চতুর্থ পর্ব:
আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সংকলনে সর্বশেষ কবি ছিলেন সুভাষচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (জ. ১৯১৯)। বুদ্ধদেব বসুর সংকলনের সর্বশেষ সংস্করণের সর্বশেষ কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত (জ. ১৯৩৭), হুমায়ুন আজাদের হুমায়ুন কবির (জ.১৯৪৮)। দুই দশকে বুদ্ধদেব বসু সর্বশেষ যে কবিকে অন্তুর্ভুক্ত করলেন, তিনি প্রথম সংকলনে অন্তর্ভুক্ত কণিষ্ঠ কবির দুই দশকের অনুজ। দশকের বিচারে পঞ্চাশের দশকের। কবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বোধ হয় সময়ের নিরিখটা মানতে গিয়ে এখানে জন্মসালকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর সর্বশেষ সংকলনের দুই দশক পরে বের করা হুমায়ুন আজাদ তার সংকলনের সর্বশেষ কবি হিসেবে যাঁকে রাখলেন তাঁর জন্ম প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের এক দশক পরে। সময়ে বিচারে ষাটের দশকের। তার মানে হুমায়ুন আজাদ জন্মসালকে আরও গুরুত্ব দিলেন। বিষয়টি এভাবে না বলে যদি বলা যায় হুমায়ুন আজাদ অপেক্ষাকৃত অগ্রজ কবিদের প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন, তাও খুব একটা ভুল হয় না। সময়ের এই হিসাবের আরেকটি কারণ হলো বুদ্ধদেব বসু প্রত্যেকটি নতুন সংস্করণে নতুন কবিদের সংযোজন করছেন, সময়ের কাছে পরীক্ষা দিয়ে পাস করার আগেই তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করার ঝুঁকি নিচ্ছেন, সেখানে হুমায়ুন আজাদ দুই দশক পরে বের করা সংকলনে অপেক্ষাকৃত আগের সময়ের কবিদের অন্তর্ভুক্ত করছেন। এক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুকেই প্রকৃত সাহসী বলতে হয়। কারণ সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যাওয়ার বা অনুপযুক্ত প্রমাণ হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে প্রয়াসী তিনি। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ এ রকম কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। এমনকি কয়েক দশক ধরে চর্চায় অব্যাহত রাখা প্রশংসিত কবিদেরও তিনি অন্তর্ভুক্ত করেননি।
হুমায়ুন আজাদ ১৯৬০ সালের পরে আবির্ভূত কবিদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাঁর একদশক পরের কবি বাদই থাক, তিনি নিজের দশকেরও প্রকৃত মূল্যায়ন করেননি। এ রকম কথাও শোনা গেছে যে, তিনি আসলে দেখাতে চেয়েছেন, তিনিই শেষ আধুনিক কবি। তিনি যদি সময়ের কাছে পরীক্ষা দেওয়ার নিরিখকে প্রাধান্য দিতেন, তাহলে দশ বছর পরে বের হওয়া সর্বশেষ সংস্করণেও সত্তর-আশির দশকের না হোক ষাটের অগ্রগণ্য কবিদের অন্তর্ভুক্ত করতেন। তিনি তা করেননি। তিনি সংস্করণের চেয়ে পুনর্মুদ্রণকে অধিকতর গুরুত্ববহ মনে করেছেন। অথবা নিজের একদা কর্ম নিয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, আধুনিকতা যে চলমান প্রপঞ্চ এবং নবায়নপ্রিয় তাও ভুলে গিয়েছিলেন। তাতে আধুনিকতার প্যাঁচে নিজেকে আটকানো সম্পাদক হিসেবেই তিনি নিজেকে প্রামাণ করে গেছেন।
এটা করতে গিয়ে পূর্ববর্তী সংকলনের মতো এ সংকলনটিকেও তিনি খণ্ডিত দোষে দুষ্ট করেছেন। এই দুষ্টু দোষ তিনি দু’ভাবে করেছেন।
