(পর্ব: চব্বিশ)
একটা রুম। মাথার ওপর টিনের চালা। তিন দিকে টিনের বেড়া। পশ্চিম কোনে একটা খাট। খাটটা মাঝারি আকারের। খাটের ওপর দুটো তোষক, কয়েকটা বালিশ, মশারি টানানো। ভাদ্র মাসের তাল পাকার গরমে ওষ্ঠাগত তিনজন শুয়েছে খাটের ওপর। মাথার ওপর যে ফ্যানটা চলছে, অনেক পুরনো। মাথার ওপর পুরনো ফ্যান ঘোরে আর বিকট শব্দ উৎপাদন করে। শব্দটা হয় ঘটাং ঘটাং ঘ্টাং। শব্দের তোড়ে তিন জনের অবস্থা কাহিল। শব্দের অশ্লীল তরঙ্গ আর ভয়ানক গরমে তিন জনে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। রাতের প্রতিটি মুহূর্ত তিনজনের কাছে বিভীষিকার অন্ধকারের মতো লাগছে।
আমির হোসেন দুই জনের তুলনায় একটু স্বাস্থ্যবান। বয়সের তুলনায় পেটটা এগিয়ে আছে সামনের দিকে। ডান পাশে শফিক আর বাম পাশে মাহমুদ। মাঝখানে আমির। তিনজনের পরনে লুঙ্গি। শুয়ে পড়েছে। কিন্তু রুমের মধ্যে আটকানো ভ্যাবসা গরম, মাথার ওপর ফ্যানের ঘটাং ঘটাং শব্দ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ঘামছে দরদর করে। ঘামের বিদঘুটে গন্ধ বেরুচ্ছে।
মহিলা কি সত্যি ড্রাইভারের বউ? ঘামবন্ধ ভয়ঙ্কর রাতের মধ্যে চিৎ শুয়ে প্রশ্ন করে আমির হোসেন। প্রশ্নটা কাকে করলো আমির হোসেন, বোঝা মুশকিল। কিন্তু মাহমুদ হাসান শুয়োরের শব্দে ঘোৎ করে ওঠে, তোর সন্দেহ আছে?
না, সন্দেহ না। কিন্তু মানায় না।
কী মানায় না?
বৌটা এত সুন্দর আর জামাইটা কালা বুতমা। মুখে গরুর দাড়ি। ঠোঁট দুইটা পাইলার তলের কালির মতো কালো। চুমা খায় কেমনে?
তোর চুমু খেতে ইচ্ছে করছে?
পরের বৌরে আমি চুমু খেতে যাবো কেন? পারলে বিয়ে করে নিজের বৌকে চুমু খাবো। ডলবো। খুলবো।
তাহলে পরের বৌয়ের দিকে নজর দিস না।
পরের বৌরে নজর দিলে তোর সমস্যা কী?
শফিক হায়দার ঢুকে পড়ে আমির হোসেন আর মাহমুদ হাসানের সংলাপের মধ্যে, আমির সাহেব আমরা যে এই টিনশেট ঘরের পেছনের আরও ছোট টিনসেটের মধ্যে ইঁদুরের মতো সেঁধে আছি, মূলত কালো ড্রাইভারের সুন্দরী বৌ মূল কারণ।
মানে?
মানে আমাদের মাহমুদ হাসান এই উলনে লজিংয়ের সন্ধানে এসে লজিং পেয়ে যখন থাকার জন্য একটা মেসবাড়ি খুঁজছিল, খুঁজতে খঁজতে এই টিনশেটের বাড়িতে এসে বাড়াটিয়া তরিকুল ইসলামের বৌ মিসেস রেহানা বেগমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। সাক্ষাৎ হয়ে যাওয়ার পর মিসেস রেহানা বেগম বাসার মালিকের পক্ষে পেছনের এই টিনশেট বারান্দা দেখালে, এটা মানুষের বসবাস যোগ্য কি না, বিবেচনা না করেই রাজি হয়ে যায়। এখন আমাদের ভ্যাপসা গরমে সেদ্ধ হতে হচ্ছে।
না, মহিলা তেমন সংকোচ বোধ করে না। ইতোমধ্যে অন্ধকার সয়ে আলোর মিছিল শুরু হয়েছে। মহিলা মাথায় কাপড় তুলে স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে আবার বাড়ির দিকে যায়।
শফিক! অনেকটা গর্জে ওঠে মাহমুদ, বেশি বাড়াবাড়ি করিস না তুই।
আমি কী করলাম? এই বাড়ির টিনশেটে আশ্রয় নেওয়ার ইতিহাস খুলে বললাম মাত্র আমির হোসেনের কাছে। নিরীহভাবে বলে শফিক।
হাতে সময় ছিল না। মাসের আছে দুই দিন। গড়গড় করে মাহমুদের গলা, আমি এই রুম ভাড়া না নিলে থাকতি কাথায়?
