॥নয়॥
মোকসেদা মেট্রিক পাস করার পরে আবির তাকে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছে। মেশিনটার দাম একবারে পরিশোধ করতে পারে নাই। মোকসেদা কাজ করে করে পরিশোধ করবে। আবিরও কিছু কিছু করে টাকা দেবে। গোসাইবাগ গ্রামের এক আপার কাছে সে কাজ শিখতে যায়। আপাকে দুই হাজার টাকা দিতে হবে। সে টাকাও আস্তে আস্তে দেবে। মোকসেদা মেট্রিক পাস করোর পরে আর কলেজে ভর্তি হয় নাই। সে বুঝতে পেরেছে কলেজ এখান থেকে অনেক দূর। প্রতিদিন আসা-যাওয়ার গাড়ি ভাড়া লাগবে। তার ভাই দিতে পারবে না। মা-ও পারেন না। তাই সে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও আবির বলেছিল, “তুই ভর্তি হয়ে থাক। সময় মতো পরীক্ষা দিস। কেলাস না করলেও চলবো।”
কিন্তু আবিরের কথায় মোকসেদা ভরাসা পায় নাই। কারণ দুইজনের সামান্য আয়ে কোনোরকম সংসার চলছে তাদের। মোকসেদার বিয়ে দেওয়ার জন্য কত টাকা-পয়সা লাগবে কে জানে! কে দেবে সে টাকা? তাই সে কাজ করতে চেয়েছে। তখন আবির তাকে মেশিনটা কিনে দিয়েছে।
কয়েক বছর আগে আবির কথা দিয়েছিল মোকসেদা এসএসসি পাস করলে আবির ঘরে টিভি আনবে। আবির সে কথা রেখেছে—একটা পুরান সাদাকালো টিভি কিনে এনেছে। তবু মোরশেদা আর আজিমকে ঘরে ধরে রাখা যায় না। বাড়িওয়ালার ঘরে চলে যায়। সে ঘরে রঙিন টিভি। আর ডিশের লাইন আছে। অনেক চ্যানেল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা যায়। কোন চ্যানেল নাকি সারাদিন শুধু হিন্দি সিনমাই দেখায়। কোনো চ্যানেলে শুধু হিন্দি গান চলে সারাদিন। নিজেদের ঘরে শুধু সাদা-কালো টিভিতে একমাত্র বিটিভি দেখতে কার ভালো লাগে!
সে বছর মন্দা সিজনে—মিলগুলোতে বলা হয় ‘গড় সিজন’—শুক্রবারগুলোতে জায়দাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখা হয়। তার কয়েকদিন পরে নাইট ডিউটি অফ রেখে শুধু দিনে ষোলো ঘণ্টা চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়; এর পরে শুরু হয় ছাঁটাই। নাইলনের জাল ও সুতার বাজার পড়ে যায়। তখন বাজারে মাল চলে না। ছোট ছোট মালিকেরা বিপদে পড়ে যান। নতুন করে কাঁচা সুতা আমদানি করেন না। মেশিন চালু রাখবেন কিভাবে?
