॥পর্ব-৩০॥
‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’—এই অসাধারণ প্রযোজনাটি দুই-একবার মঞ্চস্থ হওয়ার পর গোছানো হলো সব। পরবর্তী সময়ে কোথাও মঞ্চায়নের আগে বার ছয়-সাত টানা রিহার্সেল আর রানথ্রো করেই আমরা স্টেজে উঠতাম। এরপর আরও কম। অর্থাৎ বার দুই রিহার্সেল। ব্যস মঞ্চে উঠে গেলাম। কিন্তু এই প্রযোজনাটির সঙ্গে যুক্ত থাকতে আমার খুব যুদ্ধ করতে হয়েছিল। নিজের ও পরিস্থিতির সঙ্গে। প্রায়ই আমি গ্রুপের কাজগুলোয় মনোনিবেশ করতে পারতাম না। তখন তো প্রথম প্রেম। দেড় দুই বছর তখন। কোনো নিয়মশৃঙ্খলা কিংবা বোঝাপড়ার মধ্যে ছিল না আমাদের জীবনযাপন। উদ্দাম ঝড়োগতির প্রেম। বাঁধনহীন প্রেম। শুরুতেই না পাওয়ার মারাত্মক যাতনায় বিপর্যস্তপ্রায় আমি। হঠাৎ হাওয়ায় উড়ে আসা ধূলোর মতোই কুড়িয়ে নিয়েছি প্রাণ যেন। তবু একটা গোছানো নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের মোহ আমাকে প্রায়ই আচ্ছন্ন করে রাখতো। তাই আমি চাইতাম, নিয়মিত লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পারি যেন। সেও যেন পারে। কিন্তু না, এটা সম্ভব হয়ে উঠছে না। প্রায়ই সে চলে আসে বিনা নোটিশে। যখন-তখন আমাকে নিয়ে বের হয়ে যেতে চায় এখানে-সেখানে। কোনো কোনোদিন হয়তো কোনো গ্যালারিতে চলছে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর স্কাল্পচার এক্সিবিশন। চলো দেখি। কোথাও চলছে মেলা। এসো মেলায় যাই। হাত ভরে কাঁচের চুড়ি কিনে নেয়।
মহিলা সমিতিতে চলছে সেলিম আল দীনের ‘জৈবতী কন্যার মন’ নাটকের শো। সুবর্ণা মোস্তফা আর শিমুল ইউসুফ করছেন কালিন্দীর চরিত্র। চলো চলো…দেখে আসি। আমি এখানে-সেখানে চলে যাই ওর সঙ্গে ঘুরতে। খুব ভালোবাসি দুজনে। খুব ঝাগড়ায়ও লেগে পড়ি যখন-তখন। আবার কোনো কোনোদিন ভর দুপুর রোদেও বসে থাকি মৈত্রী হলের সামনের সেই বিশাল মাঠটাতে। ক্লাসপরীক্ষা কবিতা গ্রুপ রিহার্সেল সব ফেলে। সকাল দুপুর বসে থাকি। দুপুরে ঝা ঝা রোদে বসে বসে গায়ের চামড়া পোড়াই। তাতেও যেন ক্ষতি নেই কোনো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে। নামে সন্ধ্যের আঁধারও। হল থেকে বের হয়ে ছাত্রীরা ক্লাসে যায়। ফিরে আসে। ঘুমোয়। বিকেলে প্রেমিক আসে। সেজেগুজে ঘুরতে বের হয়। আমরা ঠায় মাঠটাতে বসে। অনেক অনেক সোনাঝরা সময় আমার এখনো পড়ে রয়েছে মৈত্রী হলের ঘাসের মাঠে। কখনো ঝোপে ঝাড়ে কাছাকাছি আসা। বড় জোর ঠোঁটে ঠোট। সন্ধ্যে হলে ঘন হয়ে বসা। খানিক স্পর্শ। আরও কাছে আসার, আরও বেশি স্পর্শ করার সবিশেষ সময় যাপন। আমি উঠে পড়তে চাই। রিহার্সেলে যেতে হবে। ‘না যেও না। আর একটু বসো’। আমি বসে পড়ি। আবার কখনো ‘আগামীকাল টিউটোরিয়াল, সানজিদা খাতুনের। এবার হলে ঢুকি পড়ি। পড়তে বসতে হবে যে।’ ‘প্লিজ আর একটু পরে যাও।’ আমি আবার ফিরে আসি। দুজনে হাঁটি, বসি, হাসি, ভালোবাসি কাছে আসি ভেঙে পড়ি। এভাবেই চলে জীবনের সব লেনদেন। কোনো কোনোদিন ভাবি ছটায় যেমন করেই হোক রিহার্সেলে ঢুকবো। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে না। একদিন এদিক সেদিক বেড়িয়ে ঘুরে দুজনে টিএসসির গেটে ধরা খেলাম হাসান আরিফ ভাইর কাছে।
-শাপলা, রিহার্সালে এলেনা যে?