রাস্তায় থাকাও অনেক ভালো, এখন যেভাবে এখানে আছিস তোরা, জবাব দেয় আমির হোসেন।
তাইলে তুই আসলি ক্যান?
বন্ধুর কাছে বিপদে বন্ধু আসবে না?
আবার বন্ধু মারায়! চড়া গলায় মাহমুদ হাসান বকে, কোনো কিছু করার মুরোদ নেই, একটা ব্যবস্থা করলে এসে থাকবে, আবার চেটং চেটাং বুলি আওড়াবে!
ভ্যাপসা গরমের মধ্যে তিন জনের রেহানা বেগম বিষয়ক গল্প বা ঝগড়ার মধ্যে খুব নিরীহভাবে শফিক হাসান বলে, আসলেই রেহানা ভাবি খুব সুন্দর। যদিও পরের বৌ, কিন্তু মাহমুদের পছন্দ আছে।
সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদ তড়িৎ গতিতে আমিরকে ডিঙিয়ে ঘুষি মারার চেষ্টা করে শফিককে। শফিক দ্রুত নিজেকে সরিয়ে নিতে নিতে গিয়ে টিনের বেড়ার সঙ্গে ঘটাং করে শব্দে মজে যায়। ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে, ও মাগো।
হারামজাদা! আর যদি রেহানাকে নিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করবি…মাহমুদ ফল উহ্য রেখে আবার শুয়ে পড়ে চিৎ, সেই চিৎ বিছানায়। মাহমুদ হাসান আর শফিক হায়দারের এই লড়াইয়ের কসরতের মধ্যে আমির হোসেন নাক ডাকা শুরু করে, ঘোওওওওওওওওওওওওওওৎ।
মাহমুদ!
কী?
আমির কি সারারাত এইভাবে নাক ডাকবে?
সারারাত যখন থাকবে, নাকও সারারাত ডাকবে।
ঘুমাবো কী করে?
আমি দুই কান বালিশে ঢেকে নিয়েছি।
উঁকি মেরে দেখে শফিক, কাৎ শুয়ে একটা কান নিচের দিকে তোষকের দিকে, আর ওপরের কানের ওপর বালিশ চাপা দিয়েছে মাহমুদ। কায়দাটা মন্দ নয়, মাহমুদের দেখাদেখি শফিকও মাথা কাৎ করে একটা কান তোষকের ওপর চাপিয়ে, আর একটা কানের ওপর বালিশ চাপায়। আমিরের নাক ডাকার ঘোওওওওওওওওওওওওওৎ শব্দ কিছুটা কম করে কানের মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু সচেতন হলেও যা হয় আর কি, শব্দটা বালিশ ও তোষকের তুলার মধ্যে দিয়ে পিঁপড়ার গুনগুন আওয়াজ মর্মে পৌঁছে যায়। কানের ওপর বালিশের চাপ আরও বাড়ায়। কিন্তু নাক ডাকার শব্দও ঢুকে যায়। বিশ্রী অবস্থার মধ্যে গভীর রাতে বড়শিতের গাঁথা মাছের মতো ঝুলতে থাকে শফিক হাসান।
অস্বস্তি আর অসহ্য ঘুম পীড়নের মধ্যে ঘুমে ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে শফিক। ঘুমানোর চেষ্টা, সারাদিনের ক্লান্তির অবসাদে ঘুমিয়ে যায় তিনজনে।
রাতের শেষ প্রহরে কাছেই মসজিদের আজানের তীব্র ভয়ঙ্কর শব্দে ঘুম ভেঙে যায় শফিকের। অবাক হয়ে দেখে, ওরা নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। শুরুর চেয়ে এখন, শেষ রাতের নিস্তবতায় আমিরের নাক ডাকার শব্দ বহুগুণ বেড়েছে। মনে হচ্ছে উলন পার হয়ে রামপুরার বড় রাস্তা থেকে আমিরের নাক ডাকার শব্দ শোনা যাবে। আর তিন জনেরই শরীর ঘামে ভিজে চপচপ করছে। অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে বিছানা ছেড়ে নামে শফিক। খুলে দেয় টিনের দরজা, সঙ্গে সঙ্গে এক দঙ্গল উলঙ্গ বাতাস