শাহাদুজ্জামানের প্রথম দুটি গল্পের বই ‘কয়েকটি বিহবল গল্প’ ও ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ’ শুরুতেই পড়েছিলাম। এরপর তার আর কোনো বই পড়িনি। সদ্য প্রয়াত রবিশঙ্কর বলের দুইয়েকটা গল্প বিচ্ছিন্নভাবে পড়েছি, কোনো বই পড়া হয়নি।
সম্প্রতি এই দুজন লেখকের দুটি উপন্যাস পড়লাম। শাহাদুজ্জামানের ‘একজন কমলালেবু’ এবং রবিশঙ্কর বলের ‘দোজখনামা’। দুটি উপন্যাসই কবিকে নিয়ে লেখা। মানে কথাসাহিত্যিকের চোখে কবি। আলোচ্য দুই উপন্যাসে বিস্তৃত দুই কবিই মহান কবি। উপমহাদেশে, এমনকী বিশ্বসাহিত্যেও। শাহাদুজ্জামান লিখেছেন জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে, আর রবিশঙ্কর বল লিখেছেন মির্জা গালিবকে নিয়ে। একজন বাংলাসাহিত্যের বড় কবি, অন্যজন উর্দুসাহিত্যের মহান কবি।
শাহাদুজ্জামানের লেখাটি পরিশ্রমলব্ধ, গবেষণামূলক। রবিশঙ্কর বলের উপন্যাসটি আরও বেশি শ্রমলব্ধ ও বর্ণনামূলক। কমলালেবুর লেখক প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে লিখেছেন, কল্পনার ডানা ওড়াতে পারেননি, কিন্তু দোজখনামার লেখক মির্জা গালিবের উর্দু ভাষা শিখে নিয়েছেন। গালিব উনিশ শতকের কবি, তার ভাষা আজকের দিল্লি, লাহোর, লখনউ, এলাহাবাদের মিডিয়ার তরল উর্দু না। অনেকটা বিদ্যাসাগরীয় বাংলার মতো। শুধু উর্দু ভাষা শেখাই না, দিল্লি, আগ্রা, লখনউসহ উত্তর ভারতের মুসলমানদের ইতিহাস, ভূগোল, জ্ঞানবিদ্যা, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম, দর্শনসহ সুফিবাদের বিশাল আয়তন, আরব, পারস্য, মধ্য এশিয়ার নানা তরিকা, রুমি, জামি, সাদি, খৈয়াম প্রমুখ কবিকেও একই উপন্যাসে উপস্থিত করেছেন। উপন্যাসটি লিখেছেন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে। পাকিস্তানের অন্যতম সেরা উর্দু লেখক সাদাত হাসান মান্টোর সাথে গালিবের সংলাপে। মান্টো বিশ শতকের গল্পকার। জন্মস্থান ভারতে, দেশভাগের পরে পাকিস্তান চলে যান। ‘ঠান্ডা গোস্ত’র মতো গল্প লিখে তিনি কুখ্যাত হন। রবিশঙ্কর বল তার উপন্যাসে দুই শতাব্দীর দুই উর্দু লেখককে একত্র করেছেন। তাদের সংলাপের ভেতর দিয়ে তকী মীর প্রমুখ সমসাময়িক কবির কথাও উঠে এসেছে। বাবর-হুমায়ুনের রাজত্ব থেকে সমকালীন রাজনীতি পর্যন্ত সমাজ-রাজনীতির নানা দিক উঠে এসেছে।
দোজখনামার লেখককে যতটা সাহসী মনে হয়েছে কমলালেবুর লেখককে সে তুলনায় সাহসী মনে হয়নি। তবে শাহাদুজ্জামানও জীবনানন্দ দাশের সমসাময়িক অনেককে টেনে এনেছেন। তবে জীবনানন্দকে নিয়ে তিনি নানা কারণেই প্রাপ্ত তথ্যের বাইরে গিয়ে চিন্তা ও কল্পনার বিস্তার ঘটাতে পারেননি। জীবনানন্দের চিন্তার জগৎ আধুনিক কালের এবং জটাজটিল। তাকে নিয়ে স্বাধীনভাবে লেখা কঠিন। এর প্রকাশিত কারণ তার কবিতা। জীবনানন্দের কবিতায় গালিবের কবিতার মতো সরল অর্থ নেই, দুই স্তর বা তিন স্তরের অর্থ করা যায়। এখান থেকে জীবনানন্দের চিন্তার কাঠামোর রূপরেখা আঁকা সত্যিই কঠিন।