পর্ব-৩২
এক.
পৃথিবীর সবচেয়ে চেনা পাখির নাম বায়স বা পরভৃৎ। যেকোনো জলবায়ু আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পারা ক্ষমতাবান পাখিটির প্রচলিত নাম কাকপক্ষী। আমার ধারণা যে সব ছাত্রী হলে থেকে পড়াশোনা শেষ করার সুযোগ পেয়েছে, কাকের মতো তারাও পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের, যে কোনো পরিবেশের সঙ্গে সুন্দরভাবে অ্যাডজাস্টমেন্ট করে হাসিখুশি থেকে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। এই অভিজ্ঞতা আমিও লাভ করেছি সাত বছর হোস্টেল লাইফ কাটিয়ে দিয়ে, তবেই।
প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে শামসুন্নাহার হলে শেষাবধি সিট পেলাম ৩২৯ নম্বর কক্ষে। তিনটি কাঠ-রডের খাট আর তিনটি টেবিল চেয়ার পাতা আছে তিন তলার এই কক্ষটিতে। সিলিংয়ে কোনো ফ্যান নেই। সিঙ্গেল খাটে ডাবলিং করে রাতে ঘুমানোর শর্তে এই বরাদ্দপত্র পেয়েছি, কাজেই রা করা যাবে না।
রুমে উঠেই দেখা পেলাম বাকি পাঁচ জনের। এক খাটে চাঁদপুরের বিলকিস বেগম, কুষ্টিয়ার হালিমা জোয়ার্দার—যতদূর মনে পড়ে ওরা দু’জনেই অর্থনীতির ছাত্রী ছিল। কুমিল্লার খালা রুবী ও ভাগনী তাহমিনা এক খাটে। তৃতীয় খাটে আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গোবেচারা, রাতের বিছানা-বালিশ শেয়ার করি ইতিহাস বিভীগের ছাত্রী নোয়াখালীর রুনুর সঙ্গে।
এই রুম মেইট ছয়জন রাতের বেলাই শুধু ডাইনিং হলে একসঙ্গে খেতাম। কলাভবন থেকে টিফিন আওয়ারে দৌড়ে এসে কোনোরকম দুপুরের তাড়াহুড়োর লাঞ্চ হতো যার যার সাবজেক্টের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে, তবে অবশ্যই তারাও ছিল সংশ্লিষ্ট হলের ছাত্রী। ফলে রাতের খাওয়া শেষ করে যখন ফিরে আসতাম—কিছুক্ষণ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছয়জনের যে গল্প হতো, তা ছিলো যেন অকারণ হাসাহাসির রিহার্সেল। কথার শব্দের চেয়ে হাসির শব্দ উছলে পড়তো বেশি। মনে হতো রবীন্দ্রনাথ আমাদের বয়সের পানে তাকিয়ে বোধ হয় গানখানি লিখেছেন।
চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।
ও রজনীগন্ধা, তুমি গন্ধসুধা ঢালো…।
আমাদের শামসুন্নাহার হলের প্রভোস্ট ছিলেন অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী মেহেরুন্নেসা আপা। যিনি রোকেয়া হলে হাউজ টিউটর হিসেবে ইতোপূর্বে কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত। বেশ ক’জন অতীব সুন্দরী হাউজ টিউটর ছিলেন—তাদের মধ্যে কবি হুমায়ুন কবিরের বিধবা স্ত্রী রেবু আপা, নিঃসন্তান সুলতানা আপা—এই দু’জনই দু’রকম সুন্দরী ছিলেন। আমাদের প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের সিট বরাদ্দের জন্যে প্রভোস্টের সঙ্গে কাজ করতেন জাহানারা রহমান আপা। শামসুন্নাহার হলে সিট পেতে বিলম্ব হওয়ায় এক পর্যায়ে আমার আবেদনপত্র আমি উইথড্র করতে চেয়েছিলাম। এটা নাকি আমার অপরাধ—এজন্যে তিনি বিরূপ ছিলেন আমার প্রতি। এই ঘটনার জন্যে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে আমাদের বাবা-মেয়ে মিলেই।
