আসছে ভাদ্র মাসে জগলুর বয়স বাহাত্তর ছোঁবে।
দোচালা টিনের ঘরের এক তৃতীয়াংশের বাসিন্দা হিসেবে এখনো সে ছেলের সংসারে অন্ন ধ্বংসকারী। কাজেই গ্রোগাসে ভাত গেলার সঙ্গে সঙ্গে পুত্রবধূর সংসারে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি, নুন আনতে পান্তা ফুরায় জাতীয় বাক্য শ্রবণে তাকে যে ভালো শ্রোতা হতে হবে, সেটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া আজ যা মানুষ নিচুস্বরে বলে, কাল তা স্পষ্ট হতে থাকে। বিশেষত পাটখড়ি দিয়ে ঘরের ভেতরে তৈরি অতখানি প্রভেদ কথা চাপা রাখার জন্য যথেষ্ট হচ্ছে না। ঝুমা প্রায়ই স্বামীর কাছে নানা বিষয়ে অভিযোগ করছে, আপত্তি তুলছে।
আপত্তি জানানোর যৌক্তিকতা অবশ্য আছে। ঝুমার ছেলে বড় হচ্ছে। সামনের বছর ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠবে। ওমন ডাগর ছেলে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমানো যায় না। তার আলাদা ঘর চাই। কিন্তু নতুন ঘর তোলার সামর্থ্য জয়েনের নেই। ঝুমা যে সেটা জানে নাম তা নয়। কিন্তু তবু কখনো কখনো ঝুমা অকারণেই কলহ বাঁধাতে চায়। জয়েন নিজের ছেলেকে এক আধবার দাদার কাছে শোয়ানোর চেষ্টা যে করেনি, তা নয়। নাতি-নাতনি বড় হলে দাদা-দাদির কাছে ঘুমাবে এতে দোষ কিছু নেই। কিন্তু ঝুমার সেটা পছন্দ নয়। বৃদ্ধ দাদার নোংরা বিছানার চেয়ে ছেলের পড়াশোনার জন্য পরিপাটি একটা কক্ষই তার বেশি প্রয়োজন। জগলুর হাড় না জুড়ালে আপাতত তা হওয়ার কোরো উপায় নেই।
মানুষ বৃদ্ধ হতে থাকলে সংসারে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে। সেদিন বেশি দূরের কথা নয় যেদিন জগলুই ছিল সংসারের কর্তা। চাল-ডাল-তেল-নুন আনা থেকে শুরু করে কবে পিঠাপুলি রান্না হবে, কবে বাড়িতে উৎসব হবে, এমনকী বাড়ির যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে তার অনুমতি নিতে হতো। সময় বড় নির্মম। নিষ্ঠুর সময়ের পরিক্রমায় আজ সে ছেলের সংসারে পরজীবীর মতো কোনোরকমে বেঁচে আছে। কিন্তু সেসব দিনের কথা মনে হলে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কী-বা করার থাকে?