ঝাপিয়ে পড়ে শফিকের ওপর। মুহূর্তে শরীরটা জুড়িয়ে অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ভরে ওঠে। অন্ধকার এখনো ভালো করে কাটেনি। বাড়ির পেছনের দিকে হালকা গাছপালা। নারকেল গাছ, আম গাছ পেয়ারা গাছ,লিুচ গাছ…এইসব গাছপালার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বুনো লতাপাতা। রুমের ভেতরের একমাত্র নড়বড়ে চেয়ারটা টেনে দরজার ওপর বসে যায়। বাতাস আসছে। রাতের ঘুমহীনতা, ঘামের গন্ধ; সব বিলীন হয়ে মুধর একটা পরিস্থিতি। পাখিদের বিচিত্র ডাকাডাকি শফিককে আরও বিহ্বল করে তোলে। মনে পড়ে গ্রামের বাড়ি। আহা, সেই করে এসেছে, এখনো যাওয়া হয়নি বাড়িতে। এক বছর হয়ে গেলো। মা ভাইবোনের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র চিঠি।
ছোট জঙ্গল পার হয়ে ওপারে একটা ইটের দালান। দোতলা। সেই দোতলা বাড়ির নিচতলার দরজা খুলে যায় এবং একজন মহিলা দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে হালকা জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে, দ্রুত পায়ে, নির্বিকার চিত্তে। আলো আঁধারির হালকা ঘোরের মধ্যে শফিকের চোখে লাগে আর এক ঘোর! কোথায় যাচ্ছে মহিলা? না, যাচ্ছে না, আসছে। শফিকের দিকেই আসছে। আসতে আসতে প্রায় শফিকের কাছাকাছি এসে শফিকের দিকে মুখ করে শাড়ি তুলে বসে যায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে।
জীবনে অনেক বিস্ময় দৃশ্য দেখেছে শফিক হাসান। গ্রামের বাড়িতে এই দৃশ্যের চেয়েও গভীর লুটোপুটির দৃশ্য দেখেছে জঙ্গলের মধ্যে। কিন্তু এটা তো ঢাকা শহর! এই ঢাকা শহরে এসে এই দৃশ্যও চোখে দেখতে হবে? মহিলার প্রস্রাবের তীব্র শব্দ ছির ছির ছির কানের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। শরীর মোচড় দিয়ে উঠছে। সকাল বা গতরাতের আমির হোসেনের নাক ডাকার ভয়াল শব্দের বিপরীতে সকালের এই রমনীয় দৃশ্য, নারীর তুমুল প্রসাবের ছির ছির ছির শব্দের তুলনাহীন গান বিহ্বল করে শফিক হাসানকে। মহিলার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় আমীর হোসেন আর মাহমুদ হাসানের দিকে। বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে, মহিলার প্রসাবের মিহি আওয়াজের পর থেকে আমিরের নাক ডাকা নেই। আমীর চিৎ থেকে পাশ ফিরে শোয়। প্রস্রাব শেষ, মহিলা হাতের বদনা থেকে পানি ঢেলে দেয় নিচের দিকে। কয়েকবার পানি দেওয়ার পর উঠে দাঁড়ায়, শাড়ি ফেলে দেয় নিচের দিকে। শাড়িটা কোমরের ওপর গিট ঠিক করে নুয়ে বদনা তুলে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে শফিককে। কয়েক মুহূর্ত বিনা মেঘে বজ্রপাতের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কোনো ভণিতা না করে বদনা হাতে দাঁড়ায়। না, মহিলা তেমন সংকোচ বোধ করে না। ইতোমধ্যে অন্ধকার সয়ে আলোর মিছিল শুরু হয়েছে। মহিলা মাথায় কাপড় তুলে স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে আবার বাড়ির দিকে যায়।
