আমার বাল্যবন্ধুদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ডাক্তার, একজনের মাস্টার, একজনের ঈমাম। পরবর্তী জীবনে ডাক্তার হয়েছে রাখাল, মাস্টার হয়েছে মাছের আড়ৎতার। ঈমাম চালায় রিকশা। (মাস্টার, ডাক্তার, ঈমাম, রাখাল, শিক্ষক, মাছের আড়ৎতার, রিকশাচালকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক)। আসলেই শখের বসে বাবা-মা সন্তানের যে নাম রাখেন, প্রায় দেখা যায় সেই নামের সঙ্গে কাজের মিল থাকে না।
এ সময়ে এসে দেখি—অনেকেই শখের বসে কিছু কিছু বাক্য-স্তবক লেখেন। লিখে আবার সেগুলোর পরিচয় দাবি করেন কবিতা। আবার ওই সব তথাকথিত ‘কবিতা’ দিয়ে বইও প্রকাশ করেন। (সেসব বই নাকি আবার দশ দিনে হাজার কপিও বিক্রি হয়! অবশ্যই বিক্রির বিষয়টি তারা নিজেরাই ঢোল পিটিয়ে জানান দেন)। তাদের কেউ কেউ আবার আমাকে ইনবক্সে তাদের লেখাগুলো পাঠান, বলেন পড়ে যেন মন্তব্য করি। কী মন্তব্য করব ভাবতে ভাবতে দিন শেষ হয়ে যায়। তাদের অনেকেরই রচনারাজি পড়লে আমার শৈশবের ওই তিনবন্ধুর কথা মনে পড়ে। যারা নামের সঙ্গে কাজের সাদৃশ্য রাখতে পারেননি। তাদের উদ্দেশে বলতে হয়—দুঃখিত! আপনাদের সামনে ‘কবিতা’ লেখা ছাড়া আরও অনেক মহৎ কাজ আছে। সেসব যদি করেন, তাহলে আপনাদের পরিবার, সমাজ উপকৃত হবে। পণ্ডশ্রম করে সময় নষ্ট করছেন। পরে দোষ দেবেন সমাজের। সবাই আপনাদের ‘কবি’-‘কবি’ বলে মুখে ফেনা তুললেই আপনারা কবি হয়ে যাবেন না। কবি অন্য সত্তা, অন্য বস্তু। যা কখনো আপনারা বুঝতেই পারবেন না। কারণ জন্মের পরই আপনাদের বাবা-মা শখ করে নাম রেখেছেন ডাক্তার, মাস্টার, ঈমাম। তারা পরিণত হন—রাখাল, মাছের আড়ৎদার কিংবা রিকশা শ্রমিকে। অতএব কবিযশ প্রার্থীগণ পদের জোরে, টাকার জোরে, মিডিয়ার জোরে, ফেসবুকে সেলিব্রিটি হওয়ার জোরে যারা কবি হতে চান, সত্যিকার অর্থে যদি কবিতার ছন্দ-প্রকরণ-আঙ্গিক না শেখেন, তাহলে একদিন আপনাদের জন্য অপেক্ষা করবে চরম পরিহাস!
এদিকে, পদের জোরে, মিডিয়ার জোরে, ফেসবুকে সেলিব্রিটি হওয়ার জোরে যারা কবি হতে এসেছেন, তারা দাবি করেন, যত বড় কবি, তত বেশি বই বিক্রি! এখন যার বই বেশি বিক্রি হয়, তিনি নিজেকে বড় লেখক মনে করেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখা ভালো, বড় লেখক হওয়ার সঙ্গে বই বিক্রির সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। তবে এ কথাও সত্য, কখনো কখনো বড় লেখকের বই বাজারে বেশি কাটে, কখনো কখনো গণরুচির জোগানদাতার বই। বই বেশি বিক্রি হলেই যে বড় লেখক হয়ে গেলেন, তা কিন্তু নয়। যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা হাসান আজিজুল হকের বই যদি বিশ কপি বিক্রি হয়, তো কাসেম বিন আবু বাকারের (কাসেম বিন আবু বাকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক) বই বিক্রি হয় দুই লাখ কপি।
সাহিত্যের মান বিচার যারা করেন, উপন্যাস নিয়ে যারা আলোচনা-সমালোচনা করেন, তাদের আলোচনার একটি বড় অংশ ইলিয়াস-হাসান দখল করে রাখলেও, কোনো সমালোচনামূলক প্রবন্ধে কাসেম বিন আবু বাকারের নামও উচ্চারিত হয় না। ভবিষ্যতেও হওয়ার কোনো আশঙ্কা (সম্ভাবনা) নেই। আসলে গণরুচি আর সাহিত্য রুচি দু’টি আলাদা বিষয়। বিষয়টি আমরা যত দ্রুত বুঝব, তত দ্রুত মঙ্গল।