মেঘনার স্রোত যেখানে শিবের নাচের ঘূর্ণি তুলে ওপর থেকে তলদেশের দিকে ডুব দেয়, সেই বাঁক থেকে এক নিশ্বাসের দূরত্বে বনদেবীর আশীর্বাদের ছায়াঘেরা ভাটিরটেক জঙ্গল। সেই জঙ্গলের খুব কাছেই নদীর পাড়ের ওপর ঢেউ আছাড়ি-পিছাড়ি খায়। আর মুহূর্তেই ছিনতাইকারীর মতো হেঁচকা টানে বনের একটু একটু অংশ নিজের উদরে চালান করে দেয়। নদীভাঙনে ভাটির টেক কমতে থাকায় এই জঙ্গলে কখনো দ্বিপদী প্রাণীর পদচিহ্ন পড়ে না।
অতীতে কখনো কোনো দ্বিপদী প্রাণীর পদচিহ্ন পড়েছে কি না, মনে কতে করতে পারে না, প্রবীণ কচ্ছপ-শেয়ালও। এমনকি খোদ পশুরাজ সিংহেরও মনে পড়ে না। তবে সম্প্রতি শেয়াল, বানর ও ছাগল দেখেছে মাঝেমাঝে জলযানে দ্বিপদী প্রাণীরা আসে জঙ্গলে। এসেই হরিণ, বুনো মহিষ শিকার করে। এরপর রাত্রি নেমে আসার আগেই তারা চলে যায়।
বনদেবীর আশ্রয়ে থাকা এই পশুরাজ্যের প্রতিটি সদস্যই নিজদের জীবন-যাপন নিয়ে বেশ খুশি। পশুরাজ সিংহ অকারণে প্রাণিহত্যা করে না। অন্যকেও সেই সুযোগ দেয় না। পশুপাখি তো পশুপাখি, কীটপতঙ্গ হত্যাও নিষিদ্ধ। খরগোশ থেকে শুরু করে সিংহ—সবাই-ই তৃণভোজী। এখানে কেউ মাংসাশী নয়, এমনকি মাছও খায় না কেউ। তবে, কোনো পশু-পাখি-মাছ বা কীটপতঙ্গ মারা গেলে রাজকীয় সম্মানে তার সৎকার করা হয়। বনের পশু-পাখির খাদ্যাভ্যাস ও জীবন-যাপন নিয়ে মাঝে-মাঝে শেয়াল-ছাগলকে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায়। শেয়াল জানায়, সে মাংসাশী বংশের উত্তরসূরি, কিন্তু তাকে তৃণ খেয়ে থাকতে হচ্ছে। মাংসাশী প্রাণীর পক্ষে দিনের পর দিন ঘাস-লতাপাতা খেয়ে আর কত! জিহ্বার অরুচি ধরে গেছে।
মাংস খাওয়ার লোভের কথা গোপন রাখে শেয়াল। ছাগলকে বলে, বন্ধু, পশুরাজ তোদের খাবার সবাইকে খাওয়াচ্ছে। খেয়াল করেছিস? শেয়ালের কথা ছাগল বুঝতে পারে না। তাই কান দুটি নাড়াতে নাড়াতে জিজ্ঞাসুদৃষ্টি মেলে ধরে শেয়ালের দিকে। শেয়ালের মনে কৌতুকের জোয়ার বয়ে যায়। ভাবে ছাগলকে অপদস্ত করার এটাই মোক্ষম সুযোগ। বলে, সাধে কি আর দ্বিপদী প্রাণীরা নিজেদের বোকাটাকে ছাগল বলে! তোকে দেখেই বুঝতে পারছি। শেয়ালের বিদ্রূপের অর্থও বোঝে না ছাগল। তাই ডানে-বামে কান দুখানি বারকয়েক নাড়িয়ে বলে, কী বললে রাজগুরু? বুঝিয়ে কও। রাজগুরু সম্বোধনে শেয়ালের মনে পুলক জাগে। তাই গলাও নরম হয়ে আসে। বলে, এই যে বনের সব পশু ঘাস খায়, তাতে তৃণভোজীদের ভাগ কমে যায় না? শেয়ালের ইঙ্গিতটা ছাগল ধরতে পারে না। তবু মাথা নাড়ে, তা তো বটেই। শেয়াল এবার উৎসাহ পেয়ে বলে, তোরা যারা তৃণভোজী, তারা ঘাস-লতাপাতা খেয়ে বাঁচবি। যারা মাছ-মাংস-পোকামাকড়ভোজী, তারা মাছ-মাংস-পোকামাকড় খাবে। তাহলে তো আর কোনো সমস্যা হয় না। কী বলিস? এবার শেয়ালের মতলব কী, তা মনে হয় ধরতে পারে ছাগল। তাই কিছুটা ভয়ও পায়। এবার ভয়কম্পিত কণ্ঠে ছাগল বলে, তুমি কী করতে বলো?
