সুন্দর ও কুৎসিত
প্রকৃতি দিয়ে জীবনকে পাঠ করা যায় না, কিন্তু তুমি প্রকৃতির নিবিড় পাঠ থেকে জীবনের অর্থবহতা খুঁজে পেতে পারো। আজ তোমার মনে হলো যে, তোমার জন্য এটি খুব জরুরি, তুমি তা হাসিল করলে, কাল দেখবে তা তোমার কাছে আর প্রিয় নয়। মানুষ বলতে পারে না প্রথমত, কী চায় সে! কেনই বা চায়, তাও। শুধু বেঁচে থাকে চারপাশের প্রয়োজনে, সে যা নিজের প্রয়োজন বলে ভেবে থাকে, তা আসলেই কি তার প্রয়োজন—তা না ভেবেই।
হে মহান সাধু, আপনার কথা আমাদের শুনতে ইচ্ছা হয় বারবার। কিন্তু আপনি এত সুন্দর করে এসব কথা বলেন যে, আমরা যতক্ষণ শুনতে থাকি, ততক্ষণ মনে হতে থাকে, আসলেই আমরা আপনার কথার ভেতর সত্য ও সুন্দরের যে আলো, সে আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছি। অথচ যখন ফিরে যাই নিজেদের কেজো জীবনে, তখন মেলাতে পারি না সে সত্য ও সুন্দরকে কুৎসিতের সঙ্গে। আমরা কি আসলেই যেতে পারছি, যেখানে আপনি যেতে বলছেন, না কি আপনার কথা আমাদের শুনতে ভালো লাগে তাই শুনি? অভ্যাগতদের একজন এ প্রশ্ন করার পর বৃষ্টি শুরু হলো। আশ্রমঘরটির চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বারান্দা ভিজে উঠেছে, খুব ভারী বৃষ্টি, দূরের পাহাড়গুলোকে ঝাপসা দেখাচ্ছে, ছোট ছোট নালা বেয়ে ঝরনামতো জল গড়াচ্ছে খাদ বেয়ে।
সন্ধ্যার আগমুহূর্তে এমন অপূর্ব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে সাধু বলে উঠলেন—দ্বিধা হলো মানুষের গোপন সিন্দুক, এর ভেতর জমতে থাকে জীবনের সম্ভাবনার বীজগুলো, কিন্তু মরার জন্য। কেউ যদি সে সিন্দুক খুলতে চায় সাহস করে, দেখতে পাবে জীবনে কত ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে; দ্বিধাগ্রস্ততায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটেছে তার অবনতি। তুমি যদি সবসময় সতর্ক থাকতে চাও, সে উত্তম; কিন্তু কিভাবে? পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বাঁশি ফুঁ দেয় যে পাহারাদার, সে দেখবে ঠিক মোক্ষম সময়ে ঘুমে অচেতন। চোরকে যদি তুমি জানিয়েই দাও যে, তুমি কোথায় কোথায় যাচ্ছো, চোরই হবে তোমার পাহারাদার, তুমি নও। তোমার কথায় ফিরে আসি। তুমি বলছিলে, মেলাতে পারছ কি? এই ভাবনাটি খুব সাধারণ। এমন ভাবনা ওই দ্বিধার সিন্দুকের ওপর কারুকাজের মতো, খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি সুন্দর ও কুৎসিত জীবন মেলানোর কথা বলে যে বিপত্তির কথা বলেছ, মেলানো কি সত্যিই সম্ভব? তোমাকে মেলানোর দায়িত্বটি দিল কে? কেউ বলেছে, মেলাতে থাকুন?
না।
তাহলে?
