উত্তরবঙ্গের মেয়ে আমি। বাড়ি ঠাঁকুরগাও জেলায়। বেড়ে উঠেছি চট্টগ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে ঘুরেছি বাংলাদেশের অনেক জায়গায়। আমাদের পরিবারের সবাই ভোজনরসিক। তাই তো নতুন নতুন জায়গার মজার মজার খাবারের স্বাদ নিতে ভুল করেনি। সেই অভিজ্ঞতাগুলো ভার্চুয়াল বিশ্বে শেয়ার করছি নিজের ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে।
শুরুর গল্প
আম্মু বলতেন- ছোটবেলা থেকেই রান্না-বান্না নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল। আব্বুর চাকরির জন্য দেশের নানা জায়গায় থাকা হয়েছে দীর্ঘদিন। আর নতুন কোথাও গেলে নতুন অনেক কিছুর সাথে পরিচিত হতাম। পরিচিত হতাম নতুন ধরনের রান্নার সাথে। একসময় ওই খাবারগুলো নিয়ে কৌতূহল বাড়লো। যে খাবারগুলো যিনি ভালো রান্না করতে পারেন আব্বু-আম্মু তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব শিখতাম। তারপর রান্না করে সপরিবারে উপভোগ করার মধ্যে আলাদা শান্তি খুঁজে পেতাম সবসময়। বিয়ের পরে যখন ছেলে একটু বড় হয়ে গেল, ওকে সময় দেয়ার জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। আর অবসরে ওই রান্নাগুলো চর্চা করতাম। এ সময় আমার স্বামী অমি আজাদ বুদ্ধি দেয়, আমার রেসিপিগুলোর একটা আর্কাইভ তৈরি করার জন্য। কারণ আমি যেভাবে সারাদেশে ঘোরাঘুরির মাধ্যমে বিভিন্ন রান্না শিখেছি, মানুষ সাধারণত সেই সুযোগ পায় না। প্রথমে ভেবেছিলাম ব্লগে লিখবো। পরে শুরু করলাম ইউটিউব চ্যানেল।
কাজ ইউটিউব চ্যানেলে
আমি যখন ব্লগ লিখবো ঠিক করেছিলাম। তখন মেটাক্যাফে, ইউটিউব, ডেইলিমোশন জাতীয় ভিডিও শেয়ার করার সাইটগুলো জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করেছে। আমার লেখার একপর্যায়ে আমার স্বামী বললো, একটা সময় মানুষ কিন্তু পড়তে চাইবে না, হাতেকলমে দেখতে ও শিখতে চাইবে; সেই কনসেপ্ট থেকেই ভিডিও করা শুরু করি। রেসিপি লিখে মানুষকে আসলে বোঝানো সম্ভব নয় যে, আসল খাবারটা কেমন হবে বা কিভাবে তৈরি করতে হবে। পাঁচ মিনিট ধরে মানুষ যা পড়বে, তাতে অনেক কিছু দেখানো যায়। সেই ভাবনা থেকেই নাইকন কুলপিক্স পি৩০০ ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও শুরু করি। আর সব প্রযুক্তিগত সাপোর্ট শুরু থেকেই অমি আজাদ দিয়ে আসতো।
একটা মজার বিষয় হলো, আমরা কিন্তু ইউটিউবকে টার্গেট করে কাজটা শুরু করিনি। ১৫ ডিসেম্বর ২০১২ সালে আমরা প্রথম ভিডিও আপলোড করি। সে সময় বাংলাদেশে কোনো এক কারণে ইউটিউব বন্ধ করে দেওয়া ছিল। আমরা ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করলেও সেটা দেশ থেকে দেখার উপায় ছিল না।
এগিয়ে চলার প্রেরণা
আমরা যেহেতু বাসার ভেতরে শুটিং করি; সে জন্য অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন – ভিডিও চলছে গাড়ির হর্র্ণবাজছে, ফেরিওয়ালা চিৎকার করছে, পাশের বিল্ডিংয়ে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। যে কারণে অনেক ঝামেলা হয়েছে শুটিং করতে। আর বিদ্যুতের সমস্যা তো আছেই। আমাদের কাজ বিদ্যুতের উপর অনেক নির্ভরশীল।