জায়দা ছাঁটাইয়ে পড়ে যান। তিনি চোখে অন্ধকার দেখেন। আবির একলা সংসার চালাবে কীভাবে? আর আবিরদের কারখানাও বন্ধ হয়ে যাবে না, তার ভরসা কী? নদীতে পানি নাই, জাল চলে না, এ অবস্থায় ছোট মালিকেরা ফ্যাক্টরি বন্ধ করেই দেবে। বড় মালিকেরা এসময় জাল বানিয়ে গোডাউনে স্টক করে রাখে। সিজনকালে দাম বাড়লে তখন বাজারে ছাড়ে। এবার বোঝা যাবে কোন মালিকের পকেটে টেকা-পয়সা কতটুকু আছে।
জায়দা কারেন্টজালের ফ্যাক্টরিতে কাজ নিতে যান। কাজ নাই সেখানে। সবখানেই ছাঁটাই শুরু হয়েছে। কয়েকদিন পরে আবিরদের ফ্যাক্টরিতেও শুক্রবার বন্ধ রাখা হয়। আবির এসময় ঢাকা যাতায়াত শুরু করে। শুক্রবারগুলো সে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। সে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা শেখার জন্য টিএসসিতে আবৃত্তি সংগঠনে ভর্তি হয়। এ সূত্রে ঢাকায় তার কিছু বন্ধু জুটে যায়। তাদের কাছে আবির কর্মজীবী পরিচয় না দিয়ে ছাত্র পরিচয়ই দেয়। যদিও তার বয়স তখন অনার্সের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্রের মতো। নাইট ডিউটি করার কারণে তার চেহারার কমনীয়তা কিছুটা কমে এসেছে, বয়স বেশি লাগে। আসলে সে তখন মাত্র উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। ভর্তি হয়ে আছে। মাঝে মাঝে ক্লাসে যায়ও। এখানে ক্লাস করা হাইস্কুলের মতো বাধ্যতামূলক না।
তাছাড়া আবির ভর্তি হয়েছে মানবিক বিভাগে। সে যেসব বিষয় নিয়েছে তার সবই আগে পড়া। অনেক গাইড বই, মেইন বই সে আগে কিনে পড়ে ফেলেছে। তার বেশি ক্লাস না করলেও চলে। এই সুযোগে সে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেও যাতায়াত করে। সেখানে সে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে প্রতি শুক্রবারে দেখতে পায়। এছাড়া আবদুল মান্নান সৈয়দ, মুস্তাফা নূর উল ইসলাম, মমতাজউদদীন আহমদ, অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ, ডক্টর আনিসুজ্জামানসহ অনেকে শীর্ষস্থানীয় লেখক-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাৎ হয়। সে সেখানে পাঠচক্রে ভর্তি হয়েছে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আবিরের ভালো লাগে। ঢাকা শহরের বুকে সবুজ এক টুকরা স্বর্গ যেন। এখানকার দোতলার লাইব্রেরিটা তার অনেক ভালো লাগে। সুন্দর করে বিভাগ অনুসারে বই-পুস্তক থরে থরে সাজানো। একতলা ভবনে দেশি-বিদেশি গান শোনার সুযোগ আছে। এখানেই সে প্রথমবারের মতো মোজার্ট আর বিঠোভেনের মিউজিক শুনেছে। ইসফেন্দিয়ার জাহিদ হাসান মিলনায়তনে এমনকী ছাদেও আলোচনা হয়। শুনতে ভালো লাগে। এখানে একদিন ড. মমতাজউদ্দিন আহমদ স্যার বলেন, “এই আমি শুধু আজকের আমি না, হাজার বছরের আমি। আমার জন্মের পেছনে আমার পূর্বপুরুষের বাঙালি জীবনের প্রভাব আছে। তার জীবনে আছে তার পূর্ব পুরুষের বাঙালি জীবনের প্রভাব।”
মমতাজউদদীন স্যারের কথাগুলো আবিরকে নতুন এক ভাবনার রসে জারিত করে। বাঙালিত্বের গভীরতা সে আগে কখনো এভাবে বোঝে নাই।
এখানে সবার কথাই ভালো লাগে আবিরের কাছে। সায়ীদ স্যারের হাস্যরসাত্মক কথাগুলোর ভেতরে অনেক কিছু উপলব্ধি করার আছে। একদিন আবদুল মান্নান সৈয়দ কার উক্তি যেন বললেন, “আসলে উপন্যাস কখনো শেষ হওয়ার নয়। লেখকেরা শেষ করেন বলে শেষ হয়। না হলে উপন্যাস চিরকাল অসমাপ্ত থাকে।”
কথাটা আবিরের কাছে সত্য বলেই মনে হয়। কিন্তু তার পাশের চেয়ারে বসা মেয়েটি নিজে নিজেই মন্তব্য করে, “কথাটা ভুল। লেভ তলস্তয়ের ‘আন্না কারেনিনা’ উপন্যাসটি আন্নার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তী অধ্যায়গুলো আসলে উপন্যাসের বারান্দা মাত্র।”
মেয়েটি কি একা একা নিজের সাথেই তিনটি বাক্য উচ্চারণ করেছে, নাকি আবিরকে শোনানোর জন্য বলেছে? ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি আবিরকে নিচ কণ্ঠে বলে, “কথাটা কি ঠিক হয়েছে?”
