॥পাঁচ॥
রবির রান্নার পাট চুকেছে। এবার পরিবেশনের পালা। একটা পুরনো কাপড় নিয়ে প্রথমে টেবিলটা এদিক ওদিক অনেকগুলো অর্ধবৃত্ত এঁকে মুছে নিল। পাখা চালিয়ে দেওয়ায় টেবিলে পানির যেটুকু অর্ধবৃত্ত রেখাকার অংশ ছিল তা শুকিয়ে গেল। জানালার পর্দাগুলো যখন বাতাসে উড়ছিল তখন জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল বাইরে শক্তিকেন্দ্রের হলুদ বাতিটা। বড় কাজের ক্ষমতাহীন পদাধিকারী অধঃস্তন কর্মচারীর মতো একা জ্বলছে। ওপরে কোথাও জ্বলছে উজ্জ্বল ঊর্ধ্বতন ফ্লাডলাইট। ফ্লাডলাইটের আলোর বিশালতার নিচে একটি ছোটঘর পেয়ে নিজস্ব ভুবনের রহস্যের আলাদা খবর পর্দা যদি ওড়ে, তো পৌঁছে দিতে পারছে।
খাবার আনতে শুরু করার আগে সরব সেবাপরায়ণ পাখাটা বন্ধ করে গেল রবি। হাড়িতে চামচকোচাররন রন শব্দ, ধাতব পাত্রে পাত্র ঠোকার টুনটুন শব্দ আর গ্লাসের ঠকাস টক শব্দের এক অবিচ্ছিন্ন মালা গেঁথে চলল সে পরবর্তী বেশ কিছুক্ষণ—কখনো রান্নাঘরে, কখনো খাবার টেবিলে। এরপর বাইরে গিয়ে দরজা ঠুকে সবাইকে ডাকতে শুরু করল। বেশ কবার ডাকের পর একেকটি ছিটকিনি খোলার মৃদু শব্দ বাতাস কেটে অতিথিশালায় এলো। সলিল গোসল সেরে পোশাক বদলে বেশ আগেই তৈরি।
ঘরে একে একে চারজনই এলো। একটু আগে যে ঘুরে চোটপাট দেখিয়ে গেছে সে জসিম। অতিথিশালার পাশের ঘরটা তার, রবি আগেই দেখিয়েছে।সবার চোখে মুখে কেমন এক অনাত্মীয়তার ছাপ, যেন কেউ কাউকে চেনে না এমনকি চিনবার সাধও যেন কারো নেই। সবাই চোখ নামিয়ে খাবারের পাত্র প্রয়োজনমতো এদিক ওদিক করতে লাগল। চিবুতে থাকল। যেন ভারী-শান্ত আর নিরুদ্বেগ সবাই। এমন সময় হঠাৎ করেই মুখ তুলল সৌরভ। বলল, আমাদের সঙ্গে আজ থেকে একজন নতুন প্রকৌশলীর পথ চলা শুরু হলো।
সলিলের উদ্দেশে নতুন প্রকৌশলীর বিশেষণটি এসেছে বুঝতে পেরে সে মুখটি তুলে তাকাল। চিবুক নড়তে থাকা অবস্থায় যতটা বিনয়ী ভাব ফুটিয়ে তোলা যায়, সলিল তা ফুটিয়ে তুলতে চাইল। কিন্তু কারো দিক থেকে কোনো আন্তরিক সাড়া এলো না বলে এক ধরনের অস্বস্তির ছাপ পড়ল তার বিনয়ী মুখটিতে। আবার নত হলো।
ওনার নাম সলিল—পদবিসহ নামটি উচ্চারণ করে গেল সৌরভ। তাকাল সলিলের দিকে। সলিল বলল, আমারই নিজ থেকে পরিচিত হওয়া উচিত ছিল, আমি খুবই দুঃখিত।
মজুমদার! মুসলমান? প্লেটে ডালমাখা ভাত আঙুলে গোলানোর মধ্যখানে থেমে প্রশ্ন করল জসিম। তার ভুরু দুটো খানিকটা কুঁচকে আছে। চিবুকটা এমনভাবে উঁচিয়ে রাখা যেন এখনই জবাব চাই।
এবার বাকি চোখগুলো ওদের দুজনের দিকে ফিরে তাকাল। মুহূর্তকয়েক তাকিয়ে চোখজোড়া ফিরিয়ে নিলো পল্লব, সৌরভ। আগের সেই জড় ভাবটি তাদের মুখ থেকে সরে গেছে, বুঝি আলোড়িত হয়েছে। চোখের তলাটা কুঁচকে মধ্য চল্লিশের জসিমের দিকে তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকাল ত্রিশের মেহেদি। সলিলেল শেষ কথাটির সুতো আঁকড়ে বলল,ওটা কিছু না। মেহেদি আমি। আর ও পল্লব। কথা কম বলার দুর্নাম আছে। খাবার থেকে মুখ তুলে মাথাটা সলিলের দিকে একবার নোয়ালো সে, চোখজোড়ায় হাসি।