শেয়াল তার চোখ দুটিকে বারকয়েক মার্বেলের মতো ঘোরায়। মাছি তাড়ানোর মতো ঘন ঘন লেজ নাড়ে। ছাগল বুঝতে পারে—শেয়াল যখন কোনো জটিল বুদ্ধির মারপ্যাঁচ খেলে তখনই কেবল এমন করে। তখনই চোখে তার ধ্রুবতারার আলো নেচে ওঠে। তাই ছাগলের মনে শঙ্কা আরও বাড়ে। তার মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে যেন শীতল কোনো পাইথন এঁকেবেঁকে চলে যায়। ভয়ার্ত ছাগল কম্পিত কণ্ঠে শেয়ালকে ডাকে, রাজপণ্ডিত তুমি আসলে কী ভাবছ, বলো তো। আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না। শেয়াল ক্ষেপতে গিয়েও পারে না, রাজপণ্ডিত সম্বোধন শুনে তার মন চৈত্রমাসের রসালো তরমুজের মতোই শীতল হয়ে আসে। আর আসে নরম হয়ে। গলায় হালকা বিদ্রূপের সুর তুলে বলে, নিজের স্বার্থ পাগলেও বোঝে। তুই বুঝিস না? শেয়ালের বিদ্রূপে ছাগলকে জোঁকের মতো জেঁকে ধরে অভিমান। সেই অভিমানে রোদনহীন কান্না বুকের মধ্যে বারকয়েক গুমরে ওঠে তার। সে আকাশের দিকে তাকায়। দেখে সেখানে আকাশ নেই। সবুজ নধর-নধর ঘাসের কোমল মাঠের মতো বিশাল ক্রেওড়া গাছের ডালপালা। তাই তার সেই কান্নারত মুখ বনদেবী যেমন দেখার সুযোগ পায় না, তেমনি আকাশের ওপর বসে থাকা বিধাতাও বোধ করি দেখে না। বান্ধবশূন্য এই জঙ্গলে দাঁড়িয়ে ছাগলটি অন্তত তেমনই মনে করে। ছাগলের মনখারাপের বিষয়টি আঁচ করতে পারে শেয়াল। এবার সে নরম সুরে বলে, শোন। প্রত্যেক প্রাণীর নিজস্ব জীবনপ্রণালী আছে, খাদ্যাভ্যাস আছে, নির্দিষ্ট খাবারও আছে। যেমন তোরা হলি তৃণীভোজী, তোদের যদি কোনো মাছ-মাংস দেই, খেতে পারবি? ছাগল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, কক্ষনোই না। শেয়ালের কেন প্রশ্নের জবাবে ছাগল বলে, কারণ বিধাতা আমাদের তৃণভোজী করেই সৃষ্টি করেছেন। বনদেবীও আমাদের সেভাবেই দেখভাল করছেন। ছাগলের জবাব শুনে ভোরের রোদপড়া নদীচরের বালুর মতো শেয়ালের চোখ চিক-চিক করে। বলে, এই তো বুঝলি। তাহলে এবার বল, আমরা মাংসাশী প্রাণী। আমরা মাংস খাবো না, ঘাস খাবো। এটা বিধিরবিধান লঙ্ঘন নয়, অধর্ম নয়? আমাদের তো নরকেও ঠাঁই হবে না রে! তুই আমার বন্ধু। তুই সহজ-সরল। তাই পশুরাজ তোর কথা সহজে বিশ্বাস করবেন, গুরুত্ব দেবেন।
সব হয়েছে ওই বুড়ো ভাম সিংহের মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণে। বনের পশু-পাখির যার-যার নিজ নিজ খাবার খাওয়ার অধিকার ফিরিয়ে আনতে হলে সিংহকে পরাজিত করতে হবে।
শেয়াল-ছাগলের ভাবনাটা যতটা সরলরেখায় চলেছিল, বাস্তবে সিংহের কাছে উপস্থাপন ততটাই জিলাপির প্যাঁচের মতোই জটিল। তারা দুজনেই দেখলো, নদীর স্রোতে কোনো কিছু ভাসিয়ে নেওয়া সম্ভব, কিন্তু জল দিয়ে বাঁধ দেওয়া যায় না। বাঁধ দিতে হলে মাটির দরকার হয়। জলের স্রোত বরং সেই মাটির বাঁধও ছিঁড়ে ফেলে। সিংহের কাছে তাদের যুক্তি ধাবমান কোনো হরিণের গতি রোধ করতে জল দিয়ে বাঁধ তৈরির ব্যর্থ চেষ্টার মতো মনে হলো। সিংহ পশুরাজ। তাই তাকে কখনো কখনো যেমন গর্জে উঠতে হয়, তেমনি কখনো কখনো কাশফুলের পরশের মতো নরম কণ্ঠেও কথা বলতে হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। শেয়ালকে এক গর্জনেই থামিয়ে তাকালো ছাগলের দিকে। বললো, কাছে আয়। বল কী বলবি?
