এক.
বুকের ভেতর কেমন যেন হু-হু করছে আয়ানার। জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। আগে এই জানালা থেকে দূরের বড় রাস্তা দেখা যেতো। এখন সেটা তো নয়ই; আকাশটাও দেখা যায় না। পাশে বড় একটা দালান উঠছে তালগাছের মতো। পনেরো তলা ভবন সেটা। আয়ানা ভাবে, পনেরো তলায় যারা থাকবে তাদের বারান্দায় কী পুরোটা গ্রিলঘেরা থাকবে তো! উঁকি দিতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না তো! কী জানি তারা হয়তো আয়ানার মতো নয়। আসলে পৃথিবীতে কেউ কারও মতো নয়।
হাসপাতালে যেতে হবে খাবার নিয়ে। গতকাল শৌনক ভর্তি হয়েছে বুকের ব্যথা নিয়ে। ডাক্তার বলেছে আগামীকাল সকালে এনজিওগ্রাম করবে। তবে, নার্স বলছে পরশুও হতে পারে। আসলে হাসপাতালে কখন কী করবে তার কোনো নির্দিষ্ট হিসাব নেই যেমন নেই হুটহাট করে শরীরে অসুখ বেঁধে দেওয়ার। কেমন নির্লজ্জের মতো এসে বাসা বাঁধে, কখনো হাড়ে, পাঁজরে, হৃদপিণ্ডে, মূত্রনালী, জরায়ু, মস্তিষ্ক কোনো প্রত্যঙ্গই বাদ যায় না যেন।
হাসপাতালে এর আগেও শৌনকের সঙ্গে থাকতে হয়েছিল বছর সাত আগে এবং একটানা পুরো এক মাসেরও বেশি সময় ধরে। দিনরাত এক মনে হতো তখন। শৌনকের আত্মীয়রা আসতো, রোগীর বেডের পাশে বসে সাংসারিক আলাপ আলোচনা করতো। রোগীর কন্ডিশন নিয়ে তাদের কোনো প্রকার কান্নাকাটি করে রোগীকে মেন্টালি উইক হতে পারে, এসব সেন্স অব হিউমার তাদের ছিল না।
চোখ এড়ায় না কিছুই। কিন্তু আয়ানার স্বভাব অনুযায়ী সে চিরদিনের মতো সব বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে।
প্রথম থেকেই আয়ানা সুন্দরী ও মেধাবী ছিল বলে তার একটু ঈর্ষাও করতো। শৌনকের পরিবারেরস্বজনের বদ্ধমূল ধারণা ছিল আয়ানার কারণে সে হৃদরোগে ভুগছে। অথচ তাদের ভাই পাঁচ বছর বয়স থেকে স্মোক করতো, নিয়ম কানুনের কোনো বালাই ছিল না, নতুন বিয়ে করা বউকে অনভ্যস্ত শ্বশুর বাড়িতে একা রেখে সারারাত ক্লাবে বসে জুয়া খেলতো। সচ্ছল পরিবেশে বড় হয়েও শ্বশুরবাড়িতে দিনের পর দিন পাকা বাথরুম, টয়লেটবিহীন অনভ্যস্ত কাঁচা গণশৌচাগার ব্যবহার করেছে, শ্বাসকষ্ট নিয়ে দিনের পর দিন মাটির চুলায় গাছের পাতা দিয়ে ধোঁয়ার মধ্যে চৌদ্দ-পনেরো জনের জন্য রান্না করছে, মুখ ফুটে তখন কোনোদিন বলেনি পারবো না। কারণ ওর খুব মনে মনে আশা ছিল, শৌনক ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। বয়সে বড় সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে যে, আয়ানার কষ্ট হয়। কিন্তু কপালে সুখ না থাকলে যা হয়, শৌনক বুঝতো না অথবা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকতো। বিশ বছরেও পারেনি শৌনক আয়ানাকে ভালোবাসতে। একটা পর্যায়ে ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমার সংসারে থাকতে চাইলে আমার ও আমার ভাইবোনদের মন রেখে চলতে হবে নতুবা তোমার কোনো অধিকার নেই এই সংসারে।
দুই.