নিজের মন থেকে কথাটি এলো।
সাধু স্মিত হেসে বললেন,এটাই হলো মন, আমরা আমাদের মনের কথা কখনো শুনি, কখনো শুনি না। যখন মনের কথা শুনি, তখন জানতে চাই না, মন কেন বললো? আবার যখন শুনি না, তখনো বুঝতে চাই না, কেন শুনলাম না। এটা ঘটে একটা প্রপঞ্চের মতো করে। মন যতক্ষণ আমার পাহারাদার হয়ে থাকছে, ততক্ষণ সে মনচোরাকে তুমি ধরতে পারবে না। আবার তুমি যদি তার পাহারাদার হতে চাও, তখনো দেখবে মোক্ষম সময়ে ঢলে পড়েছ নিদ্রাদেবীর কোলে।
সবাই হেসে উঠলো। বাইরে বৃষ্টি একটুও কমছে না, দুপুরের তাপদগ্ধ পরিবেশ এখন কেমন করে শীতল হয়ে উঠলো। একটুপর সন্ধ্যাবাতির আয়োজন শুরু হবে। সাধু উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, প্রশ্নকারীর দিকে তাকিয়ে—স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনটি কোথায় জানো?
সে বললো, মিলনে।
না, অমিলে।
যদি একে অন্যের অমিলগুলোকে সম্মান করতে না শেখে, তবে তাদের মিলন হয়ে উঠবে ভালোবাসাহীন। তুমি যে সুন্দর ও কুৎসিত জীবনের তুলনা করেছ, তার ভেতরের অমিলগুলোকে বুঝতে চেষ্টা করো, কেন এমন? দেখবে তোমার জবাব পেয়ে গেছ।
চিত্রকর ও অসুন্দরের কথা
আজ যে গল্পটি বলব, সে তোমাদের হয়তো শুনিয়েছি অনেকবার। কিন্তু প্রতিবারই শোনাতে গিয়ে মনে হয়েছে, আমার যে গল্পটি নতুন। এমন কিছু গল্প রয়েছে, যা আসলে গল্প নয়, নিছক কেচ্ছা-কাহিনি হলে তার প্রভাব থাকে না বেশিক্ষণ কিন্তু যা আমাদের ভেতরের সত্তাকে আন্দোলিত করে, তা আমরা কিছুতেই ভুলতে পারি না। আমাদের জীবনের সঙ্গে গল্পটিও বেড়ে ওঠে, আমরা তার সঙ্গে যুক্ত করি নিজেদের ভাবনা, যে কারণে এ গল্প শেষ হয় না; পুরনোও না।
__________________________________________________________________________________
এই সুন্দর প্রদীপ শিখাটিকে তুমি কিছুতেই ধরতে পারবে না কিন্তু তাকে রক্ষা করতে পারবে বাটি ও তেলের ব্যবস্থা করে।
__________________________________________________________________________________
ভোরবেলা যখন অন্ধকার ধীরে সরে আসছে, সাধু বসলেন বারান্দার একটি বেঞ্চিতে। গোটা পাঁচেক অনুরাগী, যারা অপেক্ষা করেছিলেন তাঁর জন্যে, কখন তাঁকে পাওয়া যায় নিকটবর্তী হয়ে, তিনি তাদের বসতে বললেন।
আমি জানি তোমাদের ভেতর কী চলছে। তোমরা অপেক্ষা করছ এমন কিছুর, যা তোমাদের জীবন এক মুহূর্তে পাল্টে দেবে ভাবছ। তোমরা একটা ধাক্কা চাইছ, একটা বড় পরিবর্তন চাইছ তোমাদের জীবনে। কিন্তু কেন? তোমাদের যে জীবনে প্রবেশ করানো হয়েছে, তোমরা কি ভাবছ যে, এ জীবনের জন্য তোমরা নও? কিংবা মহান ঈশ্বর তোমাদের ভুল করে পাঠিয়েছেন? জীবন হতে পালাতে চাইছ, পরিবর্তন চাইছ বর্তমানকেই অস্বীকার করে! কিন্তু কেন?
