(পর্ব-১১)
ড. ফারজানা বাসায় ফিরে বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে ভাবতে থাকেন, নতুন ভিসি স্যার ভালো মানুষ। ড. শাহেদ জাহানের মতো নারীলোলুপ নন। গল্প করে সময় পার করার মতো ব্যক্তিও তিনি নন। একেবারে আদর্শ মানুষ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই। শাহেদ জাহানের সাথে যে জীবনটা গেলো, পুরোটাই তো জলে ভেসে গেলো। অনর্থক। সিসিও তো আমার সাথে ভালো আচরণ করছেন না। গাদ্দার একটা লোক! ড. এলিনাকে জোর করে বাংলা বিভাগে যুক্ত করার চেষ্টা করছেন। হয়তো একসময় করেও ফেলবেন। কিন্তু আমি তো তার সাথে মন কষাকষির মতো কোন আচরণ করিনি। তার মনে কষ্ট লাগে এরকম কোন কথাও তো বলিনি। তাকে সার্বক্ষণিক খুশি রাখারই চেষ্টা করেছি। অত টাকা দিয়ে ঘড়ি কিনে উপহার দিলাম। নিজের থেকে গায়ে মেখে তার সাথে মিশেছি, যা করার নয়, তাও করেছি। শুধু তাকে আমার অনুগত করে চাকরিটা দাপটের সাথে করবো ভেবে। এসব তো এখন রাতের স্বপ্ন দেখার মতো লাগছে! ঘুম শেষে কোন মূল্য নেই। ড. শাহেদ জাহান চলে যাওয়াতেই বুঝেছিলাম, আমার শরীর থেকে শক্তির তিন ভাগের দুই ভাগে খসে গেছে। তবু ভরসা করেছিলাম, সিসি তো আছে। কিন্তু আজ নতুন ভিসি স্যারের সামনে তিনি যা করলেন, তাতে মনে হলো আমার শরীরে যে এক ভাগ শক্তি ছিল, তাও নেই। আর মন তো এখন শুকনো নদীর চর! মরা নদী। তাহলে আমি এখানে কিভাবে চাকরিটাকে টিকিয়ে রাখবো! আর এখন তো প্রতিদিনই প্রচুর কাজ করতে হবে—সেসব কাজের আমিই বা কতোটুকু জানি! কতোটুকু বুঝি! এতোদিন ভিসি আর সিসির মনোরঞ্জন করেই চলেছি, টেবিলে গল্পগুজব করেই দিন পার করেছি—কখনো কোন সমস্যা হয় নি। এখনকার যে পরিবেশ-পরিস্থিতি, তাতে তো নিজেকে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই থাকতে হবে। তারপর সিসির মাথায় ড. এলিনা ভালো করেই ঢুকেছে। ভাবলেন, আব্দুল করিমকে ফোন করি। রাতও তো বেশি নয়। সাড়ে নয়টা। এরকম সময়ে তো কতোই ফোন করেছি। যাকে ফোন করতে কখনো বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করিনি, ইদানিং তাকে ফোন করতে কতো দ্বিধা এসে জটলা বাঁধায়! তবুও ফোন করলেন।
আব্দুল করিম ফোনটা রিসিভ করবেন কি করবেন না—মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন। সাবিহা করিম বললেন, ধরছো না কেন? আমি কিছু বলি কিনা সেই ভয়ে! সারাদিন অফিসে কতো কি করে আসো—আর বাসায় এসে একটু ফোনে কথা বললে কি আর এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে!
এর আগে যে একদিন বললে, যা করার অফিসে করবে। বাসায় এসব কথাবার্তা আমার পছন্দ নয়। বাসাটাকে অপবিত্র করে ফেলছি নাকি!
বাসা তো কবেই অপবিত্র হয়ে গেছে! বাসার ভগবান যদি সখিদের সাথে সারাদিনমান লীলা করে নাপাক শরীরে ঘরে ফেরে, তাহলে ঘর কি মন্দির থাকে!
