॥পর্ব-৪॥
নাঈমা পারভেজ শিক্ষাবিটের নিউজ কাভার করলেও মুন্সীগঞ্জের ঘটনায় তার কৌতূহল কমে না। সে একদিন মুন্সীগঞ্জে গিয়ে কবির হোসেনের সাক্ষাৎ গ্রহণ করবে। তার মাথায় এ পরিকল্পনা। সে কবিরের আহত স্ত্রী রেশমাকে দেখতে যাওয়ার কথাই বলে। সে প্রথমে রেশমার সাক্ষাৎ নেয়।
রেশমা থাকে কবির হোসেনের দোতলা বাড়িতে। ঢাকা থেকে বাসে মুক্তারপুর ফেরিঘাটে নামতে হয়। তখন ব্রিজ ছিল না। ব্রিজ ছিল মানুষের স্বপ্ন। বড় ফেরিঘাট ছিল। দুইপারে অনেক গাড়ি লাইন ধরে থাকতো। ঢাকা থেকে চর মুক্তারপুর পর্যন্ত বাস চলতো। নাঈমা চর মুক্তারপুর নেমে ট্রলারে নদী পার হয়ে মুক্তারপুর গিয়ে কবির হোসেনের বাড়িটা কয়েকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করতেই খুঁজে পায়।
একটা পুকুরের ওপরে দোতলা দালান। পুকুরের ওপরে ঝুল বারান্দায় নানা ফুলের টব সাজানো। দোতলার রেলিংয়ে ঝুলছে নানা ফুলের লতাপাতা। তবে বিল্ডিংটার রঙ বড় অদ্ভুত। ঘন বেগুনি। রুচির ছাপ নেই। কিন্তু বাড়িটিতে যারা বাস করে তাদের মধ্যে কেউ রুচিশীল আছে।
নিচতলার গেট দিয়ে ঢুকতে হয়। কাজের মেয়ে এসে নাঈমাকে দোতলায় নিয়ে যায়। কবির তখন বাসায় ছিল না। এতে নাঈমার ভালো হয়েছে। কারণ কবির তাকে চিনে ফেলতে পারে। কবিরের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য এলেও নাঈমা সে দিকে এগোয় না। সে এগায় অন্যভাবে। সাংবাদিক পরিচয় লুকিয়ে বঞ্চিত নিবন্ধন পরীক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেয়। রেশমাকে বলে যারা কয়েক বছর ধরে নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষের কারসাজির কারণে কৃতকার্য হতে পারছে না, তারা একটি সংগঠন গড়ে তুলতে চায়। তাদের দাবি, এভাবে হবে না, আন্দোলন করতে হবে।
রেশমা বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই প্রহণ করে। সংগঠনটিকে সে অগ্রিম অভিবাদন জানিয়ে বলে, এমন কিছু করাই উচিত।
প্রস্তাবে সাড়া পাওয়ার পরে নাঈমা তার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। রেশমার কথা শুনে নাঈমার ভালো লাগে। অনার্স-মাস্টার্স পাস করা সব মেয়ে বিশেষ করে মফস্বলের কোনো মেয়ে এভাবে কথা বলে না। নাঈমা সে একটি বিষয় জানতে চায়, আপনার স্বামী তো ব্যবসায়ী, ছোট হলেও একজন শিল্পপতি। কিন্তু আপনি এমন সচ্ছল ঘরের গৃহিণী হয়ে চাকরি করার জন্য এত চেষ্টা করছেন কেন?
প্রশ্নটা করেই বোকা হয়ে যায় নাঈমা। এটা একটা অবান্তর প্রশ্ন। সে সহজেই বুঝতে পারে, এসব প্রশ্নের উত্তরে যে কোনো শিক্ষিত নারী একই কথা বলবে, শিক্ষিত হয়ে ঘরে বসে থাকব কেন, নিজে কিছু করতে চাই এমন সব উত্তরই দেবে। কিন্তু রেশমা সে ধরনের কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে।
নাঈমা সময় দেয়। সে নতুন প্রশ্ন করে রেশমাকে অন্য দিকে সরিয়ে দেবে না। বরং সময় দিয়ে এই প্রশ্নটারই উত্তর বের করে নেবে। চুপ করে থাকাতে তার কাছে সন্দেহ লেগেছে। এখানে কোনো গল্প আছে। আসলে নাঈমা জানতে চাইছে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন। এই প্রশ্নের ভেতর দিয়ে কবিরকে চিনতে চায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রেশমা বলে, সাধে কি আর নারীরা চাকরি করতে চায়! সারাদিন পুরুষ মানুষের গা ঘেঁষে, গাড়িতে উঠে, কত ইশারা ইঙ্গিত সহ্য করে প্রতিদিন কাজে যাওয়া কি খুব স্বাদের?
