এ কেমন প্রার্থী, গাছের মগডালে বসে নিচে চলাচলরত মানুষকে সম্ভাষণ জানায়, আবার ভোটও প্রার্থনা করে! শতবর্ষী প্রাচীন কড়ইগাছের উপরে বসবাস করলেও নিচে রয়েছে ‘নেমপ্লেট’ ও দরকারি নির্দেশনা—
মুনাব্বির চৌকিদার
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান
ইলিশ পার্টি বাংলাদেশ (ইপিবি)
বিশেষ দ্রষ্টব্য : সরাসরি কথোপকথনে শব্দ বিভ্রাট ঘটলে নিচের নম্বর কল করুন
০০০০০৪২০৪২০
কড়ইগাছটির গোড়া থেকে শুরু করে শাখা, প্রশাখা, উপশাখা ও গাছের আগা পর্যন্ত সবদিকেই বিভিন্ন রকমের প্ল্যাকার্ড ঝোলানো। নিচের একটি প্ল্যাকার্ড পড়ে ভ্রূ কুঁচকে ফেলেন অনেকেই—
মুনাব্বির চৌকিদারের দু’নয়ন
কাঁঠাল-জনতার বৃহৎ উন্নয়ন!
সারা জীবন শোনা গেল আমজনতা এখন সেখানে আবার কাঁঠাল এল কীভাবে! ব্যতিক্রমী একজন দর্শনার্থী পাওয়া গেল অবশেষে। তিনি কপালে ভাঁজ না ফেলে হাসি দিলেন। তাকালেন মগডালপানে—‘কী ব্যাপার ইপিবি ভাই, আমকে কাঁঠাল বানিয়ে দিলেন কেন? নয়া কৃষিব্যবস্থার প্রবর্তন করছেন বুঝি?’
মুনাব্বির চৌকিদার পত্রপল্লবের ফাঁকফোকরে আকাশের ছোটখাটো পাটাতনগুলো গুনছিলেন এতক্ষণ—চিত হয়ে। নিচ থেকে প্রশ্ন ভেসে আসায় এবার মগডালে উপুড় হয়ে শুলেন। জবাব দিলেন চেঁচিয়ে—‘জাতীয় ফল হওয়ার সব গুণ থাকাসত্ত্বেও আমকে বঞ্চিত করে কাঁঠালকে দেওয়া হলো এ সম্মান। আবার সাধারণ মানুষকে বলা হয় আমজনতা। এদের সবাই কিন্তু খাঁটি বা ফরমালিনযুক্ত আম খাওয়ার সুযোগ পায় না। আমই যদি খেতে না পেল, তাহলে আম-জনতা বলে লাভটা কী! জাতীয় ফলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুণ্ন রেখে সবাইকে কাঁঠাল-জনতা ডেকে সম্মানিত করতে চাই। আমার দল ক্ষমতায় এলে সব আমগাছ কেটে ফেলে কোটি কোটি কাঁঠালচারা রোপণ করব। যাতে মানুষের পাশাপাশি জাতীয় পাখি দোয়েলসহ হাঁস-মুরগিও ঠোকর দিয়ে কাঁঠাল খাওয়ার সুযোগ পায়। আপনার প্রশ্ন ক্লিয়ার?’
‘না, মুনাব্বির সাহেব। আরও কিছু বিষয় জানার আছে। আপনার নির্বাচনী প্রতীক ইলিশ কেন?’
