আমি এখন স্বাধীন, ভীষণ স্বাধীন।এত স্বাধীন যে, আর সহ্য হয় না! এখন থেকে রাত করে বাসায় ফিরতে, দুপুরের খাবার বিকেল করে খেতে কোনো বাধা নেই। ডেক্সটপ টেবিলে সারারাত কাটালেও কারও কাছে কোনো অভিযোগ যাবে না। সকল অভিযোগের ঝুলি জমা পড়তো যার আদালতে, তিনি আজ তারার দেশে। আরেকটি দিন বাড়ি থকার অনুরোধ করে কেউ আর পরিকল্পনা নষ্ট করে দেবে না আমার, সোনালু গাছটির তলায় দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখও মুছবে না কেউ। গভীর রাতে চুপি চুপি এসে কেউ দেখবে না বেখবর দেহখানা মশারীর সঙ্গে লেগে আছে কি না। মৃদু শীতে গুটিশুটি শুয়ে থাকা দেহে আলতো করে একখানা কাঁথাও জড়িয়ে দেবে না কেউ। যিনি ছিলেন এসবের মহাব্যবস্থাপনায়, তিনি আজ নেই, এ রাজ্যের সিংহাসন আজ শূন্য।
প্রায় সাত বছর আগে বাবা হারানোর পর মাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো আমাদের রাজ্য। যে ত্রুটিযুক্ত হৃৎযন্ত্রটির টিকটিক করে চলার সঙ্গে স্পন্দিত হতো আরও সাতসাতটি প্রাণের স্পন্দন, ঘড়ির কাঁটার মতো বন্ধ হয়ে গেলো সে হৃৎপিণ্ডটি। রাত দেড়টার সময় যখন মায়ের অসুস্থতার খবর পেলাম, তখন আমি কর্মস্থলে। সামর্থ্যের সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে চলা যন্ত্রযানটিকেও খুব গতিহীন মনে হচ্ছিল।ঘণ্টা খানেকের ব্যবধানে যখন বাড়ি এসে পৌঁছলাম, তখন মা আমার আর অন্যদিনের মতো পথ এগিয়ে দাড়ালো না, দু’বাহু বাড়িয়ে বুকে নিয়ে বললো না, তুই এত শুকিয়ে গেছিস কেন? আজ মা আমার নির্বাক। অভিমান করেছে, চির অভিমান। মায়ের নিথর দেহ সাদা কাপড়বন্দি। চারপাশ ঘিরে ভাইবোনদের আহাজারি। পবিত্র পদযুগলের কাছে পাথর হয়ে বসে আছে তার পঞ্চাশোর্ধ বড় সন্তান। হঠাৎ বুকের বাম পাশটায় কোন অসঙ্গতির জানান দিলো। আমাকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে সেখান থেকে। এতটুকু স্মৃতি স্পষ্ট, বাকিটুকুর বিচ্যুতি ঘটেছে।
সমগ্র পৃথিবীর মানবকুলকে আপনি নিঃসংকোচে দু’দলে ভাগ করে ফেলতে পারেন। প্রথম দলের মা আছে, দ্বিতীয় দলের নেই।আমি এখন দ্বিতীয় দলভুক্ত। আমি এখন যে গ্রহে বাস করি, তার নাম মাহীন পৃথিবী। এখানেও ফাগুন আসে, শিমুল ফোটে, কোকিল ডাকে; কিন্তু হৃদয় সুরের মূর্ছনায় অনুরণিত হয় না। শিশির নামক শরতের কান্নাকেও হীরের কণা বলে ভুল করার সুযোগ নেই এখানে। এ গ্রহে শীতের পাতা ঝরা দেখার জন্য বিভূতিরা আসে না, আসে ধূসরপাণ্ডুলিপির নিরস চাষীরা। আমি গোর্কির ‘মাদার’ কিংবা শওকত ওসমানের ‘জননী’ পড়িনি। আমি রবি ঠাকুরের ‘ছুটি ‘ পড়েই কাঁদি। মিজান বিন মজিদ, ওমর ফারুকের মাকে নিয়ে লেখা রত্ন গদ্যগুলো পড়েই চোখ ভেজাই, আমি অত বড় বড় বই পড়ি কী করে!