এক ছিল চিত্রকর। খানিক নামডাকও করেছে। আমাকে প্রশ্ন করল, ‘জীবন আমাকে শিল্পী হতে দিতে চায়নি, কিন্তু আমি হয়েছি, আমাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় জীবনের সঙ্গে শিল্পানুরাগের। এমন কেন? আমি মানুষের ক্রুরতা, শঠতা ও কুৎসিত চেহারাকে আঁকি, দেখি এসব ছবিই লোকে কেনে। কিন্তু কেন কেনে? ওদের জিজ্ঞাসা করেছি, ওরা বলে যে, আমার ছবিতে সবকিছুই কেমন যেন সুন্দর হয়ে ওঠে, অথচ আমি তো সুন্দরকে আঁকতে চাইনি, কেবল অসুন্দরের চেহারাটিকে দেখাতে চেয়েছি।’ আমি একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে তাকে বললাম, ওই জ্বলন্ত শিখাটিকে ধরতে পারবে? সে বললো, আঙুল ঝলসে যাবে। বললাম, এই সুন্দর প্রদীপ শিখাটিকে তুমি কিছুতেই ধরতে পারবে না কিন্তু তাকে রক্ষা করতে পারবে বাটি ও তেলের ব্যবস্থা করে। কিন্তু তোমার কাছে একটি বাটি ও এক বোতল তেল থাকলেই তুমি প্রদীপ জ্বালাতে পারবে?
উত্তরে শিল্পী বললো, কেন নয়?
পারবে না। প্রদীপ জ্বালাতে হলে সলতে লাগবে, এবং তা কতখানি তৈলাক্ত হবে, তা বুঝতে হবে। হয় তুমি খুব দ্রুত জ্বালিয়ে নিঃশেষ করবে কিংবা জ্বালাতেই পারবে না। সুন্দরকে পেতে হলে তোমাকে রপ্ত করতে হবে কিছু নিয়ম, কিছু কার্যকারণ, কিছু প্রয়োজন, কিছু ক্ষুধা, কিছু পিপাসা। দেখবে সুন্দর তোমাকে ধরা দিচ্ছে। এই যে তুমি, অসুন্দরকে আঁকতে চাইছ, এবং দেখো যে কী পরিমাণ নিষ্ঠার সঙ্গে জীবনের কদর্য, কুৎসিত রূপকে আঁকছ, যার ভেতর ওই সব নিয়ম-কার্যকারণ-প্রয়োজন-ক্ষুধা-পিপাসা রয়েছে; অবশেষে যা আঁকছ, তা-ই সুন্দরই হয়ে উঠবে!
সে হেসে উঠলো। আমি নিজেও হাসলাম, বললাম, দেখো, সুন্দর কী? সুন্দর সম্পর্কে তোমাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এর মানে। একজন শিল্পীর কাছে সুন্দর আর কিছু নয়, সৃষ্টি। যে সৃষ্টি করতে পারে সে সুন্দরের জন্মদান করে। যা সৃষ্টিশীল নয় তা সুন্দর নয় কিছুতেই। সুন্দরকে তুমি এভাবে দেখতে পারো, সু যার অন্দর, যার অন্তরে সুবোধ ও সুভাব বিরাজমান, সেই তো পারে সুন্দর করে দেখতে, নইলে কী করে তুমি অসুন্দরকে, কদর্যকে, অস্বাভাবিকতাকে অনুপম চিত্রায়িত করতে পারো? চিত্রকর এবার কিছুখানি আনন্দ পেলো। উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার মুখ।
কিন্তু তুমি যদি অসুন্দরকে খুঁজতে থাকো সর্বদা, জেনে রেখো একসময় ঠিকই অসুন্দর হয়ে উঠবে, তখন হয়তো সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতে চাইবে কিন্তু তোমার ছবি প্রকৃতই অসুন্দর হয়ে উঠবে।
নারী, পরমপুরুষ ও রূপান্তর
