পর্ব-৪০
কয়েক দিন পরে দুপুরের সময় শফিক হাসান ঢোকে বিলকিস খানমের বাসায়, যখন কনক ও প্রিয়তা স্কুলে।
বিলকিস খানম তৈরিই ছিল, শুরু হলো একজন নারী–একজন পুরুষের শরীর অভিসার। কনকের স্কুল থেকে আসার আগেই বাসা থেকে বের হয়ে আসছিল শফিক হাসান কিন্তু পড়ে যায় নিচের বাসার ব্যাংকার ওয়াকার আহসানের সামনে।
আপনি এই সময়ে?
মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নেয় শফিক হাসান, আজকে বিকেলে আমি কনককে পড়াতে আসতে পারবো না, সেটা জানাতে এসেছিলাম।
ও আচ্ছা! মুখের অভিব্যক্তিতে বোঝা যায় ওয়াকার আহসান বিশ্বাস করেনি।
আসি! কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত চলে আসে শফিক সিঁড়ি ভেঙে।
পরের দিন বিকেলে পড়াতে গিয়ে শফিক দেখে দরজায় তালা। অবাক শফিক হাসান দাঁড়িয়ে থাকে তালার সামনে। বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়েও দরজার তালাটা ধরে নাড়াচাড়া করে, যদি তালা খুলে বের হয়ে আসেন বিলকিস খানম। কিন্তু বিমূঢ় নিঃশব্দ তালার কিছু করার থাকে না, ঝুলতেই থাকে দরজার লোহার আংটায়। ঝোলানো তালার ওপর তাকায়, তাকায় ওপরের সিঁড়ির দিকে। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। প্রায় মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পরও কোনো মানুষের সাড়া না পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। নেমে আসে যদিও তবু শফিক হাসানের অন্তরাত্মা শুষে নিচ্ছিল অজানা চেতনার শিরিজ কাগজ। শরীরে কোনো শক্তি বা বোধ বা শক্তি পাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল এই পথ, এই বাসা কোনো দিন ছিল না। ভুল করে এসেছে এই পথে, আর কোনোদিন আসেনি। বিষণ্ন মনের সব অন্ধকারে নিজেকে ঢেকে রুমে চলে আসে। সাধারণত এই সময়ে রুমে থাকে না কেউ; না মাহমুদ হাসান, না আমীর হোসেন, না শফিক হাসান নিজে। রুমে ঢুকে বিছনার ওপর শুয়ে পড়ে। মনে হয়, বুকের ভেতরটা কেউ কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে চলছে, রক্তের স্রোতে অশরীরী বেদনায় শরীর মন-আত্মা কাঁদছে নিঃশব্দ ঝড়ের মূর্ছনায়। এই কুহক, এই বেদনার নিয়ন বাঁশির সুর কাউকে বোঝাতে পারছে না; একদিন কনককে না পড়ালে কী হয়? কত দিনই তো কনককে পড়িয়েছে! একদিন, মাত্র একদিন।
আপনার কি শরীর খারাপ? চিৎ শুয়ে থাকা শফিক হাসান চমকে উঠে বসে। খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে খোপা খুলে এলো চুলে শিউলি আখতার।
না, এমনি শুয়ে আছি।
আমার কিছু হারানোর নেই। কিন্তু হারানোর যে কত ক্ষত আর সুখ আছে, কয়েকদিন ধরে বুঝতে পারছে শফিক হাসান, যখন বিলকিস খানমের দরজায় ঝুলছে তালা।
শুক্রবার বা ছুটির দিন ছাড়া তো আপনি এই সময়ে বাসায় আসেন না। আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। আপনাকে আসতে দেখে মনে হলো, আপনি অসুস্থ। তাই এলাম।
অসুস্থ না, আমি মানসিকভাবে পীড়িত একটু। ঠিক হয়ে যাবে।
কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন, আর শুনলাম বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন?
দিচ্ছি কিন্তু আশেপাশেই আছি।
মসজিদ মেসে যাচ্ছেন আপনারা?
কার কাছে শুনছেন?
