[পর্ব-১৮]
বারান্দায় বই হাতে বসেছিল রতন। বেলা পড়ে এসেছে। রুমকীটা সামনের খোলা জায়গাটাতে খেলছে একা একা। তুলির বাগানের শখ। বাড়ির সামনের একচিলতে খোলা জায়গায় সে বেশ কিছু ফুলের গাছ লাগিয়েছে। ময়না প্রতিদিন দুই বেলা জল দেয় তাতে। তুলি-দীপনও সময় পেলেই যত্ন নেয়। রতনও সুস্থ থাকলে বাগানটাতে বিকেলে সময় দেয়। হরেক রকম ফুল, প্রজাপতি। মন ভালো হয়ে যায় অজান্তেই। আজকাল রতন বেশ পড়তে পারে। মাথাব্যথাটা নেই তেমন। ডাক্তারের ওষুধে কাজ দিয়েছে। মাথার মধ্যে ঝিঁঝিটারও কোনো সাড়াশব্দ নেই আর। ঘুমিয়ে আছে। হুট করে জেগে উঠবে কোনো একদিন। রতন জানে। বরাবরই এমন হয়। হঠাৎ একদিন ঝিঁঝিটা ঘুমিয়ে যায়। রা করে না আর কোনো কিছুতেই। যেন তার কোনো অস্তিত্বই নেই আর। পুরোপুরি লাপাত্তা হয়ে যায় রতনকে একা ফেলে। রতনের মাথার মধ্যে তখন এক অনন্ত শূন্যতা এসে ভর করে। ভীষণ ফাঁকা লাগে পৃথিবীটা। মাথাটা ভারশূন্য মনে হয় একদম। তারপর একটু একটু করে মনে পড়তে থাকে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন। একে একে সব এসে জড়ো হতে থাকে স্মৃতির পাতায়। শুধু ধারাবাহিকতা থাকে না কোনো। মাঝে মাঝে নিজেকে শৈশবে খুঁজে পায়। সেখানে মা থাকেন, বাবা থাকেন, থাকে সে আর দীপন। বাবা একমনে বারান্দায় পেতে রাখা টুলটায় ব’সে পত্রিকা পড়ছেন, মা উঠোনের এককোণে বসে রান্না করছেন। পাশে ডাঁই করে রাখা লাকড়ি। বাবার পাশে অদূরে পাটি পেতে বসে সে আর দীপন। দীপন সুর করে নামতা মুখস্থ করছে। আর সে নিজে একমনে ঝুঁকে অঙ্ক মেলাচ্ছে। কখনো দেখে তাদের বাড়ির পাশের বড় খেলার মাঠটাতে বিকেলে তুমুল ফুটবল ম্যাচ চলছে। ঝাঁকড়া বটগাছটার ছড়িয়ে পড়া নিচু ডালগুলোর একটাতে বসে সমবয়সি আরও ক’জনকে নিয়ে সে খেলা দেখছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে কেমন ছাইরঙা অন্ধকার মাথায় নিয়ে। ঝাঁক ঝাঁক পাখি উড়ছে কিচির মিচির শব্দ তুলে। দীপনটা মারামারি করে কোত্থেকে কাঁদতে কাঁদতে এসে বটগাছটার নিচে দাঁড়ায়। মুখ তুলে রতনের দিকে তাকিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, ভাইয়া, দেখ না বিলু আমাকে মেরেছে। কত রক্ত পড়ছে দেখ!
রতন নিচে তাকিয়ে দেখে। দীপনের মুখ বেয়ে রক্ত নেমেছে গলগল। আহ্। কত রক্ত। লাফ দিয়ে সে বটগাছটার ডাল থেকে নেমে পড়ে নিচে। দীপনকে টেনে নেয় বুকের মধ্যে। রক্তে ভেসে যায় তার বুক। দীপন ডুকরে কেঁদে ওঠে আরও। ভাইয়া…!