রাত-বিরাতে স্বামীর কাছে ঝুমার ফিসফিসানি জগলুর কানে গেলে বড় অস্বস্তি হয় তার। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। তাছাড়া তাদের স্বামী স্ত্রীর অনেক ব্যাপারও গোপন থাকছে না। বোধ করি বার্ধক্যে মানুষের শ্রবণশক্তি লোপ পায় এই ধারণা থেকেই ঘরে যে তাদের পিতা ও পিতৃসম শ্বশুর রয়েছে সেটা তারা প্রায়ই বেমালুম ভুলে যায়। কিন্তু বয়স হলে মানুষের ঘুমেরও সমস্যা দেখা দেয় এবং রাতের মধ্যে বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙেও যেতে পারে। এই ধারণাও তাদের রাখা উচিত ছিল।
একবার ঘুম ভেঙে গেলে জগলুর আর ঘুম আসতে চায় না। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে। তারপর শোয়া অবস্থায়ই বিড়ি ধরায়, ধোঁয়া ছাড়ে। ধোঁয়ার বিকট গন্ধ নিজেই সহ্য করতে না পেরে উঠে বসে। প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন হলে ওপাশে শুয়ে থাকা ছেলেকে ডাকে, ‘জয়েন! জয়েনরে বাতিডা জ্বালা। বাইরে যামু।’অত রাতে ডাকাডাকিতে ঝুমা বিরক্ত হয়। তাচ্ছিল্যভরে কিছু একটা বলে পাশ ফিরে শোয়। জয়েনও বিরক্তি নিয়ে বাতি জ্বালে। পুরো ঘরের ভেতর পঁচিশ ওয়াটের একটা বাতির টিমটিমে আলো বাহাত্তর বছর বয়সী জগলুর জন্য যথেষ্ট নয়। প্রায়ই ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে দরজার সঙ্গে হোঁচট খায় সে। শব্দ হয়। ঝুমা বিরক্তি নিয়ে বলে, সারাদিন খাটাখাটনি কইরা রাইতের বেলা ঘুমামু, তারও উপায় নাই। আল্লাহ কত মানুষ তুইলা নেয় আমারে ক্যান চক্ষে দ্যাখে না। জগলু ভালো করেই জানে কাকে তুলে নেওয়ার প্রার্থনা এটা।
দিনকয়েক আগের কথা। জগলু বউমাকে বলছিল, বউ, ভাদ্দর মাস আইতাছে। জয়েন হাটে গেলে একখানা তাল নিয়া আইতে কইয়ো। এমন দিন আইলে তালের পিঠা খাইতে মন চায়। সেদিন ঝুমার মেজাজ বোধকরি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশিই খিটখিটে ছিল। ছেলের একটা মাত্র স্কুল ড্রেস। তা দিয়ে পুরো সপ্তাহ স্কুলে পাঠানো যায় না। ঘরে শুকনো খাবারও কিছু থাকে না যা দিয়ে ছেলেকে টিফিন দেওয়া যায়। এ নিয়ে জয়েনের সঙ্গে কিছু আগেই কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। জয়েন বিচ্ছিরিভাবে জবাব দিয়েছিল দুই বেলা ভাতের জোগান দিবার পারি না আর তোর পোলার টিফিন খাওন লাগে?
সে রাগ ঝুমার তখনো পড়েনি। তাই বৃদ্ধ শ্বশুর তালের পিঠা খেতে চাইলে সেও জবাব দিয়েছে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে, এক ঠ্যাং তো কব্বরে যাইয়া রইছে তাও কত কি খাইতে মন চায়। দুই পয়সার গুড় কিনে আনবার মুরাদ তো দেখি না।
জগলু আর কথা বাড়ায়নি। বয়স হলেই মানুষের এটা-ওটা খেতে ইচ্ছে করে। যারা এখনো বৃদ্ধ হয়নি, তাদের তো সেটা বোঝার উপায় নেই।