মাহমুদ ভাই বলেছে, গতকাল আমাদের বাসায় গিয়েছিল। আপনি তো লেখক?
হাসে শফিক, লেখক? না না, লেখক হওয়া অনেক বড় ঘটনা। তবে লিখি, মানে লেখার চেষ্টা করছি।
কী লেখেন? কবিতা?
না, গল্প।
গল্প আমার খুব প্রিয়। আপনার ছাপা একটা গল্প আমাকে পড়তে দিয়েন।
ঠিক আছে, দেবো।
চা খাবেন? আমি ভালো চা বানাই।
এখন না।
আপনি সবকিছু অস্বীকার করেন কেন?
হাসার চেষ্টা করে শফিক, কই অস্বীকার করি? বলেছি আজ নয় কিন্তু অন্য একদিন আপনার হাতের চা খাবো।
খাবেন তো?
খাবো।
ঠিক আছে, শরীরে একটা তরঙ্গ ভঙ্গের ছন্দ তুলে দরজা থেকে সরে যায় শিউলি আখতার। শিউলি আখতারের চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিছানার ওপর শুয়ে পড়ে শফিক হাসান; এই মেয়ে আমার কাছে কী চায়? শালা আমি তো আটকে আছি সিল ছাপ্পরহীন এক বেড়াজালে। ডুবে মরছি অথৈ জলে। সেই জলের মধ্যে তুমি কন্যা আসতেছ নতুন মাছ মারতে?
কিন্তু কোথায় গেলো বিলিকিস খানম আমাকে উতুঙ্গ সমুদ্রের স্রোতে রেখে? কোনো দুর্ঘটনা? জেনে গেছে ওর স্বামী জহিরুল আলম? কিভাবে জানলো? কনক কি কিছু বুঝতে পেরেছে? অথবা নিচ তলার ব্যাংকার লোকটা? লোকটা সময় এবং সুযোগ পেলে দাঁতাল মাছের চোখে তাকিয়ে থাকে বিলকিস খানমের দিকে? কী হলো? কোথায় গেলো? দুশ্শালা, এত ভাবনা চিন্তার কী আছে? নিশ্চয়ই কোনো আত্মীয় অসুস্থ, দেখতে চলে গেছে। আগামীকাল পাওয়া যাবে।
ভাবতে ভাবতে ঘুমের মধ্যে ডুবে যায় শফিক হাসান। সন্ধ্যার একটু আগে ঘুম ভাঙে রেহানা বেগম আর শিউলি আখতারের ডাকে। মুলত ডাকতে এসেছে শিউলি আখতার কিন্তু সঙ্গে নিয়ে এসেছে বেহানা ভাবিকে আড়ালের চাবি হিসেবে।
আর কত ঘুমাবেন? পাতলা ঘুম, গরমের ঘামে শরীর ভেজা শিউলি আখতারের কথায় ঘুম ভেঙে যায় শফিক হাসানের।
আপনি? ঘুম থেকে উঠে বসে।
আমি একলা না, সঙ্গে রেহানা ভাবিও আছে, সহাস্যে জানায় শিউলি আখতার।
বিছনা থেকে নেমে টেবিলের ওপর রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে চোখে মুখে দিয়ে গামছায় মুছে হাই তোলে শফিক হাসান, কী খবর রেহানা ভাবি? মাহমুদ তো বাসায় নেই।
হাসে রেহানা বেগম, আপনি সেদিনও বলেছেন মাহমুদ বাসায় নেই, কেন এসেছেন? আজও বলছেন, কেন? মাহমুদ আমার কী হয়?
বসে বিছনার ওপর, কী হয় জানি না। মাহমুদ আপনার খুব প্রশংসা করে। ভাবি বলতে অজ্ঞান।
কী প্রশংসা করে শুনি? রেহানা বেগমের গাঢ় গলা।
সব প্রশংসা তো আপনাকে বলা যাবে না। কিন্তু এই অভাগার দরবারে ভর সন্ধ্যায় কেন আসলেন?
