[পর্ব-৫]
মেয়েকে খুব ভালোবাসে বাদল। মেয়ে অন্তপ্রাণ। অরুন্ধতীর প্রতি তার দুর্বলতা সীমাহীন। এমনকি তিতলিকে পর্যন্ত সে ভরসা করতে পারে না মেয়ের কোনো ব্যাপারে। বাসায় থাকলে তিতলির গোসল, খাওয়া-পরা, লেখা-পড়া সব দিকে কড়া নজর তার। মেয়েও বাবান্যাওটা ভীষণ। শুধু তার আর বাদলের কোনো সমস্যা হলে, বিশেষ করে লতিফা বানু বেঁচে থাকা অবস্থায় যখন তিনি কোনো সমস্যায় আরও ফোড়ন দিতেন, তখন বেঁকে বসতো মেয়ে। তখন সে বরাবর মায়ের পক্ষ নিতো। ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে তিতলি। এটা কি মেয়েদের সহজাত ঈর্ষার কারণে? অরুন্ধতী কি অবচেতনে লতিফা বানুকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতো? সে কি নিজেরই অগোচরে বুঝে নিয়েছিল, তার বাবার ভালোবাসার একজন বড় অংশীদার লতিফা বানু? না কি স্রেফ তিতলিকে অপছন্দ করতেন বুঝেই অরুন্ধতীর মধ্যে তৈরি হয়েছিল লতিফা বানুর প্রতি বিরুদ্ধভাব, অপছন্দবোধ! তিতলি বিষয়টার কোনো কিনারা করতে পারেনি ভেবে।
অফিসে হঠাৎই দুপুরটা একটু ফাঁকা পেয়ে যায় দীপন। বিদ্যুৎ নেই। সে কারণে নেট লাইন অফ থাকায় বেকার বসে থাকে কিছুক্ষণ। চা খায় এককাপ। সিগ্রেট টানে আয়েশ করে। ফোনে তুলির সঙ্গে কথা বলে। বাসায় ফোন করে রতনের খবর নেয়, রুমকীর সঙ্গে ফোনে খুনসুটি করে একটু। তারপর হঠাৎই কেমন একটু ফাঁকা, নির্জন হয়ে ওঠে দুপুরটা। কেমন একটু উদাস, উতল। আর তখনই দুম করে মনে পড়ে তিতলির কথা। পাগলিটাকে সেদিন খুব করে বকার পর আর সে ফোন দেয়নি এই ক’দিন। একটু খারাপ লাগে দীপনের। বুকের মধ্যে কেমন নরম একটা ডাহুক কুপ কুপ ডেকে উঠে নীরব হয়ে যায় আবার। কেমন একটু অপরাধী মনে হয় নিজের কাছেই নিজেকে। তিতলি তো সে অর্থে তার কাছে চায় না কিছুই। শুধু দীপনেরই অবসর মতো সময়ে সে কথা বলতে চায় দীপনের সঙ্গে, চায় একটুখানি হৃদয়ের লেনদেন। সে দীপনের কাছে অর্থ চায় না, বিত্ত চায় না, দীপনের সংসারে কোনো অশান্তির কারণ হতে চায় না, শুধু চায় দীপনের মনের মধ্যে একটু আলো জ্বলুক তার জন্য। একটু উষ্ণতা জমুক তার জন্য দীপনের হৃৎপিণ্ড প্রকোষ্ঠে। সে আলো কি জ্বলেনি দীপনের মনে? জ্বলেছে। তিতলির লাগামছাড়া বোধ আর পাগলামি দেখে নিজের অজান্তেই তিতলির প্রতি গভীর এক বোধ জন্মেছে দীপনেরও মনে। কিন্তু তার একটা সংসার আছে, সে কারও স্বামী, কারও বাবা, কারও ভাই, কোনো অফিসের অধীনস্ত সে। তার সময় মাপা। তার জীবন বাঁধা। সে কথা বুঝতে চায় না তিতলি। সে শুধু বলে, তোমার সময় হলেই আমার সঙ্গে কথা বলো! আর কিছু চাইছি না তো!