রেশমার এসব কথায় নাঈমা সহজেই বুঝতে পারে, এ মেয়ে বিয়ের আগেও চাকরি করেছে হয়তো। স্টুডেন্ট লাইফে হয়তো বিমা কোম্পানিতে বা কিন্ডার গার্টেনে চাকরি করেছে। এবং মেয়েটি সমাজ সম্পর্কে সচেতন।
এবার সাংবাদিক নাঈমা পারভেজ প্রশ্ন রাখে, যদিও ব্যক্তিগত বিষয়, কিছু মনে না করেন যদি তবু জানতে চাই আপনার স্বামীর এই সচ্ছলতার প্রতি কোনো কারণে আপনি কি বিরক্ত বা অনীহ?
রেশমা প্রথমে চুপ করে থাকে। পরে বলে, আসলে আমার স্বামীর সবকিছু তারই। আমার কিছু না। বাপের বাড়ি থেকে বিয়ের সময় যা দিয়েছিল সেসব তো আর ফেরত নেওয়ার উপায় নাই। এ ছাড়া আর কিছু আমার নাই। আজ যদি মারধর করে বিদায় করে দেয়, কালকেই বাপের বাড়িতে গিয়ে ভাবীদের কালোমুখের ওপর বাস করতে হবে। তাইনা? আপনি তো সবই বোঝেন।
নাঈমা যা বোঝার বুঝে ফেলেছে। তার অনুমান সবই সত্য হয়েছে। এবার অনুমানগুলোর পেছনে প্রমাণ লাগবে। নাঈমা ড্রইং রুমের চারদিকে একবার তাকায়। দেয়ালে মক্কা-মদিনার ছবি, আজমির শরিফের, মুম্বাই শহরের সমুদ্রের মাঝে আলি শাহসাহেবের মাজারের, ন্যাংটা হয়ে হিসি করছে এমন এক শিশু ছেলের ছবি। একপাশে স্বামী-স্ত্রীর ছবি বাঁধানো ফ্রেমে । অন্যপাশে মাধুরী-দীক্ষিত আর আমির খানের ছবি। বড় বড় ওয়াল শো-কেস, ওয়ার্ডরোব এ সব রেশমার বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া মনে হয়। ঘরে নিজেদের কোনো শিশুর ফটো, খেলনা, পোশাক কিছু নেই। সে অনুমান করতে পারে রেশমা-কবির দম্পতি এখনো নিঃসন্তান। এ বিষয়ে সে কোনো প্রশ্ন করতে চায় না। যা বোঝার সে বুঝে গেছে।
হঠাৎ রেশমার কথায় আরো কিছু জানা যায়। রেশমা অনুনয়ের সুরে বলে, আপনারা সংগঠন করেন। আমি সাথে আছি। চাঁদা চাইলে সব সময় দিবো। মিছিল-মিটিংয়ে যেতে বললে যাবো। তবু সবার একটা উপায় হোক। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও লোকে চাকরি পাবে না, তা হতে পারে না। সরকারি চাকরির বয়স গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেশন জট লাগিয়ে তরুণদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমার মতো অনেক নারীর চাকরি দরকার। আর ছেলেদের চাকরি বেশি দরকার।
নাঈমা প্রশ্ন করে, ছেলেদের বেশি দরকার কেন?
