পর্ব-৩৯
রেহানা ভাবির ভাড়া বাসার বারান্দার রুমে শফিক হাসান ঢুকতেই মাহমুদ এবং আমীর হোসেন উদ্বাহু নাচতে শুরু করে। এমনিতেই অনেকটা কাকা ভেজা শরীর, যদিও ওপরের শার্ট কিছুটা শুকিয়েছে কিন্তু ভেতরের গেনজি, আন্ডারওয়ার ভিজা। শরীরের গভীর গোপন জায়গায় চুলকাচ্ছে কুর কুর করে, বিশ্রী অবস্থা। রুমে ঢুকেই দ্রুত প্যান্ট শার্ট বদলানোর ইচ্ছে শফিকের, কিন্তু রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদ আর আমীরের নৃত্যে বিস্মিত।
কী হলো তোদের? কাপড় খুলে নাচ; বিরক্ত শফিক আন্ডারওয়ারের নিচে ভিজে জায়গায় চুলকায়।
নাচ থামিয়ে সামনে দাঁড়ায় আমীর, সোনার চান পিতলার ঘুঘু, কও তো দেহি মাল খান কেডা?
মানে? শফিক বুঝে গেছে, কোনো না কোনোভাবে আমীর শালায় আজকের বিহার দেখেছে। চোখ মটকে তাকায়, কী বলছিস তুই?
কোমরে দুই হাত দিয়ে কড়া চোখে তাকায় মাহমুম হাসান, সত্যি করে ক, কার লগে রিকশায় উঠেছিস? সত্যি না কইলে তোরে রুমে থাকতেই দিমু না।
এত সুন্দর নৌকা জোটাইলি কেমনে? তোর নাকি মাইয়া মানুষ দেখলে বুক কাঁপে, হাটু কাঁপে, আমীর হোসেনের গলায় কৌতুক।
মাহমুদ হাসান মুখের ওপর মুখ আনে, তুই সেদিন কইলি শিউলি আখতারের খোপায় এক্কেবারে পাগল, আইজ আমার অন্য খোঁপা, ঘটনা কী? এতসব সামলামি কেমনে?
আমার শরীর চুলকাচ্ছে, গম্ভীর থাকার চেষ্টা করছে শফিক হাসান, আমাকে চেঞ্জ করতে দে।
আমীর হোসেন আর মাহমুদ হাসান পরস্পর তাকায়। আমীর ইশারা করলে মাহমুদ সায় দেয়, ঠিকাছে। তুই প্যান্ট শার্ট চেঞ্জ কর কিন্তু।
কিন্তু কী?
মহিলার পূর্ণ বিবরণ না দিলে তোরে রুম থেকে বের করে দেবো; তাকায় আমীরের দিকে, ঠিক বলেছি?
ঘাড় নাড়ায় আমীর হোসেন, একদম ঠিক।
সামনে থেকে সর; ওরা শফিকের সামনে থেকে সরে খাটে বসে। শফিক প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরতেম পরতে বলে, তোরা এত সিরিয়াস সামান্য একটা বিষয়ে নিয়ে?
ধমকে ওঠে মাহমুদ, হালায় কয় কী? এতবড় একটা ঘটনা, আর ও কয় সামান্য!