জগলুর বয়স হলেও ক্ষুধা পায়। জয়েনের ছেলে নয়নকে বিকেলবেলা বাতাসা দিয়ে মুড়ি খেতে দেখে সে ঝুমাকে বলেছিল, বউ! ঘরে কিছু আছে খাওনের? খিদা লাগছে। ঝুমার তীর্যক কথাগুলো মাঝেমাঝে বৃদ্ধ জগলুর গায়ে এসে তীরের মতো বিঁধে। ঝুমা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে জবাব দিয়েছে, বুইড়া মাইনষের বলে ওত খিদা থাহে! দুপুরেই না এক সানকি পান্তা খাইলান। এত খিদা পাইলে কই থিইক্যা দিমু আমি? আমারে তো আপনার পোলা হাত্তি ঘোড়া আইনা দেয় না।
বিয়ের বছর না পেরোতেই ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছে হাসনা। এক জীবনে এরচেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার আছে তার? মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে।
তার কিছু বাদে ঝুমা প্লাস্টিকের একটা বাটিতে দু মুঠো মুড়ির সঙ্গে দুটো বাতাসা এনে রেখে গিয়েছিল বটে, জগলু হাত ছোঁয়ানি তাতে। বারান্দা থেকে উঠে এসে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। কোথা থেকে একটা মেনি বিড়াল এসে বাটিতে মুখ লাগিয়েছিল। তাই নিয়ে ঝুমা লঙ্কাকাণ্ড না বাঁধিয়ে ছাড়লো না।
সে রাতেও জগলু আর খেতে ওঠেনি। জয়েন বাড়ি ফিরলে ঝুমা ইনিয়েবিনিয়ে সেসবের সারবেত্তা বার কয়েক শুনিয়েছে স্বামীকে। রাতের বেলা জয়েন শুতে এলেও ফিসফাস কমেনি। জগলুর কর্ণকুহরে যে সেসব প্রবেশ করছে না, তাও তো নয়।
সে রাতে জগলুর ঘুম আসছিল না, আসার কথাও নয়। পেটে অসহ্য রকমের ক্ষুধা নিয়ে ঘুমানো যায় না। তাছাড়া নিত্য দিনের সেসব কথা বিদ্ধ হয়ে থাকে তার শরীরে, সেসবও তো কোনো কোনো রাতে ফুটে বেরোতে চায়। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতেই তখন মাঝরাত।
এই বয়সে ঘুম না হওয়া বড্ড যন্ত্রণার। জগলু উঠে বসে। আজ আর সে ছেলেকে ডেকে বাতি জ্বালানোর কথা বলে না। অত্যন্ত সন্তর্পণে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।
বাহাত্তর বছর বয়স খুব বেশি নয়। তবু জীবন সংগ্রামের এতগুলো দিন, অম্ল মধুর অতীত, কত বিয়োগ, শোকাবহ দিন পেছনে ফেলে আসা—চারটি কথা নয়। জীবনের গ্লানি টানতে টানতে আজ সে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। জীর্ণ শরীর যেন আর চলতে চায় না। তবু মনের জোর যে তার একেবারেই নেই, তা তো নয়। চোখ বুজলেই ভেসে আসে ছেলেবেলার দুরন্তপনা, যৌবনের কর্মমুখর দিন। এই তো সেদিনের কথা হালের গোরু নিয়ে মাঠের পর মাঠ চষে বেড়িয়েছে জগলু। বোরো-আমন ধান ফলিয়ে মনিবের গোলা ভরে দিয়ে এসেছে অথচ তার নিজের বলতে কিছুই নেই আজ। বরং জীবনের শেষ বেলায় এসে ছেলের অভাবের সংসারে বাড়তি উপদ্রব হিসেবেই বেঁচে আছে।
জগলু ধীর পায়ে বড় রাস্তায় ওঠে। ভূত-প্রেতের ভয় তার কোনোকালেই ছিল না। তবু নিশুতি রাতে পথ চলার সময় গলা টেনে কাশি দেয়। রাত-বিরাতে পথ চলার সময় পূর্ব-পুরুষদের এই পন্থাই অনুসরণ করতে দেখে এসেছে সে। তারপর দিয়াশলাই জ্বেলে আর একটা বিড়ি ধরায়। জগলু জানে অশরীরী কোনো শক্তি আশেপাশে থাকলে আগুন দেখলে ভয় পাবে। কাছে ভিড়বে না। এত রাতে এদিকে এখন আর কেউ জেগে নেই।