আমি হঠাৎ কী উত্তর করবো, কিছু বুঝে না উঠতে পেরে বলে উঠলাম, সময় করে উঠতে পারিনি আরিফ ভাই।
আরিফ ভাইকে দেখেছি সবসময় খুব ঠাণ্ডা আর হালকা মেজাজে রসিকতা করতে। দারুন দারুণ কঠিন আর ভারী ভারী কথা তিনি হাসতে হাসতে এত সহজভাবে বলে যান। সেদিন তাকে বেশ গম্ভীর দেখালো। কেবল একটি কথা বললেন:
শাপলা, একটা কথা বলি তোমাকে, মনে রেখো। সময় কখনো হয়ে ওঠে না। সময় বের করে নিতে হয়।
কথাটা বলার পর আবার তার সেই স্বাভাবিক ভঙ্গির হাসি ঠোঁটের কোণায় দেখা দিল। তার এইটুকু কথা পরবর্তী জীবনে ভীষণ কাজে দিল আমার। তার এইটুকু কথা ভীষণ ভাবান্তর নিয়ে এলো আমার জীবনপ্রবাহে। সারাজীবন এমনকি এখনো আমি প্রায় প্রায়ই কানে শুনতে পাই তার সেই কথা—‘সময় কখনো পাওয়া যায় না, সময় করে নিতে হয়’। আবৃত্তিরকার হিসেবে তার এক্সপেক্টেশন আমার কাছে ছিল যথেষ্ট! আর তিনি ঠিকই দেখতে পাচ্ছিলেন আমি কী করে নষ্ট করছিলাম আমার সময়! তারপর দিনের মহড়াতে আমাকে ছুটি দেওয়া হয় এই অজুহাতে যে, আমার অংশটি যেহেতু আমার মুখস্ত হয়ে গেছে, আমি যেহেতু নির্মাণটি করে নিতে পেরেছি, অতএব আমার প্রতিদিন মহড়ায় না থাকলেও চলবে। নিজে নিজে চর্চা করে আমি যেন রেডি হয়ে যাই। তবে রানথ্রোগুলোতে যে করেই হোক আমাকে উপস্থিত থাকতেই হবে। তা না হলে আমাকে স্টেজে উঠতে দেওয়া হবে না। পাশাপাশি সানজিদা সোহেলী আপাকে রেডি করা হয়েছিল আমার অলটারনেটিভ। বিশেষত সোহেলী আপা আর আমার কণ্ঠস্বর খানিকটা কাছাকাছি যায়। আর পড়ার ধরনেও বেশ মিল রয়েছে। আমি জানি সেটা গ্রুপ কতটা আশাহত হয়ে করেছিল আমার ইনসিনসিয়ারিটির কারণে। এ নিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া। প্রায়ই এমন করে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় চলে আসাটা আমার পছন্দ না।
প্রায় শেষ হতে চললো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বছর। আগের দিন বলে গেছে আগামীকাল সকাল দশটায় পরীক্ষা। টিউটোরিয়াল। দেখি বেলা ১১ টায় সে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের সামনে, ‘কী ব্যাপার? তোমার না পরীক্ষা’। ‘হ্যাঁ’—খুব সহজ তার উত্তর।
তাহলে এখন তুমি এখানে কী করে এলে? —আমার প্রশ্নে সে এতটুকুও বিচলিত নয়। উত্তর দেয়—আমি খাতা কেটে এসেছি তো।’
খাতাকাটা—শব্দটা আমি প্রথম শুনি। প্রশ্ন করি, মানে কী? আরও সহজ তার উত্তর ‘জানো না? আমার প্রিপারেশন ভালো না। প্রিপারেশন ভালো না থাকলে খাতা কেটে চলে আসা যায়। পরে আবার ওই পরীক্ষাটা দেওয়া যায়।’ আমি ফের প্রশ্ন করি ‘এভাবেই চলবে’? তার উত্তর এমন, ‘আরে নাহ। বারবার কি এমন করা যাবে?’ কিন্তু যথারীতি এমনই চললো। পড়াশোনা পরীক্ষার ধারে কাছে নেই। সঙ্গে আরও বিষয় যোগ হতে থাকলো। প্রায়ই আমাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য জোর করা একটা নিত্যনৈমত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। আমার বরাবরই বাস জার্নিতে ভীতি। বাসে উঠলেই পেট্রোল পোড়ানো গন্ধে আমার বমি আসে। বাসে চড়ে অভ্যেস নেই তেমন। এছাড়া বাসে উঠতে পারবো কি না। ঠিকমতো নামতে পারবো কি না, এই ফোবিয়া আজও আমায় ভীষণ অস্থির করে। সে আমায় শিখিয়ে দিতো। ছুটির দিনে সকালে নীলখেতের কোন গাড়িতে কিভাবে উঠতে হবে। আর জাহাঙ্গীর নগর কোথায় কোন গেটে নেমে পড়তে হবে। সে দাঁড়িয়ে থাকবে সেখানে। আমি বলতাম ‘আচ্ছা’। আর ঠিক পরের দিন যেতাম না। তাতে বিকেল নাগাদ আমার হলে এসে ভীষণ ঝগড়া। সারাদিন না খাওয়া। আমি বিমর্ষ হয়ে তাকে ধরে নিয়ে যেতাম খাওয়াতে। কোনোদিন মাসের শেষে হাতে টাকা পয়সা না থাকলে রুমেই রাঁধতে বসতাম। সে বসে থাকতো বাইরে ঘাসের মাঠে। আমি রুমে রান্না করে ভাত তরকারি প্লেটে নিয়ে নিচে নামতাম। চলে যেতাম স্যোসাল ওয়েল ফেয়ারের পেছনে সেই আধোভাঙা দেয়ালের কোণে।
