[ পর্ব-২৩ ]
দৌলতপুরে এসে পর থেকে শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না তরুণের। ঠাণ্ডা, কাশি লেগেই আছে। সঙ্গে জ্বর। ভরসা রহমত আলী। সেই যে ট্রেনে তার পাশে বসেছিল লোকটা, তারপর থেকে কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না আর। সাথে সেঁটে আছে আঠার মতো। তার পোড় খাওয়া ভাঙা গাল আর জ্বলজ্বলে চোখে কেমন আলগা একটা আলো জ্বলে ইদানীং তরুণের দিতে তাকিয়ে। তরুণ অস্বস্তিবোধ করে। বিরক্ত হয়। লোকটা কেন তার জন্য এমন ভেবে মরছে, কেন এত যত্ন-আত্তি করছে তার, কে জানে! কী মতলব আছে, ভেবে কোনো কূল-কিনারা করতে পারে নি তরুণ আজ অবদি। তবে তরুণের এই অসুস্থতায় লোকটা না থাকলে ভারি বিপদে পড়ত তরুণ, কোনো সন্দেহ নেই। বাধ্য হয়েই হয়তো তাকে গিয়ে উঠতে হতো জিনিয়ার ডেরায়। জিনিয়া তাতে খুশি হতো নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেটা তার বা জিনিয়ার কারও জন্যই মঙ্গলকর হতো না খুব, জানে তরুণ। মনে মনে লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে দারুণ। রহমত আলী। তার মনে কেন যে প্রকৃতি হঠাৎ তরুণের জন্য তৈরি করে দিল এমন অকৃত্রিম রহমত, ভেবে বিস্ময়াভিভূত হয় নিজেই। খালি গলায় বিছানায় আধশোয়া হয়ে গেয়ে ওঠে, গুরু কে বোঝে তোমার অপার লীলে।
তারপর হঠাৎই প্রশ্নটা জাগে মনে। জিনিয়ার আসল নামটা কী? জানে না তরুণ। যেমন জিনিয়াও জানে না তরুণের প্রকৃত নাম, পরিচয়। বাউল সাধনায় প্রকৃত নাম, পরিচয় এসব মুছে ফেলতে হয়। জিনিয়ার লাইনেও তাই। ভাবতেই হুট করে প্রশ্নটা মনে আসে। বাউল সম্প্রদায় যেমন তাদের সুর আর বাণী দিয়ে সেবা করে চলেন মানুষের, জিনিয়ারাও তেমনি তাদের রূপ দিয়ে, সৌন্দর্য দিয়ে, শরীর দিয়ে সেবা করে চলে কতিপয় মানুষের। বাউলরা করেন মনের ক্ষুধার নিবৃত্তি, জিনিয়ারা করে শরীরের ক্ষুধার মোচন। কোনটা গুরুত্বপূর্ন তাহলে? কিংবা কোনটা মূল্যহীন? ঘৃণ্য কোনটা? কোনটাই বা শংসাযোগ্য? ভেবে চলে তরুণ। কূল-কিনারা পায় না ভেবে। আবার সে গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে, ‘জাত গেল, জাত গেল ব’লে, এ কী আজব কারখানা।’
জিনিয়া সম্ভবত এখনো খবর পায় নি তার আগমনের। খবর পেলেই মাজারে এসে হানা দিত। টানা হেঁচড়া শুরু করত তরুণকে নিয়ে। কেঁদে কেটে তাকে দিয়ে দিব্যি করিয়ে নিত রাতে অন্তত একবারের জন্য হলেও তরুণ যেন যায় তার ডেরায়। অন্তত প্রতিদিনের রাতের খাবারটা যেন সে জিনিয়ার ডেরায় গিয়ে খায়। মেয়েটা জানে, তরুণ বাধ্য হয়ে দিব্যি করবে, কিন্তু যাবে না কখনই তার ডেরায়, তবু প্রতিবারই এই একই নাটক মঞ্চস্থ হয়। শেষে, রাতে কারও হাতে তার জন্য মাজারে খাবার পাঠিয়ে দেয় জিনিয়া। তরুণ হাসে। নারী। কী যে বিচিত্র এই নারী। অবলীলায় যে নারী শরীর বিকিয়ে দিচ্ছে অর্থের বিনিময়ে অপরিচিত, অচেনা কোনো খদ্দেরের কাছে, অপমানিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে, সেই শরীর বিক্রির টাকায়ই আবার অন্যকোনো অপরিচিত পুরুষের জন্য পরম মমতায় রান্না করছে হাত পুড়িয়ে, ভালোবাসার পদ্মপুকুর বুকের মধ্যে নিয়ে জাগছে বিনিদ্র রাত! সে শরীরই সে পরম যত্নে তুলে রাখছে অন্য কোনো প্রার্থিত পুরুষের জন্য ভালোবাসার উপাচারে! তরুণকে ভাবে পায় হঠাৎ। শুয়ে শুয়েই কল্কেতে টান দেয়। গেয়ে চলে গলা ছেড়ে। ‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়?’