‘ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। জাতীয় ফুল শাপলা তরকারি দিয়ে রান্না করলে এর স্বাদ হয় অসাধারণ! আমি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ করলে ইলিশ উৎপাদন বাড়াব। জেলেদের ঘুষ দেব, যাতে জাটকা নিধন না করে। মানুষ যেন সর্বোচ্চ সাইজের ইলিশও কেজিপ্রতি ১০০ টাকার মধ্যে কেনার সুযোগ পায়।’
এবার বিরক্তি প্রকাশ করতে বাধ্য হন আগন্তুক—‘এসবের বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব? ১০০ টাকায় তো এখন পাঙ্গাশ মাছও পাওয়া যায় না।’
‘খুব সহজেই সম্ভব। একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের কাজই হচ্ছে, নাগরিকের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা। তাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেওয়া। আমি কিন্তু ৩০০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রির ব্যবস্থাও করতে পারব।’
‘সেটা কি মাথার উপরে—বড় গাছের ডগায় বসে সম্ভব? আপনিও অন্যদের মতো দূরের বাসিন্দা! আসি আসি বলে যারা কেবলই ফাঁকি দেয়! আম দেখিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয় আমড়া। আর জনপ্রতিনিধিরা আমজনতাকে গরুর মাংস খাওয়াতে চান নাকি উল্টো তাদেরই গরু-জ্ঞান করেন!’
চলাচলকারী আরও পথচারীকে সচকিত করে তুলে এবার হা হা হা শব্দে হাসলেন মুনাব্বির চৌকিদার। কষ্টে-সৃষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, ‘খেলাটা তো এখানেই! জমিয়ে দেব এবার। মাছের সঙ্গে মাংসের বিয়ে দিয়ে দেব!’
‘খেলা হবে? তার মানে আপনিও খেলোয়াড়!’
‘খেলা মানেই খারাপ কিছু নয়। যদি সেটাই হতো প্রীতি ম্যাচ কোথাও অনুষ্ঠিত হতো না। তবে এসবের কিছুই আমি বলতে চাইনি। ইলিশ পার্টি বিশ্বাস করে, জনপ্রতিনিধি মানে সবার প্রতিনিধি। তাদের হয়ে মাঠে-ময়দানে খেলে দেবে। আর জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তারা কখনই জনগণের কাছাকাছি থাকেন না। ভোটে পাস করলে দূরে সরে যান। ইপিবি হবে সেই রাজনৈতিক দল, যারা সব সময় জনতার বাসায় সাবলেট ভাড়া থাকবে। কোনো নেতা-কর্মীরই নিজস্ব কোনো ফ্ল্যাট বা বাড়ি থাকবে না। আপাতত কৌশলগত কারণে আমরা দূরে আছি। কেউ গাছবনে কেউ হোগলাবনে বা কচুবনে বসবাস করছি। ভোটের পরে এক কাতারে সামিল হবো। আগে তিতা, পরে মিঠা; বুঝেছেন জ্যাঠা!’
আগন্তুক হাসল এবার—‘এখনো খেয়াল করলে দেখবেন, বড় বড় সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়ি সমতল থেকে অনেক উঁচুতে। পাহাড়চূড়ায়ও বাসভবন আছে। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় তারা বাঙালিদের পদানত করে রাখতে চাইত বলেই উঁচু জায়গায় বসবাস করত। তাই আপনার এই গাছ-বাস আমার ভালো লাগল না। আমি এখনো দাঁড়িয়ে আছি আপনার পায়ের নিচে। প্রতীক বেছে নিয়েছেন ইলিশ, মাছ তো পানিতে থাকে। আকাশে থাকে চিল-শকুন!’
আগন্তুকের নির্বুদ্ধিতায় এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইপিবি চেয়ারম্যান। ভাবনা গুছিয়ে বললেন, ‘আমি এখন গাছের সঙ্গে থাকছি। ভবিষ্যতে যে পুঁটিমাছের সঙ্গে থাকব না, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। কিছু ইতিহাস আমি জানি, বাকি ইতিহাসটুকু নিজেই সৃষ্টি করব। ইতিহাসচর্চা বাড়াব আরও। অন্যদিকে আপনি কম জানেন বলেই এত প্রশ্ন জাগে। কাঁঠাল-জনতার প্রতিনিধি হয়েও কিন্তু আপনি কাঁঠাল খান না। নিয়মিত কাঁঠাল খেলে বুদ্ধি বাড়ে!’
‘অন্যদের মতো ইতিহাসের নামে পাতিহাঁস, মনগড়া গল্প গেলাবেন না তো আবার?’