মহিলার হালকা পাতলা গড়নের। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু লম্বা। মাথায় প্রচুর চুল। শরীরের রঙ বোঝা যাচ্ছিল না, আলোর স্বল্পতার কারণে। অনুমান করে শফিক, মহিলার শরীরের রঙ হালকা সাদা। বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় হাত রাখে, ফিরে তাকায় শফিকের দিকে। শফিক তাকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে, নিষ্পলক! মহিলার মুখে চিলতে এক টুকরো হাসি ফুটলো কি? এতটা দূর থেকে সবটা না বুঝলেও, অনুভব করে শফিক সকালের এই অপরূপ নারী এক চিলতে হাসি উপহার দিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে, দরজা বন্ধ করে দেয়। শফিক হাসান, ভোরের প্রথম আলোয় দরজার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। শফিক হাসানের শরীরে মনে ভালোলাগার বাতাস বয়ে যায়।
কী রে, কখন উঠেছিস? বিছনার ওপর বসা আমির হোসেন।
এই তো একটু আগে। তোর ঘুম হয়েছে?
আরে ঘুম? আগে জানলে রাস্তায় থাকতাম কিন্তু তোদের এই মাদারচোদ জায়গায় আসতাম না। সারা রাতে একফোঁটা ঘুমও হয়নি, আমির হোসেনের গলায় ধিক্কার।
রেহানা বেগম অবাক, হতবম্ভ চাখে পলকের মধ্যে শফিক হাসান, আমির হোসেনের দিকে তাকিয়ে, চোখ রাখে মাহমুদের মুখের ওপর। এত মায়াময় চোখের দৃষ্টি একজন নারীর হতে পারে, লজ্জায়, সুখে, বিহ্বল দৃষ্টিতে মাহমুদের ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
শালার পুতরে একটা লাত্থি দেয়া দরকার। সারা রাতের তোর নাক ডাকার শব্দে আমরা ঘুমাতে পারি নাই। তুই তো শিয়ালের শব্দে হুক্কা হুয়া হুক্কা হয়া নাক ডাকছোস, ঘুমের মধ্যে মাহমুদ রোষমাখা গলায় বলে, আর সকালে উঠে শোনায় আমি কিছু জানি না!
আমির বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়ায় দ্রুত, মাহমুদ হালারে বিশ্বাস নেই। লাত্থি দিলেও দিতেও পারে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে তাকায় শফিকের দিকে, তোর ঘুম কেমন হয়েছে?
চোখ বুঝে আমার ঘুম ভালো হয় নাই, কিন্তু চোখ খুলে আমার ঘুম চমৎকার হয়েছে।
মানে? চোখ খুলে কোনো শালা ঘুমায় নাকি?
শফিক হাসে, ঘুমায় রে ঘুমায়।
তোরা শালা লেখকেরা কি সব বালছাল লেখো, মাথা-মুণ্ডু নেই। আবার দেখি, মানুষে খুব পড়ে। কী যে পড়ে, কী মজা পায়, বুঝি না। ব্যাগের মধ্যে থেকে দাঁত মাঝার ব্রাশ বের করে পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাঝতে শুরু করে আমির, তুই এখন বলতেছিস, চোখ খুলে ঘুমিয়েছিস!
ওর তো চোখই নেই, আবার ঘুমের মধ্যে ফোড়ং ছাড়ে মাহমুদ, ও তো সব দ্যাখে কান দিয়া।
দ্যাখ, দেখতে থাক। তোদের বাথরুম কই? জানতে চায় আমির।
আমি জানি না, শফিক বলে। মাহমুদ জানে।
মানেটা কী? বাসা ভাড়া নিয়েছিস বাথরুম ছাড়া?