প্রথমত, মধ্য নব্বইয়ে এসে আধুনিক কবিতার সংকলন করতে গিয়ে যদি সর্বশেষ কবি হিসেব ষাট দশককে বেছে নেওয়া হয়ই এমনকি প্রথম প্রকাশের দশ বছর পরও নতুন সংস্করণে আর কারও অন্তর্ভুক্তি না আনা হয়, তাহলে এখানে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। সেগুলো হলো, তিনি আধুনিক কবিতার কাল-খণ্ড হিসেবে নিজের সময়কে আপাতত সর্বশেষ কালখণ্ড মনে করেন; তার সময়ের পর চল্লিশ বছর কেটে গেলেও আধুনিকতাকে প্রবহমান করে রাখার মতো কোনো কবির জন্ম হয়নি। আমরা জানি, যেকোনো আবালও যে কোনো সংকলন করতে গিয়ে এ রকম দোষে দুষ্ট করবেন না তার পরিশ্রমকে। দুঃখজনক হলেও সত্য—হুমায়ুন আজাদ সেটিই করেছেন। তিনি নিজের আবির্ভাবকালকেই সর্বশেষ অংশ হিসেবে মনে করলেও এই দশকের উজ্জ্বল কয়েকটি নক্ষত্রকে কুণ্ঠাহীন বাদ দিয়েছেন। তাঁদের বাদ দেওয়ার জন্য ন্যূনতম ব্যখ্যা দেওয়ার সৌজন্যও বোধ করেননি। যেমন তাঁর সংকলনে আলতাফ হোসেনের কবিতা নেই। নেই মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা। আরও উল্লেখযোগ্য অনেকের সঙ্গে নেই সানাউল হক খান কিংবা হেলাল হাফিজ।
দ্বিতীয়ত, দুই বাংলা একত্রিকরণেও হুমায়ুন আজাদ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, পক্ষপাত দোষে দুষ্ট বলার সুযোগও দিয়েছেন তিনি। বাংলা কবিতার ইতিহাস কিংবা সমালোচনা কিংবা সংকলন যেটাই বলি না কেন, সেটা করতে গেলে কোনো এক বাংলাকে নিয়ে করা এবং অন্য বাংলাকে বাদ দেওয়াটা হবে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট এবং যে চিত্রটা উঠে আসবে, তা নিঃসন্দেহে আংশিক ও খণ্ডিত। মহাকালের দণ্ড এমনই নির্মম যে, এ ধরনের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। বাংলা কবিতার ইতিহাসের দুর্ভাগ্য এখনো কোনো মহৎ উদার সমালোচক কিংবা সংকলকের জন্ম হলো না। আবু সয়ীদ আইয়ুব, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কিংবা বুদ্ধদেব বসু কেউই দুই বাংলার সামগ্রিক চিত্র তুলে আনেননি। প্রথম তিন সংকলকের দুটি সংকলনে পূর্ব বাংলায় কবিতা চর্চা করা অন্তুর্ভুক্ত একমাত্র কবি হলেন জসীম উদদীন। আজ পরিহাসের বিষয় এই বাংলার একমাত্র যে কবিকে তাঁরা অন্তর্ভুক্ত করলেন, প্রবল জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর কাব্য-প্রবণতাকে আধুনিক বলা যাবে কি না, তা নিয়ে প্রবল বিতর্ক উপস্থিত। এবং আধুনিকতার মানদণ্ডে তাঁকে খারিজ করে দেওয়ার সংখ্যাই বেশি। এমনকি পূর্ববর্তী সাহিত্য থেকে অগাধ আহরণের অভিযোগে যিনি দুষ্ট।
হুমায়ুন আজাদ এ রকম সংকীর্ণতার পরিচয় দেননি ঠিকই, কিন্তু কবিতা অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে এসে তাঁর প্রজন্মের কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রেই তিনি সংকুচিত হয়ে গেলেন। তাঁর দেশের তাঁর প্রজন্মের অনেক দেদীপ্যমান কবির কবিতা, যাঁরা নিরন্তর চর্চায় কার্পণ্যহীন এবং কয়েক দশকব্যাপী বহুল পঠিত, সমাদৃত ও উত্তীর্ণ, তাঁদের অনেকের কবিতা অন্তর্ভুক্ত করলেন না। তাঁর পূর্বজ সংকলকের মতোই তাঁর প্রজন্মে এসে ওপার বাংলা কবিদের তিনি একবারেই বাদ দিলেন। হুমায়ুন আজাদের সংকলনের ওপার বাংলায় চর্চা করা তার সময়ে আবির্ভূত কোনো কবির সন্ধান পাওয়া যায় না। অথচ ততদিনে বাংলা কবিতার পাঠক পড়ে ফেলেছেন অর্ধেন্দু চক্রবর্তীর কবিতা। পড়ে ফেলেছেন অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়, আশিস সান্যাল, কার্তিক মোদক, কেতকী কুশারী ডাইসন, চিন্ময়গুহ ঠাকুরতা, তারাপদ রায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, তুলসী মুখোপাধ্যায়, তুষার রায়, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল বসাক, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, প্রভাত চৌধুরী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ভাস্কর চক্রবর্তী, মঞ্জুভাষ মিত্র, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, মলয় রায়চৌধুরী, মৃণাল বসুচৌধুরীর কবিতা। হুমায়ুন আজাদের মতো পণ্ডিত এবং অনুসন্ধিৎসু পাঠক চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে তাঁদের কবিতা পড়েননি সেটা গোলাপ শাহ মাজারের পাগলও বিশ্বাস করবে না। অথচ কী অদ্ভুতভাবেই না তাঁদের সবার কবিতা অনুপস্থিত। এ বিষয়ে হুমায়ুন আজাদের কোনো ব্যাখ্যায়ই নেই।
________________________________________________________________________________________________________________________________________
হুমায়ুন আজাদের চুয়াল্লিশ জন কবির মধ্যে ছব্বিশ জনই পূর্ববর্তী দুটি সংকলনে অন্তর্ভুক্ত। বাঁকি আঠারো জনের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক তল্লাশি চালানোর মতো কিছুই ছিল না। কারণ তাঁদের অধিকাংশই ইতোমধ্যে স্বনামধন্য। যদিও হুমায়ুন আজাদ ভূমিকায় জানিয়েছেন, তিনি কাজটি করতে গিয়ে ব্যাপক পঠন-পাঠনে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। তিনি নিজেকে এতই পঠন-পাঠনে ব্যাপৃত রাখলেন যে, অনুল্লেখ্য কাউকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিতে গিয়ে তিনি অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন সাধনা মুখোপাধ্যায়কে। তাতে সংকলনটির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং কলঙ্কই বেড়েছে। (শ্রীবৃদ্ধি ততটুকু ঘটেছে, যতটুকু হুমায়ুন আজাদ যৌন সুড়সুড়ি কাতর, সেই রুচি বোধের পরিচয় মিলেছে তার সংকলনে।)
_______________________________________________________________________________________________________________________________________
হুমায়ুন আজাদ মোট চুয়াল্লিশ জন কবিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন তাঁর সংকলনে। যার ঊনত্রিশজনই ওপার বাংলায় চর্চা করা কবি। অথচ তাঁর প্রজন্মে এসে তিনি ওপার বাংলায় চর্চা করা একজন কবিরও সন্ধান পেলেন না। তিনি জীবনানন্দ-উত্তর কবি হিসেবে শুধু আহসান হাবীব এবং আবদুল গণি হাজারীকে পেলেন অথচ আবুল হোসেনকে তাঁর চোখে পড়ল না। অন্যদিকে তিনি ওপার বাংলার সাধনা মুখোপাধ্যায়কে ঠিকই মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজে বের করলেন। এবং তাঁর চাঁপার সিন্দুক (১৯৯০) কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতা অন্তর্ভুক্ত করলেন। তিনি তো আধুনিক কবিতার নিরিখ নির্ধারণ করতে গিয়ে বিস্তর কথাবার্তা বলেছেন। এবং সংকলনটিকে অবশ্যই আমরা ধরে নেব, সেই তত্ত্বের প্রায়োগিক ফল। সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতাটি পাঠ করলে তাঁর তত্ত্ব এবং প্রয়োগিক ফলের একটি চিত্র পাওয়া যাবে।
ও বড়ো কোমল গিরিখাত
অনুপ্রবেশ করো ধীরে
আর্দ্র আনন্দের রেশ