‘প্রশ্নই ওঠে না। আমি নিজেই প্রবর্তন করব নতুন ইতিহাস। বলেছি না, ইতিহাসচর্চা বাড়াতে হবে! এখন যান। আমি একটু ঘুমাব। বিকালে সাংবাদিক সম্মেলন আছে। ইলিশ মার্কায় ভোট দিতে ভুলবেন না যেন। ভুলে গেলে কিন্তু সুলভ মূল্যে ইলিশ খেতে পারবেন না!’
দুই.
পেশ ক্লাবের সামনে সব সময়ই দেশের লাঞ্ছিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের আনাগোনা থাকে। আবার ‘ক্লাস সেভেনের পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হোক’, ‘দুর্নীতি করার অধিকার দিতে হবে’, ‘প্রত্যেক মানুষকে ভিআইপি ঘোষণা করা হবে না কেন’ এমন বালখিল্য আব্দারও কম দেখা যায় না। সব শ্রেণির মানুষ ভালোমন্দ মিলিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা এখানটায় পেশ করে বলে এটার নাম হয়ে গেছে পেশ ক্লাব। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কত মানুষ যে সমস্যার কত কথা বলে যান—কত বিচিত্র ধরনের আহাজারির কথাও শুনতে হয়! গত সপ্তাহে একদল লোক ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের দাবি—প্রতিদিনই বউ দিবস ঘোষণা করা হোক। কারণ বউ ছাড়া কারও একটা দিনও চলে না। কারও মা, কারও স্ত্রী, কারও ভাবি, কারও কন্যা—শেষপর্যন্ত নারীর পরিচয় একটাই, বউ! ঘুমিয়ে আছে শিশুর মাতা সব কিশোরীর অন্তরে—এভাবে হিসাব করলে সব কন্যাশিশুই আদতে ভবিষ্যৎ-বউ! এদের সম্মান দেওয়ার জন্যই প্রতিদিনকার দিবসটি প্রবর্তন জরুরি।
হতাশাজনক চিত্র দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে যাবেন তিনি—এসময়ই কিনা তার নাক বরাবর নিশানা ভেদ করল প্রতিবেশী কাক।
মুনাব্বির চৌকিদার ইদানীং নতুন একটি কৌশল অবলম্বন করছেন। গাছের সঙ্গে সেট করে নিয়েছেন দশাসই একটি মাইক। যখন যে বা যারাই দাবিদাওয়া পেশ করে, তিনি মাইকে সংহতি প্রকাশ করেন। এই দাবি যে শতভাগ ন্যায্য ও যৌক্তিক এমন ‘সহমত রেখে গেলাম, ভাই’ হতেও সময় লাগে না। শেষে এটা বলে বিক্ষুব্ধদের আশ^স্ত করেন—ইলিশ পার্টি বাংলাদেশ ক্ষমতায় এলে বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে। প্রয়োজনে বারো শ’ বা বাইশ হাজার সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ বোর্ড গঠন করা হবে।
এমন ফাঁকা আওয়াজ ভালোই কাজ দেয়। লোকজন আস্থায় নেয় এসব প্রতিশ্রুতি। ফলে ইপিবির নাম ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে তেঁতুলতলা থেকে মুলাতলায়; নীলসাগর-রামসাগর থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরে।
কিন্তু বর্তমানে কী শুরু হলো! কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এখন আর পেশ ক্লাবের সামনে দাঁড়াচ্ছে না। কড়ইগাছের নিচে দাঁড়িয়ে মুনাব্বির চৌকিদারের কাছে মনোবেদন প্রকাশ করেই চলে যায়। যথারীতি ইলিশ-চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা আশ্বাস দেন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন। কিন্তু এভাবে চলার কারণে তিনি মাইকে ফুঁ দেওয়ার সুযোগ পান না। গলার স্বর পৌঁছায় না অনতিদূর পর্যন্তও।
মুনাব্বির চৌকিদারকে তিন বেলার খাবার পৌঁছে দেন দলের মহাসচিব তাহাদ্দুক সারোয়ার। লোকটার থলথলে স্বাস্থ্য, খাদ্য পানীয় ঘটি-বাটি নিয়ে মোটা গাছে চড়তে কষ্ট হয়ে যায়। তিনি বসবাস করেন কৃষ্ণচূড়া গাছে; এই প্র্যাকটিসটুকু আছে বলেই এত বড় গাছে ওঠার সাহস করেন। দল ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ, আদর্শের কথা চিন্তা করে মাসের পর মাস তাকে খাবার সরবরাহের কাজটি করে যেতে হচ্ছে। মনে আশা, দল নিশ্চয়ই কোনো একদিন ক্ষমতায় আসবে। তখন উন্মুক্ত জলাশয় ও বিলের ইলিশ দিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে সবাই একত্রে মজা করে খাওয়া যাবে। স্লোগানটা আওড়ানো যাবে তখনো—মার্কা হলো ইলিশ/ কী করে তোরা ভুলিস!
