॥পর্ব-নয় (শেষপর্ব)॥
চন্দনার জল স্বাভাবিক নিয়মেই নিম্নগামী হচ্ছিল মধুমতির দিকে। কিন্তু বশিরের প্রবাহিত হলে মালতীর সমস্ত বিশ্বাস একনিমিষে বানভাসি হয়ে যায়। ক্ষোভ ও দুঃখ; শোক ও অভিমান একত্রিত হয়ে মালতীকে একেবারে অন্যমানুষ করে তুলল। সে কাঁদলো না। নৌকার গলুইয়ে যেভাবে বসে দুঃসংবাদটা শুনলো ঠিক সেভাবেই বসে রইলো। মালতী ভেবেছিল কী আর হবে, বড়জোর সমাজচ্যুত হবে! যদি তাই হয়, তাহলে সেও হয়তো যাবে খলিলের মতো। কেন? মালতী যেতোই কিন্তু খলিল যে তাকে সে সুযোগ দিলো না। ওদিকে ননী-বালার আহাজারিতে চন্দনার বাসাত ভারি হয়ে উঠছে, এইডা কী করলি তু বাপ? কী করলি তু? খলিল এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আসবে না কোনোদিন। খলিলের মাথার পাশে পচাঁত্তর বছরের ঝণ্টুমাল অসহায়ের মতো বসে থাকে মাথায় হাত দিয়ে। পায়ের কাছ বসা বিষু সর্দার নির্বাক। কোনো বিকল্প ছিল না। বারবার প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর বের করতে পারেনি বিষু সর্দার। খলিল যেমনি দরবারে মাথা নিচু করে ছিল তেমনি রইল। দুহাতে বেড় দিয়ে দুই হাঁটু মুড়ে সে বসে রইল। বিষু সর্দার বলছিল, কেনে তুই এই কাম করলি? এর উত্তর সে জানে না। ভাকুজলের নেশা তাকে ঘিরে রেখেছিল—সে কথা ডেরার সবাই জানে। কিন্তু এটা কোনো সুষ্ঠু উত্তর নয়। নেশা তাদের চিরাচরিত অভ্যাস। বাইদ্যার ডেরায় নেশার জন্যে কেউ কোনোদিন নিয়ম ভাঙেনি। তাই বলে বাইদ্যারা ধোয়া তুলসী পাতা, তা নয়। চুরি-ছেচড়ামি, লোক ঠকানো এসব তারা করে। কিন্তু সে-সব নিজেদের বেলায় খাটে না। দরবারে বসে তার কেবল মালতীর মুখখানা মনে পড়ছিল।
কী কারণে সে মালতীকে মারছিল তা কিছুতেই মনে আসছে না তার। বেদে পাড়ায় বউকে মারার ঘটনা একেবারে বিরল নয়। ভাকুজল বা ক্যাই খেয়ে হরহামেশাই এ ঘটনা ঘটায় বাইদ্যারা। প্রায়ই ডুকনিদের হস্তক্ষেপে মিটে যায় ব্যাপারটা। কিন্তু সেদিন খলিল বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। ডুকনিকে অমান্য করেছে। শেষপর্যন্ত মালতী কোঠিতে গিয়ে আইন ভরায় পা দিয়ে দাঁড়ানোর পরেও খলিল তার চুলেল মুঠ ধরে পিটিয়েছ। আঁতকে উঠেছে সবাই। ননীবালা জ্ঞান হারিয়েছে। হায়! হায় করে উঠেছে ডুকনি। ছিঃ ছিঃ করে উঠেছে সবাই। শুক্রবার পঞ্চায়েত বসে। ঘটনাটা মঙ্গলবারেরা তাই তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়। এই তিন দিনে বাইদ্যা পাড়ার কেউ তার সঙ্গে কথা বলে নাই। তাকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। খলিলের ভেতরটা নদীর পাড় ভাঙার শব্দে ভেঙে যায়। তাই সে নানাকে বলেছিল আর যে শাস্তি দেস্ না দেস দলত্যাগী করিস না। কিন্তু পঞ্চায়েত তো কেবল বিষু সর্দার আর ঝণ্টুমালকে নিয়ে হয় না। শেষ পর্যন্ত পঞ্চায়েতের রায় মাথা পেতে নিতে হয় খলিলকে। বিষু সর্দার জানিয়ে দিলো, তুর আর কুনো সোমাজ রইল নারে খইল্লা। তু সোমাজ ছাড়া দলছাড়া আইজ থেকে।
