[পর্ব-তিন]
দেখতে দেখতে দীপনের চোখ ছলছল করে ওঠে। হাতের সরঞ্জাম নামিয়ে রেখে সে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মা’র গলা। কান্না কান্না গলায় বলে, ও মা! ভাইয়াকে বলোনা ঘুড়িটা বানিয়ে দিতে! শুধু একটা! বলোনা মা!
মা’র মুখে স্মিত হাসি। সে হাসিতে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ভাসে, সুখের ছায়া নাচে। মা সস্নেহে দীপনের ঝাঁকড়া, এলোমেলো চুলকে আরেকটু এলোমেলো করে দেন। আরেকটু কাছে টেনে নেন। চুমু দেন দীপনের কপালে, মুখে। তারপর রতনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটু হেসে বলেন, দে-না বাবা! একটা ঘুড়ি বানাতে কত সময় আর লাগবে তোর! দে, একটা ঘুড়ি বানিয়ে দিয়ে পড় আবার। অমন করে না বাবা! ছোট ভাই না তোর! দিতে হয়!
অগত্যা রতন বই ফেলে বসে যায় মেঝেতে। মা’র পায়ের কাছে। দীপনও নেমে আসে নিচে। দুই ভাই মিলে চলে ঘুড়ি তৈরির তোড়জোড়। রতন কাগজগুলো কেটেকুটে ঘুড়ির আদল দেয়, দীপন উৎসুক মনোযোগে দেখে, এটা-ওটা এগিয়ে দেয় রতনের হাতের নাগালে। মা খাটের ওপর বসে হাসিমুখে দেখে দুই ভাইয়ের কর্মকাণ্ড। গুনগুন করে গান গায়, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন/ খুঁজি তারে আমি আপনায়।’
মা প্রায় সময়ই এই গানটা গায়। অবসরে, আনমনে গুনগুন করে। মা’র গলাটা ভারি মিষ্টি। কান পেতে শোনে রতন। হঠাৎ-ই সুর কেটে যায়। রুমকী রিনরিনে গলায় বলে ওঠে, কাকু! এই কাকু! তুমি তো আমার কোনো কথাই শুনছ না! যাও, তোমার সাথে আর কোনো কথা নাই!
অভিমানে রুমকীর শ্যামলা মিষ্টি মুখটা কেমন ফুলে ফুলে ওঠে। রতন সেদিকে তাকিয়ে হোঁচট খায় মনে মনে। এই না মা, সে, আর দীপন ছিল ঘরে! ঘুড়ি বানাচ্ছিল তারা দুই ভাই! আর মা খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে কী একটা গান গাইছিল গুনগুনিয়ে! তাহলে? রুমকীর দিকে তাকিয়ে প্রথমে কেমন একটু অস্পষ্ট, ঝাপসা লাগে সব। তারপর মনে পড়ে! ওহ! রুমকী! দীপনের মেয়ে! মায়ের মতো দেখতে অনেকটা!
—না না, শুনছি তো মা! তোমার কথা শুনছি। তুমি বলো, কী বলছিলে!
—শুনছ? বলো তো কোন গল্পটা বলছিলাম এতক্ষণ?
—রাক্ষস আর খোক্ষসের গল্প! কী, ঠিক বলিনি?
—কচু বলেছ! বোকা কোথাকার! আমি বুঝি রাক্ষস খোক্ষসের গল্প বলি কখনো?
—তাহলে?
—তাহলে কী? তুমি শুনছ না, কিছু না, তোমাকে তাহলে বলব কেন গল্প?
—আচ্ছা মা! এই কান মলছি! আর বোকামি করব না মোটেও! এবার থেকে লক্ষ্মী ছেলে হয়ে তোমার গল্প শুনব!
—শুনবে? সত্যি তো? বলো, বিদ্যা?
—বিদ্যা! বিদ্যা! বিদ্যা!