আবির থতোমতো খেয়ে যায়। সে গলা খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করে ফ্যাঁসফ্যাঁসে কণ্ঠে বলে, “ভুল কী বলেছেন স্যার?”
“উপন্যাস কি আসলে শেষ হয় না?”
“আমার মনে হয় স্যারের কথাই ঠিক।”
“না, এটা স্যারের কথা না। স্যার কোন এক সমালোচকের কথা যেন বললেন। আমার মনে হয় কথাটা ভুল। আপনি কি ‘আন্না কারেনিনা’ পড়েছেন?”
আবির বলে সে তলস্তয়ের কতগুলো গল্প পড়েছে কিন্তু ‘আন্না কারেনিনা’ পড়ে নাই। মেয়েটি বলে, “পড়ে দেখবেন আমার কথাই বেশি সত্য।”
সেদিন আবিরের ধারণা হয়, আসলে কুয়ার ব্যাঙের মতো শুধু বই পড়লেই প-িত হওয়া যায় না। সবখানে যেতে হয়। সবার কথা শুনতে হয়। মুক্তা নামের এই মেয়েটিই আবিরকে আন্না কারেনিনার অনুবাদ পড়তে দিয়েছে। প্রথমে এক খ- পরে প্রথমখ- জমা নিয়ে পরের খ-। আবির বুঝতে পারে, সাহিত্য পড়াই সবকিছু না, সমালোচনারও প্রয়োজন আছে। নাহলে অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। তার মনে পড়ে, সে কোথায় যেন পড়েছে এই আবদুল মান্নান সৈয়দই কোথায় যেন বলেছেন, সাহিত্য হলো নদী আর সমালোচনা তার তীর।
এখানে তীর বলতে সীমারেখা বোঝানো হয়েছে বলে আবিরের ধারণা।
আবির সেখানে কথা বলতে লজ্জা পেতো। তাই সে চুপ করে থাকতো। তার উচ্চারণে মেঘনার চরের আঞ্চলিক উপভাষার টান বেশি। এসময় সে আবৃত্তির সংগঠনেও ভর্তি হয়। আঞ্চলিক টান দূর করতে না পারলে কথায় কথায় লজ্জা পাবে। আবৃত্তি শেখার আগে বাগযন্ত্রগুলোর নানা রকম প্রশিক্ষণ আছে। গানের মতোই উদারা, মুদারা ও তারার স্বর প্রক্ষেপণ আছে। প্রথমেই উদারা, মুদারা এবং তারার হামিং প্রাকটিস করতে হয়। আবিরের জিভ পাতলা হওয়াতে সে দ্রুত হামিং করতে পারে। যে কোনো ধরনের ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারে। তবে তার বাড়িতে হামিং প্রকটিস করার জায়গা নাই। প্রথমে তার মন খারাপ হয়ে যায়। হামিং করতে না পারলে উচ্চারণ শুদ্ধ করতে পারবে না। তার সাথে আরো যারা একই ব্যাচে বা আবর্তনে ভর্তি হয়েছে তাদেরও হামিং প্রাকটিসের সমস্যা। ঢাকা শহরের ছোট ফ্লাটে এভাবে আ আ আ আ করে কণ্ঠ অনুশীলন করা কঠিন। পরিবারের সবাই নাকি হাসাহাসি করে।
কয়েকদিন পরে নাইট ডিউটি আসার পরে আবির দেখে তার আসলে বোঝার ভুল। ডিউটিতে থাকতেই সে হামিং করতে পারে। আটঘণ্টা ডিউটির মধ্যে সাত ঘণ্টাই প্রাকটিস করার সুবিধা। মেশিনগুলো চালু থাকলে এমনিতেই তো গান গেয়ে সময় কাটায়। এখন থেকে সে হামিং করে কাটাতে লাগলো। দেখা গেল, উদারা আর মুদারার হামিং অনেক সহজে করা যায়। কিন্তু তারার হামিং করা কঠিণ বেশি শক্তি লাগে, লম্বা দম লাগে। একদিন তারার হামিং করার সময় তার সামনের মেশিনের অপারেটর ইয়াসিন এসে বলে, “কিরে আজান দিতাছোস ক্যান?”