একটা বেকার ছেলেকে একটা বেকার মেয়ে বিয়ে করে না, কিন্তু একটা বেকার মেয়ের তো তবু বিয়ে হয়। বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা বা ডিভোর্সি না হলে একটা মেয়ের চাকরির আয়ে শুধু তার নিজের চলে। কিন্তু একটা তরুণ ছেলের চাকরির ওপর পুরো সংসার নির্ভর করে। তার বৃদ্ধ মা-বাবা, ছোট ভাই-বোন তার অপেক্ষায় থাকে। কোনো মেয়ের সাথে খাতির থাকলে, থাকতেই পারে। এই বয়সী একটা ছেলের গার্লফ্রেন্ড থাকাটাই স্বাভাবিক। সেও অপেক্ষায় থাকে। চাকরি না পেলে কোনো নারী আত্মহত্যা করে না। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত একটা ছেলের চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত মনে আত্মহত্যার ইচ্ছা সদা জাগ্রত থাকে।
কাজের মেয়ে ট্রেতে করে অনেক ফল, মিষ্টি, চিপস, দই, বিস্কুট, সেমাই ইত্যাদি নিয়ে আসে। নাঈমা দেখেই বুঝতে পারে নতুন শিল্পপতিদের ঘরে এমনটাই স্বাভাবিক। সে বাচ্চাদের মতো চিপস চিবাতে থাকে। রেশমা কাজের মেয়েকে বলে, আর পোনডো মিনিট পরে চা দিয়া যাইবি, বুজলি?
নাঈমা বুঝতে পারে রেশমার এই কথাগুলোর পেছনে কোনো পুরুষচরিত্র লুকিয়ে আছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করাটা বিপদজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজমের সুধাংশুশেখর স্যার সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে অনেকগুলো সতর্কতার কথা বলেছিলেন। সবগুলো এখন আর মনে নেই। আসলে এগুলো কাজে নামলেই মনে পড়ে। স্যারের কথাও মনে পড়ে। আজ তবু রেশমার সাক্ষাৎকার অনেকটা সফল। পলিটিশিয়ান বা বড় ক্রাইমপার্সনের সাক্ষাৎকার আনা সো টাফ অ্যান্ড হার্ড। রেশমার মন নানা কারণেই দুর্বল, তার দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া অনৈতিক হবে। তাই সুকৌশলে এগোতে হবে। নাঈমা বলে, এত কিছুর আয়োজন করেছেন কেন?
রেশমা বলে, করতে আর পারলাম কই? আপনি আজকে থাকেন। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করেন। একটা ভালো কাজে নেমেছেন আপনারা, এতদূর থেকে আমার কাছে এসেছেন, আমার মত নিতে, সহায়তার আশ্বাস নিতে, আমি আপনাদের কাজটা পূর্ণ সমর্থন করি।
এসময় হঠাৎ নাঈমার মনে একাট বিষয় বিদ্যুতের মতো ঝলকে ওঠে, সে প্রশ্ন করে বসে, এখানে আপনার সাথে আরো যারা এমনভাবে বছরের পর বছর ধরে নিবন্ধন পরীক্ষা দিচ্ছে কিন্তু কৃতকার্য হচ্ছে না, এমন কেউ থাকলে বলেন, আমি তার কাছেও যাবো।
রেশমা বলে, আপনি খেতে থাকেন আমি বলছি। এখানে অনেকেই আছে। আমাদের সিনিয়র ভাইও আছে। ফরিদ ভাই, ফারুক ভাই, বায়েজিদ ভাই, এমি আপা। আর আমাদের ইয়ারমেট আছে তো অনেকে…।
নাঈমা একটা নাম শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে থাকে। আবির নামের একটি ছেলে নাকি অনেক ট্যালেন্ট ছিল। সে নাকি মারা গেছে। তার নামটা রেশমা উচ্চারণ করে কিনা। সে সেমাইয়ের পিরিচটা হাতে নিয়ে সেমাই খেতে শুরু করে। এসময় রেশমা জিজ্ঞাসা করে, চিনি কি কম হয়েছে?
না, ঠিক আছে।
আমার স্বামী চিনি বেশি খায়। আপনারা তো কম খান।
নাঈমা বুঝতে পারছে রেশমা তার সিঙ্গেল সোফায় বসেই কথা বলছে। এ পর্যন্ত একবারও ওঠেনি। রেশমা এখনো সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। আর কী আশ্চর্য এ পর্যন্ত একবারও নিজের অসুস্থতার কথা, দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করেনি। নাঈমা যে এক্সিডেন্টের কথা জানে এটা রেশমা বুঝতে পারেনি। একবছর ধরে নাঈমা পিছে লেগে আছে। যা জানে আরো জানতে হবে। রেশমার দুর্ঘটনা তার স্বামীর হত্যাপ্রচেষ্টা কিনা শিওর হতে চায়। সেমাই খেতে খেতে নাঈমা প্রশ্ন করে, আপনার সহপাঠীদের মধ্যে কারা আছে কয়েকজনের নাম বলবেন বললেন কিন্তু বললেন না তো!