জসিমের প্রশ্নের কোনো জবাব তখনই দিতে পারল না সলিল। বিব্রত মুখটা সবার দিকে একেকবার ফিরিয়ে যেন পরিবেশ আর প্রতিবেশটা বুঝে নিতে কিছুটা সময় নিলো। শেষে জসিমের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। যেন কোমল স্বরে কিছু একটা বলতে গিয়ে মেষ মুহূর্তে নিজেকে দমালো। পদবি ও হালচাল দুটোই বলে দিলো—সলিলের ওপরে সবাই। জসিম বয়েসের দিক থেকে সৌরভেরও কিছু বড়। আর পদবিতে মেহেদি আর পল্লবের চেয়ে।
পল্লবের মুখে বেশ একটা ফোলা ফোলা ভাব। গায়ের রং কালো। চোখ দুটো বড় আর টানা। মাথার চুল সৈনিকের মতো ছোট করে ছাঁটা। তবে গালে বেশ কদিনের না-কামানো দাড়ি। দাড়ির ভেতর সাদাকালোর সন্নিবেশ আছে। পরেছে কালো রঙের টি-শার্ট, সাদা পাজামা। একটু স্ফীতকায় হওয়ায় গলার চামড়ায় ভাঁজ পড়ে একটা কালো চক্র তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে মেহেদি ফর্সা। রুগ্ণ চোয়ালে চাপ চাপ দাড়ি। চোখ দুটো বড়, ভুরু দুটোও গাঢ়। এরচুল আঁচড়ানোর মতো দীর্ঘ। একটু আগে স্নান করে ভেজা চুলেই একপাশে সিঁথি কেটে চিরুনি বোলানো হয়েছে। চারজনের ভেতর শুধু এই একজনই মুখ বন্ধ রেখে খাবার চিবোয়। এর চোখের আলোও সবার চেয়ে বেশি। মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য, একেকবার কথা বলার সময় ওটা খসে পড়ে। কথা শেষে আবার ঢেকে দেয়মুখ। পরনের হলুদ রঙের ফতুয়াটা পুরনো বেশ। দুই কাঁধের কাছে জ্বলে গেছে রং।
জসিম আগের পোশাকেই ছিল।মনের অশান্ত ভাব স্পষ্ট তার মুখে। ভাতের রূপালি বল, সবজির সাদাপাত্র কাছে এগিয়ে নিয়ে এসে নিজ পাতে নেওয়ার পর আরফিরিয়ে দিলো না—এমন হলো বেশ কবার। লম্বা করে হাত বাড়াতে হচ্ছিল তাই একেকজনকে।এ নিয়ে কেউ চাপা হাসল, কারো রাগ হলো, কেউ রইল নির্বিকার।এসবের মাঝেখাবার টেবিল আর রান্নাঘরে রবি এলো গেলো আরো বেশ কবার। একেকবার কাজ ফুরিয়েছে ভেবে একটি কোণে দাঁড়িয়ে ভেজা গামছায় হাত মুছল আর টেবিলে নজর করে নতুন একেকটি প্রয়োজন খুঁজে বের করল।প্রায় খালি হয়ে পড়া খাবারের পাত্রগুলো কয়েকবার করে তুলে নিয়ে গেল, ভরে এনে রাখল আবার। পানির মাঝারিকাচের জগটি নিয়েও আসা-যাওয়া করতে হলো আরো বেশ কবার। কটি পেঁয়াজ কেটে আর মরিচ ধুয়ে পিরিচে সাজিয়ে রাখল টেবিলের মধ্যখানে। ধীরে তার এ যাওয়া-আসা কমে এলো। খাবার পর্বের ওই শেষ সময়ে পরিবেশ তখন বেশ খানিকটা তরল হয়ে উঠেছে। খসে পড়তে শুরু করেছে খানিক আগে তৈরি হওয়া জড়তার ঠাণ্ডা দেয়ালের একটি দুটি ইট।
এ সময় কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুর নিয়ে আবারও মঞ্চে জসিম। বলল, তো বেশ। এর আগে কোথায় কাজ করেছেন যেন আপনি?
