॥পর্ব-৩১॥
আরও কথা ছিল তার সেদিন। বলেছিল—লেখাপড়া আসলে আমাকে দিয়ে হবে না। আমি কমিউনিস্ট। বুর্জোয়াদের মতো কথাবার্তা আমাকে শুনিও না। ওইসব পারিবারিক মান-মর্যাদা রক্ষা করার জন্য তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিক পড়ালেখা আমার দ্বারা করা সম্ভব নয়। একটা কথা মনে রেখো, ভালোবাসলে মানুষ সব করতে পারে।
আমি অবাক হয়ে ভাবতে থাকি—ভালোবাসলে মানুষ যদি সব করতে পারে, তার দায়টা একা আমার ওপরই বর্তাবে কেন? তার ওপরেও তো দায়িত্বটা থাকে—ভালোবাসার মানুষকে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা? একবার ভাবছিলাম রাগের মুহূর্তে বলে গেছেএইসব কথা। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, এসব রাগের কথা নয়। ‘বুর্জোয়া’ কথাটা একটা গালি হয়ে বিঁধতে থাকে আমাকে। দিনের পর দিন এই ‘বুর্জোয়া’ শব্দটা শুনতে শুনতে আমি শ্রদ্ধা হারাতে শুরু করি। বুঝি না—এই সমাজতন্ত্রের কী লক্ষ্য হতে পারে। কী হতে পারে এই সমাজতন্ত্রবাদী সৈনিকের উদ্দেশ্য। যে একজন মানুষকে ভালোবাসে অথচ তাকে জীবনসাথী করার পথে যা যা করণীয়, তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। নিজে উপার্জনক্ষম হওয়ার লক্ষ্যে না চলে লাখ লাখ মানুষের ভাগ আর ভোগের সমবণ্টনে কী করে নিজেকে বিলিয়ে দেবে? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আমার মিলেছে প্রায় দুই যুগেরও অধিককাল পরে। এই বছর দুয়েক আগে। সে কথায় পরে আসি। বারবার এই ‘বুর্জোয়া’ গালিটা শুনতে শুনতে আমার ভবিষ্যতের স্বপ্নটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে থাকে। হল থেকে মাঝে মাঝেই ভাইজানের বাসায় যেতাম আমি। ভাইজান তখন কাজ শুরু করেছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নির্মাণ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটা কনস্ট্রাকশন ফার্মে। রাত করে বাসায় ফেরে। রামপুরার ওই বাসাটা আমার কোনোদিনই ভালোলাগতো না। তার ওপর আমি কখনো রান্নাবান্না করতে পছন্দ করতাম না। ওখানে আমার রান্না করা লাগতো। হলে থাকলে বেশিরভাগ খাবারই ক্যান্টিনে খেয়ে নিতাম। সে যাই হোক, একদিন আবার হলে সন্ধ্যে লাগো লাগো সময়ে হলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। হলে ঢুকে পড়ার আগমুহূর্তে ভাইজান এসে উপস্থিত। দুই-চারটা কথাবার্তার পরই হলের ঘণ্টা বেজে ওঠে। আমি ঢুকে পড়ি হলের ভেতর। বাইরে কী ঘটেছে, আমি তার কিছুই জানি না।
পরদিন সকাল ১০টায় যথারীতি সে আমার ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে কলাভবনে এসে হাজির। আমি রাগ করে আর বাইরে বের হই না। ক্লাস শেষ করে এসে দেখি, বাইরে বসে আছে। তার কাছেই জানতে পারি, গতরাতে সে ভাইজানের বাসায় ছিল। আমার মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। কিন্তু সে জানালো ভাইজান তাকে নিয়ে গেছে তার বাসায়। আদতে কথাটা আমার বিশ্বাস হলো না। আমার ধারণা হলো, তার হাতে নিশ্চয়ই টাকা ছিল না—হলে ফিরে যাওয়ার মতো। বোধ করি, খাবার টাকাও ছিল না। পরদিন আরও মারাত্মক কথা শুনতে পেলাম। সে ভাইজানের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে এসেছে। তারপর থেকে প্রায়ই চলতে থাকে এমন। প্রায় প্রায়ই নাকি সে ভাইজানের রামপুরার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয় আর ভাইজানের কাছে চেয়ে নিয়ে আসে গাড়ি ভাড়ার টাকা। আমি ভাইজানের চক্ষুশূল হতে শুরু করি। আমার পরিবারের প্রতিটি মানুষের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে ওর উপস্থিতি। ভয়ানক হয়ে ওঠে আমার চারপাশ। রুদ্ধশ্বাসে আমি পালানোর পথ খুঁজি। ভাইয়ের কাছ থেকে বোনের কাছ থেকে বাবা মার কাছ থেকে। লজ্জায় মাথা হেট করে থাকি। মুখ তুলতে পারি না মায়ের সামনে। হাসতে পারি না আর প্রাণখুলে। আবৃত্তির গ্রুপে কাজ করতে স্বস্তি পাই না। লেখাপড়ায় তো গোল্লা। থার্ড ইয়ারে হুমায়ুন আজাদ স্যার পড়াতেন ধ্বনিতত্ত্ব। এর ওপর একটা টিউটোরিয়াল পরীক্ষা ছিল পরদিন। স্যার সাধারণত একটা ক্লাসরুমে পরীক্ষার হল বানিয়ে পরীক্ষা নিতেন। কখনো নিজের রুমে টিউটোরিয়াল পরীক্ষা নিতেন না। একে তো ধ্বনিতত্ত্ব একটি ভীষণ কঠিন বিষয়, তার ওপর সারাটা সন্ধ্যা তার সঙ্গে ঝগড়া করে মন খারাপ করা রাত। মৈত্রী হলের আকাশে তারা নেভা রাত। আমি অনেক রাত পর্যন্ত সেই রাতে গাঢ় অন্ধকারের সঙ্গে ছাদে বসে থাকি। রুমে এসে আর পড়তে পারি না। কোনোভাবেই মাথায় কিছু ঢোকে না। বরং যা যা আগে ছিল, তার সব গোলমাল পাকাতে থাকে। কী এক দারুণ অভিমানে রাগে যন্ত্রণায় বিক্ষত হতে থাকে আমার সেই রাত। পরদিন পরীক্ষার হলে যাই। বইপত্র কিছু সঙ্গে নেই না। দেখি ছাত্রছাত্রী—সবাই ডেস্কের নিচে বই রেখে দেখে দেখে লিখছে। স্যার কাউকে বাধা দিচ্ছেন না। নিষেধ করছেন না। বরং স্যার ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর বলছেন:
বাহ। বেশ। সবাই বই দেখে লিখছ। লিখে নাও। লিখে নাও। কিছু নম্বর তো অন্তত যোগ হবে। কিন্তু ঘটে কিছু কি জুটবে? কাজে লাগবে কিছু?
