[পর্ব-১৪]
অতপর কফি খায় তারা। মাধবী বিল মিটিয়ে দেয়। উঠে দাঁড়ায়। রতনকে পেছনে রেখে এগোয়। মাধবীকে অনুসরণ করে রতন। মাধবী গিয়ে ঢোকে বইয়ের দোকানে। বেছে বেছে বেশ কটা বই কেনে সে। রতন অবাক হয়। সাহিত্যের বই কেনে মাধবী। তার যে সাহিত্যে ঝোঁক আছে সেটা তো বোঝা যায়নি কখনো! মাধবীকে সে বড়লোকের অহঙ্কারী, জেদি মেয়ে হিসেবেই চেনে। আর কোনো পরিচয় যে আছে তার, সেটা পুরোপুরি অজানা। নীরব থাকে সে। দুই-চারটে বই নেড়েচেড়ে দেখে। মাধবী তার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে, কোন বই কিনবে, সাজেশান চায়। রতন হ্যাঁ-হুঁ করে। ভালো লাগে না তার। ক্লান্তি লাগে। শরীর বিশ্রাম চাইছে। হলে ফিরতে হবে।
বই কেনা সেরে গাড়িতে যখন ওঠে তারা, তখন ঘন সন্ধ্যা নেমেছে। আলো ঝলমলিয়ে উঠেছে রাস্তার দুই পাশে। রতনকে হলের সামনে নামিয়ে দেয় মাধবী। রতন গাড়ি থেকে নেমে হলের গেট লক্ষ করে এগোতেই পেছন থেকে ডাকে মাধবী, শোনো!
থমকে যায় রতন। অবাক হয়ে পেছন ফিরে বলে, কী হলো?
এদিকে একটু এসো তো!
কেন?—বলতে বলতেই দুই পা এগিয়ে আসে রতন।
এটা রাখো।—বলে, গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে রতনের হাতে বইয়ের প্যাকেটটা গুঁজে দেয় মাধবী। তারপর ভুস করে বেরিয়ে যায় গাড়িটা, রতনের পাশ কেটে। বোকার মতো আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মাধবীর চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে রতন। গাড়িটা ততক্ষণে চলে গেছে অনেক দূর।
পাগল!—নিজের মনেই বিড়বিড় করে ওঠে রতন। নিজের মধ্যে একটু কি আন্দোলন টের পায় সে! না!—মাথা নেড়ে অস্বীকার করে নিজেকে নিজেই। তাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। যেতে হবে বহুদূর।
অনেক রাত হলো। দীপনটা এখনো ফিরছে না অফিস থেকে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বেচারা রুমকী ঘুমিয়ে পড়েছে। রুমকীর মাথার কাছে বসে তার কোঁকড়া চুলে অন্যমনস্ক হাত বোলোয় তুলি। মাথার মধ্যে অনেক চিন্তা এলোমেলো উঁকি দেয়। দীপনটা বেশ রাত করে বাসায় ফিরছে ইদানীং। মেজাজও কেমন খিটখিটে। অকারণে রেগে যায়। কিছু একটা নিয়ে সম্ভবত চিন্তিত। অফিসে কোনো ঝামেলা যাচ্ছে কি না, কে জানে! জিগ্যেস করলে এড়িয়ে যায়। এই এক অভ্যাস দীপনের। অফিসের কোনো ব্যাপারই কখনো শেয়ার করে না বাসায়। ঘড়ি দেখে তুলি। হাই ওঠে নিজের অজান্তেই। সাড়ে এগারোটা পেরিয়েছে ঘড়ির কাঁটা। এখন ফোন দিলে রেগে যাবে দীপন। কিছুক্ষণ আগেই কথা হয়েছে, কাছাকাছি এসে গেছে, আটকে আছে জ্যামে।
রুমকীর ঘুমন্ত মুখটায় চোখ রাখে তুলি। রুমকী বা দীপন, কারও আদলই নেই মেয়েটার মুখে। বরং সেখানে রতন-দীপনের মা খুশবু বেগমের মুখটা স্পষ্ট গেঁথে দিয়েছে কেউ, সবাই বলে। তুলিও বিয়ের পর যতটুকু দেখেছে শাশুড়িকে, মনে আছে যতটুকু, তাতে রুমকীর মধ্যে শাশুড়ির ছায়াই দেখে সে-ও। দীপন, রতন দুই ভাই ই রুমকী বলতে পাগল। দীপনের কাছে মেয়ে একদিকে আর পুরো পৃথিবী অন্যদিকে। রতনও যতটুকু সময় সুস্থ থাকে, রুমকীর জন্য
কী করবে ভেবে পায় না। মেয়েটাও হয়েছে তেমন। বাবা-কাকা ছাড়া একমুহূর্ত চলতে চায় না তার। রতনের পাগলামি বাড়লে মেয়েটাই যেন সবচে বেশি কষ্ট পায়। তার মুখের দিকে তাকানো যায় না তখন। রতনকে যখন তালাবন্ধ করে রাখা হয়, মেয়েটা শুকনো, কাঁদো কাঁদো মুখে তার রুমের পাশ দিয়ে ঘুরঘুর করে, দরজায় কান পেতে কাকার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে চেষ্টা করে। তার কচি, কোমল মুখটার দিকে তাকিয়ে তুলির বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে তখন। দাদা-দাদির আদর-স্নেহ পেলো না মেয়েটা। এক কাকা, সে-ও থাকে বছরের অধিকাংশ সময়ই পাগলাবস্থায়! তুলির বাপের বাড়ির দিকেরও তেমন কেউ নেই যে রুমকীকে একটু স্নেহ-ভালোবাসা দেবে, সময় দেবে। তার পাগলি মেয়েটা স্কুলের সময়টা বাদে দিনের বাকি সময়টুকু কাটায় একা। ময়না কাজকর্ম সেরে যতটা সময় পায় চেষ্টা করে রুমকীর সঙ্গে কাটানোর। সে আর কতটুকু! তবু আশার কথা এই যে, রুমকীটা বড় হচ্ছে। ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে তারও পৃথিবী। আস্তে আস্তে তার নিজস্ব জগৎ তৈরি হচ্ছে, তাতে সে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। রুমকী, দীপন, রতন ছাড়াও তার জগতে ঢুকে যাচ্ছে তার স্কুল, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক, পড়াশোনা, বিনোদন। সারাদিনের অফিস শেষে মা-বাবা বাড়িতে ফিরলে, কিংবা ছুটির দিনগুলোতে তাই মা-বাবাকে একদম ছাড়তে চায় না মেয়েটা। তার নতুন পৃথিবীর গল্পের সাথে, চরিত্রগুলোর সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে সে অধীর অপেক্ষা করে। মেয়েটা দীপনের অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েই পড়ল আজও। বেশ কিছুদিন হচ্ছে এমন। সাবধানে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে উঠে পড়ে তুলি। রুমকীর গায়ে কাঁথাটা টেনে দিয়ে লাইট অফ করে চলে আসে নিজের রুমে। দীপন কেন আসছে না এখনো? অস্থির লাগে। পায়চারি করে রুমের মধ্যেই। আনমনে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। দাগটা স্পষ্ট। কপালের একটু ওপরে। চুলে ঢাকা। খেয়াল করলে বোঝা যায়। চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা এবার বের হয়ে যায় অজান্তেই। যায় না। কোনো দাগই মোছে না। জীবন চলে যায়। ফুরিয়ে যায় সব হিসাব-নিকাশ। তবু দাগ থেকে যায় ঠিক। ভেতরে বা বাইরে। থেকে যায়। থাকেই। কপালের ইঞ্চিখানেক ওপরের দাগটাও মুছলো না এ জীবনে আর। কলঙ্কতিলক! শব্দটা মনে করে নিজের মনেই হেসে ফেলল তুলি। কলঙ্ক! না, কলঙ্ক কেন হবে! কলঙ্ক শব্দটা অশ্লীল। ওতে ঘোর আপত্তি আছে তার। কলঙ্ক মানে ক্ষতি। কলঙ্ক মানে পাপ। তার কোনো ক্ষতি নেই। পাপও নেই কিছু। পাপ বা পুণ্য, শব্দদুটোতে আস্থা নাই তার। সে বোঝে ক্ষত। ক্ষতি মুছে যায়, ক্ষত মোছে না, দাগ রেখে যায়। ক্ষতিতে নিজের দায় কম, অন্যের বেশি। ক্ষততে উল্টো। কপালের দাগটাকে সে তাই ক্ষতই ভাবে। অন্যকে দায়ী করে তাকে অতটা গুরুত্ব দিতে সে রাজি নয়। বরং এ দায় একা তারই, তার নিজেরই বোকামির দণ্ড ওই ক্ষত, ভেবে নিজের মনেই সান্ত্বনা খোঁজে তুলি।
ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলটায় বসে সে ফিরে যায় একযুগ আগে। গনগনে রোদ ছিল বাইরে। আগুন ছড়াচ্ছিল হাওয়া। মাথার ওপর পুরোদমে ঘুরছিল ফ্যান। হালকা গোলাপি রঙা শিপনের শাড়ি, মাথায় পনিটেইল ধাঁচে চুড়ো করে বাঁধা চুল। গরমে মুখে জমেছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। শাড়ি, ব্লাউজ ভিজে উঠেছিল ঘামে। আগে কখনো এই রুমটাতে আসা হয়নি তার। মেহেদী অনেকবার অনুরোধ করেছে, রাগও করেছে কিন্তু সে আসেনি। মেহেদী থাকে ছয়তলার চিলেকোঠার ছোট্ট একটা ঘরে। সামনে খোলা ছাদ, নির্জন। আলো হাওয়ার অভাব নেই। ঘরটা ভীষণ পছন্দ হয়ে যায় তুলির। সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম, কিচেন, ছোট্ট একটা বারান্দা। মেহেদীর ঘরটা বেশ গোছানো, পরিষ্কার। এতটা আশা করেনি তুলি। সে খুশিমনে পা তুলে বসল বিছানায়। বালিশটা টেনে নিলো কোলের মধ্যে। মেহেদী বাথরুম থেকে ফিরল, খালি গা, ভেজা চুল। চোখ সরিয়ে নিলো তুলি। মেহেদীকে কখনো এ অবস্থায় দেখেনি আগে। হাতে রাখা ম্যাগাজিনটায় চোখ নামিয়ে মৃদুকণ্ঠে বলল, তোমার বুয়া কখন আসে?
