কি আর বাহনের অভাব হয়? অশ্ব কিংবা গজে চড়েও আসতি পারে।
সুবল যোগ করে,
দেবীর ইচ্ছের কতা কি বুলা যায়! আকাশের মেঘে ভেসেও আসতি পারে।
দাদার কথাটা সুদামের খুব ভালো লেগে যায়। আজকাল নানান রঙঢঙের নামীদামি মোটরসাইকেলের চল হয়েছে। কী যে গোঁয়ার্তুমি আর তর্জনগর্জন করে ঘাড় ফুলিয়ে বেড়ায়! দেবীর বাহন হিসেবে এ- কালেলের কথা বলতে গিয়েও সুদাম থেমে যায়, মেঘে ভেসে দেবীর আগমন সম্ভাবনার ব্যাপারটাই শুনতে ভালো লাগে। মেঘের রাজ্যে পরীদের ওড়াউড়ির কত গল্পই না ঠাকমার মুখে শুনেছে ছোট বেলায়। পরীর জায়গায় বর্তমানে অন্নদা দেবীর বাহন হবে মেঘ, এ আর আশ্চর্য কী! ভারতচন্দ্র কি এই দৃশ্য দেখতে আসবে মধ্যযুগের ওপার থেকে?
অন্নদা দেবীর মর্ত্যে আগমন সংক্রান্ত কেচ্ছাটি দূর শৈশবে সুবল সুদাম প্রথমে শুনেছিল ঠাকুরমার কাছে। তখন পারুলও ছিল এই বাড়িতেই।জোছনা রাতে এই উঠোনের বাতাবিনেবু গাছের তলায় বসে শোনা গল্প। ভূতের কিংবা পরীর গল্প অনেক শুনেছে, কিন্তু অন্নদা দেবীর গল্প একেবারে ভিন্ন মাত্রার গল্প। এ গল্প অবশ্য নতুন কিছু নয়,বহুকাল থেকে ঠাকুরমায়েরা বংশপরম্পরায় বলে আসছে অন্নদা মঙ্গলের গল্প। সুবল-সুদাম শুনেছে, তাদের বাবা নিবারণ মাঝি শুনেছে, তার বাবা নারায়ণ মাঝি শুনেছে, তার বাবা হরিপদ মাঝি শুনেছে ;এভাবেই চলে যায় ভৈরবপারের কোনো এক ঈশ্বর পাটনি পর্যন্ত। কেবলমাত্র ঈশ্বর পাটনি ছাড়া বলতে গেলে সবাই এই বংশগরিমার কেচ্ছা শুনেছে আপন আপন ঠাকুরমার কাছে। প্রয়াত ঈশ্বর পাটনিই এ কেচ্ছার মূল কথক। ঠাকুরমায়েরা যখন এই আদ্যিকালের কেচ্ছাটি নাতিপুতির সামনে উপস্থাপন করে, তখন তারা কিছুতেই মূল কথকের নাম উচ্চারণ করে না, তখন শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমে তাদের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে এবং নমিত হয় ; ইঙ্গিতে ঈশ্বর পাটনিকে বুঝাবার জন্যে কপালে হাত ঠেকিয়ে ‘ ‘ঠাকুর’ বলে সম্মোধন করে।
শৈশব থেকে এই বংশধারার সবাই সেই ঠাকুরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে শেখে। ঈশ্বর পাটনির বংশধর বলে মনে মনে খানিক অহংকারও বোধ করে। এতদিনে এই সুবল-সুদামের কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের ঢেউ উছলে উঠতে দেখে নিবারণ মাঝি একান্ত নিভৃতে ভয়ানক কষ্ট পায়। চোখের সামনে সেই প্রমত্তা ভৈরব নেই এবং ঈশ্বর পাটনির খেয়াপারের নৌকা নেই বলে কি সব মিথ্যে হয়ে যাবে! দয়াময়ী মা-অন্নদার দেওয়া বর মিথ্যে হয়ে যাবে! দিনে দিনে মনুষ্য সন্তানের সংখ্যা এত যে বেড়েই চলেছে, অন্নদার কৃপায় খেয়েপরে তো বেঁচেবর্তে আছে সবাই, এ তো এক রকম দুধেভাতে থাকাই বটে। সেটা অস্বীকার করলে খুব অকৃতজ্ঞতা হবে। এত বড় যুদ্ধ হলো দেশে, লাখো মানুষের প্রাণ গেল, কী ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হলো ; অতি বড় দুর্যোগেও শক্ত হাতে হাল ধরেছে ঈশ্বর পাটনি, দেবী তাকে বর না দিয়ে পারে!
এরপর নিবারণ মাঝি কোথায় যায় কোন ঠিকানায়, সে কথা কেউ বলতে পারে না। বাইরে যাওয়া নিষেধ, এ কথা জেনেও সে আর ঘরে ফেরে না।
প্রবল দুর্যোগপূর্ণ রাতে জাগ্রত ভৈরব নির্বিঘ্নে পাড়ি দিয়েছে ঈশ্বর পাটনি। দবী অন্নদা খুব খুশি। মর্ত্যভূমিতে পা দেয়া তার সার্থক। খেয়াঘাটের পাটনকেও সে খুশি করতে চায়, প্রাণ খুলে বর দিতে চায়– কী চাও পাটনি তুমি কোন বর চাও? নির্ভয়ে বলো তুমি কী আছে চাওয়ার?