ইলিশের কাঁটা থেকে অবশিষ্ট স্বাদটুকু চুষে নিতে নিতে মুনাব্বির চৌকিদার প্রশ্ন করেন দলের সেকেন্ড ইন কমান্ডকে—‘রাজনীতির ভাও কীরাম বুঝতাছেন? মসনদ কত দূরে? আন্দোলনের সুফল জমাট বাঁধবে কবে?’
তাহাদ্দুক সারোয়ার মাথা চুলকে বলেন, ‘সব বোঝাপড়ার শেষ ধাপ হচ্ছে ভোটের মাঠ। তার আগপর্যন্ত যা কিছু দেখা-শোনা যায় সবই মরীচিকা! ইয়ে…আমি বলছিলাম কী, এ বছর বৃষ্টি-বাদলা বেশি হচ্ছে। আপনি এবার অন্তত অ্যাপার্টমেন্টে উঠে যান। ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না।’
‘হঠাৎ এমন কথা কেন? ঝুঁকিইবা কীসের!’
‘বাতাস জোরে বইলে যদি গাছ থেকে আপনাকে দূরে কোথাও উড়িয়ে নিয়ে যায়? সরকারি দল-বিরোধী দলসহ অন্য দলগুলোকেও কিছুটা বিশ্বাস করা যায় কিন্তু এসব ঘূর্ণিঝড়-টর্নেডোকে একটুও ভরসা করার সুযোগ নেই। দেখেননি নার্গিস ফণি সিডর আইলা বুলবুল কী খেলাটা দেখিয়ে গেলো!’
‘এই বুদ্ধি নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছেন তাহাদ্দুক সাহেব! আমি খেটেখাওয়া মানুষ—শ্রমিক মজুর কৃষকের নেতা এসব বোঝাতেই গাছে থাকি, লুঙ্গি-গামছা পরি। খুড়কুটো ছাড়াই পাখির মতো বাসা বানিয়েছি। আজকে যে আমার ও ইলিশের এত জনপ্রিয়তা—সব গাছে থাকার জন্যই। এই কারণেই মানুষ আমাদের উপর ভরসা রাখে। বিশ্বাস করে, সমর্থন দেয়, ভালোবাসে।’
‘সেটা ঠিক আছে। আপনার কষ্টের কথা ভেবেই চিন্তাটা করলাম। তাছাড়া দলেরও প্রেস্টিজ আছে। ছাত্রদের দলে ভেড়াতে পারছি না মরার গাছের কারণেই। তারা মনে করছে, এই দলে যোগ দিলে বখরা তোলা যাবে না, দখল করা যাবে না, হুমকি-ধমকি দিয়ে চাঁদা তুলতে পারবে না; উল্টো বসবাস করতে হবে গাছতলায়!’
‘নাকি আপনারই কৃষ্ণচূড়া গাছে থাকতে কষ্ট হচ্ছে? এখন বউকে মেরে ঝিকে শেখাতে চাচ্ছেন! ছাত্র-ছাত্রীদের বিষয়ে কী করতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত আমার মাথায় আছে। পরে শেয়ার করব। আর সারা রাত আমি গাছেই থাকি—এমনটা ভাবেন কেন? আপনারা বোকা নাকি আমি? নাকি পচা কাঁঠাল-জনতা? আদতে বোকা কে বা কারা!’
