পর্ব-৪৫
চলুন, বাড়ি যাই। শ্বশুরের হাত ধরে সামনে হাঁটতে শুরু করে। পেছনে তাকিয়ে শিমুলকে বলে, তুমি দাঁড়িয়ে কেন? আসো।
বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলে,উপস্থিত লোকজন ঘিরে ধরে। থমকে দাঁড়ায় মিলি, শামসুদ্দিন আর শিমুল। কাছে এগিয়ে আসে পাশের গ্রাম কড়ইতলার মেম্বর জমির আলী, ভাই! দৃষ্টি শামসুদ্দিনের দিকে, আপনের পোলার বউ আজকা যা করলো, হেউডা দশবারো গেরামের ইতিহাসে নাই। মা, তোমারে দেইখা জীবনডা ধন্য হইলো। একদিন আমার বাড়ি আহো, দুইডা ডাইল ভাত খাওয়ামু। তোমার শ্বশুর শামসু ভাই কইলো আমার ছোডকালের দোস্ত। দুই জনে মিইল্লা অনেক দূরে হাডুডু খেলতে যাইতাম। জিগাও তোমার শ্বশুররে।
হ, হাচাই। মুখে মৃদু হাসির সঙ্গে অহঙ্কারের রঙ মিশিয়ে সমর্থন করে শাসমুদ্দিন।
বাড়ির মধ্যে থেকে হাটের দিকে আসছে শিমুলের মা পারুল বেগম, রূপালী। সঙ্গে আশপাশের অনেক মহিলা। তাদের দিকে চিৎকার করে জানায় আবুল, ওই শিমুল? বাড়ি দিয়া চাচিও আইসা পড়ছে।
কইরে? ভিড় ঠেলে বের হয়ে আসে শিমুল। শিমুলকে দেখে দ্রুত হাঁটতে থাকা পারুল বেগম এবং তার সঙ্গীরা থেমে যায়। শিমুল দৌড়ে মায়ের কাছে গেলে, পারুল বেগম ছেলেকে জড়িয়ে প্রশ্ন করেন, তোমার বাপে কই?
ভিড়ের মধ্যে থেকে শ্বশুরের হাত ধরে বের হয়ে আসে মিলি। মিলির হাতে ধরা শামসুদ্দিনকে দেখে চোখের উদ্বেগ, মনের তরাস দূরে চলে যায়। রূপালী এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে ভাবী ও পিতাকে। সন্ধ্যা নেমে আসছে কচানদীর ওপারে, উজানগাঁও গ্রামের মাথায়। হাটুরেরা, যারা মজা দেখতে এসেছিল, তাদের মজা দেখা শেষ। অনেকেই ফিরে যায় হাটে। তমালের বন্ধু আর আশপাশের বাড়ির লোকজন সমেত শামসুদ্দিন, পারুল বেগম, মিলি মাহজাবীন, শিমুল, রূপালীরা বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে বিশাল বিজয়ের এক মন্ত্র বুকের মধ্যে নিয়ে।
স্যার! বাড়ির দিকে চলতে থাকা মিছিলের দিকে চোখ রেখে এস আই জহির তাকায় ওসি দিবাকর রায়ের দিকে। ওসিও তাকিয়ে দেখছিল মিলির নেতৃত্বে বাড়ির দিকে যাওয়া মিছিলটাকে। জীবনের মধ্যে বয়সে এসে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে কিন্ত আজকের অভিজ্ঞতাটা সব অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে গেছে। হাটের মধ্যে থেকে ধরা দুইজন আসামি মুক্ত করে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী-মিলি মাহজাবীন। মিলি মাহজাবীনের পিতা সরকারের সচিব ফোনে জানিয়েছে, যেভাবেই হোক আমার মেয়েকে চাই। ওরা আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে। কিন্ত সেই কিডন্যাপ হওয়া মেয়েই তো পুলিশের হাত থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে নিজের স্বামী ও শ্বশুরকে।
হ্যাঁ বলো।
এখন কী করবেন? সরকারের সচিব গোলাম রব্বানীকে কী বলবেন?