আবির বলে, “আজান না ব্যাটা, গলা প্রাকটিস করতাছি।”
“শিল্পী হইবি নাকি?”
“হইলে, হইতেও পারি।”
ইয়াসিন বলে, “তুই চেষ্টা করলে পারবি। লেখাপড়া কইরা তুই মেশিন লইয়া অপারেটর হইয়া রইছোত ক্যান? চেষ্টা করলে তুই সুপারভাইজার হইতে পারোস না? আমরা না হয় মুরুক্ক মানুষ মেশিন চালান ছাড়া আর উপায় নাই।”
ইয়াসিনের প্রথম কথায় আবির খুশি হয়। সে তার সাধনার পক্ষে স্বীকৃতি পেয়েছে। পরের কথায় চিন্তায় পড়ে যায়। আসলে সে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়া শ্রমিকের পদ ছাড়া স্টাফ পদে চাকরি করতে পারে। কিন্তু তার সে ইচ্ছা নাই। এর কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, স্টাফরা সাধারণত মালিকের চামচা স্বভাবের হয়। দ্বিতীয়ত, সুপারভাইজারদের দুই দিকের চাপ সইতে হয়। একদিকে মালিক আরেক দিকে শ্রমিক। এসব কারণে সে শ্রমিকই থাকতে চায়। আরো একটা কারণ হলো, সুপারভাইজারদের বেতন খুব বেশি না। তারা লেখাপড়া করে সুপারভাইজার হয় তুব বেতন কম। মেশিন চালকদের বেতন বেশি। এখানকার কোনো কোনো মালিক মেশিনচালকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে সুপারভাইজারদের ধমকায়, এমনকি মারধরও করেন। এর মানে মালিকেরা শ্রমিকদের প্রতি খুব দয়াশীল তা না। তাদের লাভ কমে যায় বলেই এ অবস্থায় অপারেটরদের পক্ষে কথা বলেন। স্পষ্ট ভাষায় কেউ কেউ বলেন, “দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত পোলা আছে, তগো মতোন শিক্ষিত সুপারভাইজার তুড়িতে কুড়িটা পামু, একজন দক্ষ মেশিন অপারেটর চইলা গেলে মেশিন বন্ধ থাকবো। একদিন বন্ধ থাকলে একদিনের আয় কইম্মা যাইব।”
ঢাকার নতুন বন্ধুরা আবিরকে লেখালেখি করতে বলে। এখানে অনেকে অনেক কিছুর সাথে জড়িত। কেউ গিটার বাজায়, নিজেদের ব্যান্ড আছে। অনেকে লিটল ম্যাগাজিন করে। সবাই আবিরকে লেখালেখি করতে বলে। আবির বলে তার শুধু পড়তেই ভালো লাগে। মাঝে মাঝে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর জয়নুল গ্যালারিতে গিয়ে চিত্রপ্রদর্শনীও দেখে।
আবির অনেক গান মুখস্থ পারে। ব্যান্ডের বন্ধুরা যখন পুরানো কোনো গানের লিরিক বলতে গিয়ে আটকে যায়, আদি শিল্পীর নাম বলতে গিয়ে আটকে যায় আবির তখন তা বলে দেয়। বন্ধুরা আবিরেরর এই প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়। কেউ কেউ বলে, “আবির তুমি গান লিখো না কেন?” আবির বলে তার কাছে গান শুনতেই বেশি ভালো লাগে।