বড় রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে কালভার্ট। এখন শ্রাবণ মাসের শেষের দিক। তাই জলের প্রবাহ কমে এসেছে, নেই বললেই চলে। অথচ বর্ষার শুরুতে ভরা যৌবনা যমুনার জলে আশেপাশের গ্রামগঞ্জ তলিয়ে যেতে শুরু করলে মনদুলির এই কালভার্ট খুলে দেওয়া হয়। তখন জলের যা তেজ! সেসময় স্রোতের আশেপাশে ধর্মজাল ফেলে গ্রামের বৃদ্ধ যুবারা। সারাদিন মাছ ধরার পর সন্ধ্যা নামতেই জাল গুটিয়ে নিয়ে যে যার ঘরে ফেরে। বেশি রাত অবধি এই কালভার্টের আশেপাশে একাকী থাকা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বারণ। জগলুরা প্রাচীন মানুষ, কোনো কারণই তো তাদের কাছে অজানা নয়। বিশেষত সে কারণ যদি তার নিজের জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে।
যেবার দেশে গণ্ডগোল শুরু হলো ঘটনাটা তখনকার। জগলুর বয়স তখন কত হবে? একুশ কি বাইশ। টগবগে যুবক। সারাদিন মনিবের ক্ষেতে হাল চাষ করে ঘরে ফেরে। তবু ক্লান্তি নেই এতটুকুন। ঘরে ফিরতেই সমস্ত অবসাদ দূর হয়ে যায় হাসনাকে দেখে। হাসনা তার স্ত্রী, বয়স আঠারো। এক সন্তানের জননী। অর্থাৎ জয়েন তখন দুধের শিশু।
পাশের বাড়ির নুরু মিয়া ও জগলু পিঠাপিঠি। কাজ করার সময় প্রায়ই হাসি তামাশা করে বলে, মিয়াভাই যা- ই কও না ক্যান তুমি বিয়া করার সময় তোমার বউর মতন ওমন একটা মাইয়া কত খুঁজলাম, পাইলাম কই? হাঁছাই তুমি কপাল নিয়া জন্মাইছো। ওমন দুধে আলতা বউ গরিবের ঘরে শোভা পায় না। জগলু নিজেও মানে নুরুর এই কথাটা। মনে মনে খুশি হয় সে। বিয়ের বছর না পেরোতেই ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছে হাসনা। এক জীবনে এরচেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার আছে তার? মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে।
জগলু ঘরে ফিরলে জয়েনকে ঘুম পাড়িয়ে এসে ঘটি ভরে জল দেয় হাসনা। সঙ্গে কাসার থালায় মোয়া সাজিয়ে এনে এগিয়ে দেয়। হাসনা জানে, সারাদিন ওমন হাড়ভাঙা খাটুনির পর কেমন ক্ষুধা পায়।
জগলু খাওয়ার সময় হাসনা কাছেই দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে। জগলু একমনে খাওয়া শুরু করে। তারপর হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে, তুমি খাইছো?
হাসনা সলজ্জ ভঙ্গিতে জবাব দেয়, আপনি জিগাইছেন তাতেই আমার খাওন অইয়া গ্যাছে।
স্ত্রীর এমন ভালোবাসায় জগলুর প্রাণ সিক্ত না হয়ে পারে না। তেমনি একটা দিনের কথা। জগলু অন্যান্য দিনের মতন দিনশেষে লাঙল জোয়াল নিয়ে মাঠ থেকে ঘরে ফিরছিল। ফেরার পথে লক্ষ করলো গ্রামের মানুষগুলো হুড়োহুড়ি করে এদিক ওদিক ছুটছে। কাছেই উমেদ আলীকে পেয়ে জগলু জিজ্ঞেস করলো, কী অইছে কাহা? তোমরা এমুন ছুটাছুটি করতাছো ক্যান?
কে যেন তাকে এই নিশুতি রাতে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, আয়! আয়! জগলু আয়!
