(পর্ব-৩৩)
মায়ের কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই। মানব-পৃথিবীতে, ত্যাগে, ধৈর্যে, দয়ায়-পরমত সহিষ্ণুতায়—এই একটি সম্পর্কই অমর, অক্ষয় ও অধরা। সৃষ্টির সেরা সম্পর্ক—যা অমৃতের সমান। আমার মায়ের পোশাকি নাম ছিল বেগম রহিমা হাফিজ। ডাক নাম লেবু। প্রাণজুড়ানো লেবু ফুল বা লেবুর সুগন্ধে তার সন্তানদেরসহ তিনি আমৃত্যু মাতিয়ে রেখেছিলেন চারপাশের অপরূপ জীবন ওজগতের প্রতিটি অনুভূতিকণা।
মায়ের বয়স জানতে চাইলেই গল্পচ্ছলে তিনি প্রায় বলতেন, ‘তোমার আব্বার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। তখন আমার আঠারো বছর বয়স ছিল।’ কিন্তু আমার পরম শ্রদ্ধেয় মাতামহী হায়াতুন্নেসা মায়ের জন্ম তারিখটি কোথাও লিখে রাখেননি বলে সেই দিনটি সবার অগোচরে হারিয়ে গেছে। মা-ও আর সঠিকভাবে জানাতে পারেননি আমাদের।
আমাদের সন্তান অভিন্ন ও অব্যয়ের জন্মদিন পালনের পাশাপাশি হঠাৎ মাকে বাড়তি আনন্দ দেওয়ার জন্যে আমার মায়ের জন্মদিনটি পালনের কথা ভাবছিলাম। সেই লক্ষ্যে তার জন্মদিনের তারিখটি কবে—জানতে চাইলাম মায়ের কাছে। মা নিজের জন্ম তারিখ বলতে পারলেন না।
বাধ্য হয়ে আমিই সিদ্ধান্ত নিলাম—প্রতিবছর আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বজুড়ে পালিত ‘মা দিবস’-এর দিনটি আমাদের মায়ের জন্মদিন হোক। আমার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলো ভাই-বোনেরা। ফলে ২০১১ সালের মা দিবসের দিনটিতে প্রথম আমরা সোবহানবাগে প্রতিষ্ঠিত প্রিন্স ব্যুফে রেস্তোরাঁয় খুব ঘটা করে মায়ের জন্মদিন উৎযাপন করি। এরপরে ভাইবোনেরা মিলে বাইরোটেশন মায়ের জন্মদিন পালন করে আসছিলাম খুবই আনন্দ-উৎসাহ নিয়ে। আমাদের পরিবারে এই উৎসবটি ছিল যার যার ব্যক্তি পরিবারের বাইরে ঐক্য সম্মিলিনের কমন একটি আনন্দ উৎযাপন পর্ব।
এতে আমার মা খুবই খুশি ছিলেন। সন্তানদের এই পাগলামি দারুণ উপভোগ করতেন তিনি। ইচ্ছে ছিল ২০২২ সালে মায়ের ডাকনাম ‘লেবুমনির জন্মদিন/ শুভেচ্ছা স্বাগতম’ লিখে আগামী জন্মদিনটি পালন করবো আরও মজা করে—তার নাতি-পুতি-ধুতিদের—সবাইকে নিয়ে। কিন্তু সে সময়-সুযোগ তিনি আর দিলেন না আমাকে।
শেষের দিকে মাকে আমার নানিমা আর নাম ধরে ডাকেননি। দিলুর মা কিংবা রানুর মা বলে ডাকতেন। তবে মায়ের নিকট আত্মীয়-স্বজনেরা লেবু নামে ডাকতেন মাকে। ছোটবেলায় নানাবাড়ি গেলে আমাকে দেখেই মায়ের বান্ধবীরা বলতেন, এইটা লেবুর মেয়ে না? দেখলেই চেনা যায়। একদম লেবুর মতো হয়েছে। আমাদের মাতৃকুলীয় আত্মীয় বিচারপতি একে এম নূরুল ইসলাম একসময় দেশের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন, তার স্ত্রী একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি জাহানারা আরজু—দু’জনেই মাকে লেবুখালা, লেবুখালা বলে ডেকে কথা বলতেন। সেই ডাকটি দারুণ শ্রুতিমধুরছিলো—যা আমার শ্রবণকে এখনো বিবশ করে রেখেছে।