গান লেখার প্রস্তাবটি আবির সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিলেও তার ভেতরে স্বপ্ন তৈরি হয়। একটা ব্যান্ড দলের লিরিসিস্ট হওয়ার প্রস্তাব আবিরের বয়সের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। ব্যান্ডের দলে থাকলে খারাপ হতো না। আমির খানের মতো ব্লু জিনসের প্যান্ট আর জ্যাকেট পরে হাতা গুঁটিয়ে দাঁড়ানো ছবি ক্যাসেটের কভারে ছাপা হতো। সে পরের সপ্তায় চুপে চুপে হাতিরপুলের আর পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারের বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলো ঘুরে এসেছে। সকালে টিএসসিতে আবৃতির ক্লাস শেষ করে দুপুরে একটা পুড়ি খেয়ে সে প্রথমে হাতিরপুলে যায়, গিটার দেখে তার পছন্দ হয়। কিন্তু তার সাধ্যের অতীত দাম দেখে ফিরে আসে। সেখানেই এককজন ক্রেতার কাছে শুনতে পায় শাঁখারী বাজারে বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতে সে বংশাল হয়ে শাঁখারী বাজার গিয়ে দেখে এখানে দাম কম হলেও তার মতো একজন শ্রমিকের কাছে অনেক দূরের কথা।
বিকালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর সেমিনারে দেখা হয় লিটলম্যাগ কর্মিদের। তারা আবিরকে কবিতা লিখতে বলে। গদ্য লিখতে বলে। বইয়ের রিভিউ লেখার অনুরোধ করে। আবির তাদেরও সরাসরি না করে দেয়। সে শুধু বলে, তার পড়তে ভালো লাগে।
সে বছর গড় সিজনের পরে সিজন আসে ভাগ্য নিয়ে। আবির দেখেছে এই এলাকার মানুষেরা বড় বন্যা হলে খুশি হয়। শুধু এই এলাকার মানুষ না, মুন্সীগঞ্জের অনেকেই খুশি হয়। তবে এখানকার মানুষদের বড় বন্যা বড় ভাগ্য নিয়ে আসে। পানি বাড়ার সাথে সাথে জাল, সুতা, দড়ি, কাছির দাম বাড়ে। বন্যা হলে অনেকে চাষের পুকুরের চারপাশে ঘের দেওয়ার জন্য জাল কিনে নেয়। পানি বাড়লে পুকুরের মাছ- পোনা সব বের হয়ে জোয়ারে ভেসে যায়। তা ঠেকিয়ে রাখার জন্য তারা জাল, সুতা কিনে, দড়ি কিনে নিয়ে যায়। এতে করে হু হু করে দাম বাড়তে থাকে। অনেকে বাঁশের ব্যবসা করে তাদেরও লাভ। বন্যার সময় বাঁধ দিতে হয়, সাঁকো দিতে হয় বাঁশের দাম বাড়ে। যারা আলুর ব্যবসা করে তাদের তো মহালাভ। বড় বন্যা হলেই দেশের সব্জির বাজার পড়ে যায়। তরি-তরকারির ভিটা যখন পানিতে ডুবে যায় তখন একমাত্র আলুই বাজারে চলে। আলুর দাম বাড়ে। অনেকে চাউল, খুদ, কুঁড়ার ব্যবসা করে। বন্যার সাথে সাথে এসবেরও দাম বাড়ে। চাউলের দাম বাড়লে গরিবেরা খুদ কিনে বউয়া খায়।
এসব জিনিসের দামের সাথ সাথে শ্রমিকদের চাহিদা বাড়ে কিন্তু তাদের দাম বাড়ে না। কারো বেতন বাড়ানো হয় না। প্রয়োজন হলে ওভারটাইম খাটিয়ে আগের বেতনের হারেই উদ্বৃত্ত শ্রমের মজুরি দেওয়া হয়।
বর্ষার শুরুতে একটু একটু করে মাল চলছিলো। কিন্তু পানি বাড়তে থাকে। ভারতের বন্যার পানি চলে আসে। তখন বরিশাল, চাঁদপুর, চিটাগাং থেকে বড় পার্টি আসে। তারা মালিকদের অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখে। আবার কাজের জোয়ার আসে। সে জোয়ারের সাথে আসে বাংলাদেশের তিন দিক দিয়ে পানির জোয়ার। ঘর-দুয়ার ভেসে যায়। গলির রাস্তার ইট তুলে এনে চৌকি উঁচা করতে করতে ঘরের আড়ার সাথে প্রায় ঠেকে যায়।
