কবি জসীম উদ্দীনের ভ্রমণকাহিনি ‘চলে মুসাফির’ পড়েছিলাম ক্লাস এইটে থাকতে, আশির দশকে। এরপর তার আর কোনো গদ্যগ্রন্থ পড়িনি। এখন এমন একটা সময়, যখন জসীম উদ্দীন আদৌ কবি কি না, এই প্রশ্ন উঠছে তরুণ কবিদের মধ্যে। জসীম উদ্দীনের প্রবন্ধ-নিবন্ধ দুই খণ্ডে ‘প্রবন্ধসমূহ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান পলাশ প্রকাশনী থেকে।
প্রথম খণ্ডে আছে সতেরোটি প্রবন্ধ, আর দ্বিতীয় খণ্ডে আছে চৌদ্দটি। এগুলো লেখকের কবিতার মতোই সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। তত্ত্ব নেই, ভাষায় চমক নেই, আকর্ষণীয় কোনো বাকপ্রতিমা নেই। তবে জসীম উদ্দীন বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন, বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেছেন, অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সান্নিধ্যে গিয়েছেন, মিশেছেন। তিনি অনেক কিছু দেখেছেন, শুনেছেন, জেনেছেন, বুঝেছেন। তার অভিজ্ঞতা অনেক। তার প্রবন্ধে তাই তত্ত্ব আশা করা না গেলেও তথ্য পাওয়া যায়। তার বেশিরভাগ প্রবন্ধই প্রবন্ধ হয়ে ওঠেনি।
রচনাভঙ্গির দিক থেকে জসীম উদ্দীনের প্রবন্ধ ব্যক্তিনিষ্ঠ। বঙ্কিমচন্দ্র, রামেন্দ্রসুন্দর প্রমুখ বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ লিখেছেন ইংরেজি প্রবন্ধের স্টাইলে। এরপর রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধ রচনায় ঔৎকর্ষ দেখান। এরপর থেকে কবিরা ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধই বেশি লিখেছেন। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথসহ অনেকেই লিখেছেন। জসীম উদ্দীনও সে পথেই এগিয়েছেন।
জসীম উদ্দীনের প্রবন্ধের বিষয়বস্তু বিচিত্র। বইকেনা, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, গণসাহিত্য, সাহিত্যের সমস্যা, লোকনাট্য, লোকগান, নকশিকাঁথা, শাড়ি, মেঘনা নদী, ছড়া, হাসির গল্প, পাঁচালী, প্রথম লেখা, লাইব্রেরী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা, বাংলা ভাষায় আরবি হরফ ব্যবহারের প্রতিবাদ, দাঙ্গা, স্বদেশ, বন্ধু হাবিবুল্লাহ বাহারের স্মৃতি, মহাশূন্যে অভিযান, শল্যবিদ্যার জনকের কথা, মুক্তিযুদ্ধের একাধিক স্মৃতি, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্মৃতি পল্লী লক্ষ্মীর আঙিনা ইত্যাদি। একত্রিশটি প্রবন্ধের মধ্যে একটি ইংরেজি রচনাও আছে Folk Songs of East Bengalনামে।
আগেই বলেছি, জসীম উদ্দীনের প্রবন্ধে তত্ত্ব নেই, কিছু তথ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন দেশের লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতি, পল্লীর গান ও কবিতা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। তবে কবির নিজস্ব চিন্তা ধারণ করেছে, এমন প্রবন্ধ অতি অল্প। এর মধ্যে ‘গণসাহিত্য’ উল্লেখযোগ্য। এ রচনায় লেখকের শক্ত অবস্থান দেখা যায়। তিনি বিশ্বসাহিত্যের হোমার, শেক্সপিয়র, তলস্তয়, কালিদাস, দান্তে, ভার্জিল, আরব্যরজনী, জাতকের গল্প, বাইবেলের গল্পসহ সবার রচনাকেই গণসাহিত্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, চণ্ডীদাস, লোচনদাস, বংশীদাস, বলরাম দাস, কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম সবার রচনাকে, এমনকী হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্রকেও সে ধারার বলে গণ্য করেছেন।এ প্রবন্ধে তিনি মাইকেলের প্রতিভার প্রশংসা করেছেন কিন্তু পশ্চিমের ভিখারি হওয়ার সমালোচনা করেছেন। কবি আবদুল কাদিরকে লেখা এক ব্যক্তিগত পত্র ‘সওগাত’ পত্রিকায় ১৩৫০ সনের আশ্বিন সংখ্যায় প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘গণসাহিত্য’ নামে।
জসীম উদ্দীনের প্রায় সব প্রবন্ধই সাধু ভাষায় লেখা হলেও সময়ের দিক থেকে সবচেয়ে আগের এই প্রবন্ধটি চলতি গদ্যে লেখা। ব্রিটিশ আমলে লেখা ‘গণসাহিত্য’ প্রবন্ধে লেখকের উপনিবেশবিরোধী, সাম্রাজ্যবিরোধী চিন্তা এবং স্বদেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম আন্তরিকতা প্রকাশিত হয়েছে। কঠোর মন্তব্যে তিনি লিখেছেন, ‘ইংরেজ আগমনের পরে ইউরোপের তীব্র মদিরা পান করে আমরা ধীরে ধীরে সব খোয়ালাম।’
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কবিদের মধ্যে সম্ভবত আর কোনো কবিই ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এমন তীব্র ভাষায় মন্তব্য করেননি। কবি তার নিজের সাহিত্যচিন্তার পক্ষে জন রাসকিনের মন্তব্য Greatest pleasure for the number of men for the longest time ব্যবহার করেছেন। এই একটি প্রবন্ধেই জসীম উদ্দীনের অনেক চিন্তা, অনেক কথা ধারণ করেছে। তার অন্য রচনাগুলো যদি এমন সমৃদ্ধ হতো, তাহলে পড়ে গবেষণাযোগ্য অনেক দিক পাওয়া যেতো।
জসীমউদদীন তাঁর সমকালের নতুন ধারার সাহিত্য মেনে নিতে পারেননি। কায়কোবাদ বা দ্বিজেন্দ্রলাল যেমন রবীন্দ্রনাথের নতুন কবিতা মেনে নিতে পারেননি, তেমনই জসীম উদ্দীন অনিচ্ছা নিয়ে নতুনদের কবিতার স্বীকৃতি দিয়েছেন, কিন্তু বিনিময়ে নিজের কবিতারীতির স্বীকৃতিও চেয়েছেন। সাহিত্যে তিনি সকলের সহাবস্থান চেয়েছেন। ‘আমরাই আসল কবি, তুমি কিছুই না’-মার্কা মন্তব্য ও চিন্তার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তবে জসীম উদ্দীনে সমকাল নেই, স্বকালের মানুষের গতি প্রকৃতি বুঝে ওঠার স্বাক্ষরও নেই।