বসন্তের প্রথম বাতাস গায়ে লাগলে দেহমন মুহূর্তে উদ্বেল হয়ে ওঠে। এটা একটা রূপান্তর মনের, কিন্তু এই রূপান্তর সমগ্র সত্তায় ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই আমরা আমাদের নিজস্ব স্বভাবে ফিরে আসি। বসন্ত আমাদের সত্তাকে ছুঁতে পারে না, কেবল দেহমনে তরঙ্গ তুলে হারিয়ে যায়। এটাই হচ্ছে মানুষের পরিবর্তনের ধারা, সে বদলায় না, মাঝে-মাঝে আন্দোলিত হয়। এই আন্দোলন বেশিরভাগ সময়ই থেমে যায় কিন্তু যখন থামে না, বুঝতে হবে সত্তা গভীরভাবে রূপান্তর চাইছে, খুলে রেখেছে তার গ্রন্থিদুয়ার যেন সে প্রকৃতই সমস্তটুকু নিতে পারে, পরিবর্তনের হাওয়া বদলের সঙ্গে যা প্রবাহিত হয়।
এই যেমন তোমরা বসে আছ শীতকালের শেষটুকু দেখতে, কিভাবে দেখবে? গাছে নতুন পাতা ও ফুলের সমাহারে, বাতাসে কোমল উষ্ণতায়, পাখির কূজনে, প্রকৃতির ঐকতানে তোমাকে জানানো হবে বসন্ত আসছে। কিন্তু তুমি হাজার চেষ্টা করলেও এই পরিবর্তন নিজে ঘটাতে পারবে না। প্রচণ্ড শীতের ভেতর কেউ বসন্তের আনন্দলাভ করতে পারে না। এটা প্রকৃতি হতে তোমরা কিছুতেই লাভ করতে পারবে না, কেবল কৃত্রিম আনন্দলাভের মাধ্যম ছাড়া। কিন্তু কেউ যদি প্রকৃতির নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার ভেতর প্রবেশ করতে পারে, তার স্বভাবধর্মকে নিরীক্ষা করতে পারে, এবং নিজের স্বভাবকে তার ভেতর সমর্পণ করতে পারো, তবে সে বরফখণ্ডের ভেতর বসেও ঘামিয়ে উঠবে, প্রচণ্ড রৌদ্রে দেহমন শীতল পরশে আনন্দলাভ করবে।
কথাগুলো যখন সাধু বলছিলেন একটি মেয়ে এসে বসলো তাঁর সামনে। তার হাতের ডালিতে কিছু ফুল। সাধু বললেন, ওই যে মেয়েটি, কী নাম তোমার?
ডালিয়া।
বাহ! তুমি না এলে কী করে আমরা বুঝতাম বসন্ত প্রকৃতই আসছে? তোমার হাতে ফুলের ডালি, তেমনি আমাদের এই সভায়ও তুমি পুষ্পবৎ। আমরা তোমার উপস্থিতিকে আমাদের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ মনে করছি।
হে মহান সাধু! কিন্তু একটি মেয়ের জন্য এই পৃথিবী আসলেই কি বসন্ত আনে?—মেয়েটির প্রশ্ন।
সাধু কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। ফুলের ডালি হতে কিছু ফুল দিতে বললেন। পাশে জলে পূর্ণ একটি ঘড়াতে অন্যান্য অনেক ফুলের মাঝে ছড়িয়ে দিলেন। নানান রঙের ফুল ওই বৃহৎ ছড়ানো ঘড়ার জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি বলে উঠলেন, তোমার কথাটি অত্যন্ত সংবেদনশীল, আবার করুণবাস্তবও। নিশ্চয়ই তুমি জীবনে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছ যা বিরূপ মনোভাব তৈরি করেছে মানবসমাজের প্রতি। তুমি তবু বসন্তের আহ্বান ও আনন্দলাভের প্রচেষ্টাকে ত্যাগ করতে পারোনি। তোমার হাতে ফুলসমেত এই ডালি প্রমাণ করে ভেতরে এখনও তুমি বসন্তকেই বিশ্বাস করো।
মেয়েটি বললো, হ্যাঁ, আমি অবিশ্বাসী নই, কিন্তু মানুষের হিংসা ও লালসার কাঁটাবন থেকে যখন ছুটতে চাই, তখন আমাকে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়, বুঝতে পারি না যে আদৌ বেরুতে পারব কি? আজ যখন আপনার কাছে এলাম, এই ফুলগুলো সেই কাঁটাবনের শাখায় ফুটে উঠতে দেখলাম। দেখলাম সেখানেও ফুল ফোটে, তাই নিয়ে এলাম। আপনি আমাকে বলুন আমি কী করব তবে?