অথবা সুখী পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। এটাও সত্য সবাই একজন বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না। আয়ানা বিবাহিত জীবনে স্বামী রূপে না বন্ধু রূপে পেতে চেয়েছিল, সুখে-দুঃখে, নিরাপত্তায়, ভরসা করতে চেয়েছিল। হয়নি শৌনকের মানসিকতার কারণে। সে হয়তো হীনমন্যতায় ভুগতো অথবা অবিশ্বাস করতো। মন থেকে কোনোদিন বন্ধু রূপে গ্রহণ করতে পারেনি নিজের কিংবা তার পারিবারিক স্বজনদের পরামর্শের কারণে। কারণ শৌনক আপনার জন ভেবে কোনোদিন মন খুলে তার ও পরিবারের কোনো ভালোমন্দ কথা বলতো না, আয়ানার কষ্ট হয় এইসব ঘটনার সূত্রপাত থেকেই। পরিষ্কারভাবে বললে বলতে হয় শৌনক আয়ানাকে ভালোবাসার জন্য নয়, সংসারের একজন ফুট ফরমায়েসি পরিশ্রম করতে বিয়ে করেছে। আয়ানাকে কোনোদিন স্বেচ্ছায় দশটা টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে বলেনি, নাও এই টাকাটা তোমার কাছে রেখে দাও। কিছু পছন্দ হলে কিনে নিও অথবা বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরে এসো কারণ আমি তো তোমাকে সময় দিতে পারি না।
আয়ানা বিবাহিত জীবনের শুরু থেকেই স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবনে কোনো প্রাইভেসি রাখেনি অর্থাৎ দুজন মানুষের সংসারে তার প্রাপ্তবয়স্ক ভাই বোন এনে রেখেছে। আয়ানা নব-বিবাহিত জীবন থেকেই পরাধীন এজমালি সংসার জীবন শুরু করতে হয়েছিল শৌনকের ইচ্ছায়। স্বাধীনভাবে পছন্দের একটা শাড়িও কিনে পরার মতো পরিবেশ রাখেনি শৌনক। কোনোদিন বুঝতে চায়নি, জানতে চায়নি অনভ্যস্ত হাতে এতগুলো মানুষের রান্না-বান্না ঘরের কাজ বাচ্চার দেখাশোনা করতে করতে আয়ানা কেমন আছ তুমি? হয়তো এই সুস্থ মানসিকতা ছিল না তার।
তিন.
প্রথমবার অসুস্থ হয়ে গেলে হার্টের এই অসুখটা ধরা পড়ে। এনজিওগ্রাম করতে হয়েছিল। এবার দ্বিতীয়বার। আগামীকাল সকালে এনজিওগ্রাম হবে। জুনিয়র এক ডাক্তার বলে গেছেন, রাতে ঘুমোবেন না। মনিটরে চোখ রাখবেন সমস্যা হলে আমাদের জানাবেন।
আয়ানা জেগে আছে। গত কয়েক বছরে শৌনকের ভেতর অনেক পরিবর্তন খেয়াল করে সে। এখন সারাদিন মোবাইল ফোনে বিজি থাকে, সংসারের টাকা পয়সা যা লাগে তার চেয়েও কম দেয়। সংসারের খরচ বলতে চাল ডাল আলু মাছ শাক সবজি শুধু। বিলের কাগজ দেখে ইদানিং পই পই করে গুণে টাকা দেয়। আয়ানা ঘরে ছেড়া পুরনো জামা পরে আজকাল। সেদিকে শৌনকের কোনো খেয়াল নেই। এমনকি একজন ডাক্তার হয়েও সে জানেনা তার স্ত্রী কী কী মাত্রার কোন কোন ওষুধ খায়। রাতে ঘুম হয়, না কি হয় না।
ইদানিং বাসায় অনেক রাত করে আসে। জিজ্ঞেস করলে বলে হসপিটালে কাজের চাপ বেশি।
এর মধ্যে একদিন ওর বান্ধবী ফোন করে বলে রোগী দেখে দিতে বলছিল। কিন্তু শৌনক জানায় একটু বিজি আছি রোগী দেখে দিতে পারবো না। বান্ধবী ফেরার পথে একটা ত্রিশোর্ধ্ব মেয়ের সঙ্গে শৌনক কে এক রিকশায় দেখে। মেয়েটার হাতে বেলি ফুলের মালা জড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কিছু না বলে বান্ধবী এই দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ করে চলে আসে আরেক দিকে তাকিয়ে। আয়ানার বান্ধবী জানতে পারে মেয়েটি একজন ডাক্তার নাম সুমাইয়া।
চার.
হসপিটালে শৌনকের ছাত্রী পরিচয় দিয়ে সুমাইয়া আছে। কাছঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। আয়ানার চোখ এড়ায়নি কিছুই। দুজনের চোখে চোখে কথা, ফেসিয়াল এক্সপ্রেসন, সুমাইয়াকে দেখে শৌনকের চেহারার সুখী সুখী ভাব। চোখ এড়ায় না কিছুই। কিন্তু আয়ানার স্বভাব অনুযায়ী সে চিরদিনের মতো সব বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে।
কেবিনের ভেতর যায়। হঠাৎ ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে। শৌনকের প্রতারণার জন্য তুই কেন জীবন দিবি। গলাটা ঠিক ওর মৃত তিন ভাইয়ের মতো মন হয়।
শৌনক হঠাৎ বলে তোমরা দুজন পাশাপাশি দাড়াও একটা সেলফি তুলি। আয়ানার ফোন নম্বরটা দিতে বলে। সবকিছু বোঝার পরেও আয়ানা চুপ করে থাকে আর মনে মনে গালি দেয়। সে বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের হৃদরোগের ছাত্রী জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়। সুমাইয়ার হাবভাব চালচলন দেখে আয়ানার ভালো লাগে না। এছাড়া সরাসরি ছাত্রীও তো নয়। দুই জন দুই বিভাগের ডাক্তার।
পাঁচ.