বরিশাল অঞ্চলের ভাড়াটেদের অনেকেই পানির সাথে লড়াই করে না পেরে গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে লঞ্চে ওঠে। বাড়িওয়ালাদের ভাড়া ঘরগুলো খালি হয়ে যায়। ফ্যাক্টরির দরোজার সামনে দেয়াল তুলে পানি ঠেকানোর চেষ্টা চলে। প্রবল জোয়ারে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। চুয়ে চুয়ে ভেতরে ঢোকা পানি সেচে ফেলতে হয়। কিন্তু এক রাতে দেয়ালের ওপর দিয়ে পানি ঢোকে। হাঁটুর ওপরে পানি জমে মেশিন সব বন্ধ হয়ে যায়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে কপিকলওয়ালাদের ডেকে এনে মেশিন উঁচু করে নিচে ইটের ঢালাই দিয়ে উঁচু প্লাটফর্ম বানিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে নেট মেশিনগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা করেন তারা। যারা উঁচু করতে পারেন নাই তারা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। অতপর বেতন দিয়ে শ্রমিকদের বিদায়।
আবিরদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয় নাই। কিন্তু তাদের ভাড়া ঘরের চৌকি যখন আড়ার সাথে প্রায় ঠেকে যাওয়ার অবস্থা হয় তখন ইভারা দেশের বাড়ি চলে যায়। অনেকে স্কুল-মাদরাসার আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেও ইভার মা নিজের এবং মেয়ের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র নিরাপদ মনে না করে দেশে চলে যান।
আবিরদের বাড়িওয়ালা ভাড়াটেদের ধরে রাখার চেষ্টা করেন। তিনি অনেক কাঠ ও বাঁশ কিনে এনে ভাড়াটেদের ঘরে সাপ্লাই দেন। মাচা বানিয়ে থাকার চেষ্টা। পাকা মহাসড়কে তখন কোমর সমান পানি। প্রবল ¯্রােতের জোয়ার যায়। নৌকা চলে, রিকসা চলে। ইঞ্জিনচালিত যানবাহন বন্ধ হয়ে যায়। দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আবিরকে লুঙি ভিজিয়ে কারখানায় যেতে হয়েছে। মাথায় আরেকটা লুঙি পেঁচিয়ে রেখে গিয়েছে। ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার পরে ভেজা লুঙি পাল্টে শুকাতে দিয়ে কাজ করতে হয়েছে।
পানি কমার মাসখানেক পরে ইভারা ফিরে আসে। আবার সে কাজে যোগ দেয়। পুরান শ্রমিক, তাই ফোরম্যান তাকে কাজে নিয়ে নেয়। তখনো অনেকে দেশের বাড়ি থেকে ফিরে নাই। সব মেশিন চালু রাখার জন্য ইভাকে ডাবল ডিউটি করতে হয়। তার ডিউটি ছিল আবিরের আগের শিফটে। প্রতিদিন সে বি-শিফটে ডিউটি করার পরে আবিরদের সাথে সি-শিফটে ওভার টাইম করে। সে মাসে হাজিরা খাতায় ইভার নামে আটটি ওভারটাইমের ডিউটি যোগ হয়। সে মাস শেষে কিছু বেশি টাকা বেতন পায়।
