(পর্ব-৭)
মেরি ওলস্টোন ক্রাফটের জন্ম দরিদ্র এক কৃষক পরিবারের। আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তার সফল বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ‘এ ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইটস অব ওমেন’। না, ঠিক অর্থাভাবে নয়, অল্প বয়সে মেরির মৃত্যু ঘটনা যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনই করুণ, হয়তো সেই যুগে চিকিৎসাও ছিল ত্রুটিপূর্ণ।
মেরি ওলস্টোন ক্রাফট প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন অখ্যাত আমেরিকার লেখক গিলবার্ট ইমলের। তিন বছর তারা একসঙ্গে বসবাস করেন। ১৭৯৪ সালে ‘অবিবাহিত মাতা’হন মেরি। মেয়ের নাম রাখেন ফ্যানি ইমল। পরের বছর মেয়েকে নিয়ে মেরি ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেনে ভ্রমণে যান। গিলবার্ট ইমল ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নানা বিরোধের পর তার সঙ্গে মেরির বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু গিলবার্ট প্রকাশ্যে এক নারী নাট্যকর্মীর সঙ্গে বসবাস শুরু করলে ক্ষোভে-দুঃখে মেরি টেমস নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় বন্ধুদের সাহচর্যে একতরফা প্রেমের অনল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনতে সফল হয়েছিলেন। এরপর লেখক উইলিয়াম গডউইনের সঙ্গে মেরি ওলস্টোন ক্রাফটের বন্ধুত্ব হয়। গডউইন বুদ্ধিজীবী মহলে ততদিনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তিনি মেরির লেখা পাঠ করে মূলত তার প্রেমে পড়েন। ১৭৯৭ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের যৌথজীবন স্বল্পকালের হলেও বেশ সুখের ছিল। ১৭৯৭ সালের আগস্টে মেরির দ্বিতীয় সন্তান ‘মেরি গডউইনের’জন্ম হলো। প্রসবকালীন মারাত্মক জটিলতায় ভুগে মেয়ের জন্মের দশ দিনের মাথায় মারা যান নারীবাদের ‘জননী’খ্যাত মেরি ওলস্টোন ক্রাফট।
লড়াকু মায়ের উত্তরাধিকারী মেরি গডউইন ‘ফ্রাংকেইনস্টাইন’ উপন্যাস লিখে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন কবি পার্সি বিশি শেলিকে। শেলি ছিলেন রোমান্টিক কবি। স্ত্রী হ্যারিয়টের সঙ্গে তিনি সুখী ছিলেন না। ঠিক সে সময় বালিকা মেরি গডউইনকে দেখে মুগ্ধ হন। তার প্রেমে পড়েন। প্রথম সাক্ষাতের মাসখানেকের মধ্যে মেরি গডউইন শেলির হাত ধরে গৃহত্যাগ করেন এবং দ্রুত ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন তারা। ফ্রান্সে ভ্রমণের সময় তাদের পকেটে তেমন টাকা ছিল না। খাবার ছিল কালো রুটি, আর ছিল বাস ভাড়া। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে তারা জেনেভায় গিয়ে পৌঁছান।
এদিকে জনরোষের কারণে কবি জর্জ গর্ডন বায়রন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আর ইংল্যান্ডে থাকবেন না। পাড়ি জমালেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। সেখানে শেলির সঙ্গে দেখা হয় বায়রনের।
কিন্তু শেলি কিংবা বায়রন কেউই সুবিধা করতে পারলেন না—তবে শেলির স্ত্রী মেরি গডউইন এখানেই তৈরি করে ফেললেন বিখ্যাত ‘ফ্রাংকেইনস্টাইনের’কাহিনি।
জেনেভায় চমৎকার সময় কেটেছিল তাদের। পরে ইতালিতে এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চিরতরে হারিয়ে যান কবি শেলি। শেলির মৃত্যু সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার এক লেখায় জানাচ্ছেন—‘‘মাঝে মাঝে দু’জনে নৌবিহারে সময় কাটাতেন। শেলিকে একটি বজরা উপহার দিলেন বায়রন, বজরাটির নামও দিয়েছিলেন তিনি তার বিখ্যাত কবিতার নামে ‘ডন জুয়ান’। অবশ্য শেলি সেই নাম বদল করে রাখেন ‘এরিয়েল’। অদ্ভুত স্বভাব ছিল শেলির— সাঁতার জানতেন না, অথচ নৌকায় চড়তে ভালোবাসতেন খুব। একদিন দু’জনে নৌকায় করে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ খুব ঝড় উঠলো। বায়রন জামা-কাপড় খুলে