যমুনা সেতু ও বগুড়া
আমার জন্ম শালগাড়িয়া, পাবনা জেলায়। আমার নানাবাড়ি। এখানের যে বাড়িটিতে আমার জন্ম, সেই বাড়িটি আজ নেই। না, কথাটি ঠিক পুরো সত্যি হলো না। বাড়িটি আছে, তবে সেই বাড়ির ওপর আর আমাদের অধিকার নেই। নানা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। নানি বেঁচে আছেন, তবে তার পক্ষে একা পাবনায় থাকা সম্ভব নয়। তিনি মামাদের সঙ্গে থাকেন। মামারা সবাই পেশাগত কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেহেতু নানির পক্ষে একা থাকা সম্ভব না, আর মামাদেরও কেউ পাবনায় ফিরে যাবেন না, তাই বাড়িটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
বাড়িটিকে আমার খুব মনে পড়ে। চোখ বন্ধ করলেই বাড়িটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাড়ির পেছনে একটি পরিত্যক্ত পুকুর। ওখানে, বড়শি ফেলে মাছ ধরতাম। পুকুর ভর্তি ছিল কচুরিপানা। ওখানে অনেক ডাহুক পাখি ছিল। যখন নানাবাড়িতে যেতাম, তখন আমি আর ছোটমামা ফাঁদ পাততাম। মাঝে মাঝে ডাহুক পাখি ধরা পড়তো আমাদের পাতা ফাঁদে। বাড়িতে ছিল নারকেল আর সুপারি গাছের সারি। কাঠের কালো রঙের দরজা। বাড়ির ভেতরের বাঁধনো কুয়া। উঠোনে ছড়িয়ে পড়া নারকেলের শেকড়। ঘরের ভেতরে নানা-নানির পান খাবার জর্দার ঘ্রাণ। পিতলের পানের বাঁটা। কলসের ভেতরে ডুবিয়ে রাখা পাকা সুপারি।
এখানে বাতাসের সঙ্গে আমার সখ্য
এখানে এই শহরে আমার খুব বেশি থাকা হয়নি। যদিও ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি। মনে পড়ে সেইসব দিন। ফেলে আসা সময়। ‘ভুলে যাওয়ার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মনে রাখা একপ্রকার প্রতিবাদ’— বলেছিলেন চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা। আর মনে রাখার বিষয়টিকে কবি শামসুর রাহমান জীবনযাপনের অংশ হিসেবেই দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মূলত স্মৃতি এক প্রকার জীবনযাপন।’ আমিও স্মৃতিকে প্রতিবাদ হিসেবে না দেখে জীবনযাপন হিসেবেই দেখতে ভালোবাসি। স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে আমি হারিয়ে ফেলা সময়কে যেমন খুঁজে ফিরি, তেমনি খুঁজে ফিরি আমার জীবনের অংশগুলো। খণ্ড খণ্ড আমির মধ্য দিয়েই তো পূর্ণাঙ্গ আমি। আমি বেড়ে উঠেছি সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, আর বগুড়ায়। এছাড়া নানা কাজে, নানান প্রয়োজনে দেশের ভেতরের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতেও যাওয়া হয়েছে। তবে তার পরিমাণ খুব বেশি না। অথচ বেড়াতে ভালো লাগে। আবার একা ঘুরতেও ইচ্ছে করে না। ভালো লাগে সবাই মিলে, হৈ চৈ করে বেড়াতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তা হয় না। এখন তো সময়ই নেই। সংবাদমাধ্যমের কাজে ছুটির সুযোগ কম। যেটুকু পাওয়া যায়, তাও অধিকাংশ সময়েই কাজে লাগানো যায় না। যে কটি জায়গায় বেড়াতে গেছি, ভালো লেগেছে তার সবগুলোই, নানা কারণে। বারে বারে সেই জায়গাগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু কোথাও থেকে যেতে ইচ্ছে হয়নি (ব্যতিক্রম ভুটান)। বিশ্বের অনেক জায়গাতেই বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সাধ আছে সাধ্য নেই। অথচ বগুড়া আমার কাছে অন্যরকম।