কখনো দেখে ভার্সিটিতে ক্লাশ করছে। ক্লাশে ইকবাল স্যার পড়াচ্ছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স। জটিল জটিল সব অঙ্ক। হিসাব। গভীর মনোযোগে শুনছে রতন। ইকবাল স্যার তাকে অতিরিক্ত স্নেহ করেন। তাকে লক্ষ করেই ক্লাশে বক্তৃতা দেন তিনি। মাধবী। সে-ও পাশের চেয়ারে বসে হা ক’রে গিলছে রতনকে। ক্লাশে পিনপতন নিরবতা। শুধু ইকবাল স্যারের কণ্ঠ ভাসে ইথারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে জল ক’রে ক্লাশে ছেড়ে দেন তিনি। ছাত্র-ছাত্রীরা ডুবে যায় তাতে। তিনি তাদেরকে সাঁতার সেখান। তিনি বলে চলেন, মহাশূন্য আসলে শূন্য নয়, প্রতিটি মুহূর্তে এতে সৃষ্টি হয়ে চলেছে কণা, প্রতিকণা, একইভাবে চলছে ধ্বংসও…
কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে রতনের। একইভাবে তার মাথার মধ্যেও সৃষ্টি হতে থাকে বিস্মৃতি থেকে একটু একটু ক’রে জন্ম নেয়া নানা স্মৃতি, ধ্বংসও হতে থাকে মুহূর্তের মধ্যেই। মাথাটাকেই বিশাল এক মহাশূন্য মনে হয় তার, নিউরোনগুলো যেন একেকটা ব্ল্যাকহোল। টুকরো টুকরো স্মৃতিকণাগুলো আছড়ে পড়ে নিউরোনের খুব কাছাকাছি, তখন স্মৃতিগুলো একে অন্যকে ধ্বংস করার প্রতিযোগিতায় মাতে। হারিয়ে ফেলে কাণ্ডজ্ঞান। কোনোটা চলে যায় নিউরোনের ভেতরে, কোনোটা আবার মুহূর্তেই হারিয়ে যায় দূরে। তখন তুমুল রেডিয়েশন হয় নিউরোনের কোষগুলোতে। মাথার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা ঝিঁঝিপোকাটা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে হঠাৎ। ডেকে ওঠে ভীষণ সুরে। আর তখনই তালগোল পাকিয়ে যায় তার মাথার ভেতর। পুরোপুরি পাগল হয়ে যায় সে তখন।
যখনই যৌবনের স্মৃতিগুলো ফিরে আসতে থাকে তার, ঝাপসা থেকে স্পষ্ট হতে থাকে একটু একটু করে, তখনই বুঝতে পারে রতন, ঝিঁঝিটার ঘুম এবার ভাঙলো বলে। সে পাগল হতে চলেছে আবার। তবে এবার রতনের সে-সব স্মৃতিগুলো এখন পর্যন্ত হানা দেয়নি সেভাবে। ফলে বেশ খানিকটা সময় আছে তার হাতে। রুমকীকে কথা দিয়েছে, আর সে পাগল হবে না কখনো। কথা রাখতে হবে তাকে। কথাটা ভেবেই কপাল কুঁচকে ওঠে তার। রুমকী? রুমকীটা যেন কে? সামনের বারান্দায় চোখ পড়তেই অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে রতন। হেসে ফেলে ফিক করে। তার মা খুশবু বেগম! অদ্ভুত তো! খুশবু বেগম অমন ছোট্ট মেয়েটি হয়ে গেলেন কেন হঠাৎ? ফ্রক পরা, মাথার দুই পাশে বেণী ঝোলানো খুশবু বেগম গোলাপি রঙা একটা চপ্পল পায়ে প্রজাপতির পেছনে ছুটছেন! ভারি মজা তো! রতন হাসতে হাসতে বলল, মা! ও মা! তুমি কী করছ এসব?
ছুটতে ছুটতেই খুশবু বেগম ব্যস্ত গলায় বললেন, প্রজাপতি ধরছি কাকা! তুমিও ধরবে এসো! দেখ কত্ত প্রজাপতি এসেছে আজ বাগানে!
রতন একটু থমকায়। থতমত খায়। খুশবু বেগম তাকে কাকা ডাকছে কেন? ছেলেকে বুঝি কেউ কাকা ডাকে? রতন মনে করার চেষ্টা করে, না, মা তো তাকে বাবা ডাকে বরাবর! তাহলে? সে আবার ডাকে, মা! ও মা!
খুশবু বেগম বিরক্ত গলায় বলেন, কাকা! ডাকছ কেন? তুমিও আসো না! প্রজাপতি ধরে দাও আমাকে!