আমি কোনোকালে কারও থেকে কিছু দেখে লিখতে শিখিনি। মৈত্রী হলের পাশাপাশি দুই রুমে থাকতেন বাংলা বিভাগের আমার সিনিয়র দুজন ছাত্রী—করবী আর কাকলী। করবী আমারই রুমমেট ছিলেন। রুম নম্বর ৫০৯। আর কাকলী আপার রুম ৫১০। তাদের বহুদিন দেখেছি একটা বড় নোটের দুটি পাতা ছিঁড়ে নিয়েছেন দুজনে। একটা নোটের অর্ধেকটা একজন মুখস্থ করছেন। বাকিটা অন্যজন মুখস্থ করছেন। পরীক্ষার হলে ভাগ করে লিখবেন। আমি অবাক হয়ে দেখতাম তাদের। কী করে সম্ভব এমন তাই ভাবতাম! আমি বড়জোর বন্ধুরা কাছাকাছি থাকলে মুখে মুখে না জানা কোনো বিষয়ের একটু ধারাণা নিয়ে লিখতে পারি। ব্যস, এটুকু। পরীক্ষার হলে বই খোলার সাহস কোনোকালেই ছিল না। সেদিন সবার মাঝে বসেও তাই বই খুলতে পারিনি। আমি উদাসীন বসে ভাবছিলাম এই মুহূর্তে আমার কী করা উচিত। বইটা কী খোলা উচিত? আমি তো বইও আনিনি। কেউ কি এই সময় আমাকে বই দেবে? আমি কি পারবো পরীক্ষার হলে বসে বই খুলতে? স্যারের সামনে বসে বই দেখে দেখে পরীক্ষার খাতায় লেখা কি আদৌ আমার পক্ষে সম্ভব হবে! ঠিক তক্ষণই স্যারের চোখ পড়ে হঠাৎ আমার দিকে। স্যার বলেন,
কী আশ্চর্য! একজন সাধু দেখতে পাচ্ছি এখানে…
লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে যায়। অভিমানে চোখে জল আসতে থাকে। এসএসসি, এইচএসসিতে দারুণ রেজাল্ট করে মেধা তালিকায় চান্স পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে এক মেয়ে। যে নিজে কোনোদিন স্বপ্ন দেখতে শেখেনি। শেখেনি নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করাই যার লক্ষ্য ছিল। তার ভয়ানক অবনতি। মারাত্মক স্খলন। নিজের চোখে দেখতে আর পারছিলাম না আমি। স্যারের করা স্যাটায়ারটা শূলের মতো বিঁধছিল আমার বুকের ভেতরে আর মাথায়। বিদ্ধ হতে হতে রক্তাক্ত হতে হতে স্যারের কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলাম কী পাচ্ছিলাম না। কিন্তু সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হলে আমি সাদাখাতা জমা দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আসি। এই প্রথম আমার পুরো ছাত্রজীবনে একটা বিরাট শূন্য যোগ হয়। আর তারপর থেকে চলতে থাকে শূন্য থেকে শূন্যে পরিভ্রমণ। কেউ জানে না—সে বিষাদের কথা। কেউ শোনেনি কখনো সে বিষাদের রূপ। অবয়বহীন ‘শূন্য’ আর ভয়ানক এক শূন্যতা একের পর পর গ্রাস করতে থাকে আমার ব্যক্তিজীবন। আমার ছাত্রজীবন। আমার যৌবন। আমার প্রেম। আমার বিরহ। আমার শরীর। এই চরম বিষাদ ক্রমান্বয়ে আধিপত্য বিস্তার করে ক্রম অসীম করে তোলে আমার নীতির বোধ। আজন্ম শিক্ষা রুচি আর চিরকালের ধর্মবোধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একজন নর কিংবা একজন নারী যখন পারস্পরিক ভালোবাসাকে ঠাঁই দেয় ব্যক্তি থেকে বস্তুতে। প্লেটোনিক থেকে পার্থিবে। দুর্লক্ষ্য থেকে নিকটে। নশ্বর থেকে অনশ্বরতায়। আমি তখন আড়ষ্ট। বিরক্ত। বীতশ্রদ্ধ। বিভাজিত। দ্বিখণ্ডিত। নির্লক্ষ্য।
চলবে…
নারী: পর্ব–৩০॥ শাপলা সপর্যিতা