হা ঈশ্বর পাটনি পাটনি! কত সাধারণ তার চাওয়া। স্বয়ং অন্নদা দেবীর পূর্ণ আশ্বাসের পরও সে প্রার্থনা করে অতিশয় দীনতার সঙ্গে —
প্রণমিয়া পাটুনী কহিছে জোড়হাতে
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
ঈশ্বর পাটনির সেদিনের প্রার্থনা কিন্তু মোটেই অপূর্ণ থাকেনি। বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে জেগে ওঠা অপার সম্ভাবনাময় শস্য শ্যামলা এই ব-দ্বীপের মানুষ ‘দুধে- ভাতে’ থাকার আস্বাদ পেয়েছে। সেই দুধে-ভাতে ভাগ বসাতে বিদেশি বেড়াল এসেছে বারবার। কী যে হিংস্র আর নিষ্ঠুর তাদের থাবা! কী যে ভয়ানক তাদের শোষণ আর অত্যাচার নির্যাতন! নিবারণ মাঝির প্রবল বিশ্বাস- ঈশ্বর পাটনির নির্ঘাৎ পুনর্জন্ম ঘটেছে, নইলে তার সন্তানদের রক্ষা করবে কে! বিদেশি বেড়ালদের হঠাৎ হঠাবার জন্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করবে কে! কার ডাকে এত মানুষ প্রাণবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়বে স্বাধীনতা যুদ্ধে!
এই স্বাধীন দেশে নিজেকে ঈশ্বর পাটনির অধস্তন সন্তান ভেবে বড্ড গৌরব অনুভব করে নিবারণ মাঝি।সুবল-সুদামের বুকের মধ্যে কতদিন এই গৌরবের বারুদ ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছে ! কতদিন বুঝিয়ে বলেছে– বাঁচতে হলে বুকে বল থাকা চাই, ঈশ্বর পাটনি শুধু তো নৌকার মাঝি নয়, আমাদের সবার বুকের বল। সুবল-সুদাম বাবার এ সব কথার মাথামুণ্ডু বোঝে কিনা সেটাও স্পষ্ট বুঝা যায় না।
অথচ সেদিন শ্রাবণের নিরাক পড়া সকালবেলা কোত্থেকে কী আবোল- তাবোল শুনে এসে খোলাংকুচি ভাঙার মতো করে নিবারণ মাঝির ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। প্রতিদিন তার ঘুম ভাঙতে এমন দেরি হয় না। সেদিন ভোরবেলা কী যে এক স্বপ্ন দু’চোখের পাতায় এঁটে বসে থাকে,ঘুম থেকে জেগে উঠতে বড্ড দেরি হয়ে যায়। কলতলায় ধোয়ামাজা টলটলে কাঁসার থালা সুবলের মায়ের হাত থেকে উঠোনে পড়ে ঝনঝনাৎ করে বেজে ওঠে। তারই মধ্যে ভয়-তড়াশে কাঁপতে কাঁপতে ভয়াবহ দুঃসংবাদটি শোনায় — ঈশ্বর পাটনি আর নেই বাবা, সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে।
ধসমস করে উঠে বসে নিবারণ মাঝি। মাথার ভেতরে শোঁ শোঁ করে শব্দ হয়, দিনের আলোতেও দুচোখ আঁধার হয়ে আসে। সুবল কি শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ করেছে, নাকি বঙ্গবন্ধু বলে উল্লেখ করেছে, তালগোল পাকিয়ে যায় নিবারণ মাঝির ; তার কানের পর্দায় বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়, ঈশ্বর পাটনি আর নেই।
সত্যিই নেই তাহলে!
নেই যদি তবে আর কার কণ্ঠে মন্দ্রিত হবে অমর সেই প্রার্থনা, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে!
বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে আসে নিবারণ মাঝি। ভাতখোলা তখনো অজ পাড়াগাঁ বই তো নয়! পশ্চিমে ভৈরবের ওপারে ঝাঁঝাঁর মাঠ পেরোলেই ভারত। ভারতীয়দের দেখাদেখি এই ভাতখোলাতে বর্ডারপাড়ায় তেরাস্তার মোড়ে মুনতাজের চায়ের দোকানে অনেকেই চা খায় মাচায় বসে, সন্তোষ রেডিও থেকে গমগমে শব্দে খবর শোনে। মুনতাজের সেই চায়ের দোকানেরও অর্ধেক ঝাঁপ বন্ধ, কিন্তু রেডিও ঠিকই বেজে চলেছে। ইসলামী সংগীতের ফাঁকে ফাঁকে জনৈক মেজরের অভব্য কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে বিশেষ ঘোষণা, ‘স্বৈরাচারী মুজিব সরকারের পতন হয়েছে।’
ত্রস্ত পায়ে সাইকেল ঠেলে কে যেন সামনে এগিয়ে যায়। কাদাপাঁকের রাস্তায় ব্রেক কষে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে গিয়ে অঘটন ঘটে। হাত ফসকে সাইকেল চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মোতালেব মেম্বার উঠে দাঁড়িয়ে পরনের লুঙ্গি ঠিক করতে করতে জানতে চায়, অ কাকা, এ সুমায় তুমি যাও কুতায়?
নিবারণ মাঝি চোখ পিটপিট করে তাকায়, সাইকেল আরোহীকে চিনতে পারে। চিনতে পারে বলেই দু’পা এগিয়ে এসে বলে,
কুতায় যাই বোলো দিনি বাপ মোতালেব!
বাড়ি যাও কাকা। সারাদেশে কারফিউ জারি হয়িচে। বাইরে যাওয়া যাবে না। বাড়ি যাও।
রাস্তা থেকে সাইকেল তুলে নিয়ে মোতালেব মেম্বার সোজা চলে যায় দক্ষিণে। কিন্তু এরপর নিবারণ মাঝি কোথায় যায় কোন ঠিকানায়, সে কথা কেউ বলতে পারে না। বাইরে যাওয়া নিষেধ, এ কথা জেনেও সে আর ঘরে ফেরে না।