ছাগল ভয়ে থত্থর করে কাঁপে। পশুরাজের চোখের আড়ালে থেকে যে কথা সহস্রকণ্ঠে চিৎকার করে বলা সম্ভব, সামনে বসে সেই কথা মিনমিনে গলায়ও সম্ভব নয়। ছাগল ভয় পেয়ে ব্যাঁ-ব্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। সিংহের কণ্ঠে এবার বিরক্তি স্পষ্ট—বল, কী বলবি? না বললে কিন্তু এক থাবায় তোর মুণ্ডুটা ধড় থেকে ফেলে দেবো। ছাগলের তখন ত্রিশঙ্কু দশা, কথা বললেও বকা খাওয়ার ভয়, না বললেও প্রাণ হারানোর শঙ্কা। ছাগল ব্যাঁ-ব্যাঁ করে শেষ পর্যন্ত যা বলতে পারলো এবং সিংহ যতটা শুনতে পেলো, তার সারমর্ম এমন—বনের পশুদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা ঠিক হয়নি। মাংসাশীরা ঘাস খেয়ে শেষ করে ফেলে তৃণভোজীরা একদিন অনাহারে মরবে। ছাগলের কথা শুনে সিংহ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর চোখ দুটি মার্বেলের মতো কয়েক পাক ঘুরি গোল-গোল করে তাকায় শেয়ালের দিকে। বলে, এইসব তোর বুদ্ধি? পশুহত্যা বন্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছি। সেটা তোর ভালো লাগলো না? ছাগলকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে তার মাথাটা বিগড়ে দিয়েছিস? যাহ! তোর পরিকল্পনা কোনোদিনই বাস্তবায়ন করা হবে না। দূর হ আমার সামনে থেকে। দূর হ! ভয়ে শেয়াল ও ছাগল জড়োসড়ো হয়ে কাঁপতে থাকে। এবার সিংহ গর্জে ওঠে—কী হলো, তোরা গেলি?