সাধু মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। বললেন, তোমার জীবনের সব বেদনার অন্তে একটি করে ফুল ফোটে, তুমি যে কাঁটাবনের শাখা থেকে ফুল ছিঁড়ে আনলে, সে তোমার জন্যই ফুটেছে। সবাই বাগান থেকে ফুল তুলে আনে কিন্তু তুমি কাঁটাগাছ থেকে আনন্দের সঙ্গে ফুল ডালিতে ভরেছো। যদি জীবনের প্রতি অনুরাগের চাইতে আক্ষেপ বেশি হতো, তবে এ কাজ করতে না, এমনকি এখানে আসতেও না, এলেও তোমার প্রকাশ ও অভিব্যক্তিতে বেদনা নয় প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠতো। তুমি তো প্রতিশোধপরায়ণ নও, তুমি বেদনাজর্জরিত। তোমার বেদনা তোমার ভেতর শক্তি দিয়েছে অনুসন্ধানের। তুমি তালাশ করছ ক্রমে অস্তিত্বকে, নারীর অবয়বে মানুষকে।
কিন্তু মা, তুমি যখন নিজেকে খুঁজতে চাইবে, তোমার অসহায় নারীত্বই তোমাকে মহিমামণ্ডিত করবে। বস্তুত আমরা কেউই নারীত্ব অর্জন করার পূর্ব-পর্যন্ত সাধক হতে পারি না। এই পৃথিবীতে তারাই প্রকৃত নারী, যারা নিজেকে খুঁজতে গিয়ে শ্রমণ হয়েছেন, বৈরাগ্য নিয়েছেন, যোগী হয়েছেন, দেহতত্ত্বের অমোঘ নিয়মে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। এমন অসংখ্য সাধকগুরু রয়েছেন, যারা প্রকৃত নারী। তাঁদের উৎসর্গ মানসিকতা ও প্রেম নিবেদনই তাঁদের নারীত্বের পরিচয়। নির্বাণের পরম্পরা পার হতে হতে যারা একসময় এই নারীত্বকে বিসর্জন দিয়ে পরমপুরুষে নির্বাণলাভ করেন।
তাহলে কি আপনার কথায় মানুষের সার্বিক মুক্তির একমাত্র পথ পুরুষত্ব অর্জন করা?—মেয়েটি প্রশ্ন করলো।
আমি জানতাম তুমি এমন প্রশ্ন করবে। এটি আমাকে অনেকেই করে থাকেন। যারা ঠিক নারী ও পুরুষের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে অবগত নয়। কিন্তু মনে রেখো, যে নারী কেবল দেহমনেই নারী সে বন্ধ্যা, যে নর দেহমনেই নর সে পশু—তোমাকে আত্মময় হয়ে উঠতে হবে, কেবল তখনই বুঝতে পারবে যে, তুমি নারীও নও, নরও নও, তোমাকে অর্জন করতে হবে সেই পৌরুষ, যা কালাকালের অধীনতামুক্ত ও আত্মবিপ্লব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। পুরুষ শব্দটি নরপশুরা কলঙ্কিত করেছে। তুমি পরমপুরুষের দিকে যাত্রাপথ তৈরি করবে। এই পুরুষের চাইতে আরও বড় হলো মাতৃচেতনা, জগতের সব মহাপুরুষের মা যিনি সেই পরম আলোকময়তাকে অনুধাবণ করবার চেষ্টাই আমাদের নিরন্তর সাধনা।
জীবন ও নির্বাণের স্পর্শ