যা ঘটেছে, সেটাই বলবো।
স্যার! আমলারা এক একজন মনে করে ক্ষমতার জাহাজ। বুদ্ধির সমুদ্র। ওরা ভাব করে, জানে না বোঝে না; এমন কোনো বিষয় দুনিয়ায় নাই। এই লোক, মানে গোলাম রব্বানী আপনার কথা মানবে না । আপনি সত্য বললেও বুঝবে, আপনি আর আমরা যথাযথ দায়িত্ব বা আদেশ পালন করি নাই। অযথা একটা ঝামেলার মধ্যে ঢুকে গেলাম স্যার।
ঝতে পারছে, সমস্ত এলাকায় ঘটনাটা বিশাল তরঙ্গ তুলেছে। অনেক অনেক দিন মানুষের মুখে মুখে ফিরবে, শামসুদ্দিনের পুত্র শিমুলের স্ত্রী মিলি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ওসি দিবাকর রায়, চা খাওয়া দরকার। চলো বাজারের দিকে যাই। চায়ের দোকানে বসে শলা পরামর্শ করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
ঠিক আছে স্যার, চলুন। এস আই জহির তাকায় সঙ্গে থাকা ছয় কনেস্টেবলের দিকে, চলো সবাই উজানগাঁও বাজারে।
পুলিশের দলটা মাজাভাঙা হয়ে উজানগাঁও হাঁটের দিকে যাচ্ছে।
বাড়িতে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে বিছনার ওপর শুয়ে পরে মিলি। এই ঘটনা ঘিরে পুরো গ্রাম ও গ্রামের আশপাশের লোকজন শামসুদ্দিনের বাড়ি চলে এসেছে। একজন নারী, সুন্দরী মেয়ে, ঢাকা থেকে এসেছে, গোটা উজানগাঁও গ্রাম গত একমাসের কেন্দ্রবিন্দু। সেই মেয়ে, গ্রামের বউ পুলিশের মুখের ওপর ঝগড়া বা লড়াই করে ছিনিয়ে এনেছে স্বামী ও শ্বশুরকে। এক মুখ দুই মুখ করে করে গোটা ঘটনার ওপরের ডালপালা গজিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। শামসুদ্দিন পুরো ঘটনাটা হজম করতে পারছে না। প্রথম যখন বাজারে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল, হাতে হাতকড়া পরেছিল, অজস্র মানুষ চোখে চোখে দেখছিল, লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। নিজেকে কী করবে, কোথাও লুকাবে, বুঝতে পারছিল না। এলাকার মানুষ অসম্ভব সম্মান করে, বাড়ি বাড়ি শালিস করে বেড়ায়। কত মানুষের কত গোপন ঘটনা জানে, নির্ভরতার প্রতীক মনে করে কানে কানে বলে যায়, সেই শামসুদ্দিনের হাতে হাতকড়া পরিয়েছে পুলিশ, দিন দুপুরে- প্রকাশ্যে হাটে! চোখ তুলে কারও দিকে তাকাতে পারছিল না শাসমুদ্দিন, বাজারের লোকজনের দিকে। মাথা নিচু করে হাঁটছিল পুলিশের পিছু পিছু।
কিন্তু সবকিছু অসহ্য হয়ে উঠছিল, যখন দেখলো পুত্র শিমুলকেও গ্রেপ্তার করে এনেছে পুলিশের একটা দল। শিমুলের দুই হাতে হাতকড়া। বাজারের অজস্র মানুষের মধ্যে পিতা-পুত্র অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে ছিল একে অন্যের দিকে, অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে। পুত্র চোখ নামিয়ে নেয়, মনের মধ্যে ক্রোধ ও অসায়ত্বের জড় বইতে থাকে, কেবল মিলির জন্য বাবাকে এত অপমান সহ্য করতে হচ্ছে! অপমানের তো শুরু, পুলিশ তো এখন থানায় নিয়ে যাবে। থানায় নিয়ে সারা রাত গারদে আটকে রাখবে। আগামীকাল সকালে চালান দেবে থানা থেকে পিরোজপুরে। হাতে হাত কড়া বেঁধে কতো কতো মানুষের সামনে দিয়ে নিয়ে যাবে। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে শিমুলের। জীবনের সকল স্বপ্ন সাধ আশা ধুলার তোড়ে হারিয়ে যাবে জেলের চার দেয়ালের মধ্যে!