শোনো, এই মহিলা এক পুত্র আর কন্যার মা। আমি ছেলে-মেয়েদের পড়াই। ভদ্রমহিলা স্বামীর ওপর বিরক্ত, বলতে পারিস অনেকটা ক্ষ্যাপা। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে ফাটল দেখা দেয়, সেই ফাটলের মধ্যে আমি জাস্ট একটা ছুরির ফলা হয়ে ঢোকার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি বললে ভুল হবে, ওই ভদ্র মহিলাই আমাকে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। নইলে আমি কোথাকার কোন বালেশ্বর বাল; চাল নেই চুলো নেই, থাকি ঢাকা শহরের এঁদোগলির মাকড়সার জালে মোড়া এক অন্ধ গৃহের আরও অন্ধকারের কারখানায়। একটা সুযোগ পেয়েছি, সুযোগ নিয়েছি। কতদূর যাওয়া যাবে, জানি না। সেটা নিয়ে এত হৈ চৈ করার তো কিছু দেখি না।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শরীর একটি বিন্দুতে রসে ও পরম আস্বাদনে মিলে যায় পরস্পরে। কয়েক মিনিট দলিত মথিত হওয়ার পর বিলকিস ফিসফিসিয়ে বলে, বিছনায় চলো।
আমীর হোসেন আর মাহমুদ হাসান দমে যায়, নায়কের নৈরাশ্যজনক বাতায়। দুজনেই বুঝতে পারে, শফিক হাসান যথাযথই বলেছে। এই নির্দয় ঢাকা শহরে এক গৃহবধূ নিজে জায়গা না দিলে শফিক হাসানদের ঢুকে পড়ার সুযোগ কোথায়? সাহস তো অনেক দূরের ব্যাপার।
খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে আমীর বলে, সবই ঠিক আছে দোস্ত। কিন্তু…
কিন্তু কী?
মালটা খাসা! তোর জন্য আমার গর্ব হচ্ছে রে…আয়…আধশোয়া থেকে উঠে বসে আমীর হোসেন, তোর চরণের সাহসী আর সৌভ্যাগ্যের ধুলো নেই, যদি আমার কপালেও ওই রকম জোটে।
আয়, নিজের পা জোড়া বাড়িয়ে ধরে, নে ধুলো।
নামতে নামতে থেমে যায় আমীর হোসেন, তাকায় মাহমুদের দিকে, দেখলি হারামজাদার সাহস। আমি ধুলো নিতে চাইলাম আর ও সত্যি সত্যি পা বাড়িয়ে রেখেছে!
হাসে শফিক হাসান, পায়ের ধূলো না দিলে তো আবার বলবি সামান্য ধুলোও দিলাম না। তাই…
তোর ধুলোর নিকুচি করি, এখন চল।
কোথায়?
আমার কপালে নাইবা জুটলো, তোর কপালে তো ঝকঝকে তকতকে এক নারী জুটেছে, এক সঙ্গে রিকশায় উঠেছিস, হাওয়া খেয়েছিস। তোকে আজ রাতের খাবারটা হোটেল মাছরাঙ্গায় খাওয়াবো, আমীর হোসেন হাসে।
শুধু শফিক হারামজাদারে খাওয়াবি? ফোঁস করে মাহমুদ।
না, তুই ও লগে থাকবি। চল…
চল, মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গে খাট থেকে গেনজির ওপর শার্ট চড়ায়।
শফিক হাসান বিশ্বাস করতে পারে না আমীর হোসেনের রাতের খাবারের প্রস্তাব, তুই যে খাওযাবি, তোর কাছে টাকা আছে?
তুই কী মনে করোস আমি ফকিরনি? তোর মতো শফিক হাসানরে দুই একবেলা খাওয়ার টাকা পকেটেই থাকে, চল।