এক দিন ইভা বি-শিফটে ডিউটিতে আসে নাই। নাইটে গিয়ে আবির তার দেখা পায়নি বলে মনের ভেতর কেমন একটা যন্ত্রণা অনুভব করে। সারাটা রাত সে বিরহের গান গেয়ে কাটালো। রাতে সে একজনের কাছে খবর পেল ইভা অসুস্থ। এটা তার অনুমানেই ছিল না। নাহলে ইভা নাইটে ওভারটাইম ডিউটি করবে দূরের কথা, সে তার বি-শিফটের নিজের ডিউটিই করে নাই ক্যান এ প্রশ্নটা উঠতে পারতো।
পরদিন বিকালে আবির ইভাদের বাসা খুঁজতে যায়। সে মালির পাথর গ্রামে গিয়ে খোঁজ নেয়। বাড়িওয়ালার নাম মনে ছিল না। তার জানাও ছিলো না। একদিন শুধু শুনেছিল, ডাক্তারবাড়ি।
বাড়ি পেতে কষ্ট হয় নাই। ইভাদের ঘরে গিয়ে আবির দেখে এই বাড়ির ঘরগুলো অনেক ভালো। পুরো বস্তি বলা যায় না। উঁচু ঘর। চারদিকে টিনের বেড়া, ভিটি সিমেন্টের পাকা। রান্নাঘরে গ্যাস আছে। রান্নাঘরও পাকা। গোসলখানাও পাকা। অথচ আবিরেরা থাকে কাঁচাভিটির ঘরে, বাঁশের বেড়া। গ্যাস নাই, গোসলখানা নাই, পুকুরে গোসল করতে হয়।
ঘিঞ্জি হলেও ইভাদের বাসাটা আবিরের কাছে তুলনামূলক ভালো লাগে। সে এক পিচ্চির কাছে জিজ্ঞাসা করে ইভাদের ঘরে গিয়ে ওঠে। ইভা তখন শুয়ে রয়েছিলো। তার গায়ে জ্বর। একটা পাতলা কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আবির দুয়ারে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “এটা কি ইভাদের ঘর?”
ইভার ঘুম ভেঙে যায়, সে কাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করে জিজ্ঞাসা করে, “কে?”
ইভার কণ্ঠ চিনতে পেরে আবির বলে, “আরে তুই? অসুস্ত নাকিরে? দেখ তোরে দেকতে আমি আইলাম।”
ঘরে গিয়ে ইভার বিছানার পাশে বসে আবির। ইভা উঠে বসে। সে অসুস্থ হলেও তার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। সে বিশ্বাস করতে পারে নাই, আবির তাকে দেখতে আসবে। সে বলে, “আপনে আমারে দেকতে আসবেন ভাবি নাই।”
“তুই আমারে নিয়া কী ভাবোস?”
“বুঝছি তো। আপনে আমারে দেকতে না আইসা পারলেন না!”
“তুই কী বুঝছোত?”
ইভা খিলখিল করে হাসে। “একদিন না দেইক্কাই চইলা আইছেন। আমি কি খুশি হই নাই?”
“বাড়িতে তুই একলা ক্যান? তোর মা কই?”
“মা মোনে হয় দোকানে গেছে। আপনে কার কাছে শোনলেন আমার অসুকের কতা?”
“হালিমার কাছে।”
“অ। আবির ভাই, আপনে আমারে দেকতে আইছেন, আমার বিশ্বাস অয় না। এখানে অন্য কারো বড়িতে গেছিলেন নাকি সত্যি আমাগো বাসাতেই আইছেন? আসলেই আপনের মোনটা অনেক বড়।”
আবির জিজ্ঞাসা করে, “তোর অসুখ কবে থিকা?”
“তিন চারদিন ধইরাই জ্বর জ্বর। কাইলকা অনেক বেশি।”
আবির বলে, “এত বেশি ওভারটাইম করলে শইল তো খারাপ হইবোই। ওভারটাইম করলে ভালো ভালো খাইতে হয়।”
“কী খামু কন?”
“দুধ খাবি, ডিম খাবি।”
“দূর! দুধ খাইতে ভালা লাগে না। বমি লাগে।”
“দুধ না খাইলে ডিম খাবি, কলা খাবি।”
হঠাৎ ইভা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সে বলে, “আপনে এখন কী খাইবেন?”