আবেদনপত্র ফেরত চাওয়ার মতো দুঃসাহসকে আমার অপরাধ হিসেবে গণ্য করে জাহানারা আপা সত্যি সত্যি প্রভোস্ট আপার কাছে অভিযোগ করেছিলেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে দিন-পনেরো পরেই প্রভোস্ট মেহেরুন্নেসা আমার পিতাকে ডেকে নিয়ে সাক্ষাৎকারের নামে রামধোলাই করেছেন বেশ ভালোই। তার কন্যা যে অতিমাত্রায় দুঃসাহসী ও দুর্বিনীত—একথা আমার আব্বার মাথায় পুশ করে দিতে সফল হয়েছেন তিনি।
সেই বয়সে ভাবনায় কোনো আগামাথা থাকে না, তা বলাই বাহুল্য। কেন যেন আমার মনে হলো সুন্দরী প্রভোস্ট আপার কথায় আব্বার মনে হয় তব্ধা লেগে গেছে। তাছাড়া একথাও মনে হলো সুন্দরীদের এক কথা, অসুন্দরীর হাজার কথা। হাজার হলেও আমার আব্বা তো পুরুষ মানুষ! এত সুন্দরী, প্রিয়দর্শিনী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হিসেবে তিনি আমার পিতাকে ডেকেছেন তাতেই মনে হলো বর্তে গেছেন। উপরন্তু নিজ সন্তানের বিরুদ্ধে কথা শুনতে কারোই ভালো লাগার কথা নয়। কাজেই তার মুখের ওপর সন্তানের পক্ষে কথা বলবেন, কোন দুঃসাহসে? যখন হোস্টেলের একটা সিটের জন্যে প্রার্থী হয়ে তার মেয়ে পায়ের চটি ইতোমধ্যে ক্ষয়ে ফেলেছে।
এমন অচিন্তিত অবস্থায় পড়ে আমার আব্বা বখশী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ভুলে গেছিলেন তার পূর্ব-পুরুষের সাহস আর গৌরবগাথার কথা।
দুই.
আমার দাদার পূর্বপুরুষ ছিলেন কাশ্মিরি মুসলিম, হিজরতকারী হিসেবে একদা এসেছিলেন এ দেশে, এদেশের রমণীর পাণি গ্রহণ করে এদেশেই বংশ বিস্তার করেছেন ধীরে ধীরে। তাদের বংশের ‘বখশী’ টাইটেল অনেকেই ব্যবহার করেছেন, কেউবা ফেলে দিয়ে বাঙালির মতো নাম ব্যবহার করেছেন। আমার আব্বা তার বংশের এই উপাধি ধরে রেখে প্রেসের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য বখসী আর্ট প্রেস’। ছাপাখানার এই অভিজাত ব্যবসাসূত্রেই তিনি চারটি প্রেসের মালিক হয়ে উঠেছিলেন। অভাবিত সেই আয় দিয়েই তার বড় উত্থান হয়েছিল, দাদার তালুকদারিকে উন্নীত করেছিলেন জমিদারের আভিজাত্যে, চার ভাইয়ের মিলিত প্রয়াসে। আব্বার জমিদারি এস্টেটের নাম ছিলো ‘ইসলামিয়া এস্টেট’। সে অনেক অতীত ইতিহাসের তরবারি, যার কোনো ধার অবশিষ্ট ছিল না আমাদের ছেলেবেলা থেকেই।
যে কারণে দুই পারিবারের অতীত ইতিহাসের গল্প উঠলেই রফিক আজাদ আমাকে ক্ষেপাতেন মাইট্যা জমিদারের কন্যা নামে। কবির দাদাও তো ছিলেন নায়েব, টাঙ্গাইলের বিখ্যাত তরফ গৌরাঙ্গীর বংশধর। যাদের বংশমর্যাদার কথা ‘তরফ গৌরাঙ্গীর ইতিহাস’ নামক বইয়ে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে অনেককাল আগে থেকে। টাঙ্গাইলের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেও বটে।
