কী রান্না করলেন, কিভাবে রান্না করলেন, রান্না কতটা সুস্বাদু হলো, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, পরিবেশনটা কিভাবে করলেন, কেমন প্লেটে দিলেন। পরিবেশনের সময় আপনি আন্তরিক ছিলেন কি না, সেটাই আসল কথা। মনের ভেতর বিদ্বেষ পুষে রেখে, সোনার থালায় বিরিয়ানি পরিবেশন করলেও সেটা ছাইয়ের মতো লাগবে, আর হাসিমুখে মরিচপোড়া-পেঁয়াজ পিষে খেতে দিলেও ক্ষুধার্তের কাছে তা-ই অমৃত মনে হবে।
রাঁধুনির সমস্ত কৃতিত্ব নির্ভর করে পরিবেশকের মুনশিয়ার ওপর। পরিবেশকের একটুখানি আন্তরিকতা রাধুনির জন্য যেমন আনন্দ বয়ে আনতে পারে, তেমনি একটুখানি অবেহলা-অবজ্ঞা রাধুনিকে রসাতলে নামাতেও পারে।
কথাগুলো লেখকদের উদ্দেশে বলা। আপনি কী লিখছেন, কিভাবে লিখছেন, সেটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেটা কিভাবে পরিবেশন করছেন।
একজন লেখক-পরিবেশককে ভাবতে হবে, তিনি যা লিখছেন, তা পরিবেশন করছেন, তা কিভাবে পরিবেশন করছেন। অর্থাৎ আপনার লেখাটি কোথায় প্রকাশিত হলো, কত বেশি প্রচারিত দৈনিকের সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হলো, সেটি আসল কথা নয়, আসল কথা হলো, আপনার লেখাটি কার হাতে সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হলো। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকের সাহিত্যপাতার সম্পাদনার দায়িত্বে গুণবিচারী সাহিত্য সম্পাদক নাও থাকতে পারেন। একজন গুণবিচারী সাহিত্য সম্পাদকের সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকাটি হতে পারে মাত্র ২০০ কপি সার্কুলের লিটলম্যাগ। কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে, সত্যিকারের সাহিত্য সম্পাদকের হাতে সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার অর্থ হলো, একই সঙ্গে সম্পাদনা ও স্বীকৃতি। সুতরাং কোথায় প্রকাশিত হলো, এই প্রশ্নের চেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কার হাতে সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হলো।
আর একটি কথা। আপনার রচনাটি যতই উপকারী হোক না, তা যদি ভুল মাধ্যমে, ভুল কৌশলে পরিবেশিত হয়ে থাকে, তাহলে পাঠক ওই রচনা গ্রহণ করবে না সহজে। মনে রাখা ভালো যে, ফলের ভারে গাছ নত হয়, উদ্ধত নয়। উদ্ধত গাছ নিষ্ফলাই হয়। কথাটা ঘুরিয়ে বলা যায়, নিষ্ফলা গাছই উদ্ধত হওয়ার ধৃষ্টতা দেখায়। ফলজগাছে ফল এলে আপনা থেকেই নত হয়ে আসে। জ্ঞানও এমন ফলের মতোই। জ্ঞানীমাত্রই ফলভরা বৃক্ষের মতো, তিনি কথা বলেন বিনয়ের সঙ্গে, সে কথা যত রূঢ়ই হোক, পরিবেশন করেন এমনভাবে, তাতে কথাগুলো যার বিরুদ্ধে যাবে, সেও প্রথমপাঠে আহত হবে না। বরং নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হবে। আর যিনি উদ্ধত মস্তকে যা খুশি তা বলে মানবসমাজকে ভর্ৎসনা করেন, পরিবেশনের সময় তাবত পাঠক সমাজকে জ্ঞান দেওয়ার ভান করেন, সবাইকে গণ্ডমূর্খ বলেন, পাঠক তার লেখা ছুঁয়েও দেখে না। সেই যত বড় জ্ঞানী-ই হোক, যদি বিনয়ী হতে না পারে, তাহলে তিনি সর্বদাই পরিত্যাজ্য।