মা বলছে, ‘ভাঙা ঘরে আর কত থাকমু? জীবনডা শ্যাষ কইরা দিলাম কষ্ট করতে করতে। তোর বাপে তো কিছুই করতে পারল না। তুই এবার কিছু কর।’ নিবিড় কিছু বলেনি। চুপচাপ শুনছে। বাবা বলছে, ‘কী করমু বাজান? লাখ দেড়েক টাকা সুদের ওপর আনা। বেতন যা পাই; তা সুদের টাকা দিতে দিতেই শ্যাষ।’ নিবিড় এবারও জবাব খুঁজে পায় না। কী-ই বা বলার আছে বাবা-মাকে? আজকাল বাড়ি এসে খেতে বসলেই বাবা-মার দীর্ঘশ্বাস শুনতে হয়। কতো আব্দার-অভিযোগ কানে আসে। কিচ্ছু করার ক্ষমতা নেই তার? তাই চুপচাপ খেয়ে উঠে যায় নিবিড়।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে উড়ারচর গ্রামের শেষপ্রান্তে সিরাজ মোল্লার দোকান পর্যন্ত একাই হেঁটে যায় নিবিড়। গত কয়েক বছর ধরে বর্ষাকালে ঈদ হচ্ছে। এই রোদ-এই বৃষ্টি। যেখানে-সেখানে কাদা। তাই অনেক কষ্টে দেখেশুনে দোকান পর্যন্ত আসতে হয় তাকে।
গ্রামে গোল্ডলিফ এখন নয় টাকা। বাজেটের আগেই দাম একদফা বেড়েছে। দাম বাড়ার আশায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। কিন্তু বাজেটের পর দাম আর কমেনি। তাই এত টাকা দিয়ে একটা গোল্ডলিফ কিনতে সাহস হয় না। এছাড়া ঈদের ছয় দিনের ছুটি শেষে খালি পকেটে ঢাকায় গেলে বাকি বিশ দিন চলবে কী করে? কমদামের সিগারেট কিনতেও লজ্জা লাগে। গ্রামের মানুষ কত বড় জানে তাকে।
তবু সব দ্বিধা-সংকোচ উপড়ে ফেলে তিন টাকায় একটা শেখ সিগারেট ধরিয়ে দু’টো টান দেয়। এমন সময় পিঠ চাপড়ে দেয় মোতালেব চাচা। মোতালেব সম্পর্কে নিবিড়ের বাবার চাচাতো ভাই। বয়সে বড় হলেও কোনো রাখঢাক নেই।
কী ভাতিজা, ঢাকার থিকা চিকন চিকন দামি সেগারেট আনো নাই?
না কাকু, শেখ ধরাইছি। আমিতো তোমাগো পোলা। তুমি যা খাও, আমারও তো তা-ই খাওয়া উচিতনা কী বলো? কী কাকু, দিবা দুইটান?
