চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত। কিন্তু বাক-স্বাধীনতা স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন। সবাই সব ধরনের চিন্তা করলেও তা প্রকাশে কাউকে হতে হয় সংযমী, কাউকে বজ্রকণ্ঠ আবার কাউকে-কাউকে বিনয়ী। যে কথা সবিনয়ে বলার, তা বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হলে বক্তব্যের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। একজনের তথাস্বাধীন বাক্যবাণে অন্যের সম্মানহানি ঘটলে তাকে বাক-স্বাধীনতা বলা যায় না। তাতে মানুষের এই মৌলিক অধিকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় মাত্র। ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা’ প্রসঙ্গে সংবিধানের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে— (১) ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।’ এবং (২) ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তাদান করা হইল।’ এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট—চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার সঙ্গে বিবেকের স্বাধীনতাও যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তিমনে যা কিছু উদয় হবে, যেমন করে মন চাইবে, ঠিক তেমন করে কোনও বিষয় প্রকাশ করার নাম স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতার সঙ্গে সংযম, বিবেচনা ও ন্যায়বোধও সম্পৃক্ত।
চোখে দেখা দৃশ্য যা বলে, কানে শোনা কথা তার সাক্ষ্য দেয় না সব সময়। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের ‘চক্ষুকর্ণের বিবাদ’ না-মেটে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও বিষয়ে মন্তব্য না-করাই বাঞ্ছনীয়। দেখা বা শোনামাত্র কোনও বিষয়ে ‘সব বুঝে ফেলার ভানে’ সমাজে-রাষ্ট্রে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, বিভ্রান্ত হয় মানবসমাজ। এতে বিনষ্ট হয় সামাজিক শৃঙ্খলা, শান্তি, ভ্রাতৃভাব। কিন্তু আমাদের সমাজের দিকে তাকালে কী দেখি আমরা? দেখি রাজনীতিবিদরা পরস্পরকে কুরুচিপূর্ণ বাক্যবাণে জর্জরিত করছেন।
রাজনীতিবিদদের অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য জনগণকে অনৈতিকতার দিকে প্ররোচিত করে। অথচ তারা অবলীলায় দিয়ে যান যত সংযমহীন-লাগামহীন বক্তব্য।
আমাদের রাজনীতিবিদ-সুশীল সমাজকে মনে রাখতে হবে— প্রচলিত-আইন-সংবিধান-প্রদত্ত অধিকার-অনুযায়ী প্রতিকার না চেয়ে মনগড়া মন্তব্য করলে বাক-স্বাধীনতার সফল প্রয়োগ হয় না। তাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় মাত্র। সমাজের সভ্যরূপ-গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে গেলে প্রতিটি নাগরিককে হতে হবে বাকসংযমী। কারণ বাক-স্বাধীনতার সফল প্রয়োগে সমাজ হয়ে উঠবে সুশৃঙ্খল, রাষ্ট্রের কাছ থেকে সহজে আদায় করা সম্ভব হবে নাগরিক-অধিকার। এর অপপ্রয়োগে সমাজে সৃষ্টি হতে পারে বিশৃঙ্খলা, নেমে আসতে পারে নৈরাজ্য-নাশকতা। যদি কখনো তেমনটা ঘটে, তাহলে তার সব দায় নিতে হবে রাজনীতিবিদ-সুশীলসমাজকেই।
মনে হয়, আমাদের রাজনীতিবিদ-সুশীল সমাজের এখন সময় হয়েছে— সভ্য জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে কথায়-আচরণে সংযমী ও চিন্তায়-রুচিতে সংস্কৃতিবান হওয়ার। সময় হয়েছে বাক-স্বাধীনতা ভোগ করার পাশাপাশি চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার বিষয়টি মনে রাখারও।