আব্দুল করিমের মনটা ভালো ছিলা না। মেজাজটা তিরিক্ষে ছিল। নতুন ভিসির কথাগুলো ভালো লাগেনি। আগে অফিসে যে আধিপত্য খাটিয়েছে, এখন যে তা চলবে না—রুমে মেয়ে বসিয়ে সারাদিন স্বাধীন মতো রসালাপ—এসবের দিন যে চলে গেছে, তা তিনি ভালোভাবেই বুঝেছেন। সে কারণে মনটা এমনিই অসহ্য রোদের মতো জ্বলছিল—পুড়ছিল! এসময় ড. ফারজানার ফোন দেখে মেজাজটা আরও খারাপ হচ্ছিল। তারপর আবার সাবিহা করিমের বাঁকা কথা! আব্দুল করিম সহ্য করতে না পেরে সাবিহা করিমকে ঠাস করে এক থাপ্পড় কষে দিলেন।
সাবিহা করিম থাপ্পড় খেয়ে একটা কথাও বললেন না। কাঁদলেনও না। শুধু তার চোখের দিকে পলকহীনভাবে তাকালেন। তারপর আস্তে করে চোখটা সরিয়ে নিয়ে বিছানায় বসে দু’হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে বসে। বুকের ভেতর অচেনা এক কঠিন ব্যথা অনুভব করে—অসহনীয়। চোখের জলে চোখ অন্ধ হয়ে আসে।
আব্দুল করিমও কথা না বলে বারান্দায় গিয়ে চুপ করে বসে ভাবেন, এসব কি হচ্ছে! আমার সংসারে তো কোনদিন কোন অশান্তি ছিল না—প্রেম ভালোবাসা আবেগের কোন ঘাটতি ছিল না। সাবিহা তো কোনদিন এরকম করে আমার সাথে বাঁকাভাবে কথা বলেনি! এখন কেন বলে! এতো বছরের দাম্পত্যজীবনে কোনদিন তার গায়ে ফুলের আঘাতও দিইনি। তাকেই আজ আমি মারলাম! এভাবে তাকে মারতে পারলাম! এতো বড় অপমান তাকে আমি কিভাবে করতে পারলাম! আমি কি মানুষ আছি! আমার কোথাও কি খুব বড় কোন ভুল হচ্ছে! ড. ফারজানা কিংবা ড. এলিনা—তাদেও সাথে আমার আমি কি কোনভাবে হারিয়ে যাচ্ছে! হারিয়ে গেছে! মনের গহিনে জেগে ওঠে মনের ধূলিতে ফেলে রাখা তার প্রিয় কবিতা—কবিতার কাছে যেন মুহূর্তে আশ্রয় খোঁজে—কবিতার কাছেই যেন আত্মজিজ্ঞাসা—
আমার কী কোথাও কোনো ভুল হয়ে গেলো
তোমার দেবতী চাঁদমুখ কেনো ঢেকে গেলো কালোমেঘে
কিসের কুয়াশা দু’চোখে তোমার—
এলোমেলো চুলে কেনো বিষণ্ন দুপুর
আমার কোথাও বোধ হয় কোনো ভুল হয়ে গেলো!তোমার অদ্ভুত নীরবতায় বেদনার কর্ষণ বুকের জমিনে
হৃদয় নগর ভেঙে আড়ালে দুঃখের একতারা কে বাজায়
প্রার্থনার মতো কতোভাবে তোমাকে ডাকি
বেদনার শব্দ বানিয়ে
যৌবন বিরাণে এ কেমন দুঃখবসতি আমার!সবুজ ঘাসের বুকে মুখ রেখে দেখেছি তোমার পবিত্রতা
পলিমাটির উর্বরতায় চিনেছি হৃদয়ের গন্ধ তোমার
দুধশাদা ভাঙামেঘ দেখে বুঝেছি তোমার সুন্দরতা
তুমি তো আমার রাধিকাদেবতী সীতাকুণ্ডু গোপন গুহায়অথচ কিভাবে কোথায় যে গেঁথে গেলো ভুলের পেরেক
কিভাবে যে নেমে এলো প্রেমের শরীরে কবরের নিস্তব্ধতা
আমার কী কোনো ভুল হয়ে গেলো
ভুলগুলো কি নদীর মতো দীর্ঘচাঁদমুখ কেনো ডুবে গেলো মেঘের কুয়োতে..
ড. ফারজানা আরও এক দুবার ফোন করলেন। আব্দুল করিম রিসিভ করলেন না। ক্ষুব্ধতায় ঝাঁজ ছাড়ে—নেমকহারাম! দুদিন আগে এতো পিরিত! একদণ্ড না থেকে থাকতে পারে না! নতুন এক মাগিকে পেয়ে দুদিনেই সব মোহ আবেগ শেষ হয়ে গেলো! এখন ফোনটা পর্যন্ত ধরে না। মানুষ কি এতো জঘন্য হয়!