আমি আসি নাই, ইশারায় শিউলি আখতারকে দেখিয়ে বলে, আপনার নাকি জ্বর। দেখতে এসেছে, সঙ্গে আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে।
শিউলি আখতার ধরা পড়ে যাওয়ায় মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সুন্দর মুখে লজ্জার গাঢ় লালিমা লেপ্টে রয়েছে, খুব ভালো লাগে গোলগাল মুখে লাল লালিমা।
আপনারা কথা বলেন, আমি যাই। চুলায় রাতের তরকারি, দ্রুত চলে যায় রেহানা বেগম।
দরজার মুখে আধো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে শিউলি আখতার। পরিস্থিতি এমন হবে, বুঝতে পারেনি। মনে হচ্ছে পা-জোড়া মাটির সঙ্গে আটকে গেছে। টেনে তুলতে পারছে না। শফিক হাসান শার্ট গায়ে এগিয়ে সামনে দাঁড়ায় শিউলির, আমি বুঝতে পারছি আপনি আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু আমার সর্ম্পকে কিছু জানেন? জানেন না। লোকে বলে, আমি লম্বা, দেখতেও নাকি খারাপ না। আমি আমাকে এখনো ভালো করে দেখার সুযোগ পাইনি। জন্মের পর থেকে জীবনটাকে ঘোড়ার জিনে রেখে দৌড়াচ্ছি কিন্তু কোথাও ঠাই নাই; রবীন্দ্রনাথের ছোট সে তরীর মতো। আমার সঙ্গে আপনি হাঁটতে পারবেন না শিউলি, আমি ছন্নছাড়া ভবঘুরে এক মানুষ। গ্রামের বাড়িতে, কচানদীর তীরে উজানগাঁও গ্রামে বিধমা মা, দুটি ভাই আর দুটি বোনের মুখে চারটে ভাত জোগানোর জন্য খেটে মরছি। আমার পরিত্যক্ত বিপন্ন বিষাক্ত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে কেন আরও বিড়ম্বিত হবেন? নিজের জীবনের জোয়ালে কেন সর্বনাশ ডেকে আসবেন? আমি জানি, আপনি ভীষণ সুন্দর। আপনার দীঘল কালো চুলের আয়ত খোঁপা আমাকে ভীষণ টানে কিন্তু আমার সাধ্য নেই। আমি এক অনন্ত শূন্য মানুষ। অনন্ত এক শূন্য মানুষের সঙ্গে কি আপনার মতো তিলোত্তমাকে মানায়? এখন হয়তো আবেগ আছে, এক ধরনের শক্তি আছে কিন্তু আপনার ভবিষৎ আপনাকে ভাবতে হবে। আমি হয়তো বেশিই বলে ফেললাম শিউলি, কিছু মনে করবেন না। যদি পারেন, আমার ব্যর্থতা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
আমি ক্ষমা করতে পারবো না! কম্পিত গলায় বলেই দ্রুত চলে যায় শিউলি আখতার শরীরের ঢেউ তুলে। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে শফিক হাসান, এ কী বিড়ম্বনা! ওদিকে নেই বিলকিস খানম; দরজায় লোহার তালা। আর এদিকে অভিমানে ফেটে যাচ্ছে খোঁপা সুন্দরী শিউলি আখতার!