বোকা মেয়ে! মনে মনে বলে দীপন। সব বোঝে শুধু এটুকু বুঝতে চায় না যে, তার সময়ের সঙ্গে দীপনের সময়টা মেলে না, মিলবে না কোনোদিন। কিন্তু তিতলির জন্যে বুকের মধ্যে টলটলে, স্বচ্ছ এক জলের ধারা বয়, টের পায় সে। সংগোপনে সেটা সে লুকিয়ে রাখে নিজের থেকেই, তিতলির থেকে আরও বেশি। কিন্তু তিতলি নারী। ঈশ্বরী! সে ঠিক টের পেয়ে যায় দীপনের বুকের মধ্যে তার জন্য নামা ঝরণা ধারা। সে তাই অহর্নিশি চেষ্টা চালায় সে ঝর্ণায় ডুবতে, বোঝে না তাতে দীপন। খেই হারিয়ে ফেলে, তাল ভুলে যায় হঠাৎ।
তিতলির জন্য বুকের মধ্যে ঝর্ণাটা যেন আজ বেশিমাত্রায়ই চঞ্চল হয়ে ওঠে দীপনের। কেমন আছে পাগলিটা? ক’দিন হলো অভিমানে চুপ হয়ে গেছে একদম। ফোন করেনি আর সেদিনের বকা খাওয়ার পর। আস্তে ফোনটা হাতে নেয় দীপন। তিতলির নাম্বারে রিং দেয়। ফোন বাজে, ধরে না তিতলি, কেটে দেয়। একবার, দুই বার। ফোন ধরে না দেখে এবার মেসেজ দেয় দীপন, ফোন ধরছ না কেন? ফোনটা ধরো!
মেসেজ সেন্ট দেখাতেই আবার ফোন দেয় দীপন। এবার ফোন ধরে তিতলি। হ্যালো!—অভিমানে কাঁপা, কান্না লুকানো কণ্ঠ।
হেসে ফেলে দীপন। পাগলি। পঁয়ত্রিশের কোটা ছুঁয়েছে বয়স, তবু যদি একটু তার ছাপ থাকে তিতলির আচরণে! যেন কিশোরী এক মেয়ে সে, দীপনও সদ্য গোঁফ ওঠা এক সরল কিশোর, প্রথম প্রেমে পড়েছে তারা! তিতলির তেমনই রকম-সকম!
হাসতে হাসতেই দীপন বলে, কী ব্যাপার? তুমি ফোন ধরছ না কেন?
—আমার ইচ্ছে!
—ও আচ্ছা! তোমার ইচ্ছে! তাই তো! তাহলে বরং আর কথা বলে কাজ নেই, ফোন রেখে দেই এখন, কেমন?
চুপ হয়ে যায় তিতলি। উত্তর দেয় না কোনো। ফোনে তার মৃদু ফোঁপানির শব্দ কি শুনতে পায় দীপন? না কি মনের ভুল তার!
—কী? রেখে দেই তাহলে ফোন! তোমার কথা বলার ইচ্ছে নেই যখন!
—খুন করে ফেলব তোকে! ঠ্যাং ভেঙে ফেলবো তোর! ফাজিল!
—কাঁদতে কাঁদতে বলে তিতলি। শব্দ করে হেসে ওঠে দীপন। হাসতে হাসতে বলে, কী যে সব পাগলামি করো তুমি! কোনোদিন কি বড় হবে না আর?
—না, হবো না, তুই বড় হ, বড় হয়ে আকাশে উঠে যা!
—কী ব্যাপার, তুমি হঠাৎ এত লক্ষ্মীমেয়ে হয়ে গেলে যে? ক’দিন আর ফোন টোন করছ না আমাকে একদম! নতুন কারও প্রেমে পড়েছ না কি?
—ফাজলামি করবে না একদম!—ধমকে ওঠে তিতলি। তুমিই তো বলেছ, তোমাকে আর ফোন না করতে! আমি ফোন না করলে ভালো থাকো তুমি, বলোনি?
—তাই নাকি? বলেছি নাকি? আর কী কী বলেছি বলো তো! একটু মনে করিয়ে দাও, বয়স হচ্ছে তো, আজকাল বড্ড ভুলে যাই!
তিতলি রেগে আগুন হয়ে ওঠে। তাকে শান্ত করে দীপন। কথা বলে অনেকক্ষণ। তিতলির শাশুড়ি মারা গেছেন হঠাৎ, সে কারণে ব্যস্ত ছিল সে। এবার তিতলিকে আরও একটু রাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করে দীপনের। সে দুঃখিত গলায় বলে, ওহ! তা্-ই বলো! তোমার শাশুড়ি মারা যাওয়ায় তুমি ব্যস্ততার কারণে আমাকে ফোন দাওনি! আমি আরও ভাবলাম আমার ওপর অভিমান করে আছ, বিরহে পুড়ছ, তাই না তোমার অভিমান ভাঙাবো বলে ফোন করলাম!