—মরিয়া হয়ে রতনের বিদ্যা বলার ধরনে খিলখিল হেসে ওঠে রুমকী। রতনের আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসে বলে, আচ্ছা, ঠিকাছে! বলছি তবে! কিন্তু একদম দুষ্টুমি করবে না!
—করব না মা! একদম করব না! তোমার লক্ষ্মী ছেলে না আমি? কখনো দুষ্টুমি করি?
—করো তো! মাঝে মাঝেই তো করো! বলতে বলতেই হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে, কণ্ঠে শাসন নিয়ে বলে, আচ্ছা কাকু, তুমি ক’দিন পরপর অমন পাগল হয়ে যাও কেন? কী সব পাগলামি যে করো! একটুও ভালো লাগে না তখন। খুব কান্না পায় তখন আমার।
একটু আনমনা হয়ে যায় রতন। ধাক্কা খায়। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে, খুব কান্না পায়, মা?
—হুম! খুউউব—অন্যদিকে তাকিয়ে বলে রুমকী। কণ্ঠ ধরে আসে তার, ছলছল করে ওঠে চোখ।
—দুঃখিত, অন্যমনস্কভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে রতন। কান্না পেয়ে যায় তারও। তারপর, যেন সে নয়, অন্যকেউ, অনেক দূর থেকে, প্রবোধ দেওয়ার স্বরে, স্বান্ত্বনা দেওয়ার মতো করে খুব আস্তে আস্তে বলে, আমি আর পাগল হব না মামণি। আর পাগলামি করব না একদম।
—সত্যি করবে না তো কাকু? রুমকীর কণ্ঠটা ভারী উদগ্রীব, অধীর শোনায়।
—সত্যি করব না মা।
—হুম। করো না কাকু। তুমি পাগল হয়ে গেলে মা আর বাবার মধ্যে খুব ঝগড়া হয় তখন। আমার একটুও ভালো লাগে না সেটা।
রতনের মাথার মধ্যে ঝিঁঝিঁটা কি ডেকে ওঠে হঠাৎ! ক্ষীণ, অস্পষ্ট স্বরে তারা যেন একবার ডেকে উঠেই নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে যায় আবার! জানান দিয়ে যায়, আছে তারা! ঘুমন্ত, কিন্তু ছেড়ে যায়নি, আছে!
ধাক্কাটা সামলে নেয় রতন। রুমকীকে বুঝতে দেয় না কিছু। তার মাথায় হাত বোলোতে বোলোতে বলে, কী নিয়ে ঝগড়া হয় মা? আমাকে নিয়ে?
—হ্যাঁ তো! তুমি খুব পাগলামি করো যে তখন!
—কী করি মা?
—ইস! তুমি সব ভুলে যাও! ঠিকমতো খাও না, ঘুমাও না। চিৎকার করো, দরজা খোলা পেলে কোথায় কোথায় চলে যাও। যাকে পাও তাকেই মারতে যাও। আচ্ছা কাকু, তুমি আমাকেও মারতে চাও কেন? আমি কী করেছি?
—আমার তো তখন কিছু মনে থাকে না মা! চিনতে পারি না যে কাউকে!
—সেজন্যই তো বাবার সাথে মা ঝগড়া করে! মা বলে, তোমাকে হাসপাতালে রেখে আসতে!
—তোর বাবা বোকা! ঝগড়া কেন করে? আমাকে হাসপাতালে রেখে আসলেই তো পারে! মিছেমিছি ঝগড়া কেন করে!
—বা রে! তোমাকে হাসপাতালে রাখলে বাবার বুঝি কষ্ট হবে না! আমারও কষ্ট হবে খুউব!
রতনের চোখ জলে ভরে ওঠে হঠাৎ। রুমকীকে বুকের মধ্যে জাপটে নিয়ে বলে, আমার মা! আর আমি পাগল হব না মা! দেখিস! আর পাগল হব না!
চলবে…