কথাগুলো বলতে গিয়ে আমি বিহ্বল হয়ে পড়ি, আমার তখনো জীবন সম্পর্কে জানতে চাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়নি। কিন্তু সবসময় উপভোগ করতাম, কখনো বিরূপ হয়ে সময়কে পার হতে দেইনি, তা যতই আমাকে আক্রান্ত করতে চাইতো। সে ছিল আমার স্কুলের বন্ধু, যে স্কুলে পড়তাম সেখানে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ছিল মুচি বা চামড়া ব্যবসায়ীর সন্তান, যাদের বেশিরভাগই প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর পাঠ চুকিয়ে দিয়ে পৈত্রিক ব্যবসায় নেমে যেত। কিন্তু ওদের ভেতর জীবন সম্পর্কে খুব জোরালো একটা উপলব্ধি ছিল, ওরা সবকিছুকে সহজভাবে নিতে জানতো, এমনকি যখন বন্ধুদের ভেতর ঝগড়া ও মারামারি হতো তখনো, যখন একসঙ্গে আবার মিত্রতায় পরিণত হতো তখনো। এরা জীবনকে এমন একটি স্থান থেকে দেখতে শিখেছে, যেখানে সবকিছুকেই গ্রহণ করতে পারতো। যখন আমি পিতা বা পিতামহ কাকে বলে জানতাম না, তখন আমার বন্ধু খাতায় আমার পিতা ও পিতামহের নাম লিখে দিয়ে সাহায্য করতো।
তার নাম ছিল জীবন। সে আমাকে বন্ধুত্ব শিখিয়েছিল এবং তার কাছে আমি কেবল বন্ধুত্ব নয় প্রভাববিস্তারকারী নেতৃত্বও শিখেছিলাম। আমার সমবয়সী একটি ছেলে আমাকেই যেন আগলে ধরে রাখতে চাইতো পরম ভ্রাতৃত্ববোধে। সে যা বুঝতো, তাই করতো এবং তাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে পদক্ষেপ নিত, যখন আমি দৃঢ়তা কাকে বলে জানতামই না। সে আমাকে শিখিয়েছিল সময়কে শক্ত হাতে পার হতে, শত্রুকে বন্ধুরূপে বরণ করে নিতে। এবং আজকেও আমি যখন তার কথা ভাবি, তখনো আমার ভেতরে একটা শক্তি লাভ করি। অথচ সেই ছেলেটি প্রাথমিক শিক্ষাও সমাপ্ত করতে পারেনি। তার আগেই নেমে পড়ে পথে।
একদিন মায়ের সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে থামলাম, যেখানে গোটা দশেক সেলাই-মুচি কাজ করছে পথের ধারে। আমার পা বাড়িয়ে দিলাম একজনকে। সে খুব আলতো করে আমার পায়ের জুতা খুলে নিয়ে তা পরিষ্কার করে পালিশ করা শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর খেয়াল হলো সে আমারই বয়সের একটি ছেলে, মাথা তার নিচু, তুলছে না। মা বললেন, কী রে মাথা তোল, নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিস, কী হয়েছে? টাকা দেওয়ার সময় মায়ের ধমক খেয়ে ছেলেটি যখন মাথা তুলে তাকালো, আমার পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম! সে আমারই পরম মিত্র, জীবন।
________________________________________________________________________________
কখনো কোনো সাধারণ ঘটনাকে পাশ কেটে যেও না, যদি তুমি ঘাসফুলকেও সাজাতে জানো, তবেসেও হয়ে উঠবে তোমার ফুলদানিতে পরমশোভনীয়!