‘কোথায় থাকেন তাহলে আপনি? আমিও তবে মাঝে-মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে যাব!’
মুনাব্বির চৌকিদার জবাব দিলেন না। রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘স্কুলজীবনে এইম ইন লাইফ হিসেবে কী লিখেছিলেন বা বলেছিলেন মনে আছে?’
‘যখন যা মনে এসেছে, বলে দিয়েছি। কখনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স… শুধু একবার আদর্শ মা হতে চাই বলে হাসির পাত্র হয়েছিলাম। সহপাঠী মেয়েরা খুব ক্ষেপিয়েছিল!’
‘আর আমি হতে চেয়েছিলাম খেলোয়াড়। সেটাই হতে চলেছি। কয়েক মাসের মধ্যেই দেখবেন, ভরা মাঠে আমি কত গোল দিই, কত উইকেট ফেলি! গণ্ডায়-ছক্কায়…।’
‘আপনি যে গাছপাকা খেলোয়াড় সেটা আগেই বুঝেছি। কিন্তু হঠাৎ এইম ইন লাইফ নিয়ে মাতলেন কেন?’
‘কারণ আছে। আমার যে-সহপাঠী বন্ধু তোতাপাখির মতো বলত কৃষক হতে চাই সে এখন অনেক বড় প্রশাসক। আগামীতে ওর সহায়তা লাগতে পারে। একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। ওকে আজই পৌঁছে দেবেন। আর আপনিও একটা চিঠি লিখুন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর। সাধারণ ও অসাধারণ মানুষদের আন্দোলন-সংগ্রাম দমাতে ইপিবি সরকারের জন্য কী ধরনের সহায়ক ভূমিকা পালন করছে—এসব লিখবেন সবিস্তারে। আমাদের লক্ষ্য কিন্তু শান্তি—সংঘাত নয়!’
‘বুঝতে পেরেছি, আপনি আদতেই চৌকস খেলোয়াড়। সব দলের হয়েই খেলেন!’
‘৬৪ জেলায় ও বিদেশে মহাসমাবেশ ডাকার বিষয়টি নিয়েও ভাবুন। আমাদের পাড়ি দিতে হবে অনেক দূরের পথ। খাল হয়ে মহাসাগরে পৌঁছাতে হবে!’
তিন.
হঠাৎ করে কী হলো দেশের, বুঝে উঠতে পারেন না মুনাব্বির চৌকিদার। পেশ ক্লাব এলাকা আরও ঝিমিয়ে পড়েছে। তার কাছেও আগের মতো সমস্যাগ্রস্ত লোকজন আসছে না। এখন সভা-সমাবেশ হয় না, দাবিদাওয়া নিয়েও সোচ্চার হয় না বিভিন্ন জেলার মানুষ। হাউকাউ পার্টিরও দেখা নেই। হতাশাজনক চিত্র দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে যাবেন তিনি—এসময়ই কিনা তার নাক বরাবর নিশানা ভেদ করল প্রতিবেশী কাক। রাগ করতে গিয়ে সহানুভূতিই প্রকাশ পেল তার আচরণে—‘যা, হতচ্ছাড়া কোথাকার!’
সাহস কত, মুখে মুখে তর্ক করে আবার ক্ষমতার গরমও দেখায়, টাকার বড়াই করে! ইলিশ দেখেছিস বাছা, ইলিশের দাম বুঝিসনি, কাঁটাও আটকায়নি গলায়!
কিছুদিন আগে তিনি কাকাধিকার-বিষয়ক সম্মেলনে অপ্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেখানে এটাও বলেছিলেন, ‘জাতীয় পাখি দোয়েল না হলে কাকই হতো ঠিক ঠিক। কারণ কাকের কাছে শিখতে হবে ঐক্য ও একাত্মবোধের বিষয়গুলো। কাক জানে কীভাবে প্রতিশোধ নিতে হয়!’