খলিল মাথা তুললো না। পঞ্চায়েতের দরবার ভাঙলো, কেউ ফিরে তাকালো না খলিলের দিকে। বিষু সর্দারও উঠে গেলো, ঝণ্টু মাল কিছুক্ষণ বসে থেকে সেও চলে গেলো। নড়লো না কেবল খলিল। ঘণ্টাখানেক পর ননীবালা যখন তাঁবুর খুঁটিতে হেলান দেওয়া খলিলকে সে আবিষ্কার করে মৃত। সমাজ থেকে দল থেকে সে নিজেকে বহু দূরে নিয়ে চলে গেছে। ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে ননীবালা।
শ্মশান খোলার পাশে পরিত্যক্ত যেটুকু জায়গা সেখানেই খলিলকে দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়। একটু উঁচু ঢিবির মতো সে জায়গা। গ্রাম থেকে বেশ দূরে জনশূন্য বাদলা দিনে কয়েকজন বেদে সাপের গর্ত খোঁচা শাবল নিয়ে এগোয় বিষুর বড় ছেলে জগা আর মোস্ত। নদীর জল তুলে মস্তোর বউ একটা হাঁড়িতে গরম করলে। গরম জলে দু’চারটা বড়ইপাতা এনে দিল দশ/বারো বছরের একটা ছেলে। পানি গরম হলো কী হলো না তাতে কিছু যায় আসে না। আঁচে বসিয়েছে এই ঢের। সিদ্ধান্ত হলো ঝণ্টুমাল নাতিকে গোসল করাবে। এই সময় উদ্ভ্রান্তের মতো হাজির হলো মালতী। মুখে কোনো শব্দ নাই। দু’চোখ পাকা তেলাকুচার মতো লাল। খলিলের বাম পাশে গিয়ে বসে সে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিষ্পাপ মুখের দিকে। পাঁচশ’ এক টাকা পণ দিয়ে বিয়ে করেছিল খলিল। বর বেশে গাছের ডালে উঠে সেদিন যখন খলিল বলেছিল, গাছ থেকে পইড়ে মরলাম—লাজুক একটা হাসি ছিল ওর মুখে। সে হাসি লক্ষ করে মালতীর সতেরো বছরের যৌবন কেমন চমকে উঠেছিল। বুকের ভেতরটা টি টি করছিল। কোনো রকমে ঢোঁক গিলে বলেছিল, না-না। তু পইড়া মরিস না, আঙ তোরে সারা জেবন কামাই করি খাওয়ামু।
একদিন খলিলকে সে জানিয়েছিল—তোর বাসন মাজতি হবেনি, রানতি হবেনি। ডেমা-ডেমি অর্থাৎ বাচ্চা-কাচ্চা ধরতে হবেনি তুই ক্যাল এমন কইরে হাসিস। রাগ হলি হাসি। কাঁদলে হাসিস্। আঙ্ সবভুলে যাম্। খলিল মালতীকে জড়িয়ে ধরে হেসেছিল। মালতী এবার চিৎকার করে ওঠে, হাম্ কুন নালিশ করি নাই। আঙর কুনো নালিশ ছিল না। হা হা হা…। কঁদতে থাকে মালতী। সেই কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে চন্দনার বাতাস। রাতেই ঝণ্টুমাল ছেলেকে নির্দেশ দেয়। এইখানে আর এক রাতও নয়। গোটাও সব। ওঠো নায়। বিষু মান্তার আনুষ্ঠানিক নির্দেশ পেতেই বেদেরা নৌকার বাঁধন খুলে দেয়। পেছনে পড়ে থাকে বশিরের ঘাট, শ্মশান খোলা আর খলিলের কবর।
(শেষ)