মা ছিলেন সংসারের সুখের খনি।আমরা সেখান থেকে সুখ উত্তোলন করতাম ক্ষণে ক্ষণে। আমাদের ছোটখাটো অর্থের জোগানগুলোও আসতো তাঁর কাছ থেকে। স্কুল পথের শত বায়না, রাবার-পেন্সিল কিংবা চক-স্লেটের যৎসামান্য টাকাটারও জোগান দিতেন তিনি। উইনসেন পেনের সৌখিন স্বপ্নটাও থাকতো তাঁর আঁচলে গিট্টু বাঁধা। শীতের সকালে চুলোর চারপাশ ঘিরে বসা ভাইবোনদের চাহিদার তুলনায় স্বল্প জোগানের পিঠাগুলোকে যখন মা ভেঙে ভেঙে ভাগ দিতেন, তখন কুণ্ডুলী পাকানো সুখগুলো উড়ে উড়ে যেতো নীল আকাশের দিকে। আমরা একে বলতাম ধোঁয়া। সবার পরিতৃপ্তির পর মা খেতেন কিংবা খেতেন না।বাবার পরিমিত আয়ের সংসারে আমাদের স্বপ্নের কারিগর ছিলেন তিনি। আমাদের প্রায় ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে জোড়া লাগাতে গিয়ে নিজের কত শখের বিসর্জন দিতেন, সে খবর আমাদের দৃষ্টির অগোচরেই থাকতো। মায়ের হাতের বালা কিংবা কানের দুলের কথা জিজ্ঞেস করলে মুছকি হেসে বলতেন, হেফাজতে আছে। আচ্ছা বলতে পারেন, মায়েরা এত মিথ্যে বলেন কেন? মাকড়সা নাকি তার ডিম্বথলিটা নীড়ের মধ্যে রাখে না, রাখে বুকের কাছে একেবারে কলিজার ওপরে; যেন সদ্য ডিমফোটা ক্ষুধার্ত বাচ্ছারা কলিজাটা খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে, প্রস্তুত হতে পারে পৃথিবী নামক সমরক্ষেত্রে টিকে থাকার লড়াইয়ে।প্রকৃতির কী নির্মম খেলা, তাই না? মায়েরা এমন কত খেলারই সাক্ষী।
মা ছিলেন আমার কান্নার জাদুকর। তিনি সন্তানের দুঃখে কাঁদতেন, অতি সুখেও কাঁদতেন। মা আমার জঙ্গনামা কিংবা বিষাদসিন্ধু পড়েও কাঁদতেন। তাঁর সুর ধরে পড়া পুথিসাহিত্যের গুণমুগ্ধ শ্রোতাদেরও কাঁদাতেন তিনি। গ্রাম থেকে যখন শহরে আসতেন, তখন গ্রামের স্বজনদের জন্য কাঁদতেন, আবার গ্রামে থাকলে কাঁদতেন শহরের অংশের জন্য। মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি যেতে মা কাঁদতেন, ছেলের বউ বাবার বাড়িতে যেতেও তাঁর চোখ ভিজতো। কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যখন বাড়ি থেকে বের হতাম, দেখতাম, সোনালু গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছছেন মা। আমার যন্ত্রযানটি দৃষ্টিসীমার আড়াল হয়ে যাওয়া পর্যন্ত মাকে দেখতাম। তাঁর ছেলের বউ বলতো, মেয়েদের বিদায় দিতে মা কাঁদেন, এটা বাংলার চিরায়ত রূপ, কিন্তু ছেলে বউকে বিদায় জানাতে শাশুড়ি কাঁদেন, এ সৌন্দর্য নৈসর্গিক। বলতে বলতে তার ভোখ ভিজে যেত, কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসতো। যখন আমরা কেউ অসুস্থ হয়ে একেবারে শয্যাবরণ করে নিতাম, বঙ্কিম বাবুর (পল্লী চিকিৎসক) দাওয়া আর কুলিয়ে উঠতো না, মা তাঁর বিধাতার কাছে দু’হাত তুলতেন। হৃদয়ক্ষরণের রক্তফোঁটা যখন শুভ্র পরিধানে আবৃত মায়ের দু’হাতের কনুই বেয়ে অশ্রুজল হয়ে ঝরে পড়তো পবিত্র জায়নামাজের ওপর, তখন বুঝতাম আমাদের শয্যাত্যাগের সময় হয়ে গেছে।বিধাতা মায়েদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন না বোধ হয়।