“কী খাওয়াবি? কিচ্ছু খাওন লাগবো না। তুই আমার কাছে মিষ্টি পাওনা আছোত না? আমার উচিত আছিল কিছু আনা।।”
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ইভার দেখিয়ে দেওয়া সুইচ টিপে আবির লাইট জ্বালায়। এসময় ইভার চোখ লাল হতে থাকে। আবির দেখে ওর জ্বর বাড়ছে। হঠাৎ সে ইভার কপালে হাত রাখে। হাতে প্রবল তাপ লাগে। আবিরের হাতের ত্বক অনেক শক্ত। সে শক্ত ত্বকের ভেতর দিয়াই জ্বর অনুভব করে।
ইভা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুই হাত দিয়ে আবিরের হাতটা ধরে রাখে। চোখে, মুখে নাকে, গলায়, গ্রীবায় চেপে ধরে। এসময় বিদ্যুৎ চলে যায়। আবির দুই হাতে ইভার মুখটা তুলে আনে নিজের মুখের কাছে। আস্তে করে ঠোঁট রাখে ইভার ঠোঁটে। জীবনে এই প্রথম। নরম ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আবির কেমন বিহ্বল হয়ে যায়। ইভা তার একটা হাত আবিরের কাঁধের ওপরে রাখে। আবির ইভাকে কাছে টেনে আনে। বুকের সাথে লেপ্টে রাখে জ্বরতপ্ত ইভাকে। ইভা আবিরের ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস ছাড়ে। আবির ইভার দুই গাল থেকে হাত নামিয়ে কাঁধে, বাহুমূলে, সেখান থেকে বুকে, বুক থেকে আরো নিচে নামিয়ে আনে।
হঠাৎ আবিরের ডান হাতের চারটা আঙুল ইভার বুকের বাম পাশে সুকোমল স্নেহপিণ্ড বেয়ে নিচে নেমে পাঁজরের খাঁজে আটকে যায়। পাঁজরের বাঁকা হাড়গুলোর মাঝে বসে যায় আবিরের চারটি আঙুল। আবির অনুভব করে ইভার বুকে সুকোমল স্নেহপ্নিণ্ড ছাড়া আর কিছু নাই। এর সামান্য নিচে হাড়ের ওপরে চামড়া শুধু। এইতো শ্রমিক শ্রেণীর শরীর। শ্রমিক শ্রেণীর প্রেম, শ্রমিকের কাম। এখানে সামান্য পরিমাণও চর্বি নাই। চর্বিই তো পুঁজি। ইভার শরীরে পুঁজির কোনো চিহ্ন নাই। সে এই অনুভবের পরে ইভাকে আরো শক্তিকে বুকের কাছে মিশিয়ে রাখে।
আবির মেঘনার সন্তান। মেঘনার তীরে জন্ম নেওয়া। তাদের বাড়িঘর মেঘনার পানিতে মিশে গেছে। ইভা বঙ্গোপসাগরের সন্তান। সে সাগরের তীরের খেপুপাড়ার চুঙিপাশা গ্রামে জন্ম নিয়েছে। মেঘনা তো চিরকাল বঙ্গোপসাগরের দিকেই এগিয়ে চলে। এটাই তো স্বাভাবিক গতি। সকল মিষ্টি পানি আসলে নোনাপানির দিকে ধাবিত হয়। নোনাপানিই তাহলে মানুষের আসল ঠিকানা।
বিদ্যুৎ চলে আসার পরে ইভাদের বাসা থেকে আবির বের হয়ে বাসায় ফিরে আসে। সেদিন সে রাতে মায়ের কাছে প্রস্তাব করে। ইভাকে বিয়ে করার চিন্তাটা সে প্রকাশ্যেই সাহস করে প্রকাশ করে।
কিন্তু জায়দা বানু সরাসরি আবিরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “বরিশাইল্লা মাইয়া বউ বানায়া আনতে চাই না।”
আবির প্রচ- এক ধাক্কা খায়। সে কোনো কথা না বলে স্তব্ধ হয়ে যায়। সে রাতেই সে রেডিওতে শুনতে পায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানটি।
… গগনেতে ডাকে দেয়া
আসমান হইল আন্ধি
রে বন্ধু, আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি॥
চলবে…