॥পর্ব-২৭ (শেষপর্ব)॥
কারখানার বিকেল। সোনালি আলো, মৃৎ-বাষ্পচাপা। ফটকে দ্বাররক্ষী নজরুল কপালের কাছ হাত তুলে স্থির, পরনে দায়িত্বকালীন পোশাক। চোখের সামনে গোটা কারখানাও স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে। সীমানা দেয়ালের বাইরে পাতা নাড়তে থাকা কোমল চিরসবুজ শাখীর ছবিটা কেবল চলচ্চিত্র। বানবাতির আলো জ্বলতে সন্ধ্যা, তাই ছাউনির নিচ, বিকট যন্ত্রদানবের আড়াল, বাতি না জ্বলা অতিথিকক্ষ, কোর তৈরির গুদামঘরের ফাঁক ফটকের ওপারসহ আরও অনেক জায়গায় শিকারি বেড়ালের মতো অন্ধকার। কোথাও কোনো কুটো পড়ে নেই। কোনো ধাতব বর্জ্য প্রতিবন্ধক হয়ে পথের ওপর শুয়ে নেই। দৃষ্টিপথে নিরীক্ষাগারের হলুদ দেয়াল, এর ওপর দোতলায় দপ্তর ঘরের জানালা খোলা। পর্দার ভাঁজ একাংশ চোখে পড়লো। এরপর অন্ধকার, যেন আসতে নিষেধ করছে ঘর।
কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে! আপন মনে বলে উঠলো মারুফ, শুনলে? মনিবের মুখ থেকে কিছু উচ্চারিত হয়েছে, এটুকু কেবল বুঝেছে নজরুল। কী সেই উচ্চারণ, বুঝতে না পেরে বিব্রত ভীষণ। তাকে কি কোনো নির্দেশ দেওয়া হলো? জিজ্ঞেস করে যদি ভ্রূকুটি দেখতে হয়? না করেও তো দাঁড়িয়ে থাকা বোকামো। তাতে পরিস্থিতি আরও মন্দও হতে পারে। ক্ষমা চেয়ে জিজ্ঞেস করাই উচিত। নজরুল কপালের কাছ থেকে হাত নামিয়ে দু’হাত জড়ো করে ঝুঁকে দাঁড়ালো। নত চোখে কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, স্যার কি আমাকে কিছু বললেন? মারুফের চিবুক তখনো উঁচু, চোখ দপ্তরের জানালায়। দৃষ্টি ফিরে এসে পাশে দাঁড়ানো মানুষটির ওপর পড়লো।
সোজা হও নজরুল! না, তোমাকে কিছু বলিনি। তারপর? বলো, তুমি কাজের পোশাক কেন পরেছ? আজ তো আরও ছুটির দিন। তোমাদের বাড়তি বিড়ম্বনায় ফেলব না বিধায় ছুটির দিনে এলাম। যাক পরেছ ভালো। নজরুল উত্তরে কী বলবে ভেবে পেলো না। শব্দভাণ্ডারের দুয়ার সশব্দে বন্ধ হয়ে গেলো। সেই শব্দে কানে লাগলো তালা, আর মুখ হলো নির্বাক্য। আশ্রয় অগত্যা সেই বোকাটে হাসির কোল। নজরুল সেই কোলে তখন সংকুচিত শিশু। তবে মনিব সোজা হতে বলেছেন যখন, ওটুকু কর্তব্যজ্ঞানে নজরুল বুক টান করে হলো সোজা।
আমি দপ্তরে যাব, ব্যবস্থা করো। একটা ছেলে আছে না? ওকে চা নিয়ে যেতে বলে দিও। দরজা তো খোলা নেই দপ্তরের। আছে? নেই, বেশ তো। নিয়ে এসো চাবি।
পরিপাটি মেহেদি নিজ ঘর থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো মারুফের কাছে। স্যার, চলে এসেছেন? দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, বেলাও পড়ে আসছে, ভাবছি স্যার কোথায়।
মারুফ হেসে মেহেদির পিঠ চাপড়ে দিলো। এই তো মাই বয়, চলে এসেছি। তোমরা তো একদম নজরুলকে ইউনিফর্ম পরিয়ে রেখেছ। যাহোক, রাতটা তোমাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করব, গল্প চলবে, সকালে বাঁশির সঙ্গে শুরু করব নতুন সংসার। কী বলো, কেমন হয়েছে। এই যে এবার আমিই চলে এলাম!
মেহেদি তখন সশ্রদ্ধ নত চোখে তাকিয়ে। কণ্ঠে চাপা উচ্ছ্বাস। খুব ভালো হয়েছে স্যার। আমি আর পল্লব বলছিলাম আপনার কথা। বলছিলাম স্যারের সিদ্ধান্ত খুবই ভালো হয়েছে। এমনটা যদি আরও আগে হতো, অনেককে আমরা হারাতাম না; কণ্ঠের উচ্ছ্বাসটা পড়ে গেলো; বললো আবার, অনেককে হারাতে হতো না। খুবই ভালো হয়েছে স্যার, আপনি নিজেই এসেছেন। কিন্তু শরীরে ধকল সইবে তো? মানে, কারখানা জীবন তো আপনাকে চেনানোর নেই! দুঃসাহস!