ইদানিং গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়।আস্তে করে মশারিটা সরিয়ে বারান্দায় আসি। মায়ের শূন্য চেয়ারটার পাশে বসি। এত রাতে প্রাণীকুলের তেমন সাড়া থাকে না। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে, একটি কাঠবিড়ালি এ ডাল থেকে ও ডালে ছুটছে, কিংবা জামরুল গাছে ডানা ঝাপটে ওঠা একটি হুতুমপেঁচা। ডোবা সদৃশ পুকুরটার দু’ধারে ঝোপঝাড়ে চোখে পড়ে নরম কোমল মায়াবি আলোর ছোটাছুটি-ওরা জোনাক পোকার দল। বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটারে বসতিগড়া সংসারী চড়ুই দম্পতিকেও চোখে পড়ে মাঝেমাঝে। নিজেদের সদ্যোজাত সন্তানদের রাত জেগে পাহারা দিতে হয় নিশাচর প্রাণঘাতী শত্রুদের ভয়ে। দূর আকাশে জেগে থাকে নৈশপ্রহরী তারারা। ওরা আমার নিত্যরাতের সাথী।ওদের সঙ্গে এক অদ্ভুত ভাব হয়ে গেছে আমার। আচ্ছা, তারারা এত জেগে থাকে কেন? ওদের কি অনেক কষ্ট? ওরাও কি আমার মতো মাহীন গ্রহবাসী? যদি তাই হয়, তবে তুমিও শূন্য আমিও শূন্য, এসো হই মোরা সাথী। না, মাকে নিয়ে লেখা যায় না। মাকে নিয়ে লিখতে গেলে কলমে কালি প্রসব হয় না, হয় চোখের নোনাজল।
গতকাল বাড়ি এসেছি।পূর্ণিমার গোলগাল চাঁদটি দিনের মতো আলো ছড়াচ্ছে। ঘুম আসছে না আজ। বারান্দায় গিয়ে দেখি হাসনাহেনায় ফুল এসেছে।এক অন্যরকম মাদকতায় ভরে গেছে বাড়িটা। মা’র গাছটিতে (মায়ের লাগানো আমগাছ) এবার গুঁটি এসেছে খুব বেশি। দক্ষিণা বাতাসে দুলছে কচি আমগুলো। তিন পায়ে ভর করে চলা কুকুরটাও বসে আছে সিঁড়িপথে। তার কোনো চিৎকার নেই। তাকে এত শান্ত দেখিনি আগে কখনো। চিচিঙ্গার মাচায়ও ছোঁয়া লেগেছে এই ফাগুনের।ভ্রমরদের উঁকিঝুঁকি। খোয়াড়ের রাজহাঁসগুলো চেঁচামিচি করছে।রাণীটা (হাঁসি) নাকি গতকাল প্রথম ডিম দিয়েছে। মা থাকলে কী যে খুশি হতেন!
মা’র কবরটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। মসজিদের পাশে বাবা-মার জোড়া কবর। বাবার কবরের গুবাকতরুতে বারমাসী ফল এসেছে। মায়ের কবরে লাগানো বৃক্ষ শাবকরাও টিকে যাওয়ার আভাস দিচ্ছে। পশ্চিম আকাশে হেলেপড়া রূপবতী চাঁদটিতে আলোর বন্যা। পূর্ণিমার আলো ঠিকরে পড়েছে নতুন বাঁধানো কবরে। বেলে মাটিতে চিকচিক করে ওঠা লাস্যময়ী জোছনা যেন লুকোচুরি খেলছে। এ এক অপরূপ মায়া, অদ্ভুত সৌন্দর্য! আমি দু’চোখ ভরে দেখছি, সে রূপের মেলা। অতৃপ্ত নয়ন ফিরে আসতে চায় না আজ।
দু’বছর আগে একটি প্রশিক্ষণে ইন্ডিয়া যাওয়ার কথা ছিল। মায়ের অসুস্থতার কারণে যাওয়া হয়নি। সম্রাট শাহজাহানের যে অমর কীর্তি দেখতে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ছুটে আসে মানুষ, খুব কাছে থেকেও তা না দেখার অতৃপ্তি থেকেই গিয়েছিল আমার। ভাবলাম, মা সুস্থ হোক, তারপর যাব, দেখে আসব যমুনাতীরের মর্মর পাথরের রূপগাঁথা।কিন্তু আজ এ ভরা পূর্ণিমায় আমার সে ভাবনায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এলো।আমাকে আর যমুনাতীর যেতে হবে না। এই তো আমার তাজমহল।