উমেদ কিছু বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়, দ্যাশের খবর কিছু রাখোনি? মিলিটারি নামছে। পাকিস্তানি মিলিটারি। স্কুল মাঠে ক্যাম্প করছে। যারে পাইতাছে ধইরা নিয়া গুলি কইরা মাইরা ফালাইতেছে। ম্যায়া-ছেলেও বাদ নাই। তাগোরেও তুইলা নিয়া যায়।
—কী কও কাহা? এমুন সব্বনাশা কথা তো হুনি নাই জীবনে।
—হুননের কাম নাই। নদীর ধারে হগলে গিয়া পলাইতেছে। তুমিও চলো।
হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে জগলু। বাড়িতে জয়েনকে নিয়ে হাসনা নিশ্চয়ই তার পথ চেয়ে রয়েছে। হালের বলদ, লাঙল, জোয়াল সেখানেই পড়ে রইলো। জগলু ছুটলো বাড়ির দিকে। বেশিদূর যেতে হলো না তাকে। নুরু মিয়ার মা জয়েনকে কোলে নিয়ে এদিকেই আসছিল। জগলু কান্নারত জয়েনকে কোলে নিয়ে নুরুর মাকে জিজ্ঞেস করলো, চাচি জয়নালের মা কই? হাসনারে দেহি না যে। নুরুর মা তৎক্ষনাৎ জবাব দেয়, হাসনারে মিলিটারিরা তুইলা নিয়া গ্যাছে।
জগলু পাগলের মতো ছুটতে চায় ক্যাম্পের দিকে। নুরু, উমেদ আলীসহ অন্যরা জগলুকে আটকে রাখে। একুশ বাইশ বছরের টগবগে জগলুর গায়ে অশরীরী শক্তি ভর করে। তাকে ফেরানো কি সোজা কথা? তবু হাত-পা ধরে জগলুকে সেদিন নদীর ধারে নিয়ে আটকে রাখে মনদুলি গ্রামবাসী।
তার মাসখানেক বাদের কথা।
মুক্তিবাহিনীরা মনদুলি স্কুল মাঠে পাকিস্তানি মিলিটারিদের ক্যাম্পে হানা দিয়ে সমস্ত জ্বালিয়ে দেয়। জয় বাংলা স্লোগানে আকাশ বাতাস কম্পিত হতে থাকে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা অনেকেই মারা যায়, মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বাকিরা। সেদিন অন্যদের মতন জগলুও ছুটে গিয়েছিল ক্যাম্পে, দৌড়ে সবার আগে। না, হাসনাকে তারা প্রাণে মারেনি। কিন্তু এ হাসনাকে চেনা যায় না। মলিন চেহারা, উস্কোখুস্কো চুল, চোখ দুটো কোটরাগত, ভয়ে তখনো কাঁপছিল হাসনা।
হাসনাকে সেদিন বাড়ি ফিরিয়ে এনেছিল জগলু কিন্তু ঘরে ফিরে জয়েনকে একবারও কোলে নেয়নি হাসনা। দুই দিন ঘরের ভেতর একা বন্দি থেকে এক রাতে কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে আসে।
পরদিন মনদুলি খালে হাসনার লাশ ভেসে উঠেছিল। জগলুর চোখ দিয়ে এক ফোটা জলও বেরোয়নি। নুরুর মা বিলাপ করে বলেছিল, আহা জগলুটা শোকে পাথর অইয়া গেলো।
জনশ্রুতি আছে, সেদিনের পর থেকে প্রায়ই মনদুলি কালভার্টের নিচে থেকে মাঝরাত্রিতে মেয়েলি কণ্ঠে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। তারপর জগলু কতবার যে সে কান্নার আওয়াজ শোনার জন্য মাঝ-রাত্রিতে এই কালভার্টে এসে দাঁড়িয়ে থেকেছে, কই কোনোদিন তো কিছু শোনেনি!
হাসনা মারা যাওয়ার পর জগলুকে কতজনই আবার বিয়ে করতে বলেছে, সে কোনো কথায় কান দেয়নি। বলেছে, সৎ মা ঘরে এলে আমার জয়েনের কষ্ট হবে। আমিই ওর বাপ, আমিই ওর মা। তারপর প্রায় পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে।
ভুতুড়ে গল্পের বাইরে মনদুলি গ্রামে সেসব দিনের চিহ্ন কোথায়?
আকাশে আজ জ্যোৎস্না। পূর্ণিমা কি না, কে জানে। জগলু বিড়িতে শেষ টান দিয়ে ধীরে ধীরে কালভার্টের ওপরে এসে দাঁড়ায়। কালভার্টের হাতল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভেজা চোখে নিচে তাকায়। পঞ্চাশ ফুট নিচে স্বচ্ছ জলের ওপর জ্যোৎস্নার আলো পড়ে মোহমায়া তৈরি হয়ে আছে। জগলু তাকাতেই এক আশ্চর্য আবেদন তার ভেতরে সাড়া ফেলে। কে যেন তাকে এই নিশুতি রাতে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, আয়! আয়! জগলু আয়!