আইচ্ছা, না থাকলে কী আর করা? কতা কিন্তু মন্দ কও নাই। যত বড়ই হও না ক্যান, তুমি তো আমাগোই পোলা। তয় দিও শেষে দুই টান।
নিবিড়ের টানা শেষে মোতালেবের হাতে দেয়। মোতালেব আগ্রহ ভরে টানে।
তা ভাতিজা, বয়স তো কম অইলো না। বউ আনবা কবে? চুল তো পাঁকা শুরু করছে।
নিবিড়ের কাঁধে হাত রেখে একটা চাপ দেয় মোতালেব। নিবিড় আর বসতে চায় না। বুকের ভেতরটা খচখচ করে ওঠে।
সময় হোক…আমি এখন উঠি চাচা।
নিবিড় এ কথা বলেই সামনের দিকে পা বাড়ায়।
একটা চা খাইয়া যাও। বাড়ি গিয়া করবা কী? কোনো কাম তো নাই।
যেন একটু লজ্জা পায় নিবিড়।
না, এখন খাবো না। একটু ঘুমাবো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এখন চা খেলে ঘুম নষ্ট হয়ে যাবে।
নিবিড় দ্রুত পা চালায়। মোতালেব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নিবিড়ের যাওয়ার পথে।
গ্রামের মানুষগুলো যতটা না সহজ-সরল; ততটাই প্যাচে ভরা। অন্যকে খোঁচা দিয়েই তাদের চরম আনন্দ। তবে কখনো-কখনো উদারতার কমতি থাকে না। তারা দূর থেকে মানুষকে অনেক বড় করে ভাবে। এ মানুষগুলোর চাহিদা কম বলে শুধু চা-সিগারেট খাইয়েও সারাদিন সঙ্গে-সঙ্গে রাখা যায়।
ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বাড়ি ছেড়েছে নিবিড়। তা প্রায় একযুগ ধরে শহরে আছে সে। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করছে বছর তিনেক হলো। গ্রামে নিবিড়ের নাম-ডাক ভালোই। কখনো কখনো নিবিড়কে টিভিতেও দেখেছে গ্রামের মানুষ। মাঝেমাঝে নিবিড়ের লেখা গল্প-কবিতাও পড়েছে। ফেসবুকে কী সব বড় বড় মানুষের সঙ্গে ছবি তোলে। টাকা-পয়সা নিশ্চয়ই ভালোই কামায়।
ভাবনার জাল ছিন্ন করে অবন্তীর ফোন।
হ্যালো।
কী করছ?
কিছু না।
কিছু না মানে কী?
হাঁটছি।
কোথায়?
রাস্তায়।
বাইরে বৃষ্টি নেই?
ছিলো, এখন নেই।
তারপরও রাস্তায় কেন?
আমার বাড়িতে ছাদ নেই।
সে তো জানিই। সোজা করে বললেই পারো। এত ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলার মানে কী?
বললাম তো রাস্তায়, একা একা হাঁটছি।
ভরদুপুরে রাস্তায় কেন? দুপুরে খেয়েছ?
হুঁ। খেয়েছি।
দুপুরে খাওয়ার পরে রেস্ট নিতে হয়, জানো না?
জানি।
তাহলে বের হলে কেন?
সব কিছুরই কেন থাকে না।
সিগারেট খেতে নিশ্চয়ই?
ছিঃ ছিঃ, সে কী? না। কবে থেকেই তো…
ছেড়ে দিয়েছ। অনেক আগে থেকেই বলে আসছ।
বিশ্বাস হচ্ছে না? কতবার বললাম তোমাকে। কবে থেকেই বাদ দিয়েছি।
অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু সন্দেহের উর্ধ্বে নও তুমি। যদিও পুরনো বদঅভ্যাস।
জানি।
সে যাকগে। এই ঈদটাও গেলো। বয়স কিন্তু কমছে না।
ধরো, আগামী ঈদের মধ্যেই।
উহুঁ। ক’বছর ধরে তো ধরেই আছি। ছাড়তে পারলাম কই?
আর দেরি হবে না। প্রমিজ।
এই রাখো তো। সব কিছুতেই প্রমিজ করো না। প্রমিজের মর্যাদা বোঝো তুমি? যত্তসব। সস্তা পেয়েছ সব?