গালাগালি করেন। রাগারাগি করেন। ফাইল ছুঁড়ে ফেলেন। আপনি তো কোন ফাইল দেখেন না। না দেখইে সই করে দেন। আমি গিয়ে সাবমিট করি। আপনাকে না ডেকে আমাকে ডাকেন। সে কি মেজাজ তার! সে কি ধমক! আমি যেন তার ঘরের বউর থেকেও বেশি কিছু! কতোবার যে ভেবেছি চাকরিটাই করবো না!
সেলুলয়েডের ফিতার মতো ড. ফারজানার মনে ভাসতে থাকে আব্দুল করিমের সাথে দিনের পর দিন আবেগময় কথা—একান্ত সঙ্গ—গভীর আলিঙ্গন। যে মানুষটার সঙ্গে এতদিনের এত গভীর সম্পর্ক, সেই মানুষটা হুট করে আমাকে এখন দেখা তো দূরের কথা, নামই শুনতে পারে না, ফোনই ধরে না! যার রুমে আমার সারাদিনের নিঃশ্বাস পড়তো, সেই রুম এখন কতো দূরের! রুমে ঢুকতেও পারি নে। পিএস আগেই বলে দেন, স্যার অনেক ব্যস্ত। আপনাকে ফোন করে অ্যাপয়মেন্ট নিয়ে আসতে বলেছেন। তার রুমে আমার ঢোকার কোন অনুমতি নেই! একটা পর একটা অভিযোগ আসছে আমার নামে। প্রায় প্রতিদিন কৈফিয়ত তলব হচ্ছে। এর কোন হিসাব মেলাতে পারেন না তিনি। মনে মনে ভাবেন, চাকরিটা রাজরানীর মতো করবো বলে নিজের থেকে অতদূর পর্যন্ত তাকে জড়িয়ে নিলাম। সবই তো বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়ার মতো ভেসে গেলো। একটু পলিমাটিও কি তাতে নেই! একটু উর্বরতাও কি তৈরি হয়নি! সবই অনর্থক! অর্থহীন! শরীরে শুধু শুধু আগুন জ্বালানো আর নেভানো! সেখানে কোন ফুল নেই! ঘ্রাণ নেই! জীবন নেই!
একদিন দুপুরে প্রোগ্রাম অফিসার ফারিয়াকে রুমে ডাকলেন ড. ফারজানা। আচ্ছা ফারিয়া, তুমি তো অনেকদিন এ অফিসে আছো। সিসি স্যারকেও তো তুমি জানো। বলো তো তিনি কেমন মানুষ!
কেন ম্যাডাম কি হয়েছে আগে বলেন তো!
তেমন কিছু হয়নি। কয়েকদিন ধরে তাকে আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। আমি ঠিক তাকে বুঝতে পারছি নে।
এলিনা ম্যাডামের সাথে আপনার কিছু হয়েছে?
না তো। তবে তার সাথে সিসির এখন বেশ খাতির। এখানে ক্লাস নিতে চেয়েছিল, আমি দিইনি।
কয়েকদিন আগে আপনার কাছে এসেছিল। আপনি নাকি তাকে চা কফিও খেতে অফার করেন নি। ব্যস্ততার কথা বলে বের করে দিয়েছেন!
সেদিন তো আমি আসলেই ব্যস্ত ছিলাম। ড. তপোবন বিশ্বাস স্যার ছিলেন। তাকে সময় না দিয়ে আমি কী এলিনাকে সময় দেবো! আর এটা তো এখনকার বিষয় নয়। আগের ভিসি স্যার থাকতে তো এই ঘটনা।
ওই সময় উনি ভিসি বিল্ডিংয়ে গিয়ে সিসিকে আপনার সম্পর্কে অনেক বাজে কথা বলেছে। এটা তো অনেকেই জানে। রেজিস্ট্রার স্যারও জানে। আপনাকে কেউ কিছু বলেনি?
বাজে কথা? কী রকম? বলো তো! উদ্বেগের সাথে জানতে চান ড. ফারজানা।
তপোবন স্যারকে জড়িয়ে। আচ্ছা ম্যাডাম, আপনি তো সবসময় সিসি স্যারের রুমেই থাকতেন। এলিনা ম্যাডাম ওখানে কিভাবে জায়গা পেলেন! এখন তো শুনি সিসি স্যার আর এলিনা ম্যাডামের অন্যরকম সম্পর্ক! উনিই নাকি ডিপার্টমেন্টে চেয়ারপারশন হয়ে আসবেন!