তিন জনে সত্যি সত্যি রুম থেকে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যার বৃষ্টির কারণে ঢাকা শহরের অলিগলি ভিজে ছুপ ছুপ। খানাখন্দকে পানি জমেছে। এইসব পার হয়ে তিন বন্ধু গলি মলি পার হয়ে রামপুরার মেইন রোডে বিখ্যাত হোটেল মাছরাঙ্গায় এসে খেতে বসে। খেতে খেতে বিলকিস খানমের সঙ্গে বিহার পর্ব যতোটা সম্ভব খুলে বলে আমীর হোসেন আর মাহমুদের কাছে শফিক হাসান। গরুর মাংস, পাতলা ডাল আর লাউয়ের তরকারি দিয়ে গরম ভাত খেতে খেতে বিস্ফোরিক মনে ও চোখে শোনে অবিশ্বাস্য ঘটনা। যে ঘটনা ঘটিয়েছে সামনে বসা টিনটিনে শফিক হাসান। দুই বন্ধু আমীর হোসেন আর মাহমুদ হাসান শুনতে শুনতে এক ধরনের নিষ্ফল ঈর্ষায় জ্বলতে থাকলেও সামলে নেয়, প্রিয় বন্ধুর প্রেমে তো বাগড়া দেওয়া যায় না। খাওয়া দাওয়া শেষে এক শ আশি টাকার বিল দেয় আমীর হোসেন।
পরের দিন শফিক হাসান পড়াতে যায় না কনককে। বেতার থেকে বিকেলে এসে নতুন লজিংয়ে যায়। দুপুরের ভাত সাড়ে চারটায় খেয়ে ফিরে আসে রুমে। কেউ নেই। একলা রুমে চিৎ বিছানায় শুয়ে গতকালের ঘটনাটা নিজের মতো করে ভাবতে থাকে; কেন বিলকিস খানম আমাকে বেছে নিলেন? একটু ভালো পড়াই, দুই চারটে গল্প লিখি, একটু আধটু সামাজিক পরিচয় তৈরি হয়েছে, সেই সূত্রে বিলকিস খানম আমাকে ধরেছে? কিন্ত মহিলাদের তো হিসাব থাকে। সেই হিসাবের বাইরে আমি। শূন্য মানুষ আমি। ছোট আমার তরী। বোঝাই ময়লা আর লড়াইয়ের আর্বজনায়। একটু কাৎ দিলে নৌকা ডুবে যাবে….।
দরজায় ছায়া পরে মানুষের; চিৎ থেকে সোজা হয়ে বসে শফিক হাসান, কে?
আমি দরজা ঠেলে ভেতরে মুখটা পাঠায়, রেহানা বেগম।
আরে ভাবি, আপনি? আসুন। কিন্তু রুমে তো মাহমুদ নাই।
হাসে রেহানা বেগম, মাহমুদ না থাকলে কী? আমি আসতে পারুম না?
নিশ্চয়ই পারবেন; তো বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য?
আমার জন্য কিছু করা প্রয়োজন নেই; আপনি একটা কাজ করতে পারবেন?
কী কাজ?
একটা থ্রির মেয়েকে পড়াতে পারবেন?
ভাবি, আমার কাছে আর একটা ছাত্র পড়ানোর টাইম নাই।
রেহানা বেগমের পাশে উঁকি দেয় শিউলি আখতারের মুখ। সঙ্গে চুলের সঙ্গে দৃশ্যমান অনন্য সুন্দর খোঁপা; বেশি না সপ্তাহে তিন দিন পড়ালেই হবে। শুনেছি আপনি খুব ভালো পড়ান। টাকা-পয়সা নিয়ে ভাইবেন না।
একটু সময় নেয় শফিক হাসান, হিসাব মেলায়, অফিস, লজিংয়ের পড়ানো সন্ধ্যা থেকে রাত নটা-সাড়ে নটা, অফিস আর লজিংয়ের পড়ানোর মাঝখানে মাত্র তিন চার ঘণ্টার বিকেলটুকু নিজের। সেখানেও ঢুকেছে কনক; এখন কনকের মাও; সময় কই? একদম সময় নেই। রাতে রুমে বসে নিজের গল্প লেখা, লেখার সঙ্গে পড়া; কোন দিকে যাবো?