এমনি একদিন ভর দুপুর। উদ্ভ্রান্তের মতো হলে এসে উপস্থিত। সকাল থেকে না খাওয়া। ওকে দেখে আর সকালে না খাওয়ার কথা শুনে খুব মায়া হলো। রাগ হলো ওর বাবার ওপরও। এই লোকটির একটি মাত্র মামরা ছেলে। ওর কাছে শুনেছি তার অনেক টাকা সম্পত্তিও নাকি আছে। তবে যে ছেলেটি ঘুরে বেড়ায় তার বাউণ্ডুলের মতো, অর্থকষ্টে থাকে, তিনি কী কিছুই খেয়াল করেন না? কিন্তু এ কথা আমি মুখে বলতে পারি না। মা-হারা বাউণ্ডুলে ছেলেটির জন্য এই একটা জায়গার মায়া আমি কাটাতেই পারতাম না। সেদিনও ওকে ঘাসের মাঠে বসিয়ে রেখে আমি রান্না করতে বসেছি ৫০৯ নম্বর রুমের হিটারে। আমার হাতে টাকা নেই। বাইরে খেতে যাওয়ার মতো। কিংবা তাকে ধরিয়ে দেওয়ার মতো। ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর একটা আইসক্রিমের বাক্স করে ভাত তরকারি চামচ নিয়ে নিচে নেমে আসি। সোস্যাল ওয়েল ফেয়ার ডিপার্টমেন্টের সেই আধো ভাঙা দেয়ালের আড়ালে গিয়ে খাবার বের করি। গোগ্রাসে খেতে লাগে। আমি খাওয়া দেখি। কথায় কথায় জানতে পারি, আজও তার পরীক্ষা ছিল। আর সে পরীক্ষায় এটেন করেনি। এই নিয়ে শুরু হয় ঝগড়া। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। আর তারই এক পর্যায়ে সে ছুড়ে মারে ভাত-তরকারি। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত হয়ে যাই। দূরে তাকিয়ে দেখি সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের বেশকিছু ছেলে-মেয়ে উঁকি মেরে দেখছে এই ঘটনা। একের পর এক পরীক্ষা না দেওয়া। ভীষণ রকমভাবে তার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া আর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদাসীনতা আমাকে চরম বিধ্বস্ত অবস্থার সম্মুখীন করে তোলে। তার ওপর আজকের এই অনভিপ্রেত ঘটনা—আমার আজীবন রুচি আর শুদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে যা একেবারেই যায় না। আমি দারুণভাবে আশাহত হতে শুরু করি। আমার পারিবারিক আবহে তাকে নিয়ে আসতে হলে অবশ্যই তাকে সাবলম্বী হতে হবে। একে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন চলছে মারাত্মক রকম সেশনজট। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছু মোটামুটি গুছিয়ে চলছে–পরীক্ষাগুলো ঠিকঠাক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হরতালের মাঝে ছুটির দিন করে পরীক্ষাগুলো নিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
আমার চেয়ে সে এমনিতেই পিছিয়ে রয়েছে। আছে ওদের পারিবারিক সমস্যা। আমার পরিবার স্বাবলম্বী এডুকেটেড ছেলে ছাড়া কোনোভাবেই মেনে নেবে না। তার ওপর ওর প্রতি ভাইজানের বিরূপ মনোভাব। আমি দিশেহারা হতে থাকি। কী করে তাকে আমার পরিবারের যোগ্য করে তুলবো! সে চেষ্টায় আমি প্রাণপাত করি। কিন্তু আমার একার পক্ষে এই বেয়ারা ভবঘুরেকে আদৌ কি ঠিক পথে আনা সম্ভব? আমি ভয় পেতে শুরু করি। আমি শঙ্কিত হই। অবশেষে প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়ি তার কিছু কথায়। তাকে একদিন বলছিলাম, ‘প্লিজ লেখাপড়াটা ঠিকমতো করো। নিজের পায়ে দাঁড়াও। না হলে আমি বাসায় কী বলবো সবাইকে?’ ভীষণ রুঢ়ভাবে সে আমাকে স্থবির করে দিয়ে বললো, ‘তুমি একজন বুর্জোয়া। তোমার ভাবনা-চিন্তা সব বুর্জোয়াদের মতো’। আমি বিস্মত হতবাক…
চলবে…