তা আসতেই পারেন। এখন যে অবস্থা! যে কোন কিছুই ঘটতে পারে। তবে, নতুন ভিসি স্যার কিন্তু খাঁটি মানুষ। উনি বিশ্ববিদ্যালয় বোঝেন—নারীগিরি বোঝেন না। যদি ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেন এসব—সিসিরও খবর আছে—এলিনারও খবর আছে। কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষ। কাউকে পরোয়া করে কথা বলেন না। কোন অন্যায় অনৈতিকতা মানা লোক উনি নন—এ কয়দিনেই বুঝে গেছি। প্রোভিসি স্যার, রেজিস্ট্রার স্যার, ডিন স্যাররাও এখন হিসাব করে চলছেন।
ম্যাডাম, ঝামেলায় না গিয়ে এলিনা ম্যাডামকে একটা ক্লাস দিতেন! তাহলে তো এসব জটিলতা হতো না। উনি তো আমার কাছেও আপনার নামে যা-তা বলে গেছেন।
তাই না কি! কী বলেছেন?
আমি ওসব বলতে পারবো না, ম্যাডাম। অনেক বাজে কথা। আমি মুখে উচ্চারণ করতে পারবো না। উনি চেয়ারপারশন হচ্ছেন, তাও তো বলেছেন।
তুমি যদি ওর সব কথাগুলো আমাকে বলো, তাহলে আমার উপকার হবে। দেখো, আমিও কিন্তু তোমার নামে অনেকরকম কথা শুনি। পাত্তা দিই না। কারণ আমি বিশ্বাস করি না। মাঝেমধ্যে বিকেলের দিকে তোমার কোন বিশেষ বন্ধু আসে! সেসময় দরোজা বন্ধ রাখো তুমি! তার সাথে বাইরেও সময় কাটাও। এমনকি আরিফুলকে জড়িয়েও তোমার নামে কথা আছে।
হ্যাঁ, আমার এক বন্ধু কখনো কখনো আসে। আমরা একসাথে কলেজে পড়তাম। ওর অফিসটা জিগাতলায়। অফিসে শেষে কখনো কখনো আমার এখানে আসে। আর দরোজা তো এমনিই বন্ধ থাকে। ওটা তো সব রুমেই থাকে। আপনার রুমেও থাকে। আর আরিফুল তো পিয়ন, ম্যাডাম। পিয়নকে নিয়েও যদি কথা ছড়ায়, কী বলার আছে! এক সাথে কাজ করি—কথা বলি—কে কিভাবে নেয়—কে কিভাবে কী বলে, আমি কী করে বুঝবো—আমাকে নিয়ে কে কী বলছে! আসলে ম্যাডাম, আমাদের এখানে নোংরামিটা বেশিই হয়।
কিন্তু অই বিল্ডিংয়ে এসব কথা এতো সহজভাবে যায়নি, যত সহজ করে তুমি বললে! আমি এসব কথা বেশিদূর বাড়তে দেইনি। একটা কথা তোমাকে বলি, আরিফুল পিয়ন হলেও ওর সাথে তোমার মানসিক হোক আর যা-ই হোক একটা সম্পর্ক যে আছে, তা কিন্তু আমি বুঝি। আর ও যে সুপুরুষ, তুমি তো অস্বীকার করতে পারো না। পিয়ন হলেই যে সে অযোগ্য—এই খোলসে তো নিজেকে বেশিক্ষণ ঢেকে রাখা যায় না। ফারিয়া খুব মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর বললো, আমি তো সবার মুখ বেঁধে রাখতে পারবো না, ম্যাডাম।
তোমার চেয়ারে আরিফুল বসেছিল। আর তুমি চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে কখনো ওর গলা জড়িয়ে ধরেছিলে?