কাজেই কে কার চেয়ে কম, এমন একটা চটুল হাস্যরসের গল্প হয়ে যেতো এক পশলা। তখন আমি বলতাম, আমি তো তোমার বংশ পরিচয় না জেনে, শুধুই একজন কবিকে প্রেম ও পরিণয় সূত্রে বেঁধেছি। কত দুঃসাহস আমার, ভাবো তো! বিয়ের পরে যদি জানতাম, তুমি একজন মুচি, মেথর কিংবা ক্ষৌরকারের সন্তান, তাহলে কি আমি তোমাকে ফেলে ছুটে পালাতাম? কখনোই না।
ফিরে আসি হোস্টেল কথকতায়।
প্রভোস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষে আব্বা বেরিয়ে এলেন বিরস বদনে। রাগী রাগী চেহারা, একহারা গড়নের ছয়ফুট উচ্চতার আব্বা আমার ঝড়ে নুয়ে পড়া বাঁশের মতো নিম্নমুখী। ভয়ে দুরু দুরু কলার থোরের মতো আমি দাঁড়িয়েছিলাম প্রোভস্টের বারান্দায়। কেবলই পায়চারী করছিলাম, না জানি আমার আব্বাকে কী শুনতে হবে আমার জন্যে!
আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভয় করছিল। নিঃশব্দে আব্বার পেছন পেছন বেরিয়ে এলাম হল থেকে। দু’জনেই হাঁটছি নির্বাক। আমি যাবো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তী ক্লাস করতে, আব্বা চলে যাবেন পুরানো ঢাকার ইসলামপুরে তার প্রেসের উদ্দেশে। কিছুদূর হেঁটে এসে রোকেয়া হল ও টিএসসির মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে বললেন, শিক্ষকদের সঙ্গে সংযতভাবে কথা বলবে। ওই তো চেহারা, ব্যবহারটিও যদি বিনয়ী না হয়, তবে টিকে থাকবে কিভাবে? বলেই আব্বা চলে গেলেন, আমি হাঁটছি কলা ভবনের দিকে। হঠাৎ করেই আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো, পা নাড়াতে পারছি না। আব্বার বলা সব কথা হারিয়ে গেলো আকাশে-বাতাসে, শুধু একটি অর্ধবাক্য ‘ওই তো চেহারা’মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু করে দিলো। ধিক! তিনি জন্মদাতা পিতা। তিনি সন্তানের চেহারা নিয়ে এভাবে কথা বলতে পারেন কি?
তিনিই তো আমাকে জন্ম দিয়েছেন। সুন্দরী যে হইনি, সেই ব্যর্থতা তো তার। আমার নয়। আমাকে কেন তার মুখ থেকে এমন কথা শুনতে হবে—কেন কেন কেন? রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এ কেমন পিতা, একজন সুন্দরী মহিলার সঙ্গে কথা বলার পরে তার নিজের সন্তানকে কুরূপা মনে হয়? এই বেদনা অনেক দিন ভুলতে পারিনি। এমনিতে ছোটবেলা থেকেই আমার মনে হতো আমার চেহার অসুন্দর। ছোটবেলায় একদিন সদরঘাট মার্কেটের দোকানে ঢুকে বড় আয়নায় নিজের মুখ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম, মনে হয়েছিল আমার চেহারাটি মোটেও সুন্দর কিংবা সুশ্রী নয়। এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হলো আব্বার কটূক্তি শুনে, সেদিন যেন মরমে মরে গেলাম।