তিনি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। আমি এমন একজন মায়ের গর্ভে জন্মেছি, যিনি ঈশ্বরের প্রিয় প্রতিবেশী কেবল নন, স্রষ্টার মতোই লীলাময়, ফুলে-ফলে বাঙ্ময়ও।
আমার মায়ের মৃত্যুর মাসখানেক আগে হাসপাতাল থেকে ভালো হয়ে বাড়ি ফেরার পরের দিন আরজু আপা (কবি জাহানারাআরজু)ফোন দিয়ে তার কুশলাদি জেনেছেন। সমসাময়িক বয়েসী খালা-ভাগনীদের মধ্যে যে মধুর বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা ছিল—সেইসব দিনের স্মৃতিচারণ করে কবি আপা আমাকে ফোনে বলছিলেন, ছোটবেলায় যখন নানাবাড়ি জাবরা গ্রামে যেতাম, দেখতাম লেবু খালা কাঁঠাল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, নয়তো পুকুরে সাঁতার কাটছেন। তখন তার লম্বা কালো চুল জলের ওপর ভেসে থাকতো। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে তার সেই সাঁতার উপভোগ করতাম ছোটবেলায়।
আমার মা তাদের সম্পর্কে এবং বয়সেও কিঞ্চিত বড় ছিলেন বলে ধারণা করি। আমার আব্বা কখনো মাকে লেবু নামে ডাকেননি। হ্যা গো, ওগো বলে সম্বোধন করে কথা বলতেন। তার মুখে মায়ের নাম শুনিনি কোনো দিনও। এমনকি সন্তানের নাম ধরে অমুকের মা কিংবা তমুকের মা বলে কখনো ডাক-খোঁজ করেননি। এই মা আমার চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গী ছিলেন, এখনো আছেন, আমৃত্যু থাকবেন। আনন্দে-উদ্বেগে,কষ্টে-দুঃখে-শোকে-শিহরণে—চেতন-অচেতন-অবচেতনে কিংবা বিনিদ্র রজনীর দহনে, সুতীব্র হাহাকারে, দু’চোখের প্লাবনে—এমনকি সঙ্গমে ও শীৎকারেও তিনি আমার অংশ হয়ে সঙ্গে ছিলেন সারাক্ষণ।
মাকে হারিয়ে এখন বুঝি, আমার চেয়ে আমার মা-ই আমাকে বুঝতেন সবচেয়ে বেশি। তাকে কখনো মুখ ফুটে কিছু বলতে হয়নি আমাকে। ন্যায়ে-অন্যায়ে একটি ‘না’বাচক শব্দ ব্যবহার না করেও যে সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করা যায়—আমার মা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। আমি এমন একজন মায়ের গর্ভে জন্মেছি, যিনি ঈশ্বরের প্রিয় প্রতিবেশী কেবল নন, স্রষ্টার মতোই লীলাময়, ফুলে-ফলে বাঙ্ময়ও।
সংসার বাগানখানি তিনি সাজাতে পেরেছিলেন তার মনের মতো চিরহরিৎ পত্র-পুষ্পে সুশোভিত করে। জানি, জন্মদান করতে পারলেই সব মা সমান হয় না। সন্তানের আদালতে কোনো কোনো মাকে কাঠগড়ায় দাড়াতে হয় বৈকি।আমার মা ছিলেন ‘মা’শব্দটির মহিমাখচিত চিরকালের উত্তরীয়।
সেদিনই তার পছন্দ অনুযায়ী দশ হাজার টাকায় ছোট জরিপাড় শাদা একটি তসর শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম মাকে। খুবই পছন্দ করেছিলেন তিনি, বেশ ক’বার পরেছেনও বিভিন্ন পালা-পার্বণে।