চলুন, ওসি দিবাকর রায় আদেশ করে শামসুদ্দিন ও শিমুলকে।
উপায়হীন দৃষ্টিতে বাজারের অজস্র মানুষের কৌতূহলের বিষদৃষ্টির মধ্যে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে দলটি। সবার আগে হাতকড়া পরা পিতা ও পুত্র। পেছনে পুলিশ ও মানুষের ঝাঁক। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে পুলিশেরা বুঝতে পারছিল না শিমুল। দফাদার হানিফ হাতে একখানা ছাতা নিয়ে মাথায় পাগড়ি চেতে দলের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে দ্বিগিজয়ের গতিতে।
হানিফ? ডাক দেয় ওসি দিবাকর রায়।
পেছন থেকে ঝড়ো কাকের মতো দৌড়ে আসে হানিফ, স্যার?
শিমুলদের বাড়ি কোন দিকে?
ওইতো স্যার, বাজারের পশ্চিম দিকে। খালের পার দিয়া গেলে ঘুরা অইবে। কোলার মইধ্যে দিয়া গেলে তারাতারি যাওয়া যাইবে।
তাহলে কোলার মধ্যে দিয়েই চলো।
পুরো দলটা রাজ্য জয়ের মহান কৃত্বি নিয়ে উজানগাঁওয়ের বাজার ছেড়ে শুকনা ধানের জমিতে নেমে হাঁটতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে শিমুল বুঝে যায়, মিলিকে ধরার জন্য যাচ্ছে পুলিশের দল বাড়ির দিকে। তাহলে, একসঙ্গে পিতা, পুত্র ও পুত্রবধূকে থাকতে হবে থানায়? আশপাশে তাকায়, পরিচিত কেউ থাকলে বলবে, দৌড়ে বাড়ি যাও। বাড়ি গিয়ে মিলিকে কোথাও লুকিয়ে থাকতে বলো।
স্যার! আমাগো বাড়ি যাইতে অইবে না, দফাদার হানিফের উল্লসিত গলা, শিমুল মিয়ার বউ আইয়া পড়ছে।
মানে?
দফাদার হানিফ হাত বাড়িয়ে দেখায়, দ্রুত বেগে হেঁটে আসা মিলি মাহজাবীনকে, ওইতো স্যার। আমাকে কইলো সোবাহান মিয়া।
শিমুল ও শামসুদ্দিন তাকিয়ে দেখে, মিলি দ্রুত হেঁটে আসছে। পেছনে পেছনে দৌড়ে আসছে জগদীশ আর তমাল। ওদের পেছনে আশপাশ বাড়ির কয়েকজন প্রতিবেশীও ছুটে আসছে। মিলিকে দেখে ভীষণ অসহায় বোধ করে শিমুল। মনে মনে বলে, মিলি কেনো পুলিশের কাছে ধরা দিলো? কেন এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে? এখন, এলাকার প্রত্যেকটা মানুষ দেখবে, স্বামী শ্বশুর আর স্ত্রী মিলে গ্রেফতার পুলিশের হাতে।
কিন্ত মুখোমুখি হয়েই মিলির রুদ্ধরূপ দেখে প্রথমে ভয়ে ভড়কে গেলেও ভেতরে ভেতরে মুক্তির বিন্দুও দেখতে পাচ্ছিল। মিলি সরাসরি রাজনীতি না করলেও ওর অনেক বন্ধু সরাসরি রাজনীতি করে। ক্যাম্পাসের রাজনীতির মিছিলে যায়। মিলি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মিছিল দেখে। রাজনীতি বিষয়ে আলোচনায় অংশও নেয়। ওকে দেখলে রাজনীতির মানুষই মনে হয় না। অথচ আজ চোখের সামনে যা করলো, বিস্ময়। মিলির প্রবল চাপে আর উপস্থিত জনতার মৌন সমর্থনে পুলিশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে আমাদের। বুঝতে পারছে, সমস্ত এলাকায় ঘটনাটা বিশাল তরঙ্গ তুলেছে। অনেক অনেক দিন মানুষের মুখে মুখে ফিরবে, শামসুদ্দিনের পুত্র শিমুলের স্ত্রী মিলি।
চলবে…
মোকাম সদরঘাট-৪৪ পর্ব ॥ মনি হায়দার