প্রতিবার বগুড়া যাওয়ার সময়, যখন যমুনা সেতু পার হই, মনে হয় ফিরে এলাম মাটির কাছে। নিজস্ব শহরে। এই মাটি আমার চেনা। এই মাটি আমাকে চেনে। এখানে বাতাসের সঙ্গে আমার সখ্য। এখানে বাতাসের ঘ্রাণ আমাকে উতলা করে। তাই বগুড়ার মতো প্রিয় আর কোন স্থানই হয়নি বগুড়ার কথা মনে হলে, এখনো প্রাণচাঞ্চল্য অনুভব করি। বাড়ি যাওয়ার কথা মনে হলেই, শিশুর আনন্দ আমাকে ছুঁয়ে যায়। রাজধানী থেকে প্রতিবার যখন বগুড়ার পথে বের হই, প্রতিবারই একই টান হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করি। এই টান পূর্ণতা পায় যমুনা সেতু এলে।
কতবার চাকরি ছেড়েছি
উত্তরবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করেছিল যমুনা নদী। একসময় এই নদী পেরিয়ে উত্তরের খুব কম মানুষই রাজধানীতে আসতো। নেহায়েত প্রয়োজন না হলে, কেউ ঢাকায় আসার কথা চিন্তা করত না। সেই নদীতে ব্রিজ হবে। আমাদের আগের কেউ হয়তো ভাবতেই পারেনি কখনো। ‘যমুনা নদীতে ব্রিজ হবে’ শুনে—স্পষ্ট মনে আছে, আব্বা বলেছিলেন, ‘আমরা মনে হয় এ ব্রিজ দেখে যেতে পারব না। তোমরা দেখবে।’ অথচ সেই ব্রিজ হলো। আমার আব্বাও দেখতে পেলেন। আমি সেতু তৈরির সময়েই দেখতে এসেছিলাম। সেতুর নির্মাণ কাজ দেখার উদ্দেশ্যে আমরা কলেজ থেকে এসেছিলাম শিক্ষাসফরে। তখন, যমুনা পাড়ে এসে দেখি—মাঝ নদীতে বড় বড় পিলার উঠছে। নদীর ভেতরে এক মহাযজ্ঞ চলছে। দুপাড়ে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। এলাহি ব্যাপার। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি তখন। একসময় সেতু নির্মাণ শেষ হলো। সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হলো। সেতু দেখলাম, নির্মাণ শেষ হওয়ার কয়েক মাস পর।
বইমেলা উপলক্ষে ঢাকা এলাম। ব্রিজের ওপর আমাদের কয়েকজনের অনুরোধে চালক সেতুর ওপর বাস থামলো। এখন তো ব্রিজের ওপর বাস থামানো নিষেধ। আর এত গাড়ির চাপ, বাস থামানোরও উপায় নেই। তখন, প্রথম প্রথম থামানো যেত, কেউ কিছু বলতো না। ব্রিজের ওপর হাঁটলাম। সেতুর ক্রংক্রিট ছুঁয়ে দেখলাম। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম। তখনই দেখেছি, নদীর মরে যাওয়ার বেদনা। সেতুর নিচে, বহুদূর পর্যন্ত চর জেগে উঠেছে। সেতু হলো, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হলো। প্রথম প্রথম সাড়ে তিন ঘণ্টা থেকে চার ঘণ্টার ভেতরে ঢাকা চলে আসতে পারতাম। সেই সুযোগে উত্তরের লোক বাড়তে লাগলো রাজধানীতে। আমিও একসময় চলে এলাম। সেই সেতু, সেই সেতু—আমাকে নিয়ে এলো এই শহরে। কতদিন রাস্তায় হাঁটার সময় চোখের পানি গড়িয়ে পড়েছে। রাস্তায় হাঁটতাম, এলোমেলো। এই শহর ভালো লাগতো না। কতবার বাড়ি ফিরে গেছি, এ শহরে থাকব না ভেবে। কতবার চাকরি ছেড়েছি। থাকব না, ভালো লাগে না। বগুড়া গিয়ে চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকতাম। বন্ধুরা শহরে কেউ নেই। সবাই কোথাও না কোথাও চাকরি করে। আড্ডা দেওয়ার মতো কেউ নেই। কিছু দিন বসে থাকার পর, আবার অস্থির হয়ে যেতাম। আবার সেতু পেরিয়ে চলে আসতাম ঢাকা। এই করে করে টিকে গেলাম। যদিও আজও আমার মন স্থির হয়নি ঢাকায়। এখনো সময়, সুযোগ পেলেই চলে যাই বগুড়া। যেহেতু এই সেতু আমাদের যোগাযোগ সহজ করে দিয়েছে। তাই এই সেতু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর এই সেতু পেরুলেই বুঝতে পারি, চলে এসেছি বগুড়ার কাছাকাছি। সেতু পেরুলেই শুদ্ধ বাতাসের অস্তিত্ব টের পাই। সেতু পেরুলেই মাটির গন্ধ বুঝতে পারি। সেতু পেরুলেই আমি আমার মা’র স্পর্শ পাই। আমার প্রিয় শহরের অস্তিত্ব টের পাই। তাই প্রতিবার যমুনা সেতু পেরুনোর সময় প্রিয়জনদের জানিয়ে দেই—চলে এসেছি, আমি চলে এসেছি প্রিয় শহরের কাছে। আমি চাই, ‘সকল ভ্রমণ শেষে বগুড়ায়’ ফিরে যেতে।
চলবে…