সিংহের সামনে থেকে পালিয়ে এসে জঙ্গলের যে প্রান্তে নদীর বাঁক গোখরো সাপের মতো ফনা তুলেছে, সেখানে এসে থামে শেয়াল-ছাগল। ছাগল হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, পণ্ডিত মশায়, আর দৌড়াতে পারছি না। পশুরাজ তো ক্ষেপলেন। এখন কী করে কে জানে! ছাগলের কথায় শেয়াল ক্ষেপে ওঠে মনে মনে। কিন্তু প্রকাশ করে না। ভাবে, ছাগলকে ক্ষেপিয়ে লাভ নেই। বরং কৌশলে কাজে লাগাতে হবে। তাই গলার ভেতর থেকে টক-ঢেঁকুর ওঠার আগে যেভাবে কৌশলী প্রাণী দমন করে নেয়, ঠিক সেভাবেই নিজের সমস্ত রাগ হজম করে শেয়াল। গলায় রাজ্যের মধু ঢেলে বলে, ছাগল ভাইয়া, দৌড়াতে দৌড়াতে ক্ষুধা লেগে গেলো। তোর ক্ষুধা লাগেনি? নদীর তীরে যেখানে তারা কথা বলছিল, সেখানে ঘাস নেই, থকথকে কাদা আর বাইন-ক্রেওড়া গাছের শ্বাসমূল উঠে আছে। খাওয়ার মতো কোনো ঘাস নেই। ছাগল চারদিকে তাকিয়ে বলে, পণ্ডিত মশায়, ক্ষুধা তো লেগেছে। কিন্তু খাবো কী? শেয়াল এই ছাগলের ক্ষুধাকে পুঁজি করতে চায়। বলে, চল একটু বনের দিকে যাই। এরপর হাঁটতে হাঁটতে যেখানে পৌঁছয় তারা, সেখানে একগ্রাস মাত্র সবুজ ঘাস হালকা বাতাসে দোল খেতে খেতে একটি আরেকটি গায়ে ঢলে পড়ছে। শেয়াল ঘাসগুলোর ওপর শুয়ে পড়ে। ছাগলকে বলে, আমি খুব ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম নেই। তুই একটু এদিক সেদিক দেখ তো খাওয়ার মতো কোনো ঘাস-লতাপাতা পাওয়া যায় কি না।
ছাগল এদিক-সেদিক ঘুরে আবার ফিরে আসে শেয়ালের কাছে। দেখে শেয়াল কচি কচি ঘাস চিবুচ্ছে। ছাগলকে দেখা মাত্রই বলে, তুই যাওয়ার পরই এখানে এই ঘাসগুলো দেখলাম। ভাবলাম, তুই তো ঘাস পাবি। তাই ক্ষুধায় কাতর হয়ে এই একগোছা ঘাস খেয়ে নিলাম। তুই রাগ করিস না। ছাগল কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। তার খাওয়ারযোগ্য কোনো ঘাস কিংবা লতাপাতা পেলো না। ছাগলের করুণ অবস্থা দেখে শেয়াল রক্ষরোগীর মতো খেক-খেক করে হাসে। ছাগল বলে, কী পণ্ডিত মশায় হাসছেন যে! ছাগলের নির্বুদ্ধিতা দেখে শেয়াল আরেক দফা হাঁসে। এরপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়। এরপর ধীরে ধীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বুঝলে ছাগল ভাইয়া, ওই একগোছা ঘাস আসলে তোর খাবারযোগ্য ছিল। যার যা খাবার, তার জন্য যদি তা-ই বরাদ্দ হতো, তাহলে ঘাসটুকু তুই খেতে পারতি। আমি হয়তো কাঁকড়া বা ছোটখাটো পাখি শিকার করে খেতাম। কিন্তু বনের রাজার স্বেচ্ছাচারিতায় তা তো আর হলো না! আমি মাংসাশী, আর আমাকে নাকি হতে হলো তৃণভোজী। এখন বল, মাংসাশীরা যদি তৃণভোজ করে, তাহলে তৃণভোজীরা কী খাবে?
ছাগল মনে মনে শেয়ালের বিচারবুদ্ধির তারিফ করে। ভাবে, আরে শেয়ালপণ্ডিত তো যৌক্তিক কথাই বলছে। পশুরাজ তো বনের নিয়ম উল্টে দিয়ে তৃণভোজীদের জন্য দুর্ভিক্ষ ডেকে আনছে। এর একটা বিহিত করতেই হবে। বলে, পণ্ডিত মশায় সব তো বুঝলাম। কিন্তু প্রতিকারের উপায় কী? আমরা তো আর সিংহের সঙ্গে লড়াই করে জিততে পারবো না। উপায় বলো পণ্ডিত মশায়।