পরপর চার দিন যাওয়ার পরও বিলকিস খানমের বাসার সামনে তালা ঝুলতে দেখে শফিক হাসান। বুঝতে পারে, কোথাও কোনো বাঘ সিঁদ কেটেছে। কী করবে নিজেকে? কাটবে? ভাসাবে? নাকি ঢাকা শহরের কোনো চৌরাস্তায় ফাঁসির একটা মঞ্চ বানিয়ে ঝুলে যাবে শফিক হাসান? জীবনটা তো চলছিল একটা রথে, নিজের মতো করে। রেডিও অফিস, টিউশনি, লজিং আর গল্প লেখায়; হঠাৎ করে বিলকিস খানম ঝড়ের গতিতে ঢুকে সব দখল করে, মধুর জলে সাঁতারের রূপরেখা শিখিয়ে কোন অজানায় হারিয়ে গেলেন? হারিয়ে গেলেন আর শফিক হাসানকে রেখে গেলেন বধ্যভূমিতে। বিলকিস খানমের ঘোর এক মুহূর্তের জন্যও কাটাতে পারছে না শফিক। হাঁটতে হাঁটতে দেখে পথের পাশে দাঁড়িয়ে খলবল হাসছে বিলকিস খানম। অফিসে কাজ করছে, হঠাৎ তাকিয়ে দেখে সামনের চেয়ারে বসে র্নির্নিমেষ তাকিয়ে বিলকিস খানম। বাসে বসে যাচ্ছে, মনে হয় পাশের সিটের যাত্রী বিলকিস খানম। খেতে বসেছে, পাশে বসে থালায় খাবার দিচ্ছে বিলকিস খানম। চারপাশে একজন বিলকিস খানম স্বর্ণালু লতার মতো জড়িয়ে রেখেছে। কোনোভাবেই মুক্তি পাচ্ছে না; জীবনের প্রথম আনুষ্ঠানিক নারীর শরীর ও প্রেমের রাজ্যে প্রবেশ করেছে শফিক হাসান, মাত্র কয়েকটা দিন রাত্রির মধ্যে ডুবে গিয়ে মনে করেছিল, সব পেয়েছে, আমি সব পেয়েছি। আমার কিছু হারানোর নেই। কিন্তু হারানোর যে কত ক্ষত আর সুখ আছে, কয়েকদিন ধরে বুঝতে পারছে শফিক হাসান, যখন বিলকিস খানমের দরজায় ঝুলছে তালা।
আমার বুকের ভেতরটা বালির মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে, আমাকে আমি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। ঝরঝর কাঁদতে শুরু করে মেসের মধ্যে নিজের লেখা ও পড়ার টেবিলের ওপর মাথা রেখে শফিক হাসান।
তোর সমস্যা কী? নতুন মেসে চলে এসেছে মাহমুদ হাসানরা। মসজিদ মেস। মসজিদের সঙ্গেই পূর্বপাশে অনেকখানি খোলা জায়গা। সেই জায়গায় টিনের বড় বড় লম্বা ঘর বানিয়েছে মসজিদ কমিটি। মেস ভাড়া দিয়ে আয় হচ্ছে। ছোট বড় ছয়টা রুম। একটা রুমে মসজিদের মুয়াজ্জিন থাকে, বাকি পাঁচটা ভাড়া। শেষের রুমটা ভাড়া নিয়েছে মাহমুদ। লম্বা মোটামুটি বড় একটা রুম। তিনটা খাট ফেলার পর মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা। নিজের খাটের ওপর একটা টেবিল সাজিয়েছে শফিক। টেবিলের ওপর রাজ্যের বই। বইয়ের মধ্যে নিজের লেখার একটু খানি জায়গা। রাতে পড়া ও লেখার জন্য রেখেছে একটা ঘ্ড়া বাঁকানো টেবিল আলো।
শফিক হাসান নিজের টেবিলে বসেছে লেখা বা পড়ার জন্য। সামনে সাদা কাগজ বিছিয়ে রেখেছে, হাতে রেডলিফ কলম, সামনে খোলা উপন্যাস শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। রাত দশটার দিকে নিজের বিছনায় শুয়ে মাহমুদ প্রশ্ন করে শফিককে।
শফিক হাসান একটা গল্প লেখার চেষ্টা করছিল, কিন্তু গল্পের কোনো আখ্যান মাথায় ঢুকছে না, যদিও বাংলার বাণীর সাহিত্য সম্পাদক কবি সোহরাব হাসান তাগাদা দিয়ে রেখেছেন। গল্পের চরিত্র ভাবতে গেলেই হারিয়ে যাওয়া বিলকসি খানম সামনে এসে দাঁড়ায় উদ্ধ্যত হাসিতে। গল্প আর লেখা হয় না।
মাহমুদের প্রশ্ন কানেই যায়নি শফিকের। পাশে নিজের বিছনায় শুয়ে পা দোলাচ্ছে আমীর হোসেন। মাহমুদের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে বিছানা ছেড়ে নামে, এসে দাঁড়ায় শফিকের টেবিলের সামনে। চমকে তাকায় শফিক; জেগে আছিস কেন আমীর? আগামীকাল না সকালে তোর কিসের কাজের তাড়া?