দুম করে মনে পড়ে তখনই। আরে! ও তো রুমকী! দীপনের মেয়ে! আহা! কী মিষ্টি দেখতে হয়েছে মেয়েটা! অবিকল খুশবু বেগম। তাদের মা। মুহূর্তেই মাথার ভেতর থেকে অন্ধকার সরে যায় দীপনের। বইটা পাশের টেবিলে রেখে পায়ে চটি গলাতে গলাতে বলে, এই তো মা! আসছি দাঁড়াও!
রুমকী একটা প্রজাপতির পেছনে সেই তখন থেকে ছুটে মরছে। কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না দুষ্টুটা। রতন গিয়ে দাঁড়াতেই কোমড়ে হাত রেখে রুমকী বলে, ঐ যে কাকা, দেখতে পাচ্ছ, ঐ নীল আর জাফরান রঙের বড় প্রজাপতিটা? দেখেছ?
হ্যাঁ মা। দেখেছি তো।
ওটা ধ’রে দাও আমাকে। কিছুতেই ধরা দেয় না জানো তো! ভারি দুষ্টু! ধরতে গেলেই দৌড়ে পালায়। তুমি ধ’রে দাও না কাকা! ও কাকা!
রুমকীর কণ্ঠে অনুরোধ ঝ’রে। রতনের বুকের ভেতর স্নেহের ঢেউ কেমন পাক খেয়ে ছড়িয়ে যায়। রুমকীর মাথায় হাত রেখে সে হাসে। বলে, দূর পাগলী! এভাবে কি প্রজাপতি ধরা যায় কখনো!
তাহলে কিভাবে ধরা যায় কাকা? তুমি দাও না ধরে!
প্রজাপতি ধরতে হয় লাঠি দিয়ে। একটা লাঠির মাথায় আঠা লাগিয়ে প্রজাপতিটার আশেপাশে রাখতে হয়, তখন প্রজাপতিটা টুপ করে এসে লাঠির ডগায় বসে। ব্যস। তারপর আটকে যায় আঠায়। তখন আর উড়তে পারে না। তখন ধরে ফেলতে হয়।
রুমকীটা কতক্ষণ রতনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী একটা দেখে। খোঁজে কিছু একটা। তারপর উজ্জ্বল, হাসিমুখে বলে, তুমি ভালো হয়ে গেছ একদম, না কাকা?
হ্যাঁ মা। একদম ভালো হয়ে গেছি।—বলে রুমকীকে কাছে টেনে নেয় রতন। আদর করে সস্নেহে। রুমকী গ’লে যায়। কণ্ঠে আবদার ঢেলে বলে, তাহলে দাও না প্রজাপতিটাকে ধরে, ও কাকা! দাও না!
আচ্ছা মা! দেব তো! কিন্তু আজ তো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আজ আর ধরা যাবে না মা। কাল ধরব আমরা প্রজাপতি, কেমন?
রুমকী কী একটা ব’লে প্রতিবাদ করতে যায়। তার আগেই গেটে গাড়ির শব্দ। তুলি ফিরল অফিস থেকে। সন্ধ্যাও হয় হয়। তুলি গাড়ি থেকে নেমে বাগানেই আসে সোজা। রুমকীকে আদর করে একটু। রতনের খোঁজ-খবর নেয়। বাগানের গাছগুলোতেও চোখ বুলোয় স্নেহের। তারপর রুমকী আর রতনকে ভেতরে যাওয়ার তাড়া লাগিয়ে নিজে ঢুকে পড়ে টুপ ক’রে। রুমকীর চোখ তখনও প্রজাপতির দিকে। কোথায় গেল দুষ্টুটা? নেই তো! পালিয়েছে! দূর! মনটাই খারাপ হয়ে যায় হঠাৎ। কাল আবার আসবে কি-না কে জানে! কাকাটা যে কী! আজকে ধরলে কী এমন হতো! ভাল্লাগে না! বড়রা কেন যে এত অবুঝ হয়! কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি থাকে না এদের! যত্তসব! মন খারাপ ক’রে কাকার হাত ধ’রে ঘরে ফেরে রুমকী। ততক্ষণে গাঢ় হতে শুরু করেছে অন্ধকার।
চলবে…
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-১৭॥ শিল্পী নাজনীন