শেয়াল ঋষীদের মতো গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে। ভাবতে ভাবতে ভাবনার অথই সমুদ্রে একবার ডুব দেয়, আরেকবার বড়শীর ফাতনার মতো ভেসে ওঠে। মনে পড়ে, বনে যখন মাংসাশীদের মাংস ভক্ষণের অধিকার ছিল, তখন গরগোশ, ছোট ছোট গাধার বাচ্চাকে ভুল বুঝিয়ে ভুল পথে নিয়ে কত হত্যা করেছে, তার হিসাব আজ কষতেও পারবে না। কিন্তু হঠাৎ সিংহের কী হলো! আইন জারি করলো, বনে কোনো প্রাণী হত্যা করা যাবে না। আরে বাবা, আমরা বন্যজন্তু, আমরা মাংসাশী, প্রাণীহত্যা না করলে মাংস পাবো কই? না আমাদের মাংসও খেতে দেবে না পশুরাজ। আমাদেরও তৃণভোজী হতে হবে। আমরা প্রাণী হত্যা করতে পারবো না, বললেই হলো? আমরা হত্যা না করলাম, তাই বলে কি প্রাণীহত্যা বন্ধ হয়ে আছে? দ্বিপদী প্রাণীরা হাতে তিরধনুক নিয়ে বনে ঢুকে প্রাণীহত্যা করছে না? এই তো সেদিনও হরিণ শিকার করে নিয়ে গেলো। কই সিংহমশায় ওই হরিণকে বাঁচাতে পারলো? পারবে কিভাবে? ছিল মাংসাশী, হয়েছে তৃণভোজী। শরীরে তো আর সে তাগদ নেই। নামেই পশুরাজ, শরীরে নেই এক বলদের শক্তি। আর বনের হাতি-ভল্লুক-বুনো মহিষগুলোও হয়েছে তেমন। সিংহের কথায় উঠবোস করবে।
শেয়ালের ভাবনা আর শেষ হয় না। ছাগল পলকহীন ধ্যানমগ্ন শেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ বনের দিকে একটি গাছ যেন অস্বাভাবিকভাবে নড়ে ওঠে। সেদিকে ভালোভাবে তাকাতে না তাকাতেই একলাফে গাছ থেকে নেমে আসে বানর। লাফাতে লাফাতে এসে উপস্থিত হয় শেয়াল-ছাগলের যৌথসভায়। বলে, কী ব্যাপার তোমরা এখানে কী বুদ্ধির মারপ্যাঁচ কষছ? আমাকে খুলে না বললে কিন্তু মহারাজকে সব বলে দেবো। শেয়ালের এভাবে ধ্যান ভাঙে, বলবো, বলবো।
শেয়ালের কাছে সব শুনে বানর বলে, তো এখন কী করতে চাও? এরপর শেয়াল তার পরিকল্পনার কথা বলে, শোনো বানর ভাইয়া, এখানে বিশাল বিশাল জলযানে করে দ্বিপদী প্রাণীরা আসে। তারা হরিণ-বুনো মহিষ শিকার করে। দেখেছ তো? তারা কিন্তু এসব প্রাণীকে হত্যার পর কাঁচা চিবিয়ে খায় না। তারা আগুনে ঝলসে খায়।
বানর চোখ গোল গোল করে তাকায়, তো? তাতে আমাদের কী? শুনে শেয়াল একটু হাসে। এরপর বলে, আমাদের অনেক কিছু। বনের সবাই যদি ফলমূল আর ঘাস-লতাপাতা খায়, তাহলে তৃণীভোজীরা তো একসময় না খেয়ে মরবি। বনদেবী আমাদের সবার জন্য আলাদা আলাদা খাবার নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমরা কিনা তার নির্দেশ অমান্য করে সবাই তৃণভোজী হয়েছি। সব হয়েছে ওই বুড়ো ভাম সিংহের মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণে। বনের পশু-পাখির যার-যার নিজ নিজ খাবার খাওয়ার অধিকার ফিরিয়ে আনতে হলে সিংহকে পরাজিত করতে হবে।
এবার ছাগল দৌড় দেবে। ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে দাবানল। ছাগলের আর পা চলে না।