_______________________________________________
এই গল্পটি আমি সবসময় মনে রাখি, এটি আমার জীবনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ পাঠ, যা অস্তিত্ব নামক একটি গল্পের জীবন নামক অধ্যায় থেকে শিখেছি। আমি জানি না, সে আজ কোথায়, এখনও তার সেই দৃঢ়তা ও ভ্রাতৃত্ববোধ আছে কি না? কিন্তু আমার ভেতর সে জন্ম দিয়েছিল দৃঢ়তা ও সংকটকে সহজভাবে দেখার সাহসের। তার কাছে আজও কৃতজ্ঞ। জীবনকে আমি জীবনের ভেতর মিশিয়ে দিয়েছি, নুন যেমন জলের ভেতর মিশে যায়।
তোমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন কিছু পাঠ রয়েছে, গল্প রয়েছে যা তোমরা মনে করতে পার, তুলে আনতে পারো, তার ভেতর থেকে নুনটুকু নিয়ে তোমাদের নিজস্ব জীবনভাবনায় মেশাতে পারো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা আমাদের পরিপার্শ্বকে সচেতনতার সঙ্গে ধরতে পারি না, সবসময় একটা অচেতন ভাব কাজ করে। এই সচেতনতা কোনো বিষয়ের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া নয়, এ হলো জীবনপ্রবাহে ঘটতে থাকা প্রতিটি মুহূর্তকে আনন্দ ও উৎসুক মনে দেখতে চাওয়া। আমাদের শৈশবেই আমরা সেই স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে বসি, কৃত্রিম জীবনাচরণ ও পদ্ধতির কারণে।
কিন্তু তোমাকে বের হতে হবে, কোনো না কোনো সময়, যখনই সুযোগ পাবে। যখন মানুষ বিপর্যয়বোধ করে, তার ভেতর সন্তাপ ও বেদনা জাগ্রত হয়, পতিত হয় গভীর আত্মসংকটে। মানুষকে একটা সময় এই সংকটে পতিত হতেই হয়। শৈশবে যে শিক্ষা পায়নি তার জন্য যৌবনে রয়েছে সুযোগ, যৌবনেও যে শিক্ষালাভ থেকে বিরত রয়েছে, তার জন্য রয়েছে প্রৌঢ়কাল। আর যদি প্রৌঢ়েও সে কিছু নিতে পারে না, তবে তার মতো দুর্ভাগা কেউ নেই।
কখনো কোনো সাধারণ ঘটনাকে পাশ কেটে যেও না, যদি তুমি ঘাসফুলকেও সাজাতে জানো, তবে সেও হয়ে উঠবে তোমার ফুলদানিতে পরমশোভনীয়! বুঝতে হবে, জীবনের সহজ ও স্বাভাবিকতার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ঘটনাবলির ভেতরই রয়েছে জীবনকে সাজানোর মতো উপকরণ। কেউ তোমাকে প্রস্তুত করে দেবে না, নিজেই তা করে নিতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে অস্বাভাবিকতা ও প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে পারবে।
আমাদের ভেতর যে প্রেম ও দয়া তা কি একবারেই ভেতরের? বাইরের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে তা অস্তিত্বহীন। মানবসত্তা হলো একটি উর্বর কৃষিক্ষেত্র, তার বীজ, সার, আলো-হাওয়া, জল আসে বাইরে থেকে; আসে পোকামাকড় ও বিপত্তিও। আমার বন্ধু জীবন যেমন আমার ভেতর বপন করেছিল বীজ, তাতে কেউ না কেউ সার দিয়েছিল, আলো-হাওয়ার সুযোগও পেয়েছি, আনন্দ ও বেদনার জল দিয়ে তাতে সেচ দিয়েছি কিন্তু অতৃপ্তির ঝড়-বন্যায় তাকে হারাতে দেইনি।
বসন্তের শুরুতে সাধু এই কথাগুলি বলে শেষ করলেন তাঁর কথোপকথন, আজ অনেকেই তাঁর সামনে বসেছেন, যারা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথাও বলতে লাগলেন, তিনি গভীরভাবে শুনছেন তাদের কথা। একসময় বলে উঠলেন—তুমি যদি প্রকৃতি ও মানুষ থেকে নিরন্তর নিতে না পারো, তবে নির্বাণের পথ তোমার জন্য বন্ধ হয়ে আসবে। নির্বাণ এক নিত্যধারা, ভেসে চলা মেঘ যেমন বৃষ্টিতে নির্বাণ ঘটে, বৃষ্টির যেমন জলাশয় ও ধারাজলে নির্বাণ ঘটে, সে জলও তেমনি একে একে নদী-সাগরে নির্বাণ লাভ করে। নির্বাণ একটি পরম্পরা, এই পরম্পরাটিকে বুঝতে শেখো—দেখবে দুঃখও একটি নির্বাণ, তবেই তুমি নির্বাণের গভীরতাকে স্পর্শ করতে পারবে এবং মুক্ত হতে পারবে।
চলবে…