—কে তুমি? পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে তোমার ওপর কেন অভিমান করতে যাবো আমি! ভীষণ সিরিয়াস কণ্ঠে বলে ওঠে হঠাৎ তিতলি। এই এক সমস্যা মেয়েটার। নিজে সে ঠাট্টা করে ইচ্ছেমতো, কিন্তু তার সঙ্গে কেউ ঠাট্টা করতে গেলেই হুট করে সিরিয়াস হয়ে যায়।
—তাই তো! আমি তো কেউ নই তোমার! তাহলে কাঁদছ কেন?
—আমার ইচ্ছে আমি কাঁদব, তোর কী?
এমন পাগলের সঙ্গে আলাপ চালান মুশকিল, বিশেষ করে অফিসে। অগত্যা প্রসঙ্গ পাল্টায় দীপন।
—অরু কেমন আছে?
—ভালো আছে। তুমি কেমন আছ দীপন? খুব ভালো আছ আমাকে কষ্টে রেখে?
প্রশ্নটা এড়িয়ে যায় দীপন। বলে, কোথায় তুমি? অফিসে?
—হ্যাঁ, তুমি?
—অফিসে।
—কী করছ? কাজ নাই এখন?
—না, বিদ্যুৎ নাই তো। নেট কাজ করছে না।
—সেজন্যই ফোন করেছ, না দীপন? নইলে করতে না, না?
—হয়তো করতাম! হয়তো করতাম না!—হেঁয়ালিপূর্ণ উত্তর দেয় দীপন।
—কিপ্টুস কোথাকার! ঠিকমতো উত্তরটাও দেয় না!
—বাদল কেমন আছে?
—আছে। যেমন থাকা যায় এ সময়। তুলি কেমন আছে? রুমকী, ভাইয়া?
—ভালো আছে সবাই। ভাইয়া আবার সুস্থ হয়ে উঠছে মনে হয়। অনেকটা স্বাভাবিক আচরণ করছে এখন সবার সঙ্গে। ক’দিন হলো রুমকীকে স্কুল থেকে নিয়ে আসছে নিয়ম করে।
—তাই না কি! বাহ্! খুব ভালো! তবু রুমকীকে একটু সাবধানে রেখো। ভাইয়ার তো আসলে নিয়ন্ত্রণ নাই নিজের ওপর।
—সেই। ময়নাকে বলা আছে। ও খেয়াল রাখে। ড্রাইভারকেও বলে রেখেছি। তুলিও ভয় পায় খুব। ভাইয়াকে ঠিক ভরসা করতে পারে না।
—স্বাভাবিক।
—কী করছিলে? এত বকবক করলে অফিসে কাজ করো কখন?
—এ সময় আমার কাজ থাকে না তেমন। পেপার পড়ছিলাম। অমনি তুমি ফোন দিলে।
—ফোন ধরছিলে না কেন?
—জানো না, কেন?
—রাগ কমেছে?
—হু।
—আমার সোনা। আদর। ব্যস্ত থাকি তো, সব সময় অমন বিরক্ত করলে কাজে মন বসাতে পারি না, বোঝো না কেন?
—স্যরি। আর করবো না।
—হাহাহা! শব্দ করে হাসে দীপন। বলে, কে ফোন করবে না? তুমি? মনে থাকবে তোমার? কুকুরের লেজ সোজা হয় কখনো?
হেসে ওঠে তিতলিও। বলে, এই, আমি কুকুরের লেজ?
—নও তো কী? এত যে বকি, তবু যে কে সেই! কিচ্ছু মনে থাকে না। আবার সেই অস্থিরতা, আবার সেই বিরক্ত করে মারা!
—আর করব না! দেখো তুমি!
—আচ্ছা দেখব। এখন রাখি?
—আচ্ছা, রাখো। ফোন করো। ভালো থেকো।
—তুমিও ভালো থেকো। ছাড়ছি। বাই।
—বাই।
ফোনটা রেখে আরেককাপ চা খায় দীপন। ফুরফুরে লাগে। বুকের ওপর চেপে থাকা পাথরটা নেমে গেছে কখন। তিতলির মুখটা ভেসে ওঠে মনে। এই বয়সেও এত অবুঝ কেন মেয়েটা কে জানে! বোকা মেয়ে! মনে মনে বলে ওঠে আবার।
চলবে…