অদূরেই গ্যাঁট হয়ে বসেছিল রহমত। বাবড়ি চুল দোলাচ্ছিল তরুণের গানের তালে তালে। তরুণ বেশ খোশমেজাজে আছে আজ। শরীরটাও বেশ ভালোর দিকে বোঝা যাচ্ছে। এ বেলায় আর জ্বর আসে নি নতুন করে। মাজারের এই পেছন দিকটা বেশ নির্জন। এদিকটাতে লোকজনের ভিড়-ভাট্টা নেই তেমন একটা। শুধু তাদের মতো সংসারত্যাগী, ছন্নছাড়া ভবঘুরেদের আড্ডা এদিকে। শুধু গান শুনতে বা তাদের সাথে আলাপের উদ্দেশেই যা লোকজন আসে এদিকে। বাকীরা আসে মাজারে বিশেষ কোনো মনোস্কামনা নিয়ে সিন্নি দিতে, জিয়ারত করতে। সে কারণে এদিকেরই একটা নির্জন জায়গায় বিছানা করে আপাতত ঘাঁটি গেড়েছে তরুণ। বরাবরই তেমন। এবার সাথে বাড়তি লেজ জুড়েছে রহমত আলী। স্টেশন থেকে নেমে সেই যে পিছু নিল লোকটা, ছাড়ছে আর। বাকী জীবন না-কি তরুণের সাথেই লেপ্টে থাকবে লোকটা, তেমনই নিয়্যত। মনে মনে একচোট হেসে নিয়েছে তরুণ! পাগল আর কী! কোনো এক গভীর রাতে লোকটা ঘুমিয়ে পড়লেই পাত্তারি গুটোবে তরুণ এখানকার। চম্পট দেবে অজানার পথে। তাছাড়া বাউল বলতে যা বোঝায় সে তো তা-ও নয়। সে আসলে নিজের স্বার্থে ঘর ছেড়েছে। ভেকধারী সে, প্রকৃত সন্নাসী নয়। সে কেন সাগরেদ জোটাবে অনর্থক! বাউলরা ঘর ছাড়ে বৃহৎ স্বার্থে। মানবসেবাই তাদের ব্রত। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার সাদৃশ্যানুসন্ধান আর তার মিলনতৃষ্ণাই তাদের মূল সুর। মানবধর্মের প্রতিষ্ঠা তাদের ধ্যান-জ্ঞান। সেখানে সে নিজে কী করছে? সে তো আসলে লুকোচুরি খেলছে তার নিজের সাথেই। নিজের দুঃখ-কষ্টের ভার লাঘবই তার বাউল-ভেক ধরার একমাত্র কারণ। বিশ্বসংসারের, অন্য মানুষের দুঃখ-কষ্টে থোড়াই এসে যায় তার। লোকটা মিথ্যেই তার মধ্যে মুক্তো খুঁজে মরছে। আদতে শামুক সে। লুকিয়ে আছে খোলসের আড়ালে। কোনোদিন যদি বুকের মধ্যে এক অণু বালু ঢোকে তার, তাহলে সেখানে হয়তো চাষ হবে একদানা মুক্তো। ভাবতেই, আরেকটা কথা মনে আসে। এই বালু আসলে কী? সংসারের ছুঁড়ে দেওয়া বিষ? কষ্টের ছুরি? সে কি ঢোকে নি তার মনে? কারও মনই কি মুক্তি পায় আদতে সে বিষ কিংবা কষ্ট-ছুরি থেকে? পায় না, সে জানে, পায় না। তবে কি ভেতরে ভেতরে সব মানুষই বাউল, ভবঘুরে এক সন্নাসী? বরং বাউলবেশী লোকগুলোই কি আসলে দুঃখভীরু, কাপুরুষ? সংসারের কাঁটার ভয়ে, যন্ত্রণা-ত্রাসে, পালিয়ে বেড়ায় জীবন থেকে? তাহলে মুক্তো ফলে কার অন্তরে? গৃহীর না-কি সন্নাসীর? ভেবে কেমন গুলিয়ে উঠতে চায় মাথা। এলোমেলো লাগে সব। জীবন তার কাছে লাগে এক বিশাল ধাঁধা। জগত সে ধাঁধার বৃহৎ আকর। এর রহস্যভেদ করা অসম্ভব তার মতো ক্ষুদ্রজনের পক্ষে। বিশাল এই ধাঁধায় পড়ে হাবুডুবু খেতে খেতে মাত্রই চোখে আঁধার দেখছিল তরুণ। সম্বিত ফিরল রহমত আলীর ডাকে।