কী ভাবছেন? শিউলি আখতার ঢুকে পরে রুমের মধ্যে। আমার আব্বা বিদেশে, আবুধাবি থাকে। আমরা তিনটা ভাইবোন। নীলু আমার ছোট বোন। আমার কাছে পড়ে না। খুব দুষ্টমি করে। ছোট ভাই ইভানের কাছেও পড়ে না। কয়েকজন মাস্টার রেখেছিলাম; কিন্তু নীলুর দুষ্টমীর কারণে ওরা টিকতে পারেনি। এক মাসও পড়াতে পারেনি। শুনছি, আপনি ভালো পড়ান।
ভালো না মন্দ পড়াই, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমার সময়। আমি হিসাব করে দেখলাম, আপনার বোন নীলুকে পড়ানোর কোনো সময় আমার নেই। একমাত্র শুক্রবার সকাল ছাড়া।
মাত্র একদিন? শিউলি আখতারের গলায় হতাশা।
এ ছাড়া আমার হাতে সত্যি একদম সময় নেই। আর আমি মিথ্যা বলতে পারবো না, পড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে আধঘণ্টা- পনেরো মিনিট আমি পড়াই না।
খুব বেদনামিশ্রিত গলা শিউলি আখতারের, সময় না থাকলে কী আর করবেন। চলুন ভাবি, শিউলি আকতার রুম থেকে বের হয়ে যায়। সঙ্গে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রেহানা বেগমও সঙ্গী হয় শিউলি আখতারের। রেহনা বেগম ও শিউলি আখতারের চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শফিক হাসানের মনটা ভীষণ খারাপ হলো; মেয়েটি এসেছিল করে। কিন্তু আমি কী করতে পারি? খারাপ মনটা সঙ্গে নিয়ে রুম থেকে বের হয় শফিক। দরজায় তালা লাগিয়ে ফিরে তাকাতেই চোখ আটকে যায়, সামনের বাসার গাছপালার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। এই মেয়েটি বা মহিলাই ছিল, এই বাসায় আসার পর প্রথম সকালের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া। বিষণ্ন মনটা ভালো হয়ে গেলে মুখে মৃদু হাসির রেখা দুলিয়ে বের হয় শফিক হাসান।
বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ছোট ছোট গলি পার হয়ে নেমে আসে রামপুরার পেছনে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠধনী জহুরুল ইসলামের হাইজিংয়ে। রামপুরা টেলিভিশনের পেছন থেকে পাইপে পাইতে বালি এনে তলিয়ে থাকা জায়গাটা ভরাট করছে। অনেক খানি ভরাট হয়ে গেছে। অনেকে বিকেলে এখানে আসে; দল বেঁধে খেলতে বা ঘুরতে। আমীর হোসেন, মাহমুদ হাসান ও শফিক বিকেলে সময় পেলে আসে। গল্প করে চলে যায় সন্ধ্যার আগে লজিংয়ে। কিন্তু শফিকের মাথায় ঢুকছে না; এই বালু ভরাট জায়গা কে কিনবে? কবে কিনবে? এই জলের মধ্যে একদিন বাড়ি ঘর হবে? ভাবনার সঙ্গে নিজের বিষণ্ন জীবনের সন্ধি করে সন্ধ্যার আগে ফিরে আসে লজিংয়ে। পড়াতে বসে পঞ্চম শ্রেণীর মিরাজ, দ্বিতীয় শ্রেণীর ফারজানা আর প্রথম শ্রেণীর ফারহানাকে।
আপনি কাল আসেননি কেন? পরের দিন কনককে পড়াতে গেলে প্রথম প্রশ্ন করে বিলকিস খানম।
হাসে শফিক, এমনিই।
বিলকিস খানম কাছে এসে পাশে বসে, জানেন অনেক ঘটনা ঘটেছে।
কী ঘটনা?
আপনি আমাকে গলির মোড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন তো, পাশের বাসার ভাবি দেখেছে। অন্যদিকে নিচের তলার এক ব্যাংকার; ওই লোকটার সঙ্গে দেখা হয়েছে সিঁড়ির গোড়ায়। আমার শরীরের ভেজা কাপড় দেখে লোকটার চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে…আমি দ্রুত বাসায় চলে আসি।
শফিক হাসান শুনছে, কী বলবে বুঝতে পারছে না। কী বলা উচিত, মনের মধ্যে তালাশ করে পাচ্ছে না।
বিলকিস খানম আবার শুরু করে, এই ঘটনা যদি কনকের বাবার কানে যায়, খুব ঝামেলা করবে।
সেটাই তো স্বাভাবিক।
সমাজ আমাকে বেঁধে রাখবে, আর আমি পিষ্ঠ হচ্ছি-লাঞ্চিত হচ্ছি-অপমানিত হচ্ছি দেখবে না?