আসলে আমির, বিছনার ওপর উঠে বসে মাহমুদ, এই বাসাটার পেছনের রুমটার জন্য আলাদা কোনো বাথরুম নেই। বাথরুমটা বাড়ির ভেতরে। সামনে গিয়ে বাম পাশের টিনের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলেই দেখতে পাবি বাথরুমের দরজা।
কোন কুয়ার মধ্যে টেনে আনলি, বুঝতে পারছি না, রাগ ঝেড়ে কাঁধে তোয়ালে ঝুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় আমির হোসেন।
সঙ্গে সঙ্গে বেসুরো গলায় রবীন্দ্র সংগীত গাইতে শুরু করে শফিক, ‘তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে’। পুরো গানটার একটা লাইনই জানে শফিক, ঘুরে ঘুরে একটা লাইনই গলা ছেড়ে গায়। শরীরে, মনে, সকালের প্রকৃতির শরীরে, নারীর প্রস্রাবের গন্ধ ও শব্দ এখনো টেনে আনছে শরীরের কোষে কোষে। খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসা মাহমুদ হাসে, তোর কী হয়েছে?
কী হবে? গান গাইতে ইচ্ছে করছে গাইছি। তোর সমস্যা আছে?
এগুলো গান গাওয়া বলে? থামা, কুত্তায় তোর গান শুনবে না, মানুষ তো ভালো।
কিন্তু বন্ধু আমার যে প্রাণ খুলে গান গাইতে ইচ্ছে করছে, ‘তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে’। আর তুই গানের কী বোঝস?
আমি বুঝি না, তুই সব বোঝো। কী হয়েছে তোর?
কী আর হবে?
তোর একটা কিছু হয়েছে, বলতে বলতে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায় মাহমুদ। আড়মোড়া ভেঙে ব্যাগের ভেতর থেকে পেস্ট আর ব্রাশ বের করে দাঁত মাঝতে মাঝতে কেবল দরজার সামনে দাঁড়ায়, ভূতের মতো দৌড়ে ঢোকে আমির। চোখে মুখে তীব্র ঝলক।
কী হলো? শফিক প্রশ্ন করে, এত টেনশনের কী হলো?
ওটা তো বাথরুম না, গোসলখানাও। আমিরের কণ্ঠে আবেগ, কামনা আর সুখ।
তো! আপনার কেউ ঢুকতে নিষেধ করেছে?
আরে না, বাথরুমের দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়, ভেতরে এক মহিলা গোছল শেষ কাপড় বদলাচ্ছে। বুক টুক খোলা। যাচ্ছেতাই অবস্থা।
মাহমুদ চট করে ঘুরে সামনে আসে আমির হোসেনের, তাকায় কঠিন চোখে, রেহানা বেগম?
মাথা নাড়ে আমির হোসেন, না। অন্য মহিলা।
মাহমুদেন টান টান শরীরে ঢিল লাগে, সকাল বেলা অন্য নারীর খোলা বুকসহ শরীর দেখেছিস, তোর তো দিন ভালো যাবে।
হাসে আমির হোসেন, সত্যি বলতে কী, জীবনে প্রথম দেখলাম তো! দেখ, আমার শরীর কাঁপছে।
দেখেই কাঁপাকাপি! শফিকের পাঁচ ফোড়ং, তোরে জড়িয়ে ধরলে কী করতি?
কী আর করবে? ফোড়ং বাড়ায় মাহমুদ, ও বমি করে দিতো।
বদ্ধ রুমটার মধ্যে তিনজনে একসঙ্গে হাসে। রুমটা হাসিতে ফেটে পড়ে।
সকালের হাসির মধ্যে যে যার মতো গোছল সেরে প্যান্ট শার্ট পরে প্রস্তুত হয়, বাইরে দিনের কাজে যাওয়ার জন্য। নাস্তা করবে উলন রোডের একটা রেস্টুরেন্টে। মাহমুদ বাইরে পা রেখেছে। আমির পুরনো জুতো খবরের কাগজ দিয়ে মুছে পরিষ্কার করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। শফিক হাসান জামা প্যান্ট পরে, চিরুনি হাত অনুমানের ওপর মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে ভাবে, বিকেলে ফিরে আসার সময়ে একটা আয়না কিনে আনতে হবে। রুমে একটা আয়নাও নেই, চেহারা না দেখে কি মাথা আঁচড়ানো যায়?