একটা বড় সমস্যা হলো: ভিডিও পাইরেসি। অনেকেই ইউটিউব থেকে ভিডিও কপি করে ফেসবুকে দিয়ে দেয়। এতে আমরা অনেক দর্শক হারিয়েছি। অনেকেই আবার ভিডিও ইউটিউবে বসে দেখেন না। ডাউনলোড করে দেখেন এবং সেটা আবার অন্যদের সাথে শেয়ার করেন। এতেও কিন্তু আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। ঠিক এরকম কারণেই আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি আজ ধ্বংসের পথে। অনেক বাধা-বিপত্তির পরও এই কাজ একটি নেশায় পরিণত হয়েছে।
কেমন চলছে
এখন ভিডিও যেভাবে ভাইরাল হয়, একসময় হতো না। আমরা একের পর এক কাজ করে গিয়েছি, কিন্তু সেভাবে দর্শক পাইনি। ২০১৪ সালে আমার মেয়ে হওয়ার পরে এই কাজ থেকে বিরতি নেই এবং আমরা সিঙ্গাপুরে চলে যাই। সেখানে ইউটিউব এবং মিডিয়াকর্পের ওয়ার্কশপগুলোতে গেলে অনেক কিছু শিখতে পারি। হঠাৎ করেই দেখি আমাদের ভিডিওগুলোর ভিউ অনেক বাড়ছে। অনেকে অনেক প্রশ্ন করছে, নতুন জিনিস জানতে চাইছে। আমাদের ধারণা, ওই সময়ে আমাদের দেশের ইন্টারনেট প্রসারিত হতে শুরু করে এবং সে জন্য সাধারণ মানুষ এ জাতীয় ভিডিওগুলো বেশি দেখা শুরু করে। প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পরে দর্শকদের চাহিদা আর অনুপ্রেরণায় আবার ভিডিও বানানো শুরু করলাম।
এককথায় বলতে হয়, এগিয়েছি শুধু দর্শক ও পরিবারের অনুপ্রেরণায়- সাথে আল্লাহর রহমত তো অবশ্যই আছে। আগে হয়তো দুই সপ্তাহে একটা ভিডিও শেয়ার করতাম, এখন প্রায় প্রতি তিন দিনে একটি রেসিপি শেয়ার করি।
সফলতা-ব্যর্থতা
সফলতা আমার দর্শকরা। ভিডিও শেয়ার করি, দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দেই, এটাই ভালো লাগে। তবে একটা শঙ্কা আছে আমাদের দর্শকদের জন্য। এটা আসলে একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছে। আমি যেমন আমার ভালো লাগা বা প্যাশন থেকে এগুলো করি, কিন্তু একটা অসাধু শ্রেণি চলে এসেছে; যারা এই প্ল্যাটফর্মকে সম্পূর্ণ মুনাফার জন্য ব্যবহার করছে। সেদিন একটা চ্যানেল দেখলাম- ৫টি রেসিপি কিন্তু ১ লাখ সাবস্ক্রাইবার! পরে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখি এরকম কৃত্রিম চ্যানেল কিনতে পাওয়া যায়, এমনকি ভিডিও আপলোড করে কৃত্রিমভাবে ভিউ বাড়ানো যায়। আমাদের কাজ আমরা করে যাবো, কিন্তু আমাদের দর্শকরা এতে মারাত্মকভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
আগামীর পথচলা
এই চ্যানেল থেকে যে রোজগার করা যাবে- কখনো ভাবিনি। আগে ভিডিওগুলো ক্রিয়েটিভ কমনস্ লাইসেন্সের আওতায় ছিলো। একসময় দেখি আমাদের ভিডিও দিয়ে মানুষ ব্যবসা করছে। তখন ইউটিউব সিঙ্গাপুর আর মিডিয়াকর্প আমাদের পরামর্শ দেয় লাইসেন্স বদলে মনিটাইজেশন (টাকা রোজগার) শুরু করতে, তাহলেই শুধু ভিডিওগুলোর অপব্যবহার বন্ধ করা যাবে। পরে সেটা করতে বাধ্য হই। যখন আয় করতে শুরু করলাম, চিন্তা করলাম- এই টাকাগুলো দিয়ে তাদের সাহায্য করি; যাদের সত্যিই টাকা প্রয়োজন। আমরা এই রোজগারের টাকা দিয়ে কিশোরগঞ্জের একটি স্কুল, বগুড়া ও নোয়াখালীর দুটি এতিমখানায় অর্থায়ন শুরু করি। এখন ওদের দিকে তাকিয়েই আর থামা যাবে না। আমরা যতো ভালো করবো; ওদের ততো উপকারে আসবে। এ কথা ভেবেই এগিয়ে যেতে হবে।
নতুনদের জন্য
নতুনদের আমরা সরাসরি সাহায্য করি। আমাদের চ্যানেল ছাড়া আমরা আরও চারটি চ্যানেলকে সবকিছু সঠিকভাবে করার জন্য সাহায্য করেছি। কেউ যদি এ রকম সাহায্য চান, আমাদের সাথে ফেসবুকে (www.facebook.com/rumanaranna) যোগাযোগ করতে পারেন।
<>