বানর বলে, সেটা কিভাবে সম্ভব? শেয়াল বলে সিংহকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করবো। আগুনে পুড়িয়ে মারার বিষয়টি ছাগলের মাথায় ঢোকে না। তাই ব্যাঁ-ব্যাঁ করে প্রতিবাদ জানায়, আমরা আগুন পাবো কই। আর সিংহের গুহায় আগুন লাগাবে কে? ছাগলের কথায় না হেসে পারে না শেয়াল, আরেক দ্বিপদী প্রাণীরা তাদের বোকাটাকে সাধে কি আর ছাগল বলে? আরে বুদ্ধু, দ্বিপদী প্রাণীদের জলযান যখন আবার আসবে, এখানে তীরে ভিড়বে। বানর ভাইয়া কৌশলে সেই জলযানে ঢুকবে। সেখান থেকে আগুন জ্বালানোর যন্ত্র, আর জ্বালানি তেল নিয়ে আসবে। গভীর রাতে, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে, তখন সিংহের গুহার চার দিকে দশ/বারো লাফ পর্যন্ত ওই জ্বালানি তেল ছিটিয়ে দেবে। এরপর দূর থেকে চারদিকে আগুন লাগিয়ে দেবে। আমরা দূর থেকে দেখবো। কেউ কাছে যাবো। বুড়ো সিংহ সেই আগুনে পুড়ে মরবে। ব্যস, খেল খতম। কষ্ট হজম। পরিকল্পনার কথা তিন জনের মধ্যেই থাকে। দিন যায়, রাত যায়। তিন পশু সিংহের দরবারে যায় না। নিয়মিত সভায় উপস্থিত থাকে না।
অনেক দিন পর সেখানে একটি জলযান নিয়ে বনে আসে দ্বিপদী জন্তুরা। তারা জলযান থেকে নেমে বনের গভীরে ঢুকে পড়ে। সুযোগ বুঝে জলযানে লাফিয়ে পড়ে বানর। দেখে একজন দ্বিপদী প্রাণী রান্না করছে। দ্বিপদী প্রাণীটি আগুন জ্বালানোর জন্য তিনটি উপকরণ ব্যবহার করে। একটি লাকড়ি, দ্বিতীয়টি কেরোসিন, তৃতীয়টি দিয়াশলায়। প্রথমে লাকড়িতে কেরোসিন মেখে নেয়, এরপর দিয়াশলায়েল কাটি ঘষে আগুন জ্বালিয়ে সেটা লাকড়িতে দিয়ে একটি বাক্সের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। অমনি আগুন জ্বলে ওঠে। লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখে বানর। এরপর দ্বিপদী প্রাণীটি ঘুমিয়ে পড়লে, বানর কেরোসিনের পাত্র ও দিয়াশলায় নিয়ে সন্তর্পণে লাফিয়ে নামে জলযান থেকে। এরপর একদৌড়ে উপস্থিত হয় শেয়ালের গুহায়। সেখানে ছাগলও আছে।
তিন জন্তু মিলে রাত নামার অপেক্ষা করে। পশ্চিমাকাশ তখন সিংহের থামায় সদ্যমৃত হরিণের রক্তের মতো লাল আভা ছড়িয়ে সূর্যদেবকে বিদায় জানাচ্ছে। শেয়াল ভাবে, সিংহ মশায়ের জীবনে এই-ই শেষ সূর্যাস্ত। আজকের এই সূর্যাস্ত সিংহের জীবনেরও সূর্যাস্ত। স্বেচ্চাচারিতার ফল ভোগ করুক বেটা সিংহ। একসময় হামাগুড়ি দিতে দিতে রাত গভীর হয়। সিংহের নাক ডাকার শব্দ কানে আসে শেয়ালের। বানরকে বলে, এই-ই সুযোগ। এবার কেরোসিন ছিটিয়ে দাও চারদিকে। চারদিকে কেরোসিন ছিটানোর আগুন জ্বালিয়ে দেবে। আমরা আমার গুহায় অপেক্ষা করছি।
শেয়াল ও ছাগল শেয়ালের গুহায় চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় প্রহর গোনে, কখন বনে দাউ-দাউ আগুন জ্বলে উঠবে। আর সেই আগুনে সিংহ পুড়ে মরবে। ভাবতে ভাবতে ছাগলের চোখে হালকা ঘুম লেগে আসে। আর তখনই সিংহের গগনবিদারি মরণ চিৎকার ভেসে আসে। সেদিকে তাকাতেই ছাগল দেখে বনের যত দূর চোখ যায়, কেবল আগুনের লেলিহান শিখা। এরপর ভেতর দিয়ে সিংহ, বুনো মহিষ, হাতি, হরিণ, শেয়াল দৌড়ে পালাচ্ছে। হঠাৎ করেই ছাগলের সামনে লাফিয়ে পড়ে বানর। তার লেজে আগুন। ছাগল দেখলো, সেই আগুন বানরটির সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। এবার ছাগল দৌড় দেবে। ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে দাবানল। ছাগলের আর পা চলে না।