পাথর ও শক্তির কথা
চন্দনবীজের বাকসো থেকে বেরিয়ে এলো একটা পুরনো ভিক্টোরিয়ান পয়সা। লোহাতে যেমন জং ধরে, তেমনি তামার পয়সাতেও ফিরোজা-সাদা একধরনের দাগ ধরে। দেখে মনে হতে পারে কেউ বুঝি রঙ মেখে গেছে। এ রকম বেশকয়েকটি পয়সা নাড়িয়ে দেখতে গিয়ে উসমান বখস উত্তেজিত হয়ে বললো, পেয়ে গেছি সাধু জি! এই বস্তুটাই আপনাকে দেখাতে চাইছিলাম।
একটা বহু পুরনো ইংরেজ আমলের প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া দলিলের পাতায় মোড়া একটি পাথর হাতে নিয়ে সাধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বলছেন না। মাথার ওপর পুরনো একটা ফ্যান হালকাভাবে বাতাস দিচ্ছে, সেদিকে তাকালেন।
-এই ফ্যানটির চাইতেও কম মূল্যবান এই পাথর।
কেমন করে বুঝলেন? উসমানের প্রশ্ন।
দেখো, পাথরটিতে কোনো শিল্পগুণসম্পন্ন আকৃতি নেই, এটি ভালো ডিজাইনারের হাতে পড়েনি মোটেও। আর যদিও বা পাথর হিসেবে ভালো তবু এর উজ্জ্বলতা ও রঙ মলিন হয়েছে।
উসমান হতাশ হয়ে বললো, এটি কিন্তু আমার দাদা মারা যাওয়ার আগে আমাকে দিয়ে বলেছিলেন যে, অত্যন্ত দামি পাথর। যার কাছে থাকবে তার কোনো ক্ষতি হবে না।
সাধু হেসে উঠলেন। একটা পাথরের অনেক ক্ষমতা তাই না? তোমার নেই?
উসমান বললো, আমার আর কিসের ক্ষমতা, থাকলে কেন আপনার কাছে আসি?
কেন আসো? ক্ষমতার জন্য?
তা নয়তো কী? সবাই তো ক্ষমতালাভের জন্যই আপনার কাছে আসে।
তোমার কি তাই মনে হলো এতদিন ধরে? তাহলে তুমি বিষয়টি ধরতে পারোনি একেবারে। আশপাশ দিয়ে ছুটে গেছে।
উসমান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, কী বিষয় সাধুজি!
না কিছু না। তোমাকে বলে লাভ নেই। একটা পুরনো পাথরকে যেভাবে ধরে রেখেছো ঠিক সেভাবেই ধরে রাখে মানুষ পুরনো মূর্তি, এটা ভালোবাসার বা ভক্তির টানে না, আসক্তির টানে। তোমার ভেতরে প্রবল আসক্তি রয়েছে এর প্রতি, যে এটা তোমাকে রক্ষা করবে বিপদ-আপদ হতে। যা তোমার একটা ভুল ধারণা, কিন্তু তুমি এর ভেতর দিয়ে একটা শক্তি পাচ্ছ, তাই তোমার ভেতর সাহস আছে, শক্তি আছে সবকিছুর মুখোমুখি হওয়ার। এখন আমি যদি তোমাকে প্রকৃতই পাথরের শক্তি সম্পর্কে ধারণা দিতে যাই, তোমার সে শক্তির জায়গাটিতে টান পড়বে, দুর্বল হয়ে পড়বে তুমি।
সে কেমন কথা সাধুজি, তাই বলে কি আপনি সত্য বলবেন না?
বলবো, কিন্তু সে সত্য যে তোমার ভেতরের সত্যকে আঘাত করবে, তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, হতাশাগ্রস্ত করবে।
কী সব কথা বলেননা, মাথা ঘুরে যায় একেবারে! আমি তো খুব সাধারণভাবে বিষয়টি আপনার কাছে খুলে বললাম, দেখালাম। এখন দেখছি এতে উল্টো ক্ষতিই হলো আমার।
সাধু বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন, বললেন, হ্যাঁ। তাই হবে, তুমি একটি পাথরে যতটা ভরসা করছো, ততটা নিজের ওপর নেই। পাথরটির গুণাগুণ তালাশ না করে একে ধারণ করো, আসক্তি থেকে নয়, ভালোবাসা থেকে। দেখবে তোমার মঙ্গল হবে।
উসমান উত্তরে বললো, সে তো করছিই সাধুজি। এখন কেবল আপনার কাছ থেকে এর পরিচয়টা জানতে পারলে মঙ্গল।
দেখো উসমান, মঙ্গল-অমঙ্গলের বিষয়টা নির্ভর করছে তোমার নিজের ওপর। পাথরটি যদি একটা সাধারণ পাথরও হয়ে থাকে। তবু, আমি বলবো তোমার নিজের ভেতরের প্রেরণাশক্তিই এর ভেতরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবে। এখানে পাথর নয়, তুমি নিজেই মুখ্য।
আচ্ছা, লোকে যেমন মূর্তি গড়ে নিজেই পূজা করে, সে রকম? উসমানের প্রশ্ন।
হুম ঠিক তাই।
এটা অত্যন্ত সাধারণ বুদ্ধিশুদ্ধির মানুষের কাজ, যারা একটা কিছু নিয়ে পড়ে থাকাকেই জীবনের সার্থকতা ভেবে বসে। কিন্তু তুমি যদি তাদের মতো না হও, যদি তোমার ভেতরে জীবনের গভীরতার স্পর্শ থাকে, যদি তুমি জীবনকে ভেতর থেকে দেখতে চাও, তবে নিশ্চয়ই তোমাকে পাথরটিকে পেরুতে হবে। ঠিক যেমন সাধক মূর্তিকে পার হয়।
তোমাকে কথাগুলো বলছি, যদি তোমার বোঝার ক্ষমতা থাকে, কিংবা যদি নাও থাকে, কথাগুলো অন্তরের সেই সত্যকে জানান দেয়; যে সত্যকে তুমি দেখতে পাও না। এই যেমন ধরো তোমার ভেতর এই বাসনা আছে যে এই পাথরটির গুণ বিচার করে এটিকে তুমি যোগ্যভাবে ব্যবহার করবে, কিন্তু তুমি নিজেই যে সেই গুণে গুণান্বিত হয়ে আছ, তোমার ভেতর পাথরে যা নেই, তার প্রতিবিম্ব শোভা পাচ্ছে, সেটা দেখতে পাচ্ছ না।
পাশে বসে থাকা উসমানের স্ত্রী হেসে উঠলো এই কথা শুনে কী বলবো সাধুজি? আপনার কথার মাঝখানে কথা না বলে পারছি না। উসমানকে আমি এই পাথর হতে বের করতে পারছি না, পাথরচাপা হয়ে আছে সে।
তা নয় মা, এটা একটা পর্যায় জীবনের। সে তো পাথরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। সে পাথরের প্রাণ সে নিজেই। এই সত্যটি না বোঝা পর্যন্ত সে নিজেকে চিনতে ভুল করবে।
উসমান পাথরটি হাতে নিলো। চোখের নিমেষে ছুড়ে ফেলে দিলো পদ্মফুলের ডোবায়। বললো, আপনার কথা আমি ঠিক ভালো করে বুঝিনি সাধুজি। কিন্তু কথাগুলো আমার ভেতর একটা শক্তি দিয়েছে।
-কী শক্তি?
-ছুড়ে ফেলার।
চলবে…
নির্বাণ গল্প-আট ॥ আজহার ফরহাদ