সাঁতরাবার জন্য প্রস্তু হলেন এবং শেলিকে সাহায্য করতে চাইলেন। শেলি তার সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে শান্ত হয়ে বসে রইলেন এবং বললেন, কোনোরকম বাঁচার চেষ্টা না করেই তিনি সমুদ্রের তলদেশে চলে যেতে প্রস্তুত আছেন। সেদিন অবশ্য ঝড়ের কবল থেকে রেহাই পেয়েছিলেন তারা। তবে এই এরিয়েলে চড়ে বেড়ানোর সময়েই একদিন শেলি পানিতে ডুবে মারা যান। মৃত্যুর পর শেলিকে দেখতে এসেছিলেন বায়রন। সম্পূর্ণ দেহটি মদে ভিজিয়ে সমুদ্র সৈকতে দাহ করা হয়, গভীর বিষাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখেছেন বায়রন।’’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘তার (বায়রন) মনে পড়লো, কয়েকদিন আগেই প্রবল বৃষ্টির মাঝে তারা একসঙ্গে বসেছিলেন। সেই বৃষ্টিতে বাইরে বেরুনো যায় না। নানা অলৌকিক বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল রহস্য এবং আত্মা নিয়ে। ঠিক করলেন, এই সময়ে তারা রহস্য কাহিনি রচনা করবেন। কিন্তু শেলি কিংবা বায়রন কেউই সুবিধা করতে পারলেন না—তবে শেলির স্ত্রী মেরি গডউইন এখানেই তৈরি করে ফেললেন বিখ্যাত ‘ফ্রাংকেইনস্টাইনের’কাহিনি। সেদিন শবদেহের পাশে দাঁড়িযে বায়রন লে হান্টকে বললেন, ‘শেলির মরদেহ পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওর আত্মা চিরকাল বেঁচে থাকবে।’’
কবি শেলির মৃত্যু সম্পর্কিত আরেকটি ভিন্ন তথ্য পেয়েছি প্রমথনাথ বিশি’র লেখা ‘শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ‘সমুদ্র থেকে তার (শেলির) দেহ উদ্ধার হলে দেখা গেলো—ট্রাউজারের পকেটে কিটসের সদ্য প্রকাশিত কাব্যখানা উল্টোভাবে মুড়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশ বুঝতে পারা যায়, শেষ মুহূর্ত অবধি বইখানায় তন্ময় হয়ে ছিলেন, মৃত্যুর আশঙ্কায় নয়, পড়ায় বিঘ্ন ঘটলো বলে হয়তো বিরক্ত হয়ে থাকবেন। রবীন্দ্রনাথের মতো শেলিরও হ্রদ-নদী-সমুদ্র অর্থাৎ জল বড় প্রিয় ছিল। তকে কি শেলিরও মীনরাশি না কি? রবীন্দ্রনাথের তো জানি মীন রাশি।’
শেলি যখন মারা যান, তখন তার বয়স ছিল ঊনত্রিশ বছর। আর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখন মাত্র কলেজের ছাত্র। শেলির রোমান্টিক কবিতা পাঠে তিনি মুগ্ধ ও মাতাল প্রায়। নিজের আত্মকথা ‘বহে জলবতীর ধারা’য় তুলে ধরেছেন সেসব কথা। বর্ণনাটি আছে এভাবে—‘শেলির স্বপ্নতাড়িত শান্তিহীন ঝড়ো জীবন—উল্কার মতো বেপরোয়া উদ্দাম আর বিদ্রোহী—আমার তরুণ বয়সের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ালো। সতের বছর বয়সে ‘দ্য নেসেসিটি অব এথিজম’ পুস্তিকা লেখার অপরাধে অক্সফোর্ড থেকে তার বহিষ্কার, একই সময়ে ষোড়শী হ্যারিয়েটের সঙ্গে তার বিয়ে, এর তিন বছর পর অক্সফোর্ডের অধ্যাপক উইলিয়াম গডউইনের মেয়ে মেরি গডউইনের (মা মেরি ওলস্টোন ক্রাফট) সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিয়ে, তার নিদ্রাহীন পড়াশোনা, মানুষের তৈরি নিষ্ঠুর সমাজ আর রাষ্ট্রের প্রতি তার ঘৃণা, ইতালি আর সুইজারল্যান্ডের নানা জায়গায় অস্থির ছোটাছুটি, প্রথম স্ত্রীর আত্মহত্যা আর এই বিপর্যস্ত ও স্বপ্নতাড়িত জীবনেরই এক বেদনার্ত পর্যায়ে ফ্লোরেন্সের সমুদ্রে নৌকা অভিযানে বেরিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে তার সলিল-সমাধি—প্রতিটি ব্যাপারই আমার তরুণ মনকে রোমাঞ্চিত করে তুলতো।’
আজও তিনি বেঁচে আছেন সৃষ্টির মাঝে ‘ব্লাইন্ড বার্ড’ নামে। সৃষ্টির মহত্বের গুণে হয়তো প্রজন্ম থেকে প্রজান্মান্তরে অবিরত এই বার্তাই পৌঁছাতে থাকবে ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ নামে বিশ্বসেরা দুটি কাব্যের লেখক ছিলেন মহাকবি হোমার।