পল্লব আর মেহেদি—দুজনেই সলিলের মুখের দিকে তাকাল। সৌরভের খাওয়া শেষ হয়েছে। সশব্দে চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে সে বেসিনের দিকে এগোল। সলিল অতীতে ডুব দিয়ে কয়েক রকম মুক্তো বুঝি তুলে আনলো। শেষমেষ কোনোটাই দেবে না—এমন এক মুখভঙ্গি করে বিনয় ধরে রেখে বলল,জি, কোথাও নয়। এবারই প্রথম।
শুনে জসিম বলল, তাই নাকি? তাহলে তো কঠিন হবে।
মেহেদি বলল, তা একরকম হবে সন্দেহ নেই। এখানে জীবন যেমন তাতে করে। যাহোক, আলাদা করে চিন্তার কারণ নেই। কাচের জগটা কাছে টেনে এনে বাম হাতে গ্লাসে পানি ঢেলে নেওয়ার ফাঁকে যোগ করল,তবে কী,কোনো কাজে কেউ নতুন বা পুরাতন যাই হোন না কেন, জায়গাটা যখন নতুন,তখন ব্যাপার সবার ক্ষেত্রেই এক। প্রায় এক। ঠিক হয়ে যাবে। শিখে নিতে আর কদিন।
কথা কটির পর জসিমের দিকে মেহেদির চাহনি আবারও এক শীতল যুদ্ধের ইঙ্গিত যেন বহন করল।
সৌরভ বেসিনের পাশে মরচে ধরা রূপালি আংটায় ঝোলানো গোলাপি তোয়ালেতে ভেজা হাত দুটো মুছে নিচ্ছিল। মুখটা ফিরিয়ে বলল, আপনারা অত ভাবছেন কেন? সলিল সাহেব হচ্ছেন হেড অফিসের নির্বাচিত লোক। হাউজ তো আর মুখ দেখে কাউকে পাঠায়নি। ঠোঁটে কৌতুকের হাসি ফুটিয়ে বলল, সুতরাং নিশ্চয়ই সলিল সাহেব বিশেষ কেউ। তার ক্ষমতা অক্ষমতা নিয়ে ভাবার অন্তত আমি কোনো কারণ দেখছি না।
সলিল এই কৌতুকে নিঃশব্দেহাসলো আর অন্যেরাও অল্পবিস্তর। পল্লব ওপরনিচ মাথা দোলালো শুধু। মেহেদি বলল, তা তো বটেই।
সুতরাং খাওয়ায় মন দিন। আমি বেরোলাম। শেষ কথাটি টেবিলের দিকে ছুড়ে সৌরভ লম্বা পায়েএগোতে শুরু করল খোলা দরজা দিকে।
স্থির সলিলের ভেতর থেকে এসময় এক অর্বাচীন তরুণ জেগে উঠল, চোখে-মুখে। একেবারেই কিছুই যে করিনি তাও নয়। সংকোচ প্রথমটায় তার কণ্ঠ কামড়ে ঝুলে থাকল বটে,পরে তাকেও ঝরেও পড়তে হলো। তৃতীয় থেকে চতুর্থ বর্ষে উঠব যেবার, সেবার মাঝের ছুটিতে এক বড় ভাইয়ের কারখানায় কাজ করেছিলাম দিন পনের। দিন পনেরর ব্যাপার তো, তাই আলাদা করে বলিনি আর, ভাই যখন জিজ্ঞেস করলেন। একটা ফিশ ফিড মিল ছিল ওটা, মাছের খাবার বানাতো। আমার যতসামান্য যে কাজ, তা তড়িৎ প্রকৌশলীরই ছিল।
সৌরভ সিঁড়িতে রাখা স্যান্ডেলজোড়া পায়ে গলিয়ে ততক্ষণে নিজ ঘরমুখী হয়েছে। ফ্লাডলাইটের আলোয় তার কাপড়ের ভাঁজে ছায়া-ছায়া খেলা। দেহের ছায়া পড়েছে চারটি। টেবিলে পল্লব সহৃদয় কণ্ঠে বলে উঠল,তাহলে তো হলোই। কোথায় ছিল ওটা?