বিধাতা বলে যদি কেউ থাকেন, মনে হয় ওপর থেকে তিনি হাসছিলেন আর বলছিলেন, মন খারাপ করিস না বান্দা আমার, আমি তোর সব দুঃখ পুষিয়ে দেবো। প্রশংসার স্তুতিকারক প্রাণ যে কবি, তার ভালোবাসায় আপ্লুত করে দেবো তোকে। যে তোর জন্যে সর্বস্ব ত্যাগে পিছপা হবে না মোটে। প্রতীক্ষার পায়ে শেকড় গজাবে। তবু সে তোকে ফেলে যাবে না কোথাও, সেই মন্ত্র আমিই দিয়ে দেবো তাকে।
মানুষের জীবন বোধ হয় এভাবেই ঘাটে ঘাটে তার সওদা তুলে নেয় নৌকা বোঝাই করে। এর বেশকিছুকাল পরে হঠাৎ করেই বিটিভিতে সবার জন্যে শিক্ষা’ নামে বয়স্ক শিক্ষার একটা গণসচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেলাম। পিক আওয়ারে প্রথমে ‘এসো পড়া শিখি’ এবং পরে ‘সবার জন্যে শিক্ষা’শিরোনামে সপ্তাহে দু’দিন প্রচারিত হতো অনুষ্ঠানটি। শাইখ সিরাজের মাটি ও মানুষ এবং আমার উপস্থাপনায় সবার জন্যে শিক্ষা নামের অনুষ্ঠান দুটি দীর্ঘকাল চলেছে বিটিভিতে।
তখন সাকুল্যে বাংলাদেশে একটাই মাত্র চ্যানেল ছিল। পরে ঔপন্যাসিক রাবেয়া খাতুনের পুত্র ফরিদুর রেজা সাগরের উদ্যোগে ‘চ্যানেল আই’যাত্রা শুরু করলে মাটি ও মানুষ নিয়ে শাইখ সিরাজ চলে গেলো সেখানে। আমি বিটিভিতে রয়ে গেলাম ২০১১ সাল পর্যন্ত। তখন মনে মনে ভাবতাম, আহারে আমার আব্বা বেঁচে থাকলে আজ বলতে পারতাম, আব্বা, আমার চেহারাটা অত খারাপ ছিল না, নইলে বিটিভি থেকে ডেকে আমাকে এই অনুষ্ঠান করতে বলতো না কেউ। দেখুন, কত হাজার হাজার লোক বাইশ বছর থেকে আপনার মেয়ের চেহারা দেখে এবং কথা শুনে প্রশংসায় শতমুখ। একটুও ক্লান্ত হয়নি তারা। বরং পথেঘাটে আমাকে দেখলেই আমার দিকে এগিয়ে এসে তাদের ভাবাগের কথা বলে, আমি যা পড়াই, সেসব উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বলতে চায়, তারা আমার অনুষ্ঠানের দারুণ ভক্ত। শুধু আপনিই দেখলেন না আপনার সেদিনের হাবাগোবা মেয়েটি যে কথা বলতে শিখেছে।
বেঁচে থাকলে নিশ্চয় আনন্দে আপনার বুক ভরে যেতো। আপনি জানলে আরও আনন্দ পেতেন যে, সেদিন আপনাকে ডেকে অপমান করেছিল যে প্রোভোস্ট মেহেরুন্নেসা—তিনি এবং আমি একইমঞ্চে একই দিনে বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছি।
শামসুন্নাহার হল অ্যালামনাইদের পক্ষ থেকে সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে বারবার আপনাকে মনে পড়ে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিল। আমাকে তারা ডেকে সম্মানিত করেছে শামসুন্নাহারের কৃতি ছাত্রী হিসেবে। আর আমাদের মেহেরুন্নেসা আপা সম্মানিত হয়েছেন ছাত্রীদের প্রোভোস্ট হিসেবে।
আহা আব্বা, আপনি কিছুই দেখে গেলেন না। হয়তো এসব কিছু হয়েছে আপনার মধ্যে যে গভীর জ্ঞান-তৃষ্ণা ও আবেগ ছিল, তার পুরোটা আপনি পুঁতে দিতে পেরেছিলেন আপনার সন্তানদের মধ্যে।
চলছে…