ফারিয়া ভাবলো, এ কথা কিভাবে ম্যাডামের কাছে গেলো! তখন তো বিভাগে আরিফুল আর আমি ছাড়া কেউই ছিল না। আর এটা তো আজকের কথাও না। তিন চার মাস আগের। চট্ করে মিথ্যে করে বললো, এ তো কোনদিনই সম্ভব নয়, ম্যাডাম। আপনার চেয়ারে কি আমি বসতে পারি! পিয়ন আমার চেয়ারে বসবে কেন! ওর জন্য যে টুল আছে, ও তো টুলেই বসে।
আমিও ওসব কথা বিশ্বাস করিনি। আমি সবসময়ই তোমার প্রশংসা করি। এ কারণে কখনো তোমাকে এসব জিজ্ঞেসও করিনি।
ফারিয়া যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। তারপর কথার সাথে বিষ মেখে দিয়ে বললো, ম্যাডাম, আপনাকে কেউ গাড়ি কিনে দিয়েছে?
ড. ফারজানা বড় বড় চোখে তাকালেন ফারিয়ার দিকে। বিস্ময়ে বললো, এ কথা তুমি জানলে কি করে!
আমি কেন ম্যাডাম সবাই তো জানে। আপনি হোটেলে যান—থাকেন। কত কথা তো বাতাসে ভাসে! আপনাকে বলি না। আপনি তো আমার বস। আগের শাহেদ জাহান ভিসি স্যারের সাথে আপনি নাকি হোটেলে যেতেন, তাও তো অনেকেই বলে।
ফারিয়া এখানে মান-সম্মান নিয়ে থাকা কঠিন! ড. ফারজানা খুব শান্তস্বরে বললো, তুমি তোমার রুমে যাও।
যাবার আগে, একটা কথা বলি, ম্যাডাম!
ড. ফারজানা চোখের কোণে জমে ওঠা পানি টিস্যু দিয়ে মুছে বললেন, বলো।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশটা আগের ভিসি নষ্ট করে দিয়ে গেছেন। কাউকে যদি না বলেন, একটা কথা বলি, সাইফ স্যার, আমাকে ডেকেছিলেন—বেশ কয়েক মাস আগে।
সাইফ মানে তো ডেপুটি রেজিস্ট্রার!
জি।
বলো।
ম্যাডাম, কথাটা কিন্তু ভেরি কনফিডেন্সিয়াল।
বলো। সমস্যা নেই। আমার ভেতরেই থাকবে।
সাইফ স্যার আমাকে বললেন, তুমি তো বিবিএ করেছ, এমবিএ করেছ। দেখতেও অনেক সুন্দর। বয়স এখনো বেশি হয়নি। নিজের ক্যারিয়ার শেষ করে দিচ্ছো কেন?
বললাম, কী করবো স্যার, এখানে তো তিনবার প্রমোশনের পরীক্ষা দিলাম। কিছুই হলো না।
সাইফ স্যার বললেন, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে এভাবে প্রমোশন হয় না। তুমি আগামীকাল সন্ধ্যায় মালিবাগে হোয়াইট হাউজ হোটেলে এসো। আমার বন্ধু ওখানকার জিএম। পরিবেশ ভালো। কথা বলা যাবে। বিস্তারিত আলাপ করবো।
আমি তাকে বললাম, আমি তো কখনো হোটেলে কারো সাথে দেখা করতে যাইনি। বাইরে অন্য কোথাও কথা বলি। সাইফ স্যার আমার কথায় খুশি হলেন না। ম্যাডাম, আমি এ কথা আপনাকে বলতে পারিনি। অনেকবার বলতে চেয়েছি। পারিনি। আমি তার সাথে দেখা করতে হোটেলে যাই নি। এরপর থেকে আমার কাজে তিনি শুধুই ভুল ধরেন। গালাগালি করেন। রাগারাগি করেন। ফাইল ছুঁড়ে ফেলেন। আপনি তো কোন ফাইল দেখেন না। না দেখইে সই করে দেন। আমি গিয়ে সাবমিট করি। আপনাকে না ডেকে আমাকে ডাকেন। সে কি মেজাজ তার! সে কি ধমক! আমি যেন তার ঘরের বউর থেকেও বেশি কিছু! কতোবার যে ভেবেছি চাকরিটাই করবো না!
তোমার হাজবেন্ডকে বলেছো এসব?