খালা তো সেই সকালে আসে একবার। নাশতা বানিয়ে দিয়ে চলে যায়, আবার আসে সন্ধ্যায়। কেন বলছ?
না, এমনিতেই। দুপুরের রান্না?
শুক্রবারে বুয়ার ছুটি। আমি রান্না করি। আজও করেছি। খেয়ে দেখ, কেমন রাঁধি!—মেহেদীর কণ্ঠে কৌতুক।
তাই? কী রান্না করেছ?
খিচুড়ি, গোমাংস, বেগুন ভাজা!
আচ্ছা!
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-১৩॥ শিল্পী নাজনীন
একপাশের ছোট্ট টেবিলটায় খেতে বসে তুলি। মেহেদীও। খেতে খেতে টুকটাক কথা বলে। মেহেদী ভালো রাঁধে সত্যিই। বেশ ভালো। তুলি প্রশংসা করতে ভোলে না। মেহেদী হাসে। খাওয়া শেষে মেহেদী শুয়ে পড়ে। তুলি বসে মাথার কাছে। হাতটা টেনে নিয়ে মেহেদী বলে, আচ্ছা, একটা কথা বলো তো। সত্যি বলবে।
কী?
তুমি কি বিশ্বাস করো না আমাকে?
মানে?
এই যে, কতদিনের সম্পর্ক আমাদের, অথচ এত অনুরোধের পরও কখনো আসোনি আমার বাসায়!
আজ এলাম তো। অবিশ্বাস থাকলে আসতাম না। বিষয়টা বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের নয়।
তাহলে?
আমার অস্বস্তি হয়।
অস্বস্তি! কিন্তু কেন?
জানি না।
মেহেদী খেয়াল করে কেমন রাঙা হয়ে উঠেছে তুলির কান থেকে গাল অবদি। মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। তারপর হেসে বলে, বোকা মেয়ে!
বোকা কেন?—কৌতূহলী মুখ তুলে প্রশ্ন করে তুলি।
তুমি, আমি, কেউই আমরা শিশু নই। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমরা একান্তে কিছুটা সময় কাটাব সেটা খুব স্বাভাবিক। বরং উল্টোটাই অস্বাভাবিক। এখানে অস্বস্তির কী আছে?
কী আছে সে তো জানি না। তবু অস্বস্তি হয়।
এটা তোমার হিপোক্রেসি।
হিপোক্রেসি কেন?
চাও না আমাকে? কিংবা আমি তোমাকে?
চাই তো।—নখ খুঁটতে খুঁটতে সলজ্জ, ছোট্ট উত্তর তুলির।
তাহলে? দুজনই দুজনকে ভালোবাসছি, চাইছি, তাহলে আবার অস্বস্তির কী? আর যতটুকু তোমাকে বুঝেছি, তুমি তো সেকেলে ধ্যান-ধারণা পুষে রাখো না মনে। তাহলে অস্বস্তিটা কিসের?
ও তুমি বুঝবে না।—বলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তুলি। সে কী করে বোঝায় মেহেদীকে, মুখে সে যতই আধুনিকতার বুলি আওড়াক, মনে মনে সে এখনো অতটা আধুনিক হতে পারেনি আসলে। মনে সে মেহেদীকে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু শরীরে সে কুমারি। এতদিনের পুষে রাখা সংস্কার একদিনেই ঝেড়ে ফেলা অসম্ভব, তেমনটাই বিশ্বাস ছিল তার, তখন পর্যন্তও।
কী বুঝব না, শুনি? —বলে মেহেদী শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরল তাকে। মেহেদীর শক্ত আলিঙ্গনে থরথর কেঁপে উঠল তুলির নরম, পলকা শরীর। প্রতিরোধ তৈরির কথা মনেই পড়ল না তার। সে আবিষ্কার করল মেহেদীকে কখন জড়িয়ে নিয়েছে তারও দুহাত। নিজের মধ্যেই তুমুল বিস্ময় নিয়ে সে দেখল, শরীর অস্বীকার করছে তার মন। যেন এক ঘোর তাকে গ্রাস করে নিলো সহসা। তাতে ডুবতে ডুবতে ঘোর বিস্ময় নিয়ে মনে মনে সে ভাবতে থাকল, এত সহজ তাহলে ব্যাপারটা! এত্ত সহজ!
কলিংবেল বাজতেই চমকে উঠল তুলি। দীপন এলো। আয়নায় নিজেকে আবার দেখল। কপালের সামান্য ওপরে দাগটা স্পষ্ট ফুটে আছে। ক্ষত। এ জীবনে মুছল না আর। মুছবে না।
চলবে…