না মিলায় রক্তিমে তিমিরে
ও বড়ো চাঁপার সিন্দুক
ওইখানে আপলের খনি
চাড় দিয়ে খুলো না কো ডালা
আঁচড়ে আহত হবে নদীও বড়ো নরম জঙ্গল
আষ্টেপৃষ্টে আছে তৃণভূমি
কচি কচি কদম কেশর
তেমনই ভঙ্গিমা করো তুমিও পথ তো গোলাপেরই পথ
পাপড়ি মতো মসৃণ
ভোমরার মতো আঁচরণে
বিচরণ করো চিরদিন।
অজিত দত্ত ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত আধুনিক কবিতার ইশতেহারে বলা হয়েছিল আধুনিক কবিতা এমন বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে যেন পড়ামাত্রই সম্পূর্ণ বুঝা যাবে না। আড়াল থাকবে রহস্য থাকবে, পুনঃপুনঃ পাঠে আবিষ্কৃত হবে ভিন্নার্থিক দ্যোতনা। এবং এই বক্তব্যটি প্রকাশের পরপরই ব্যাপক সমাদৃত, সমর্থিত, উল্লিখিত হয়। এমনকি কেউ কেউ এটিকেই আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রধাণ লক্ষণ হিসেবে অভিহিত করেন। হুমায়ুন আজাদকে কখনোই এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে কিছু বলতে শোনা যায়নি। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি বুদ্ধদেব বসুকৃত এই লক্ষণ-বৈশিষ্ট্যটিকে তিনি মান্যই করতেন।
সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতাটি একবার পড়লেই এর অন্তর্নিহিত রূপ-রস সহজেই অনুধাবন করা যায়। এমনকি এটি দ্বিতীয়বার পড়ারও কোনো পিপাসাও জাগে না। কারণ এখানে কোনো আড়াল রাখা হয়নি। সবকিছু বলে দেওয়া হয়েছে। সব কিছু বলে দেওয়া কবিতা আধুনিক কবিতার মানদণ্ডে প্রথমেই খারিজ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ এটিকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে ধরা যায় যৌনতা। চাঁপার সিন্দুক কিংবা কবিতায় যে চিত্র (চিত্রকল্প নয়) মূর্ত (বিমূর্ত নয়) করে তোলা হয়েছে তা সহজেই অনুধাবনেয়। একজন রমণীর সবচেয়ে সংরক্ষিত অঙ্গ, যে অঙ্গটির অভ্যন্তরে অঙ্গ সঞ্চালনা করা একজন পুরুষের পরম আরাধ্য তারই চিত্র আঁকা হয়েছে অত্যন্ত স্থুল প্রতীকের মাধ্যমে। এমনকি এখানে যৌনতাকালীন অঙ্গ সঞ্চালনার পদ্ধতি সম্পর্কে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায়ও কবিতাটি উত্তীর্ণ হতে পারত যদি অনুভূতির একটা রসঘন রসায়ন তিনি নির্মাণ করতে পারতেন। তাও পারেননি। তাহলে এই কবিতাটি নির্বাচনের হেতু কী? যৌনতা? তাহলে কি হুমায়ুন আজাদ আধুনিকতার মানদণ্ড হিসেবে স্থুল যৌনতার উপস্থিতিকে একটি লক্ষণ হিসেবে দাঁড় করাতে চান? আমার মনে হয়, এ বক্তব্যে কাওরান বাজারের ডিমের আড়তদারও সমর্থন করবে না।
এভাবেই আমরা আবুল হোসেনকে বাদ পড়তে দেখি। ভাস্কর চক্রবর্তীকে বাদ পড়তে দেখি। অন্যদিকে চাঁপার সিন্দুক থেকে আধুনিকতার রস পড়তে থাকে।
এ রকম রস হুমায়ুন আজাদের সংকলনটির কলঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বকে একটি যৌনগন্ধী কবিতার কাছে সমঝোতা করতে দেখি। হতে পারে যৌনতার মতোই কবিতাটি উপভোগ্য, যৌনতার মতোই পৌণপুণিক পাঠ হয়তোবা মনের ভেতরে রসের সঞ্চার করতে পারঙ্গম, কিন্তু মনে রাখতে হবে এটি আধুনিক কবিতার সংকলন। এবং প্রবল প্রতাপে সেই সৌধে আঘাত করা হচ্ছে যা একদা নির্মাণ করেছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং বুদ্ধদেব বসু।