আপনাদের নাস্তা! দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে মাহমুদ হাসানের প্রিয় রেহানা বেগম। হাতে বড় একটা থালা, থালায় গরম পরাটা, আর একটা হাতে বাটি। বাটিটা ঢাকা একটা ঢাকনা দিয়ে। পেছনে আট নয় বছরের একটা ছেলে। ছেলেটার দুই হাতের এক হাতে পানির একটা জগ। অন্য হাতে আর একটা বাটি। বাটির ওপর ঢাকনা নেই। বাটিতে ঘন ডাল।
আপনি এত কষ্ট করেছেন কেন? মাহমুদ এগিয়ে এসে রেহানা ভাবির সামনে দাঁড়ায়।
রেহানা বেগমের মুখে সকালের স্নিগ্ধ হাসি, কই আর কষ্ট! আপনারা খেয়ে নিন। ধরেন। তাড়া দেয় রেহানা বেগম। মাহমুদ ধরে থালা আর বাটি। ঢোকে রুমের মধ্যে, রাখে খাটের শক্ত তক্তার ওপর। পেছনে পেছনে রুমের মধ্যে ঢোকে রেহানা বেগম। ছেলেটাকে তাড়া দেয় রেহানা বেগম, সাজু? আসো। বাইরে কেন?
ফর্সা ছেলে সাজু রুমের মধ্যে ঢুকলে, হাত থেকে রেহানা বেগম বাটি জগ নিয়ে মাহমুদের হাতে দেয়। রেহানা বেগমের হাত থেকে নিয়ে সব রাখে মাহমুদ, খাটের ওপর। রেহানা ভাবির মুখে প্রশান্তির হাসি।
আপনি খেয়েছেন? রেহানা বেগমকে জিজ্ঞেম করে মাহমুদ হাসান।
না, আপনারা খান। পরে খাবো। সাজু চল।
বলার আগেই সাজু দৌড় দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। ছেলের পিছু যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় রেহানা ভাবি। আবার প্রশ্ন করে মাহমুদ, ভাই কই?
থমকে দাঁড়ায় রেহানা বেগম। উনি তো ফজরের আজানের সমায় চলে যায়। স্যারের বাসা ধানমন্ডি। সাড়ে সাতটার মধ্যে উপস্থিত থাকতে হয়, নইলে স্যার রাগ করেন। ওনার মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাসায় এসে আবার স্যারকে নিয়ে সচিবালয়ে যেতে হয় সকাল নটার মধ্যে।
ও! মাহমুদ হাসান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ভাই খুব কষ্ট করে।
মাথা নাড়ায় রেহানা বেগম। মুহূর্তে রুমটার মধ্যে বিষণ্ন একটা হাওয়া এসে ঝাপটে ধরে। রেহনা বেগম সুন্দর মুখের ওপর একটা কালো আলোর ছায়া পড়ে।
আমি যাই, আপনারা খান।
ভাবি! আপনিও আমাদের সঙ্গে খান।
আবার হাসির ফোয়ারা ফোটে রেহানা বেগমের মুখে, আরে না। আপনারা খান। আমি বাসায় খাবার রেডি করে রেখে এসেছি, গিয়েই খাবো। রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মাহমুদ হাসান চট করে রেহানা বেগমের হাতটা ধরে, আমাদের সঙ্গে খেতে হবে আপনাকে!
রেহানা বেগম অবাক, হতবম্ভ চাখে পলকের মধ্যে শফিক হাসান, আমির হোসেনের দিকে তাকিয়ে, চোখ রাখে মাহমুদের মুখের ওপর। এত মায়াময় চোখের দৃষ্টি একজন নারীর হতে পারে, লজ্জায়, সুখে, বিহ্বল দৃষ্টিতে মাহমুদের ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
চলবে…