আমার কাজের তাড়া থাউক, তোর অবস্থা কী, হেইডা আগে বল; মিটিমিটি হাসে আমীর হোসেন।
আমার অবস্থা ভালো!
তোর অবস্থা যদি ভালোই হয়, দেড়ঘণ্টা ধরে টেবিলের ওপর বসে আছিস তুই। কী বালের গল্প লিখবি; বললি, তোকে ডিসটার্ব না করতে। কিন্তু তুই তো লিখছিস না; সাদা কাগজের ওপর তাকিয়ে আছিস। মাহমুদও চলে এসেছে নিজের বিছানা ছেড়ে শফিকের বিছানার ওপর। বসে পাশে, গত কয়েকদিন ধরে দেখছি তুই কেমন অন্যমনস্ক! ঘটনা কী?
হাসার চেষ্টা করে শফিক হাসান, কী আর হবে? আমি আছি তো…আমি অন্যমনস্ক হবো কেন?
শিউলি আখতার তোরে কিছু কইচে? আমীর হোসেন কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে, কনকের মাকে তুই বিয়ে করতে পারবি না। অন্যর বউ, দুইটা ছেলে-মেয়ের মা। তোর সঙ্গে লটরপটর করতে আইছে প্রতিশোধ লইতে স্বামীর ওপর। সময় হলে, মজা নেওয়ার পর ফুড়ুত, মানে ভাইগা যাইবো। কিন্তু শিউলি আখতার কিন্তু থাকবো। মেয়েটাও ভালো।
আমীর হোসেনের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলে মাহমুদ হাসান, যদিও একটা ঝামেলা আছে।
চট করে তাকায় শফিক হাসান, কী ঝামেলা আছে শিউলি আখতারের?
ওর একটা বিয়ে হয়েছিল।
কবে?
বছর পাঁচেক আগে, বিয়েটা মাত্র ছয় মাস টিকেছিল। বাবার দিকে আত্মীয় ছিল জামাই। কিন্তু বিয়ের পরই যৌতুক চেয়ে খুব অত্যাচার করতো জামাই সিরাজ মিয়া। শেষে তালাক দিয়ে চলে এসেছে। ওর বাবা-মা শিউলি আখতারকে বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু রাজি করাতে পারেনি। বিয়ের প্রতি এক ধরনের ঘৃণাই এসেছে শিউলি আখতারের। কিন্তু তোকে দেখার পর…
প্রেম উথলে উঠেছে? যত্তোসব ।
কেনো শিউলি আখতারকে তোর পাশে মানাবে না?
আরে শুয়োর, আমার পাশে মানাক আর না মানাক; আমি কি বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত?
বিয়ে করলে তোর কোনো খরচ দিতে হবে না। কোনো টাকা-পয়সাও দিতে হবে না।
তীব্র চোখে তাকায় আমীর হোসেনের দিকে, তোদের দুই শালাকে ঘটক লাগিয়েছে কে রে?
তুই সত্যিই বলেছিস, মাহমুদ হাসান খুব ভালো মানুষের ঢংয়ে বলে, খালা মানে শিউলি আখতারের মা আমাকে আর আমীরকে ডেকেছিল গতকাল। সব বলেছে আমাদের। শিউলি কিন্তু পড়াশুনায়ও ভালো। ইন্টারমিডিয়েড পাস করে সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়ের পর স্বামীর অত্যাচারে বাবার বাড়ি চলে আসার পর আর পড়াশুনা হয়নি। খালা বলেছে, বিয়ের পর তোকে বিদেশে মানে তোর শ্বশুরের অফিসে নিয়ে যাবে, সৌদি আরবে।
টেবিলের সাদা কাগজের ওপর কলম রেখে ঘুরে বসে শফিক হাসান, তোরা আমাকে না জানিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিস?