ম্যাডাম, আপনি বোঝেন না? আপনি আপনার কথা আপনার হাজবেন্ডকে বলতে পারেন? সব কথাই কি হাজবেন্ডকে বলা যায়! বলিনি। চাকরিটা ছাড়লে কি ভাববে! কি কারণে ছাড়লাম! কি হয়েছিল! কতো কিছু জিজ্ঞেস করবে! কতো রকমের সন্দেহ করবে! এসব চিন্তা করে কতো রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। আবার আমার হাজবেন্ড যে আমার মনের মতো—তাও নয়। বিয়ের সময়ই পছন্দ ছিল না। তবুও বাবা-মায়ের সম্মানের দিকে তাকিয়ে, তাদের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়েছি। ওর সাথে আমি পারতপক্ষে কম কথা বলার চেষ্টা করি। যত কম বলে পারা যায়। ওর চেহারা ভালো না, মানুষ হিসেবেওে নোংরা রুচির। সবকিছুতেই সন্দেহ! আমি সেজন্য গুরুত্ব দিই না। মাঝেমধ্যে বলে, সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করাই একটা বড় অপরাধ! শুনি। উত্তর দিই না। মন তো একটা বড় ব্যাপার। মন না চাইলে কিছুই হয় না। তারপর আবার অফিসে প্রতিনিয়ত এই যন্ত্রণা!
ঠিক ম্যাডাম, এই এক দেড় মাসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা যে পরিবর্তন হয়ে গেছে—কল্পনাও করা যায় না। এখন দেখেন সবাই ঠিকমতো অফিসে থাকে—রুটিন ধরে ক্লাস নিচ্ছে। সেমিনার হচ্ছে। কতো কিছু নিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা হচ্ছে। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন একটা তাজা প্রাণ ফিরে এসেছে। পবিত্র একটা ভাব ফুটে উঠেছে।
চাকরি মানেই কী এত সব, ফারিয়া? আমার জীবনও তো শেষ হয়ে গেলো! ঘর সংসার তো বানের জলে ভেসে যাওয়ার মতো হয়ে গেলো।
আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সানিয়া সাইফ স্যারের খুব প্রশংসা করতো। তার পাশের রুমেই তার অফিস রুম। স্যার দেখতেও তো সেই রকম হ্যান্ডসাম। কী সুন্দর করে কথা বলেন। ওর কাছে আমার কথা বলতেন—আমাকে স্যার অনেক পছন্দ করেন। আমার বান্ধবীও অনেক সুন্দর—আপনি তো সানিয়াকে চেনেন।
চিনি তো। খুব মিষ্টি চেহারার মেয়েটা।
জি। ওর অনুরোধেই আগের সবকিছু ভুলে একদিন হোয়াইট হাউসে গেলাম। সানিয়াও সাথে ছিল। সন্ধ্যায়। স্যার আগে থেকেই ওখানে ছিলেন। আমাদের অনেক যত্ন করলেন—খাতির করলেন। আমাদের দুজনকেই দুটো ভালো শাড়ি উপহার দিলেন। তারপর থেকে স্যার আমাকে আর রাগ করতেন না। অনেক আদর করে কথা বলতেন। যে কোন কাজ নিয়ে গেলে খুব আন্তরিকতার সাথে করে দিতেন। তারপর থেকে কখন যে কিভাবে স্যারকে ভালো লেগে যায় নিজেও বুঝনি। এরপর স্যার, কখনো কোথাও যেতে বললে আমি আর না করিনি—আমার নিজেরই যেতে ভালো লাগতো। হাতিরঝিল, জাতীয় যাদুঘর, শিল্পকলা—এসব জায়গাতে তার মোটর সাইকেলে অনেকবার গিয়েছি। প্রথম দিনের পর থেকে সানিয়াকে আর সাথে নিইনি। ওকে সবকিছু জানাইওনি। কারণ সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠতার এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, তা আর কাউকেই বলা যায় না। বিশ্বাস করেন, সবসময় সাইফ স্যারের মুখটাই আমার চোখে লেগে থাকতো। আমার মনে সে ছাড়া আর কেউ ছিল না—স্বামী সংসার কিচ্ছু না। কিন্তু কী অদ্ভুত—সাইফ স্যারের ডেপুটি হিসেবে বিলকিস সুলতানা যখন জয়েন করলো—আনম্যারেড মেয়ে। এর পর কয়েকদিন যেতে না যেতেই স্যার আমাকে আর চেনেন না। আমার সাথে ভেরি অফিসিয়ালি আচরণ করে। এখন আগের মতো খারাপ আচরণ করে না ঠিকই, কিন্তু আমাদের যে একটা বিশেষ সম্পর্ক ছিল—ঘনিষ্ঠতার চূড়ান্ত সম্পর্ক ছিল; তার মনে এখন এটার কঙ্কালও আছে বলে মনে হয় না। মানুষ মরে গেলেও তো কঙ্কালটা থাকে—প্রেম মরে গেলে তো কিছুই থাকে না, ম্যাডাম! কেউ কেউ বলে ঘৃণা থাকে। হয়তো থাকে। আমিও মনে মনে ঘৃণা করি। কিন্তু যেহেতু এখানে চাকরি করি, উপরে উপরে তো ভালো ব্যবহার করেই থাকতে হয়। আমিও এমনভাবে চলি, যেন আমাদের কিছুই ছিল না!