নারায়ণগঞ্জ। বিরাজ ফিশ ফিড মিল।
বেশ। ওখানে আমার স্ত্রীর কলেজ। তোলারাম।
ফিশ ফিড মিলের দিন পনেরর অভিজ্ঞতা? এটা ট্রান্সফর্মার কারখানা মিস্টার! ওই বিদ্যার খাওয়া নেই। আর বিএসসি ক্লাসে যা শেখায়, তা তো জানিই। শেষ বাক্যটা একটা প্রচ্ছন্ন ঝাঁঝের সঙ্গে কথা কটা বলে দাঁতের ওপরের পাটিতে জিভ চেপে বোলাতে থাকল জসিম। এরপর গ্লাসে পানি ঢেলে এক ঢোকে সবটা পিয়ে ঠোঁট উল্টে পুনরাবৃত্তি করল আগের কথার। কোনো কাজে তো আসবেই না ওসব বরং বিপদটা বাড়বে। সলিলের দিকে তাকিয়ে ঘাড়টি কাত করে বলল,সাবধান কিন্তু। কারখানার সব কোটি টাকার ব্যাপার। এখানে নিজের বিদ্যা না ফলিয়ে আমাদের জিজ্ঞেস করবেন। আমাকে সবসময় নাও পেতে পারেন, তবে ওদের দুজনকে, আঙুল দিয়ে পল্লব আর মেহেদিকে দেখিয়ে, সবসময় পাবেন। প্রশ্ন করবেন। নবিশ ছেলের বিড়ম্বনায় আমরা আগেও পড়েছি তো, তাই বলে রাখতে বাধ্য হলাম। কাল থেকেই তো শুরু করছেন। কারখানায় কোনো হানিমুন পিরিয়ড নেই।
পল্লব অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে মেহেদির চোখে তাকিয়ে যেন বলল, দেখলে ব্যাপারটা?
চেয়ার ছেড়ে বেসিনের দিকে যাওয়ার পথ ধরল জসিম। সলিলের খাওয়া শেষ হয়েছে আরো আগেই। এবার চেয়ার ছেড়ে উঠল সেও। উঠল বটে কিন্তু এগোল না আর। জসিমকে বেসিনের দিকে যাওয়ার পথ করে দিতে চেয়ারের হেলান ধরে দাঁড়িয়ে রইল। মুখে মেঘ থমথম করছে। চোখে বৃষ্টির আভাস। জলধরমেঘ উড়িয়ে দিতে চাই হাওয়া আর সেই হাওয়ার উৎস খুঁজতে গিয়েই পেল রবিকে। দরজার কাছটায় দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা,চোখে মমতা নিয়ে তাকে দেখছিল।
দারুণ রেঁধেছ তুমি রবি! ভাত চড়িয়ে বোধয় একটু লবণও দিয়েছ। সবজির রঙটা কী সুন্দর রেখেছ। আর ডালটার তো জবাব নেই। শিখেছ কোথায়?
রবি হেসে মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে নিলো। মুখে কিছু বলতে না পারলেও তার পুরো অবয়ব যেন কৃতজ্ঞতা জানাল এ কথার। দরজার কাঠের ওপর নিঃশব্দে তবলা বাজিয়ে চলেছে তার আঙুল। মুখের পেশিতে মনের ছন্দের আভাস, কিন্তু উদ্ভাস নেই। একটা কিছু বলতে গিয়েও যেন পরমুহূর্তে সামলে নিচ্ছে। দরজাপথে বাইরের আঙিনায় তাকাল একবার। ভেতরে আবার চোখ ফিরিয়ে এনে দেখতে পেল সলিলের প্রফুল্ল চোখজোড়া তখনো তাকে দেখছে।
রান্নাঘরে ফিরে নড়বড়ে জলচৌকিটিতে বসল গিয়ে রবি। ডালঘুটনিটা হাতে নিয়ে এর পাখার মতো দিকটা নাকের কাছে ধরে কিছুক্ষণ হলুদের গন্ধ শুঁকল। দৃষ্টি দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্য কোথাও। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের কাছেরকালি-হলুদের দাগ ধরে যাওয়া মগে রেখে দিলো ডালঘুটনিটা। পাশ ঘেঁষে একটা কিছু গেল বরে মনে হতেই ঝট করে তাকাল। দেঁয়াল ঘেঁষে মুখে কিছু একটা নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে ধূসর একটা ইঁদুর। যাক!