সামনে বসা ইপিবি কর্মী-সমর্থকরা তুমুল করতালি দিল। শব্দে মিলনায়তন ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলে তিনি বলেছিলেন, ‘কাকের সঙ্গে আ-কার দিলে আমরা কাকাকে পাই, হ্রস্ব ই-কার দিলে পাই কাকিকে। চিন্তা করে দেখুন, কাক না থাকলে কাকা-কাকিকে কোথায় পেতাম? কী হতো শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্কটির! কাকতালীয় শব্দটিইবা অভিধানে যুক্ত হতো কীভাবে?’
নাক পরিষ্কার করে মুনাব্বির চৌকিদার কাত হয়ে শোন। তাকান নিচের পৃথিবীর দিকে। একজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে আছে বিষণ্ন ভঙ্গিতে। মুনাব্বির ডাকেন তাকে—‘কী পুলিশ ভাই, বাড়তি কোনো ইনকাম নাই!’
রাগে মুখ বিকৃত হয়ে উঠল পুলিশ সদস্যটির। সামনে থেকে খুঁজে নিল ইটের আধলা। ছুড়ে মারার ভাবগতিক অনুধাবন করে মুনাব্বির বললেন, ‘ভাবিয়া করিয়া করিও কাজ! আগামীকাল কিন্তু পত্রিকার খবর হবে এটি। তখন এটাকে আমি নানাভাবেই ক্যাশ করতে পারব। চাইলে সরকারি দল, বিরোধী দল উভয় পক্ষকেই বেকায়দায় ফেলা যাবে। কিন্তু তোমার কী দশা হবে—ভাবো একবার!’
পুলিশ সদস্য ইটের গতিপথ পরিবর্তন করে ছুড়ে মারল অদূরে দণ্ডায়মান একটি নেড়ি কুকুরের দিকে। কুঁইকুঁই শব্দ তুলে বিরক্তি প্রকাশ করে দৌড়ে পালাল কুকুরটি। একটু দূরে গিয়ে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে নিজের ভাষায় হুমকিও দিল—খাড়া, তোগোরে দেইখা লমু। আমার মিত্র বাহিনী আসুক!
গাছে আবাস-গাড়ার পরদিন থেকেই প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরা শুরু করেছেন মুনাব্বির। সাধারণের কাতারে মিশে যাওয়ার জন্য লুঙ্গি-গেঞ্জির চেয়ে ভালো পোশাক আর হয় না। লুঙ্গির খুঁট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে কল করলেন এক শিল্পপতিকে। কুশলাদি বিনিময়ের পর বললেন, ‘আমি তো এবার নির্বাচন করব। একজন ভবিষ্যৎ-এমপি মহোদয়কে আপনি সর্বোচ্চ কত টাকা পর্যন্ত অনুদান দিতে পারবেন?’
ওপাশ থেকে ভেসে এল বজ্র-হুঙ্কার—‘মুখ সামলে কথা বল, মুনাব্বির। তুমি কি জানো না, এখন ব্যবসায়ীরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে! তারাই দেশের মা-বাপ, শালা-সম্বন্ধি। তোমার আগেই আমি নিজেই এমপি হয়ে যেতে পারি। তখন তুমি আমাকে কী দেবে—সালাম নাকি সালামি!’
বিরক্ত ও অপমানিত মুনাব্বির চৌকিদার কালো খাতাটা বের করলেন। এটা তার ‘ব্ল্যাক লিস্ট’ খাতা। টুকে রাখলেন বেয়াদবির বিষয়টা। কখনো দল ক্ষমতায় এলে এ শালাকে প্রথমেই টাইট দিতে হবে। সাহস কত, মুখে মুখে তর্ক করে আবার ক্ষমতার গরমও দেখায়, টাকার বড়াই করে! ইলিশ দেখেছিস বাছা, ইলিশের দাম বুঝিসনি, কাঁটাও আটকায়নি গলায়!