ড. ফারজানা ভাবেন, সানিয়ার সাথেও যে সাইফের সম্পর্ক ছিল-তা আর ফারিয়াকে না বলি। বললে আরও কষ্ট পাবে—ঘৃণাটাও বাড়বে। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, কী অদ্ভুত মিল পুরুষে পুরুষে! নতুন একটা সুন্দরী মেয়ে পেলেই আগেরটাকে অবহলোর স্তুপে ছুঁড়ে ফেলে। মেয়েমানুষ মানেই যেনো তাদের কাছে শরীরের তৃপ্তিকর স্বাদ! এর বাইরে তারা নিজেকে কিছুই ভাবতে পারে না, ভাবেও না। প্রফেসর শাহেদ জাহান, সিসি আব্দুল করিম, ডেপুটি রেজিস্ট্রার সাইফ—একটা জায়গায় সবাই তো সমান! কিন্তু মুখে বলার সময় নারী জাতিকে এমন সম্মান দিয়ে কথা বলে— এর চেয়ে মহান আর কিছু নয়! বাস্তবে নারীর শরীরটা পেলেই হিংস্র বাঘের মুখে অসহায় হরিণীর মতো অবস্থা! ড. ফারজানা মুখ ফুটে এসব কিছুই বললেন না। সারা মুখ কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।
ফারিয় বললো, জানেন ম্যাডাম, এখন তো সাইফ স্যার নিজের মোটর সাইকেলে বিলকিসকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়—সব কথাই কানে আসে। এই সাইফ স্যারই কিন্তু আমাকে প্রথম বলেছিলেন, আগের ভিসি স্যারের সাথে আপনার নোংরা সম্পর্কের কথা। সিসির সাথেও যে আপনার সম্পর্কটা বেশিদিন থাকবে না, এলিানা দখল করে নেবে— তাও কিন্তু তিনিই আমাকে বলেছিলেন। আর একটা কথা বলি, শুধু আমি না, আপনিও না, খোঁজ নিয়ে দেখেন—বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশেরই এরকম কেউ না কেউ আছে। সেটা প্রেম না-চাকরি বাঁচানোর শক্ত খুঁটি!—জানি না।
ড. ফারজানা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, অপেক্ষা কর—এসবের কিছুই থাকবে না। যে ভিসি স্যার এসেছেন—কিছুদিনের ভেতরেই দেখো এসব আগাছা ছাপ হয়ে যাবে। নোষ্টামির সব দুর্গন্ধ ডেটল দিয়ে ধুয়ে ছাপ করে ফেলবেন। কঠিন এক মানুষ—সত্যিকারের একজন সত্যসাধক। নারীপ্রীতি-স্বজনপ্রীতি এসব এখান থেকে দেঁড়ে পালাবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ই বানিয়ে ছাড়বেন। এখন যে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে, কাজের এই প্রতিযোগিতায় আমি নিজেই টিকতে পারবো কিনা জানি না। তুমিও নিজেকে শুধরে নিয়ে কাজ করো। যা হয়েছে, যা করেছ—ভুলে যাও।
ঠিক ম্যাডাম, এই এক দেড় মাসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা যে পরিবর্তন হয়ে গেছে—কল্পনাও করা যায় না। এখন দেখেন সবাই ঠিকমতো অফিসে থাকে—রুটিন ধরে ক্লাস নিচ্ছে। সেমিনার হচ্ছে। কতো কিছু নিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা হচ্ছে। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন একটা তাজা প্রাণ ফিরে এসেছে। পবিত্র একটা ভাব ফুটে উঠেছে।
সবই তো ঠিক আছে ফারিয়া, এখন নিজের চাকরিটা থাকলে হয়! মরা স্রোতের মতো নিস্তেজ স্বরে বললেন ড. ফারজানা।
চলবে…
ঈশ্বর ও শয়তান-১০॥ রকিবুল হাসান