আমার মায়ের ছয়মাস বয়সী প্রথম পুত্র সন্তানের মৃত্যুর পরে আমাকে পেয়েছিলেন তিনি শীতল হতে। এককথায় বলা যায়, তার শোক-সন্তপ্ত মাতৃ-হৃদয়ের হাহাকার বিসর্জন দিয়েছিলেন তিনি আমাকে পেয়ে। কাজেই মায়ের নারী প্রতিনিধি হিসেবে আমার প্রতি তার ছিল বাড়তি মনোযোগ—যা ছোটবেলায় বুঝতে পারিনি। বড় হতে হতে তার আঁচ পেয়েছি সংসার সমুদ্রের অতল জলের তলদেশ থেকে।
আমি মায়ের প্রথম সন্তান। আমার প্রতি তার প্রত্যাশাও ছিল আকাশছোঁয়া। সেই হিসেবে আমার জ্ঞানার্জনের প্রতিটি পর্ব, সৃজনশীলতার অর্জন, চাকরি জীবনের নানাবিধ কর্মের দায় ও দায়িত্ব আমার মা যেন নিজের সত্তার গভীরে তার নির্যাসকে অনুভব ও উপভোগ করতেন পরম আনন্দে।
আমার প্রতি তার মায়া-মমতা, অঢেল বিশ্বাস, নির্ভরতা সব কিছুই ছিল অটল পাহাড় সমান। মা তার খাওয়া-পরার ইচ্ছে অনিচ্ছার কথা কখনো বলতেন না আমাদের। কিন্তু কেমন করে যেন আমি বুঝে যেতাম মায়ের ইচ্ছের প্রজাপতি কখন কী চায়। ঢাকায় মা আমার বাসায় বেড়াতে এসেছেন, আমি ইডেন কলেজ থেকে ফেরার পথে পোলার আইসক্রিমের একটা ফ্যামেলি সাইজবক্স এনে মায়ের হাতে তুলে দিয়েছি।
মা আমার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, তুমি কেমন করে বুঝলে যে, আমার এখন আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছিল। আত্মতৃপ্তির মিষ্টি একটুকরো হাসি উড়িয়ে দিয়ে মায়ের হাতে একটা কাঁচের বাটি এবং টেবিল চামচ তুলে দিলাম যেন তিনি ইচ্ছেমতো প্রাণভরে তৃষা হরিয়ে আইসক্রিম খেতে পারেন।
আমার কাছে মা মানে আমার ভক্তি ও বিশ্বাস। ঠিক একইভাবে মায়ের রুচি অনুসারে যে শাড়িগুলো বিভিন্ন পালা-পার্বণে কিনতাম—সেগুলো খুবই পছন্দ হতো তার। আমার অন্য ভাই-বোনদের দেওয়া শাড়ি কাপড় সব বেলায় যে তার পছন্দ হয়েছে—তা নয়। কিন্তু আমার বেলায় মনে হতো আমি তার ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পেরেছি। মা নিজেও যেন জানতেন, আমি যখন তার জন্যে কিছু কিনবো—সেটি আমার সামর্থ্যের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সর্বোচ্চ কেনাকাটার উদাহরণ।
আমি আমার চাকরি জীবনের শেষ দিকে নিজের জন্যে যখন প্রথম দশ হাজার টাকার একটি শাড়ি কিনেছি, সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয়েছিল—নিজে এত দামের একটা শাড়ি পরার আগে মাকে পরানো উচিত। সেদিনই তার পছন্দ অনুযায়ী দশ হাজার টাকায় ছোট জরিপাড় শাদা একটি তসর শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম মাকে। খুবই পছন্দ করেছিলেন তিনি, বেশ ক’বার পরেছেনও বিভিন্ন পালা-পার্বণে।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-৩২॥ দিলারা হাফিজ