আপনেরে খুঁজতেচে সাঁইজি, দেহেন তো চেনেন কি-না, -বলে উৎসুক চোখ রাখে রহমত আলী তরুণের মুখে। তীক্ষ্ণ, অনুসন্ধানী চোখে কী একটা খোঁজে।
ভ্রু কুঁচকে ওঠে তরুণের। কে তাকে খুঁজবে এখানে! কে তাকে চেনে! এসব জায়গায় কেউ তো স্থায়ী নয়। ভাসমান সবাই, তার মতোই। এসব জায়গায় কেউ কাউকে খোঁজে না। নিয়ম নেই।
কিডা খোঁজে আমাক? –প্রশ্নটা করেই রহমত আলীর দৃষ্টি লক্ষ করে তারও চোখ যায় দূরে। বোরকায় পুরো মুখ ঢাকা। হাতে, পায়ে, মোজা। তবু ঠিক চিনে নেয় তরুণ। জিনিয়া। অন্য কেউ নয়। চোখ দেখেই বুঝতে পারে। তাছাড়া এখানে তাকে খুঁজতে আসার মতো নারী চরিত্র আর নেইও কেউ। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ওঠে তরুণ। তার মানে জিনিয়ার কাছে খবর পৌঁছে গেছে। এবার আবার জিনিয়ার ডেরায় ঢুঁ দিতে হবে তাকে মাঝে মাঝেই। রহমত কী বোঝে কে জানে। সে দূরে সরে যায়। বিছানায় উঠে বসে তরুণ। ইশারায় জিনিয়াকে ডাকে। আসে জিনিয়া। বসে অদূরে। তারপর কণ্ঠে অনুযোগ ঢেলে বলে, এতদিন এসেছেন, একটা খবর পর্যন্ত দিলেন না আমাকে! অসুস্থ শরীরে কষ্ট দিলেন নিজেকে!
এতদিন আইচি তুমাক কিডা কয়চে? তাছাড়া তুমাক খবরই বা দিতি হবি কী জন্যি! আমার সাতে লোক আচে, কষ্ট হয় নি কো!
হ্যাঁ। দাঁত উঁচু, হাঁড়িমুখো লোকটাকে দেখেছি তো। যেন দারোগা। জেরা করে আমার পেটের সব খবর পারলে একদিনেই বের করে নেয়।
কিজন্যি আইচো কও।
কেন? অপরাধ হয়েছে? চলে যাব?
রাগ কর ক্যান? আমার খোঁজে তুমার আসাডা কি উচিত? তুমিই কও।
ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। আপনিও ভাবেন না, সে জানি। সন্ধ্যায় আসবেন। আমি অপেক্ষা করব। এখন যাই।
চলে যায় জিনিয়া। তার চলে যাওয়া পথের দিকে চিন্তিত মুখে চেয়ে থাকে তরুণ। সুযোগ বুঝে সুরসুর করে এসে হাজির হয় রহমত। উদাস গলায় বলে, সাঁইজি, মিয়াডা মনে হয় খুপ দুঃক্কি। কেমুন টলটলে পদ্মর মতো দুইডে চোক। তাতে দুক্কু কুসুম ফুটে আচে। আহা।
চমকে রহমত আলীর কথাগুলো তরুণ নাড়াচাড়া করে মনে মনে। দুঃখ! আহা! দুঃখ কার নেই! দুঃখ আছে বলেই জিনিয়া বেশ্যার ভেক ধরেছে, আর সে ধরেছে বাউলের ভেক। জগত মূলত দুঃখময়, ভেকে ভেকে সয়লাব তার সকল প্রান্ত। নির্বাণ নেই কোনো, মুক্তি নেই কিছুতেই।
চলবে…