[পর্ব-১০]
মা ছাড়া আর কোনো নারীর সঙ্গে তেমন সখ্য কখনো গড়ে ওঠেনি রতনের। নারী চরিত্র তার কাছে অপার রহস্য। সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে, অবাক, গোবেচারা মুখে বললো, মানে?
গনগনে মুখে রতনের দিকে খরচোখে তাকিয়ে মাধবী বললো, খুব ভাব তোমার, না? প্রতিদিন যে তোমার পাশের চেয়ারে বসি, চোখে দেখো না?
বিস্মিত রতন বললো, দেখব না কেন? দেখি তো। তুমিও অনেক ভালো ছাত্রী।
—ওহ্! দেখো! আমি তো তোমাকে অন্ধ ভেবেছিলাম!
এত অবাক রতন জীবনে হয়নি আর। তার মতো চক্ষুষ্মান একজন মানুষ, যে দিব্যি একা একা হাঁটছে, ফিরছে, চলছে, কোনোরকম অস্বাভাবিকতা ছাড়াই, তাকে কেন কেউ অন্ধ ভাবতে যাবে! সে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললো, যাহ্! কী বলো এসব! আমি কেন অন্ধ হতে যাব!
—অ্যাঁ, তুমি অন্ধ নও? আমাকে দেখতে পাও?
—আশ্চর্য! দেখতে পাব না কেন?
—তাহলে কথা বলো না কেন?
—আমি তো কারও সাথেই কথা বলি না তেমন।
—কারও সাথে কথা বলতে হবে না! শুধু আমার সাথে বলবে! –হুকুম জারি করে মাধবী।
—কী কথা বলব? বেকুবের মতো প্রশ্ন করে রতন।
—এই আমি দেখতে কতটা খারাপ, কতটা অসুন্দর, সে সব বলবে!
কিন্তু তুমি তো দেখতে খারাপ নও, তুমি তো অনেক সুন্দর। আহাম্মকের মতো বলে বসে রতন!
কলকল হাসে মাধবী। রতন কি ঝর্ণার শব্দ পায়! হাসি থামিয়ে মাধবী বলে, আমি অনেক সুন্দর? তাহলে তাই-ই বলবে! কাল থেকে যদি মুখে কুলুপ এঁটে থাকো, তাহলে তোমার মুখে পিন মেরে দেব আমি, মনে রেখো!
সেই থেকে শুরু। মাধবী রতনকে গিনিপিগ পায় যেন। কিংবা রতনকে সে মনে করে প্রিয় কোনো খেলনা। অথবা রতনকে সে সত্যিই ভালোবেসে ফেলে। প্রতিদিন রতনকে সে তালিম দিতে চেষ্টা করে প্রেমের। রতনের তখন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। সে ব্যস্ত পড়াশোনায়। তার লক্ষ্য দূরে। পড়াশোনা শেষে বড় চাকরি করবে, দীপনকে বড় করবে, মা’র কষ্ট কমাবে। মাধবীর পাগলামিতে অবাক হয় সে, বিরক্ত হয়। মাঝে মাঝে সহানুভূতিও উঁকি দেয় মনে। কিন্তু, ওইটুকুই। তার বেশি নয়। মাধবী অস্থির হয়ে ওঠে। অবাধ্য হয়ে ওঠে। ক্লাসের সবাই রতনকে বোঝায়, মাধবী ভালোবাসে তাকে, কেন সে কষ্ট দিচ্ছে মেয়েটাকে!
রতন অবাক হয়। কেন এমন বলে সবাই? মাধবীকে কিভাবে সে কষ্ট দিচ্ছে? মাধবীর জন্য তার মধ্যে কোনো বোধ তো জন্মায়নি। তাহলে, সে যদি মিথ্যে করে বলে, মাধবীকে ভালোবাসে, তাতে কি কষ্ট কমবে মাধবীর? খুশি হবে সে? বুঝতে পারে না রতন। তালগোল পাকিয়ে যায় সব। সে বইয়ে ডুবে যায় আরও।
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-৯॥ শিল্পী নাজনীন
ভাইয়া! চলে এসেছি! নাম এবার! দীপনের ডাকে সম্বিত ফেরে রতনের। ক্লিনিকের পাশে গাড়ি কখন পার্ক করেছে দীপন, টেরই পায়নি। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে দীপন। রতন আস্তে নেমে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে হেঁটে যায় দীপনকে অনুসরণ করে ডাক্তারের চেম্বার বরাবর।
অনেক যত্ন নিয়ে দেখলেন ডাক্তার। দূরের জিনিস দেখতে কষ্ট হয় রতনের। চোখের পাওয়ার কমছে তার। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ওষুধের সাইড ইফেক্ট আর বয়স দুই মিলে এ সমস্যার উদ্ভব। ওষুধ দিলেন, সঙ্গে চোখের ড্রপ, কিছু ভিটামিন আর অতি অবশ্যই চশমা। কথা যা বলার দীপনই বললো সব। রতন শুধু মাঝে-মধ্যে হু-হ্যাঁ করে, মাথা ঝাঁকিয়ে দায় সারল। মনটা বড্ড চঞ্চল হয়ে উঠতে চাইছে হঠাৎ, উচাটন। থামাতে হবে, মনকে শেকল পরাতে হবে! নইলে মাথার মধ্যে আবার দুম করে ডেকে উঠবে ঝিঁঝি, তারস্বরে ডেকে যদি ওঠে একবার সহসা আর থামবে না সে। অস্থির, উত্ত্যক্ত করে তুলবে ভীষণ। ছটফট করে রতন, হাঁসফাঁস করে। দীপনকে বলে, চল তো, যাই এবার। ভালো লাগছে না আর।
আতঙ্কিত বোধ করে দীপন। রতনের চোখ-মুখের অবস্থা স্বাভাবিক লাগে না তার। তাড়াতাড়ি চশমার অর্ডারটা দিয়েই গাড়িতে উঠে বসে। রতনও এসে বসে পাশের সিটে। ক্লান্ত, অস্থির দেখায় তাকে। গাড়িতে স্টার্ট দেয় দীপন। শ্লথগতিতে চলে। রতন মাত্রই একটু সুস্থ হয়ে উঠছিল, এত তাড়াতাড়ি আবার অসুস্থ হওয়ার কথা নয় তার। এমনটা আগে হয়নি তখনো। সাময়িক অসুস্থতা হবে হয়তো, মনে মনে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয়। বেশি খারাপ লাগছে ভাইয়া? মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করে।
বাইরে এসে, বুকভরে শ্বাস নিয়ে রতন ততক্ষণে সামলে নিয়েছে খানিকটা। চোখ বুঁজে সিটে হেলান দিয়ে আস্তে করে বলে, না না! একটু খারাপ লাগছিল, এখন ঠিক আছি। তুই সাবধানে গাড়ি চালা। একটু আস্তে চালাস।
—আচ্ছা। তুই রেস্ট কর। বেশি খারাপ লাগলে পেছনের সিটে গিয়ে শুয়ে পড়।
—এখানেই ঠিক আছি। চিন্তা করিস না। বলে সিটে চোখ বুজে আবার গা এলিয়ে দেয় রতন। মাথার মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা, ঝিঁঝিটা চুপচাপ আছে এখনো, এই যা স্বস্তি। বড় শ্বাস ছাড়ে সে, ফুসফুস ভরে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে আপ্রাণ।
চলবে…