না, আমাদের সমাজের সেই সময় নেই।
তাহলে আমি কী করবো? বিলকিস খানম কাঁদতে শুরু করে ফুঁপিয়ে, আমি এখন কোথায় যাবো? ওর বাবা খুব একরোখা মানুষ। আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করেই, যা ইচ্ছে করে ফেলতে পারে।
রূপসী একজন নারী চোখের সামনে, হাতের আয়ত্তের মধ্যে বসে কাঁদলে এত প্রস্ফুটিত সৌন্দর্যে বিকশিত হয়, প্রথম দেখে শফিক। রেশমি কোমল চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ছে দুপাশ থেকে। অদ্ভুত সৃন্দর দৃশ্যর বাতাবরণে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারে না, একটু কাছে এগিয়ে জড়িয়ে ধরে বিলকিস খানমকে। বিলকিস খানমও অপেক্ষায় ছিল এমন মধুর আকর্ষণের জন্য, টুকরো টুকরো চিনির ছন্দে গলে পড়ে বিলকিস খানম, শফিক হাসানের বুকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শরীর একটি বিন্দুতে রসে ও পরম আস্বাদনে মিলে যায় পরস্পরে। কয়েক মিনিট দলিত মথিত হওয়ার পর বিলকিস ফিসফিসিয়ে বলে, বিছনায় চলো।
শফিক হাসান এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না, পাঁজা কোলা করে বিলকিস খানমকে তুলে, বিলকিস খানমের রুমে ঢুকে বিলকিস খানমের ফর্সা সাদা বিছনার ওপরে শুইয়ে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে প্রশ্ন করে, ওরা কোথায়?
বিলকিসের মনে হচ্ছে; আরও সাবধান হওয়া দরকার ছিল। তাকায় কনকের দিকে, কী বাবা? কনক কোনো উত্তর করে না, তাকিয়ে দেখছে মায়ের কমনীয় মুখ!
আমার বড় খালার বাসা, খিলগাঁওয়ে গেছে।
দুটো শ্রান্ত কিন্তু প্রশান্ত শরীর পাশাপাশি শুয়ে-বিলকিস খানম আর শফিক হাসান। শফিকের মনে হচ্ছে; দিনের কোনো স্বপ্নযাত্রার মধ্যে ডুবে আছে। জীবনের জটিলতার চক্রে শহরের কত বিচিত্র বিস্ময়কর গল্প বা ঘটনা শুনেছে; আজ আচমকা নিজের জীবনেই ঘটে গেলো? এই যে নারী পুরুষের শরীরের মনের সম্পর্ক, এটা আসলে কী? প্রেম? ভালোবাসা? চাওয়া পাওয়া? হাসি কান্না? নাকি প্রতিশোধের কোনো তরবারি? আমার পাশে শুয়ে থাকা এই অনিন্দ্য নারী নিজের স্বামীর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে? যে প্রতিশোধের তরবারি আমি?
বিলকিস খানম উঠে বসে, তুমি বসো। আমি তোমার জন্য খাবার আনছি।
ঠিকাছে, শরীরজুড়ে সুখের নহর বইছে শফিক হাসানের। নিজেকে মনে হচ্ছে অথৈ জলের মাছ। ডুবে ডুবে জলের মোমসুখ নিংড়ে নিংড়ে খাচ্ছে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে, ঢোকে বাথরুমে। ধুয়ে, পরিষ্কার হয়ে জামাপ্যন্ট পড়ে ড্রয়িংরুমে কেবল বসেছে, বেজে ওঠে কলিংবেল। শফিক কী করবে ভেবে পায় না, আবার কলিংবেল বাজে। উঠে দরজা খোলে-দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কনক, কনকের বোন আর এক মাঝ বযসী লোক।
ভেতরের দরজায় এসে দাঁড়ায় বিলকিস খানম, কী হেলাল ভাই?