হুমায়ুন আজাদের চুয়াল্লিশ জন কবির মধ্যে ছব্বিশ জনই পূর্ববর্তী দুটি সংকলনে অন্তর্ভুক্ত। বাঁকি আঠারো জনের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক তল্লাশি চালানোর মতো কিছুই ছিল না। কারণ তাঁদের অধিকাংশই ইতোমধ্যে স্বনামধন্য। যদিও হুমায়ুন আজাদ ভূমিকায় জানিয়েছেন, তিনি কাজটি করতে গিয়ে ব্যাপক পঠন-পাঠনে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। তিনি নিজেকে এতই পঠন-পাঠনে ব্যাপৃত রাখলেন যে, অনুল্লেখ্য কাউকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিতে গিয়ে তিনি অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন সাধনা মুখোপাধ্যায়কে। তাতে সংকলনটির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং কলঙ্কই বেড়েছে। (শ্রীবৃদ্ধি ততটুকু ঘটেছে, যতটুকু হুমায়ুন আজাদ যৌন সুড়সুড়ি কাতর, সেই রুচি বোধের পরিচয় মিলেছে তার সংকলনে।)
তারপরও হুমায়ুন আজাদের সংকলনটিই সবচেয়ে উল্লেখ হওয়ার যোগ্যতা রাখে অপেক্ষাকৃত কম দুর্বলতার জন্য, অপেক্ষাকৃত কম স্ববিরোধিতার জন্য, অপেক্ষাকৃত কম পক্ষপাতের জন্য, অপেক্ষাকৃত কম সমঝোতার জন্য।
এইসব সংকলনের আগে-পরে মাঝে আরও কতিপয় সংকলন হয়েছে। যেগুলো বিশেষ কোনো কিছু নিয়ে উপস্থিত হয়নি। প্রচণ্ড রকম একপেশে, কবি ও কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানদণ্ডহীনতা এ সব সংকলন নিতান্তই কাগজের অপচয় এবং সংকলক ও অন্তর্ভুক্তজনদের অলীক তৃপ্তি ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। যেমন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় কবিতা’, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৩, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া। সংকলনটির নাম দেখেই মনে হবে ভারতের বিভিন্ন ভাষার কবিতার সংকলন এটি। কিন্তু না। এটি বাংলা কবিতার সংকলন। ভারতের স্বাধীনতার পঁচিশ বছর উপলক্ষে বের করা এই সংকলনটির উদ্দেশ্য ‘বাংলার দেশকালের একটা গতিময় বহুবর্ণ ছবি ফুটে’ তোলা। কিন্তু ‘বাংলা’টা কি, কোন বাংলা, বাংলা খণ্ডাভিভূত কি না, তার কোনো উল্লেখ নেই, পর্যবেক্ষণ নেই, ব্যাখ্যাও নেই। কিন্তু বাংলা কবিতার সংকলন এটি। উপরন্তু অনেক গৌণ কবির স্থান হলেও এখানে এমন সব কবি অন্তর্ভুক্তহীন, যাঁদের বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখা অসম্ভব। যেমন এখানে বিস্ময়করভাবে অন্তর্ভুক্তিহীন হতে দেখি সমর সেন, অশোকবিজয় রাহা, নরেশ গুহ, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, পুর্ণেন্দু পত্রী, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, কেতকী কুশারী ডাইসন, তুলী মুখোপাধ্যায়, তুষার রায়, প্রভাত চৌধুরী, ভাস্কর চক্রবর্তী, মলয়রায় চৌধুরী, মঞ্জুশ দাশগুপ্ত , একরাম আলী, গৌতম চৌধুরী, জয় গোস্বামী, জহর সেনগুপ্ত, মৃদুল দাশগুপ্ত, রণজিৎ দাশ, সমর রায়চৌধুরীর মতো প্রভাববিস্তারী কবিদের।
এরপর শুরু হয় দশক ভিত্তিক সকলন। সে-সব নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে দশক নিয়ে। বিংশ শতাব্দীতে আমদানি হওয়া এই শব্দটি যা প্রকাশ করছে সে-সম্পর্কে বিজ্ঞজনের ধারণা, পর্যবেক্ষণ, প্রাপ্তি, ফলাফল, ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাতের পরই ঢোকা যেতে পারে দশকভিত্তিক সংকলনের অন্দরমহলে। তখন হয়তো বেরিয়ে আসবে অনেক অন্ধকারের রূপ।