সবার খাওয়া শেষ হলে টেবিল থেকে অবশিষ্ট ভাত, সবজি ডাল, মাংস নিয়ে এসেছে রবি। চুলার নিচে জড়ো করে রাখা হাড়িগুলোর তলানিতে এখনও কিছু খাবার অবশিষ্ট রয়ে গেছে। সেগুলো বাটিতে ঢেলে হাড়িগুলো একটির ওপর আরেকটি রেখেমিনার বানালো। এরপর আস্তমিনারটা তুলে নিয়ে গেল রান্নাঘরের পেছন দিকে ওই খোলা দরজার বাইরে। ওখানে রবির অপেক্ষায় পেছনে বেণী এলিয়ে মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে ছিল একটি চাপকল। চাপকলটির পাশে দাঁড়িয়ে তার শিষ্যশাবক, নীলরঙা বালতি। আধভরা জলে একাকী ভাসছে তার পালিতপুত্র,তলা ফেটে যাওয়া মগ, টুকটুকে লাল।
শরীরে ঢেউ তুলে চাপকল চেপে নীল বালতিটা জলে ভরে তুলল রবি। কলের চারপাশে কয়েক বর্গফুট জায়গা পাকা করা। গোটা জায়গাটা শ্যাওলায় পিচ্ছিল। তাকে ঘিরে রেখেছে প্রায় ইঞ্চি ছয়েক উঁচু ইটের ঘের। তার ওপর বসে হাতের একপাশে বালতি আর অপর পাশে হাড়ির ওই স্তম্ভ নিয়ে বসলো রবি। ঘেরের ওপরকার প্রলেপ জায়গায় জায়গায় খসে গেছে। পাকা জায়গাটিরও এখানে ওখানে গেছে ভেঙে। ভাঙা জায়গায় জমে আছে জল। পায়ের কাছে হাঁড়ি রেখে ঘষে ঘষে পাত্রের তেলচিটে ভাব পরিষ্কার করতে লেগে গেল রবি। ডান হাতে ধুন্দলের জালি চেপে ধরে বাম হাতে যখন হাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাজতে থাকল। পাকা মেঝের সঙ্গে হাঁড়ির তলার রগুড়ে আলাপ চলল অনেকক্ষণ।
রবি একবার সহকর্মীদের বলে ফেলেছিল, ওই শব্দটা আমার ভালো লাগে খুব। এরপর থেকেই আরও অনেক কিছুর সঙ্গে এটা নিয়েও সে হাসির পাত্রে পরিণত হলো। তুই জাত কামলা রবি, এইতো প্রমাণ।
হাড়িকুড়ি মেজে ঘষে রান্নাঘরে ফিরে এসে সব সাজাল এক তেলচিটে তাকের ওপর। এরপর একটা ধোয়া চিনামাটির প্লেট নিয়ে নড়বড়ে জলচৌকিকে খেতে বসে গেল। ভাত অনেক থেকে গেলেও সবজি মিলল না তেমন। যা-যা ছিল সব একসঙ্গে ভাতের ওপর ঢেলে মেখে নিয়ে খেতে শুরু করলো রবি। গাল ভরা খাবার নিয়ে চিবোনোর মাঝামাঝি কামড় বসাল টিয়েরঙা এক নাদুসনুদুস মরিচে। মরিচটা জিভের কোথায় গেছে লেগে। আস্ত গ্রাসটা দ্রুত গিলে ফেলল রবি।
খাওয়া শেষ করে সবাই তখন যার যার ঘরের দিকে চলে গেছে। অতিথিশালার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে সলিল। আঙুলের ফাঁকে না-ধরানো সিগারেট। চারটি ফ্লাডলাইটের মধ্যে দুটি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতেও কারখানার সীমার ভেতর সাদা আলো বান। বাইরের প্রকৃতি তাই যা নয় চোখে তারও বেশি অন্ধকার হয়ে আছে। গোটা গ্রামের ওপর হিমের একটা চাদর যেন এসে পড়েছে। সীমানা দেয়ালের বাইরে একটা ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁ পোকার দল।
সলিল কালচে ঠোঁটে সিগারেট চেপে এক হাতের উল্টোপিঠে বাতাস আড়াল করে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালালো। তার কাঁধজোড়া জড়ো হয়ে এলো তখন। ফ্লাডলাইটের সাদা আলোয় সিগারেটের নীল ধোঁয়া পাক খেতে খেতে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে গেল। ফটকের দিকে ধীর পায়ে হেঁটে গেল সলিল।