আপনার মাইয়া পোলারে দিয়া গেলাম। আর খালাম্মায়ে কাইলকা আইবো আপনার বাসায়, আমারে জানাইতে কইচে।
ঠিক আছে, আসুন আপনি।
হেলাল চলে যায়। বিলকিস খানম নিজেই দরজা বন্ধ করে কনক আর কনকের বোনকে নিয়ে ভেতরে যায়। যাওয়ার সময়ে ঘাড় ফিরিয়ে বলে, এক মিনিট আমি আসছি। শফিক হাসে, অবাক ঘটনা, বিলকিস খানম নিজেকে দ্রুত ঠিক করে নিয়েছে, শরীরের পোষাক ঠিক করে নিয়েছে। অনুভব করে শফিক, প্রবল খিদে পেয়েছে। টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাসের পানি খায়। শরীরটা মৌমাছির মতো নৃত্য করছে বাতাসে বাতাসে, সুখে বিভোর নিজের মধ্যে।
খাবারের ট্রে হাতে আসে বিলকিস খানম। রাখে টেবিলের ওপর, অনেক খাবার। ডিমের অমলেট, গরুর মাংস ভুনা, রুটি, সালাদ, চায়ের কাপ। দুজন তাকায় দুজনের দিকে। ইশারা করে বিলকিস খানম, শুরু করো।
আমি একলা?
হ্যাঁ।
না, আমি একা খাবো না।
একা খাও, কনক বাসায় আছে। যে কোনো সময়ে চলে আসতে পারে; দুজনকে একসঙ্গে খেতে দেখলে ওর বাবাকে বলে দিতে পারে। ও খুব শার্প ছেলে; খাবো দুজনে, একসঙ্গে পরে। এখন তুমি খাও।
ওকে, রাজকীয় স্টাইলে খেতে শুরু করে শফিক, ক্লান্ত শরীরে গরম গরম উপাদেয় খাবার খেতে খেতে শফিক হাসান নিজেকে হারিয়ে ফেলছে সুখের সঙ্গমে। জীবন, সত্যি অনেক উপভোগ্য, আনন্দের।
কেমন হয়েছে?
খুব সুস্বাদু।
সত্যি?
মিথ্যা বলবো কেন? সত্যি দারুণ সুস্বাদু হয়েছে তোমার রান্না।
আমার রান্নাটাই সুস্বাদু? আর কিছু না?
চোখে চোখ রাথে শফিক হাসান আর বিলকিস খানম। হাসে শফিক হাসান, তোমার শরীর সমুদ্রের কাছে এসব কিছুই না। তোমার শরীরের মধ্যে আমি পেয়েছি হাজার বছরের গান্ধর্ব সুখ আর বয়ে যাওয়া নদীর দোলা! আমি সুখে আনন্দে বিহ্বল।
আমিও, অনেক অনেক দিন পর আমি শরীর সুখে ভিজলাম। আমার শরীরটা শুষ্ক ঘাসের মতো পড়েছিল এতদিন; আজ বৈশাখের ঝড়ের বৃষ্টি এনে দিলে।
তুমি সুখী?
তোমার দেয়া সুখে আমি পূর্ণ শফিক।
শফিক মাংস রুটি খেয়ে হাতে তুলে নেয় চায়ের কাপ, আয়েশ করে চায়ে চুমুখ দিতে দিতে বলে, জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ দিলে আমায়।
শফিক, হাত ধরে বিলকিস খানম।
বলো।
তোমাকে ছাড়া আমি আমি থাকতে পারবো না।
আমিও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না বিলকিস।
দুজনে গভীর অনুরাগে হাত ধরেছে, তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার্ত সুখে। দরজায় এসে উঁকি দেয় কনক; মা?
নিমিষে হাত ছেড়ে দুজনে সরে বসে, কনক তাকিয়ে দেখছে মা ও প্রিয় শিক্ষককে। কনকের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছ ছোট বোন প্রিয়তা। বিলকিসের মনে হচ্ছে; আরও সাবধান হওয়া দরকার ছিল। তাকায় কনকের দিকে, কী বাবা? কনক কোনো উত্তর করে না, তাকিয়ে দেখছে মায়ের কমনীয় মুখ!
চলবে…