ওহ, ভুলেই গেছিলাম। আমাদের মধ্যে আছে জুনিয়া, ঝুনু, রেহানা, সোহান, পারভেজ, আমিনা, সোহানা। আরো আছে চেহারা দেখলে নাম মনে পড়বে, এখন ভুলে গেছি।
আচ্ছা, ধন্যবাদ অনেকের নাম পেলাম। আপনার কাছে আবার আসব আমি। বিরক্ত করতেই আসব।
অবশ্যই আসবেন। সংগঠনের সব কিছু আপনার কাছ থেকে জানব—বলে রেশমা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে, ঘুরে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। নাঈমা তাকে ধরে বসায়। সোফায় আবার বসে রেশমা কাজের মেয়েকে ডাক দেয়, আমিনা, আমিনা, এদিকে আয়। চা অইছে? চা নিয়া আয়, আর গোসলখানায় গরম পানি দে।
রেশমা এখনো হাঁটাচলা করতে পারে না, এটা নাঈমার কাছে স্পষ্ট হওয়ার পরে রেশমা বলে, গত বছর নিবন্ধন পরীক্ষা দিতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়েছিলাম। এখনো আমি হাঁটতে পারি না।
কোথায় এক্সিডেন্ট হয়েছিলেন, যাত্রাবাড়ী?
আবারো একটা অবান্তর প্রশ্ন করে ফেরেছে নাঈমা। রেশমা বলে, জি, যাত্রাবাড়ী। ঘটনাটা আপনি জানেন?
নিবন্ধন পরীক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করছি, জানারাই কথা। শুনেছিলাম ঘটনাটা। আচ্ছা, আপনাদের মুন্সীগঞ্জের আরেকটা লোক আগের বছর একইভাবে নিবন্ধন পরীক্ষা দিতে গিয়ে এক্সিডেন্ট হয়েছিল, আবির না কী নাম। মারা গেছে। শুনেছি অনেক ট্যালেন্টেড ছিল, তাকে চিনতেন?
রেশমা মুখ কিছু খুলতে যাচ্ছিল, এসময় কাজের মেয়ে আমিনা চা নিয়ে আসে। রেশমা চুপ হয়ে যায়, বিষয়টা নাঈমার চোখে পড়ে। আমিনা চলে না যাওয়া পর্যন্ত রেশমা চুপ করে থাকে। এর পরে চারদিকে চেয়ে সতর্কভাবে বলে, ওর আসল নাম আসগর। এখানে এই নামেই আমরা চিনি। জি। ওকে চিনি বেশ ভালোভাবেই চিনি। ও অনার্সে আমার ক্লাসমেট ছিল। খুবই মেধাবী ছিল। ওর বিসিএসও হয়েছিল প্রিলিতে। কিন্তু রিটেনে অল্পের জন্য পারে নাই। বলেন, এমন বিসিএসে টেকা ছেলে নিবন্ধন পরীক্ষায় ফেল করতে পারে?
আমি তার সম্পর্কে জানতে চাই।
রেশমা বলে, আচ্ছা, তার সম্পর্কে আপনাকে বলবো। কিন্তু এখন না। আপনার ফোন নম্বর দিয়ে যান ফোন করে সব বলবো।
নাঈমা অনুমান করে রেশমার স্বামীর বোধহয় ঘরে ফেরার সময় হয়েছে, তাই তাকে বিদায় করে দিতে চাইছে। দ্রুত চা খেয়ে চলে যাওয়ার জন্য সে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে সে তার একটা ভিজিটিং কার্ড রেশমার হাতে দিয়ে যায়। ভিজিটিং কার্ডে শুধু নাঈমা পারভেজের নাম, মোবাইল নম্বর আর ইমেইল এড্রেস আছে। আর কিছু নেই।
যাওয়ার সময় নাঈমা ভাবে অনেক তথ্যের ভাণ্ডার পাওয়া গেছে। তার গবেষণাও অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
আসলে সাংবাদিক নাঈমা পারভেজ তখনো মূল ঘটনা থেকে অনেক দূরে।
চলবে…