আরে গাধা না, জোর দিয়ে বলে আমীর হোসেন, সামনে একটা সুযোগ এসেছে, সেইটা বললাম। তুই রাজি থাকলে বিয়ে, না থাকলে নেই।
ফুটানি চোদাস, মেয়েটা তোকে দেখে পছন্দ করেছে, ভালোবেসেছে, তোর চৌদ্দ গুষ্ঠির সৌভাগ্য, চেতে ওঠে মাহমুদ। জানিস, যে বাড়িতে থাকে গত মাসে ওই বাড়িটা কিনেছে শিউলি আখতারের বাপ জনাব আলহাজ সোবাহান আলী। তুই কেডা ওদের সামনে, বালেশ্বর বাল।
আমি তো কিচ্ছুই না। পায়ের ধূলো মাত্র।
তাইলে এক কথায় রাজি হয়ে যা।
মানে?
খেকিয়ে ওঠে আমীর হোসেন, আবার মানে মানে চোদায়? তুই তো দুই টাকার লেখক। কয়েকটা গল্প ছাপা হয়েছে পত্রিকায়, এই তো! আর একখান সাড়ে তিন হাজার টাকা দামের চাকরির মালিক। শিউলি আখতারকে বিয়ে করলে ঢাকা শহরে মাটির মালিক হয়ে যাবি।
মাটির মালিক মানে?
লেখকগিরি ফুটায়, আবার মাটির মালিক বোঝে না? আমীর হোসেন খেকিয়ে ওঠে, শিউলি আখতারকে বিয়ে করার সঙ্গে ওই বাড়িটির মালিক বনে যাবি। সাড়ে তিন কাঠার ওপর চারতলা বাড়ি। তোর জীবনের কষ্ট শেষ হয়ে যাবে, আমাকে পছন্দ করলে তো আমি সঙ্গে সঙ্গে…
আমি বলে দেই শিউলি আখতারকে তোকে পছন্দ করতে?
শালার ইঁদুর, পছন্দ কি কাউরে বইলা কইলা করানো যায়? ভালোবাসা, প্রেম তো অনুভব অনুভূতির ম্যাটার। তোর তো ভালো বোঝা উচিত!
মাহমুদ হাসান তাকায় কড়া চোখে, শিউলি আখতারকে তোর পছন্দ না?
পছন্দ না মানে? খুব পছন্দ। অমন ডাগর চোখের খোঁপা ঝোলানো মেয়ে কার না পছন্দ! কিন্তু বিয়ে আমি করতে পারবো না।
কেন?
আমি…
কী থামলি কেন?
মাহমুদ আমার সমস্যাটা তোরা বুঝবি না।
ক, বুঝাইয়া ক। কইলেই বুঝমু।
ও কইবে আমার বাল, হোন শফিক ওই মহিলা মানে কনকের মায় কোনো ঝামেলা পাকাইচে? আমীর হোসেন সোজা দাঁড়ায়। হোন এইসব মহিলাদের সাইজ করা কোনো ব্যাপার না। তুই ফোন নাম্বারটা দে ওর স্বামীর, আমি টাইট করে দিমু।
মাহমুদও তাকায়, আমীরের কথা সত্যি? ওই মহিলা কেন ঝামেলা করছে?
দুইজনের দিকে তাকিয়ে থাকে শফিক হাসান বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে, পলকহীন।
কিরে, কথা ক। ভ্যাবলার মতো চাইয়া রইচো ক্যা? খোঁচা দেয় আমীর হোসেন।
আমীর গত পনেরো দিন বিলকিসের কোনো খবর নাই।
মানে?
কই গেছে জানি না, দরজায় তালা; কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারি না। আমার বুকের ভেতরটা বালির মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে, আমাকে আমি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। ঝরঝর কাঁদতে শুরু করে মেসের মধ্যে নিজের লেখা ও পড়ার টেবিলের ওপর মাথা রেখে শফিক হাসান।
বিস্ময়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আমীর হোসেন ও মাহমুদ হাসান প্রেমিকার জন্য কাতর কান্না দেখছে একজন প্রেমিকের।
চলবে...