কবির ওপরে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অভিমানসুলভ উচ্চারণ, ‘নৌকায় করে কেন শেলির সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবার অকারণ সাধ হলো—এ আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারতাম না। যখন তার কবিতা সবে পরিণতিতে পা রাখছে, তখন এমন আত্মঘাতী যাত্রায় কেন এগিয়ে গেলেন—এই যন্ত্রণা আমাকে অসুস্থ করে তুলতো। তখনো প্রাচীন গ্রিকদের মতো আমার জানা হয়নি, যা অতীত—ঈশ্বরও তা পরিবর্তন করতে পারে না—তাই হয়তো অমনটা হতো।’
জর্জ গর্ডন বায়রনের (লর্ড বায়রন নামে পরিচিত) জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলি—একবার নামকরা এক জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি শুধু বলুন, আমার মৃত্যু হবে কত বছর বয়সে?’ জ্যোতিষীর জবাব, ‘ছত্রিশ বছর বয়সে আপনি মারা যাবেন।’ শুনে বায়রন চমকে ওঠেন। কারণ, তার বাবা ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য মারা গেছেন ছত্রিশ বছর বয়সে। ফলে বায়রন তার ছত্রিশতম জন্মদিনটি বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করেন। হয়তো মনে মনে ভেবেছিলেন যে, এই দিনটি তার জীবনে আর কখনো ফিরে নাও আসতে পারে। প্রকৃতির রহস্য বোঝা দায়—ছত্রিশ বছর বয়সেই মারা যান কবি জর্জ গর্ডন বায়রন। মৃত্যুর আগে বলে গেছেন, এই ছত্রিশ বছর বয়সের অভিশাপ আমার গোটা পরিবারেরই আছে। ছত্রিশতম জন্মদিনটা হলো আমার বংশের লোকদের জন্য অত্যান্ত ভয়াবহ। বায়রনের মেয়ে আগাস্টিস আভ বাবার মতোই উচ্ছৃখল জীবনযাপন করতেন। কী অবাক ব্যাপার, ছত্রিশ বছর বয়সে আগাস্টিস চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান।
১৯৪২ সালে কাজী নজরুল ইসলাম যখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন, তখন তার বয়স ৪৩ বছর। কবি জসীম উদ্দীনকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন তিনি। বাকহীন নীরব হয়ে যাওয়ার আগে থেকেই কবির মাঝে কিছুটা লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছিল। এ সময় জসীম উদ্দীন একদিন নজরুলের সামনে এক টুকরো সাদা কাগজ এগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই চিরকুটে কবি লিখেছিলেন, ‘আমি দশ হাজার বছর বাঁচিব’। কবিতা আর গানের মধ্য দিয়ে বাঙালির হৃদয়ে আজও বেঁচে আছেন নজরুল। আসলে কবি-সাহিত্যিকরা মরে না, বেঁচে থাকে অনন্তকাল!
যিশু খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৯০০ বছর আগ জন্মেছিলেন হোমার। রেখে গেছেন ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’র মতো কালজয়ী দুটি মহাকাব্য। যদিও ‘ওডিসি’ নিয়ে স্যামুয়েল বাটলারের ভিন্ন মত আছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো—কবি হোমার ছিলেন পুরোপুরি অন্ধ একজন গরিব মানুষ, যিনি রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়াতেন। কিন্তু দারিদ্র্য বা অন্ধত্ব দমাতে পারেনি তার কবি প্রতিভাকে। আজও তিনি বেঁচে আছেন সৃষ্টির মাঝে ‘ব্লাইন্ড বার্ড’ নামে। সৃষ্টির মহত্বের গুণে হয়তো প্রজন্ম থেকে প্রজান্মান্তরে অবিরত এই বার্তাই পৌঁছাতে থাকবে ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ নামে বিশ্বসেরা দুটি কাব্যের লেখক ছিলেন মহাকবি হোমার।
পাদটীকা:
আমার বন্ধু সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী জাহিদ রহমান দেখা হলেই অবিরাম তাগাদা দেন—কেন বই লিখি না। তাকে বলি—ভাইরে, আমি তো লেখক না। বই লেখার যে যোগ্যতা, দক্ষতা ও বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা দরকার, তার কোনোটাই আমার নেই। বন্ধুটি আমার এসব কথায় পাত্তা না দিয়ে নানান যুক্তি তুলে ধরেন। ফেসবুকে-ইনবক্সে অবিরত তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। জাহিদ রহমান কম করে হাফ ডজন বইয়ের লেখক। একাত্তর-মুক্তিযুদ্ধ তার আগ্রহের বিষয়। আমি তার জন্য গর্ববোধ করি।
আরও পড়ুন:
বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব-৬॥ আনোয়ার পারভেজ হালিম