লাইনটা কেটে দিল। রোজই তো কাটে। এ আর এমন কী? যাক, বাঁচা গেল। ফোনের টাকাটা তো বাঁচল। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি ফুটে ওঠে।
অভাবের সংসারে যা হয়। খাবারের টেবিলে বাবা-মার দীর্ঘশ্বাস। প্রতিবেশীর টিপ্পনি। ফোনের ওপাশে প্রেমিকার হা-হুতাশ। অফিসে বসের তিরস্কার। এ-ই তো হচ্ছে আজকাল।
সে খবর কী আর গ্রামের মানুষগুলো রাখে? তবু গ্রামের মানুষের ভাবনাগুলো মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয় না নিবিড়। তারা তাদের ভাবনা নিয়েই থাকুক। একটু বাহাদুরি দেখাতে দোষ কী? কিন্তু সেই বাহাদুরি কতক্ষণ? রোজই তো থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে অবন্তীর ফোনে।
অন্তহীন অপেক্ষার প্রহরগুলো মোটেই ফুরোবার নয়। বাড়ির ভাঙা ঘর ছেড়ে নতুন ঘর তোলা, ঢাকায় মেস ছেড়ে নিজের একটা বাসা ভাড়া নেয়াকত কিছুই তো মেকি বাহাদুরির কাছে হার মানে। তবু বাহাদুর সাজতে হয়।
সরকারি চাকরি পেতে পাঁচ-সাত লাখ টাকার ঘুষ। সাহস হয় না। এত টাকা কোথায় পাবে? টাকার অভাবে গত ঈদে তো বাড়িই আসা হয়নি। এবার যদিও বোনাসের কিছু টাকা সাহস জুগিয়েছে। তবু নিজের জন্য কিছুই কেনেনি নিবিড়। গত মার্চ মাসে কেনা প্যান্ট-শার্টই ঈদের বলে চালিয়ে দিয়েছে।
একটা প্রমোশন কিংবা বেতন বৃদ্ধির স্বপ্ন দেখে নিবিড়। আবার চাকরি হারানোর ভয়টাও মাঝে মাঝে সব স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। সবকিছুই তো বদলে যেতে পারে। তবে স্বপ্নের মতো করে দ্রুত বদলায় না। সবাই চেয়েছিল নিবিড় শিক্ষকতা করবে। নিবিড় চায়নি। দেড়বছর পড়িয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। নিবিড়ের পছন্দের চাকরি সংবাদপত্র। সম্পাদনা খুব ভালো লাগে। অবন্তী বলে-কয়েও ফেরাতে পারেনি তাকে।
যা ভালো লাগে করো। ভবিষ্যতের কথাটাও মাথায় রেখ কিন্তু?
আর যাই করি, অন্যায় তো আর করছি না।
সে আমি জানি। অন্যায় করতেও বুকের পাটা লাগে, বুঝলে? তা তোমার নেই।
আমাকে আমার কাজ করতে দাও।
নিষেধ করলো কে? বাবা-মা কবেই তো ক্ষ্যান্ত দিয়েছেন। এখন তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় আমার চোখ দু’টি জ্বল-জ্বল করছে।
অবন্তীর আশার মাঝেও হতাশার সুর বেজে ওঠে। অবন্তীরও তো স্বপ্ন আছে বা থাকতে পারে। খুব বেশি না, অন্তত দুই রুমের একটা বাসা। একটা বারান্দা। শেষ বিকেলে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে গল্প করবে দু’জন। দূরের আকাশে তাকিয়ে দেখবে পাখিরা নীড়ে ফিরছে। অথবা মাঝরাতে দেখবে আকাশে তারারা মিটিমিটি জ্বলছে। একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চাই অবন্তীর। নিবিড়কেও কতবার যে বলেছে এ কথা তার ইয়ত্তা নেই।
হ্যাঁ, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সে আশায় দিন গুনছে নিবিড়। খুব নাম-ডাক হবে। সারাদেশে নাম ছড়িয়ে পড়বে। অবন্তীর সব হতাশা মুছে দিয়ে একদিন অন্তহীন অপেক্ষার অবসান হবে।
ভাবতে ভাবতে রাস্তার কাদায় পা পিছলে পড়ে যায় নিবিড়। হাতের ফোনটা ছিটকে পড়ে যায় বৃষ্টির জমানো জলে। ব্যথার কথা ভুলে ফোনের ভবিষ্যৎ চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে নিবিড়ের মন।
মন্তব্য