মূল ফটকে ডিউটি বদল হয়েছে। বিকালের সেই নজরুল। এবার তাকে খানিকটা ভালো করে দেখার সুযোগ হলো সলিলের। নজরুলের শরীরে একটা আরামদায়ক শিথিল ভাব আছে, উন্নত তলপেট। ফটকের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সীমানা দেয়াল ঘেঁষে হেঁটে আসছে কিছুক্ষণ পরপর। আড়চোখে সলিলকে দেখে কাঁটাতারের দিকেও সতর্ক চোখে তাকাতে থাকল। টর্চ ফেলতে লাগল কারখানার এ কোণ থেকে ও কোণে। নিশিজাগা বড় বড় চোখের দৃষ্টিতে ভারী সতর্কতা। থেকে থেকে দেখছে সলিলকে, যেন সুযোগ পেলে একটু আলাপ করে নিতে চায়। আবার বাধো বাধো ঠেকায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে আবার।
সলিল তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে ঢালাই দেওয়া মেঝে ধরে কিছুদূর সামনে হেঁটে গেল। টিনসেডের ছাউনিগুলোর নিচে দানবীয় যন্ত্রগুলো ভৌতিক অবয়ব নিয়েছে। টেনের ছোট একটি দুটি ছিদ্র দিয়ে সরলরেখায় ঢুকে পড়ছে ফ্লাডলাইটের আলো। অতিথিশালার পেছনে একবার শক্তিকেন্দ্রটির কাছ থেকেও একবার ঘুরে এলো। ততক্ষণে সিগারেট শেষ হয়েছে।
ঘরে ঢুকে পড়ে শেষবারের মতো পরিচ্ছন্ন হয়ে মুখহাত মুছে কাপড় আর না বদলেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ মুদলো সলিল। কোন মুহূর্তে ঘুমটা এল টেরও পেল না। অনভ্যাসে দরজা লাগাতে ভুলে গেল।
কারখানার ডাকু মশা জানালা বন্ধ করার আগেই যথেষ্ট ঢুকেছিল। সেই সন্ধ্যা থেকেই নিজ অবস্থান পরিষ্কার করার পক্ষে যথেষ্ট অবকাশ ওরা পেয়েছে, কাজেও লাগিয়েছে। নিথর কিন্তু জীবিত মাংসপিণ্ডটা পেয়ে এবার জেঁকে ধরল। ঘরে উষ্ণ রক্তের প্রাণি বলতে ওই একটিই ছিল। সুতরাং তার শরীরের কোথাও আর সুঁই পড়তে বাকি রইল না।
মিটসেলফের দেরাজ খুলে কচুরিপানার তৈরি কয়েলের একটা প্যাকেট বের করল রবি। পলিথিলিন মোড়কের দলাপাকানো মুখটা প্যাকেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে। একটা কয়েল বের করে বাঁকানো চোখা মাথায় জ্বলন্ত দিয়াশলাই ধরে সাবধানে আগুন লাগাল। কালচে ধূসর ধোঁয়ার কয়েকটি পাক কুণ্ডুলি পাকিয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেল কালি জমা চালার দিকে। অতিথিশালার ভেজানো দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল রবি। খাটের নিচে লুকিয়ে থাকা একটি রূপালি প্লেট টেনে বের করল। তাতে কয়েল পোড়া ছাইয়ের ভাঙা বৃত্ত। গেঁথে রাখার পাতলা ধাতব একটা দাঁড়ও ওখানে দাঁড়িয়ে। ছুঁচাল মাথায় আগের কয়েলটির ছাই-অবশেষ তখনো লেগে আছে। নতুন কয়েলটা গাঁথার সময় ওটা আপসে খসে গেল।
অতিথিশালার দরজাটা নিঃশব্দে ভিড়িয়ে দিয়ে উঠোন পেরিয়ে উল্টো দিকের প্রহরীঘরের দিকে যেতে থাকল রবি। অবসন্ন পা জোড়া ধীরে ফেলে ফেলে এগোচ্ছিল, ক্লান্ত হাত দুটো দুলছিল দুপাশে প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন। ফটকের কাছে নৈশপ্রহরী নজরুলকে দেখে দাঁড়াল একবার। মৃদু কণ্ঠে সম্ভাষণ বিনিময় হলো। নজরুল মুখে একটা কপট কঠোরতা এনে হটতে ইশারা করতেই সেখানে আর দাঁড়াল না ক্লান্ত কিশোর। প্রহরীঘরের ভেজানো দরজা নিঃশব্দে খানিক ঠেলে ঢুকে পড়ল অন্ধকারে।
চলবে…