টেরাকোটা লাতিন শব্দ। এর অর্থ মাটি, আর ‘কোটা’ অর্থ পোড়ানো। পোড়ামাটির ফলকের আরেক নাম টেরাকোটা। মানুষের ব্যবহার্য পোড়ামাটির তৈরি সব ধরনের দ্রব্য টেরাকোটা নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের বহু পুরনো শিল্পগুলোর মধ্যে এটি একটি। মাটির ফলকে নকশা কিংবা ছবি আঁকার পর তা পুড়িয়ে বানানো হয় টেরাকোটা। আঠালো মাটির সঙ্গে তুষ, খড়কুটো মিশিয়ে কাদামাটি প্রস্তুত করা হয়। সেই মাটি থেকে মূর্তি, দৃশ্যাবলি তৈরি করে রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে টেরাকোটা তৈরি করা হয়। মানবসভ্যতার বিকাশকাল থেকেই এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে টেরাকোটার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির। ১৮ শতকে নির্মিত একটি অনবদ্য স্থাপনা এটি। এই মন্দিরের বিশেষত্ব, পুরো মন্দিরটি প্রায় ১৫ হাজার টেরাকোটা টালি দিয়ে দিয়ে মোড়ানো। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি, দ্বিতীয় তলায় ২৭টি ও তৃতীয় তলায় মাত্র ৩টি দরজা রয়েছে। যা খিলান নামে পরিচিত।
দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ রোডের কান্তবাজার থেকে একটু ভেতরে ঐতিহাসিক কান্তজির মন্দির। টেরাকোটার বড় নিদর্শন হলো এই মন্দির। এটাকে কান্তজিও বলে অনেকে। টেপা নদীর তীরে দিনাজপুর থেকে ১৩ কিলো মিটার দূরে অবস্থিত এ স্থাপনাটি মন ভরাবে যে কারও।
বাংলার স্থাপত্যগুলোর মধ্যে বিখ্যাত এ মন্দিরটির বিশিষ্টতার অন্যতম কারণ হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনীগুলো পোড়ামাটির অলঙ্করণে দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ টেরাকোটা শিল্পের নির্দশন রয়েছে এ মন্দিরে। জমকালো পিরামিড আকৃতির এ মন্দিরটি তিনটি ধাপে ওপরে উঠে গেছে। তিন ধাপের কোণগুলোর ওপরে মোট নয়টি অলঙ্কৃত শিখর বা রত্ন রয়েছে, যা দেখে মনে হয় যেন একটি উচুঁ ভিত্তির ওপর প্রকাণ্ড রথ দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের চারদিকে খোলা খিলান পথ রয়েছে, যেন যেকোনো দিক থেকেই পূজারীরা ভেতরে রাখা দেবমূর্তিকে দেখতে পায়।
বর্ণনা থেকে জানা যায়, দিনাজপুরের মহারাজা প্রাণনাথ ১৭০৪ সালে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তার মৃত্যু সময়ের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার পালক পুত্র রামনাথ এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ চলমান রাখেন। ১৭৫২ সালে তা শেষ করেন। কান্তজিউ মন্দির নির্মাণে সময় লেগেছিল ৪৮ বছর। তিনতালা এ মন্দিরটির প্রাঙ্গণ আয়তাকার হলেও মন্দিরটি বর্গাকৃতির (৫০ ফুট বাই ৫০ ফুট) ও ৩ ফুট উঁচু একটি পাথরের বেদীর ওপর নির্মিত; বেদীটিও বর্গাকৃতির (৬০ ফুট বাই ৬০ফুট)। একসময় এ মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। চূড়াগুলো ভেঙে যাওয়ার পর এখন উচ্চতা ৫০ ফুট। মন্দিরের পুরো দেওয়ালে টেরাকোটার কাজ। টেরাকোটার পরম্পরার ধারাবাহিকতা রয়েছে। রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি; এ চারটি শাস্ত্রীর যুগের পৌরাণিক কাহিনীগুলো মন্দিরের চার দেয়ালে চিত্রায়িত।
কিভাবে যেতে পারেন
বাস ও ট্রেন দুভাবেই ঢাকা থেকে দিনাজপুর যাওয়া যায়। তবে ট্রেনে যাতায়াত আরামদায়ক। ঢাকা থেকে দিনাজপুর যেতে সময় লাগে ৮/৯ ঘণ্টা। ঢাকার কমলাপুর থেকে ২টি আন্তঃনগর ট্রেন দিনাজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। দ্রুতযান এক্সপ্রেস কমলাপুর থেকে সন্ধ্যা ৭.৫০ মিনিটে ছেড়ে যায়, দিনাজপুর গিয়ে পৌঁছায় সকাল ৫.১০ মিনিটে। একতা এক্সপ্রেস সকাল ৯.৫০ মিনিটে কমলাপুর থেকে ছেড়ে সন্ধ্যা ৭.২০ মিনিটে দিনাজপুর গিয়ে পৌঁছায়।
ঢাকার গাবতলী থেকে নাবিল পরিবহন, হানিফ পরিবহন, শ্যামলী, সেফ লাইন, এসকে ট্রাভেলস, কেয়া পরিবহন, বাবুল পরিবহন, এসএ পরিবহনসহ সড়কপথে বেশ কয়েকটি বাস সার্ভিস রয়েছে। এছাড়া উত্তরা থেকেও কিছু পরিবহন দিনাজপুর যায়। তবে দিনের বেলা গেলে বাস এড়িয়ে চলাটাই ভালো। ট্রেনের ভাড়া শ্রেণীভেদে ৫০০ টাকা থেকে শুরু। আর বাসে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা (মান অনুযায়ী)।
থাকা-খাওয়া
দিনাজপুর শহরে থাকার জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেলসহ বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন হোটেল পাওয়া যাবে। আপনার পছন্দমতো যেকোনো হোটেলে থাকতে ও খেতে পারবেন! দিনাজপুর স্টেশনের পাশেই বিভিন্ন দাম ও মানের থাকা-খাওয়ার হোটেল পাবেন। স্টেশন ভ্রমণ স্পটের মাঝামাঝি হবে।