—কেমন আছ অণু?
—ভালোই তো।
—কেমন ভালো, একটু বিস্তারিত বলো।
—ভালো আছি।
—আরে অণু বিস্তারিত…
—বেঁচে থাকাই ভালো থাকা।
—তারপর?
—তার আর পর নেই।
আমি অণুগল্পের সঙ্গে কথা বাড়াতে পারি না। কারণ ওটা ওর প্রকৃতিতে নেই। ও ছোট ছোট পরিসরে এমন সব কথা বলে, যাকে অস্বীকার করার সাধ্যি কারও নেই। লেখালেখির চৌদ্দপুরুষে যে এমন একটি চরিত্র অপেক্ষা করে ছিল, কে জানতো। ঠিক সময়মতো আবার নাজেলও হয়ে গেছে, মানে চলে এসেছে। শুনেছি নানান দেশ ঘুরে এখন সে আমাদের বাংলাতেও।
কবিতার সঙ্গে দীর্ঘপথ হেঁটে জেনেছি, কত অল্প কথায়, কতটা ভেতর উন্মোচিত করা যায়। সেজন্য মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাসকেও স্বল্প-শ্বাসে গোপন করতে জেনে গেছি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, মুক্তগদ্য পাঠপ্রান্তরে চক্কর খেতে খেতে একজন অণুগল্পের সঙ্গে যখন দেখা হলো, তখন আমি আনন্দ বোধ করলাম। সে কিন্তু এলো তার মতো করে। যেভাবে সবাই আসে ঠিক সেভাবে নয়। উড়ে উড়ে ভেসে ভেসে।
সেই টান টান অনুভব কখনো কখনো ফুরিয়ে যাবার বদলে, আমাকেই পৌঁছে দেয় অল্প শ্বাসে শ্বাসে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ-মাঠে।
কোনো একদিন অণুগল্প একটি চরিত্র হয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। কাছে এসে বসে। হেসে জিজ্ঞেস করে, ভালো আছ? পছন্দ হয় আমাকে?
আমি তো অবাক! অণুগল্প নিজে নিজে কথা বলছে! তাও আবার ভালোলাগার বিষয়ে জিজ্ঞেস করছে! এত মোক্ষম ইঁচড়েপাকা। কিন্তু এসব কথা যে গহনে বলতে হয়, বেশি বেশি করে নয়, তাও জানে। তাহলে বুঝতে হচ্ছে, ভালো লাগছে ওকে। অণু বলে মনে মনে ডাকি। আর বাইরে চুপচাপ দেখতে থাকি ওর বলা, চলা, উন্মোচন।
কিছুক্ষণ অণুগল্পের সঙ্গেই কাটাবো।
উপন্যাসে চরিত্র ও বর্ণনার ঘনঘটায় মাঝে-সাজে আমার বেদিশা লাগে। চাপে পড়া সময়ে বাড়তি মনোযোগে কখনো কখনো বাঁধতে পারি না তাকে। গল্প বা ছোটগল্প মন্দ নয়, তবে চালটা মনমতো না হলে সেভাবে এগুতে পারি না। তবে চালিয়ে নেই শেষতক। এদের পাশ কাটিয়ে অণুগল্প বড্ড স্মার্টলি এসে দাঁড়ায় (শোয়া তো দূরের কথা, বসেও না)। সময় বেশি নেয় না, কিন্তু মোক্ষম কথা বলে চলে যায়। এই ব্যস্ততম সময়ে কপালে যখন ভাঁজ পড়ে, চিন্তা যখন মাল্টি-টাস্কের প্রাবল্যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, তখন অণুগল্প চরিত্রটি আগ্রহ টেনে নেয়। কাছে টানে। কাছে টানি। একটা কবিতা, একটা উড়ো বাতাসের শন শন শব্দ, রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে স্বল্প-ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ইঞ্জিনের হুসহুস, তারপর চলে যাওয়া, তারপর নীরব নিস্তব্ধতা। ভালো লাগে অণুর ছোট ছোট পরিধিতে এঁকে যাওয়া না-ফুরানো দোলগুলো। সেই টান টান অনুভব কখনো কখনো ফুরিয়ে যাবার বদলে, আমাকেই পৌঁছে দেয় অল্প শ্বাসে শ্বাসে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ-মাঠে।
সে মুচকি হাসে। বলে, বেশ করছি। একটু দেবো, অনেক নেবো, ঠিক ওই কবিতার মতো!
—অণু, তোমাকে দার্শনিক না বাজিকর বলবো? সেটাই ভাবছি। আচ্ছা বলো তো, কেমন করে ইনুনি-বিনুনি করে বেণী না গেঁথেই একটা গল্প বলে যাও! উড়ু উড়ু বাতাসের কারসাজি তাহলে তুমিও জানো! একদম ছুপা রোস্তুম।
অণু এবার হেসে জিজ্ঞেস করে, কবিতা তাহলে কী?
—কবিতা কবিতাই।
—তাহলে অণুগল্পও অণুগল্প।
—আমি তোমার হৃৎস্পন্দন শুনিতে পাচ্ছি।
—পাবেই তো।
সে বেশি কথা বলে না। কিন্তু আমি চাই ও আরও কিছু বলুক। সেই কথার জন্য আমার তৃষ্ণা জাগে। আমি মনে মনে কিছুটা হা-পিত্যেস করি। একটু বাচাল হলে ক্ষতি ছিল খুব! তা কিন্তু নয়, দৃশ্যটা বদলে দিয়ে অণু বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে থাকা থেকে সোজা হাঁটতে শুরু করে। আমি ভাবি, আরও কিছুক্ষণ থাকতে বলি ওকে। কিছুটা পিছু ডাকি—এত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছ কেন?
সে মুচকি হাসে। বলে, বেশ করছি। একটু দেবো, অনেক নেবো, ঠিক ওই কবিতার মতো!