শৌনককে মরফিন দেওয়া হয়েছে। সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। গত দুই দিনে আয়ানার চোখে ঘুম নেই। আয়ানা ছাড়া রোগীর সেবা করতে শৌনকের পরমাত্মীয় কেউ রাতে থাকে না। এজমা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত আয়ানা কিন্তু নিজের শরীরের দিকে খেয়াল করার সময় কোথায়। আগের মতো শক্তি নেই, শরীর দুর্বল লাগে সবসময়, শ্বাসকষ্ট মাঝে মধ্যে বাড়ে কমে। কিন্তু আমাদের এই সমাজে সংসারে মেয়ে মানুষ হচ্ছে কলুর বলদের মতো। যতদিন ঘানি টানতে পারবে, ততদিন তোমার কদর। মাঝে মাঝে আয়ানার মনে হয় সংসারের চেয়ে কবরের মাটিও হয়তো অনেক উত্তম।
হঠাৎ শৌনকের মোবাইল এই একটা মেসেজ আসে। আয়ানা চেক করে মেসেজ। পড়তে থাকে। অনেক দিনের জমানো প্রেম, আবেগ, স্বপ্ন, একসাথে শপিং করতে যাওয়ার ছবি, মেয়ের মায়ের সাপোর্ট, গ্রামের রিপোর্টে বেড়াতে যাওয়ার ছবি, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে ডিলিট করে দেওয়ার ছবি, ভবিষ্যতে পরিকল্পনার কথা, সুমাইয়াকে নিয়ে নতুন কবিতা লেখার কথা, প্রতিদিন একসাথে বসে খাবার অর্ডার করে খাওয়ার কথা, আমার কেনা ড্রেস কেন পরছো না বলে অভিযোগ, মাসিক কবে কত তারিখ শুরু হয়েছে তার বিবরণ, হিন্দু ছেলের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার জন্য অভিমান, দুই দিন দেখা হয়নি বলে কান্না, কান্না দেখানোর ছবি, ঈদের কেনা শাড়ি কী বলে দেবে, তার গোপন পরিকল্পনা, তাদের ভবিষ্যৎ দাম্পত্য পরিকল্পনা, পহেলা বৈশাখে হলুদ শার্ট পরে থাকার ছবি, বৈশাখে গিফট করা শাড়ি না পরার অভিমান, সুমাইয়া কে শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ভালোবাসার শপথ, আদর করে সেতু, সোনিয়া, সুস্মিতা, ভ্যালেন্টাইন, আমার জান, হৃদস্পন্দন বলে ডেকে মান ভাঙিয়ে সারাজীবন শুধু তাকেই একমাত্র তাকেই ভালোবেসে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা।
এমনি আবেগে আপ্লুত চ্যাটিং পড়তে পড়তে ফজরের আজান ভেসে আসে।
ছয়.
আয়ানা স্থানুর মতো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কতক্ষণ ধরে মনে নেই। আস্তে আস্তে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে পনেরো তলায় যাবার জন্য লিফট খোঁজে। মাথা ঝিম ঝিম করে। আয়ানা এদিক-ওদিক দৌড়ে লিফট খোঁজে। পনেলো তলায় উঠে সে ঝাঁপ দেবে, আত্মহত্যা করবে, লিফট বন্ধ দেখে সিঁড়ির দিকে যায়। আয়ানা লিফট সিঁড়ি কিছু খুঁজে পায় না, বারান্দায় এ-পাশে ও-পাশে দৌড়ে দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার।
কেবিনের ভেতর যায়। হঠাৎ ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে। শৌনকের প্রতারণার জন্য তুই কেন জীবন দিবি। গলাটা ঠিক ওর মৃত তিন ভাইয়ের মতো মন হয়।
আয়ানা জেগে ওঠে। অঝোর ধারায় বৃষ্টির মতো কাঁদে। সন্তানদের কথা মনে পড়ে। আয়ানার ভেতরের পরিবর্তন টের পায়। সে এখন আর একা নয়। তার মনোবল ও শক্তি আজ মরহুম বাবা আর মায়ের গায়ের গন্ধ আর অকাল মৃত তিন শিশুভ্রাতার আশীর্বাদ। আয়ানার টিকে থাকার লড়াই চলছে এবং চলবে।