ঠিক বলেছে ছেলে, দুঃসাহস। না, পারব বলেই বোধ হচ্ছে। আমার অর্ধাঙ্গী, তারপর মেয়ে; সবাই খুব সমর্থন যুগিয়েছে আমাকে। আর ধরো বাসাটা ঢাকার শেষপ্রান্তে বলে বাঁচোয়া। সপ্তাহান্তে খুব বেশি দূরের পথ তো নয়। তবে এখানে থাকাটা আরেকটু গুছিয়ে নিতে পারলে হয় আর কি, বেশ চলে যাবে। আর আমিই বা ক’দিন। সত্যি কথা, আগের সেইসব দিন তো হারিয়েছি, যখন দিন রাত পড়ে থাকতাম। হায় রে, কী সব দিন! আমি আর আমার বন্ধু, রাতের পর রাত, হ্যাঁ? ভাবা যায়? সেই বন্ধুই কিনা পেছন থেকে ছুরি বসালো। আর বাকিরা তো দুধভাত, ওদের গোনাতেই ধরব না।
বাতাস কেটে ঝাড়া চেটো, তাচ্ছিল্যে ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চেপে রাখা। কিন্তু কণ্ঠে ব্যথার ছাপ।
ওসব কিছুই নয়। সব সয়ে যায়, সব। বুঝলে মেহেদি? শুধু বন্ধুরটা সয় না। যাক, যা বলছিলাম, আমি ক’দিন হাল ধরে স্রোতটা বুঝি। আর যুঝতে গিয়েও তো ধারণা হবে, কী বলো। এরপর তোমরা তো আছ। আমাদের হাতে গড়া, আমার জুয়েল ছেলেরা তো আছই।
অনেক ধন্যবাদ স্যার; মেহেদির গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। শুরুর উচ্ছ্বাসটা আবার ফিরে এসেছে। তার কাঁধে হাত রেখে মারুফও দপ্তরের পথে এগোচ্ছে তখন। ফটকের কাছাকাছি এসে বললো, তারপর? তোমার জোড়া কোথায়? পল্লব?
ও বাজারে গিয়েছিল স্যার। আপনি এসেছেন জানিয়েছি তাকে। এই তো চলে আসবে।
বেশ, আর জসিম?
জসিম ভাই বাড়িতে গেছেন। মেয়ে হয়েছে নতুন, মুখ না দেখে আর কতদিন থাকা যায়; এই আরকি। কাল প্রথম বেলাতেই যোগ দিচ্ছেন। তবে আপনি আসবেন জানলে চলে আসতেন। সে কারণেই জানাইনি।
না না ঠিক আছে, খুব ভালো করেছ জানাওনি। বাড়িতে সময় দিক, ওখানেও তো ওকে দরকার। দেখো, শেষ পর্যন্ত এটা কিন্তু মানুষেরই জীবন। এটা তো মানতেই হবে। শরীরটা এক পাশে হেলিয়ে কাঁচাপাকা চুলে ভরা মাথা দুলিয়ে বলে উঠলো মারুফ, বেশ আমুদে ভঙ্গি। বললো, শরীরে কারখানার হাওয়া লাগার পর, বুঝলে, মনে হচ্ছে ফেলে আসা দিনগুলোর কাছে বুঝি ফিরে গেছি। সেই আমি আর এই আমি, কে বলবে।
তবু স্যার, অনেক শক্ত আছেন আপনি। শরীরের কথা জানি না। তবে মনটা যে একেবারেই সেই প্রবাদতুল্য লৌহকঠিন, তা তো আবারও প্রমাণিত হলো।
আচ্ছা, বলো কী! হ্যাঁ ওই দায়ে পড়ে লৌহকঠিন হতে হয়েছে আরকি। অন্য দুটি বড় ভাইয়ের কথা যদি বলো, বিবেক খাটালে মানতেই হবে তাদের বিশ্রাম দরকার। উপর্যুপরি এমন বিপাকে কখনো পড়বে শক্তিমতি, তো ভাবাই যায়নি। কী, গেছে? খেটেছেন তো কম নয়। বয়েস হয়েছে। তাই আমাকেই বলতে পারো যৌবন খুঁড়ে বের করতে হলো। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে তো আর পারব না, আমার বাহু হয়ে থেকো। থেকো, বুঝলে? আচ্ছা, ভালো কথা। সর্বশেষ সলিল বলে যে ছেলেটা চলে গেল, ও কিন্তু আমাকে ইমেইল করেছিল। আহ, সেই সিঁড়ি। তো যাক, মেহেদি, তুমি আর ওঠো না। ওই যে ছেলেটা আছে না, কী নাম, রবি, ও চা নিয়ে আসবে। আমি কাগজপত্তর কিছু উল্টে পাল্টে দেখব, এই তো। যাও, তুমি যাও। রাতে খাবার পর আবার আড্ডা দেওয়া যাবে।
কথাগুলো বলে খানিকটা এগিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকালো মারুফ। বক্তার মতো তর্জনি তুলে মাথা নেড়ে নেড়ে বললো, অনেক কিছু কিন্তু জানার আছে আমার মেহেদি, অনেক কিছু! তার ভগ্নপরিধি আয়ত চোখজোড়া তখনো হাসছে।
দরজা খুলে ঘরের বিজলি বাতি আর পাখার সারিবদ্ধ চাবি ছুঁতে গিয়ে দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে নিলো মারুফ। পায়ের নিচে আঁধার সবুজ মাদুর। পরোক্ষ আলোয় ঘর বিষণ্ন, নিঃসঙ্গ, ভীত। দক্ষিণের জানালা খুলে দিলো মারুফ। ভীতি আর নিঃসঙ্গতা ওই ফাঁক গলে তখন বেরিয়ে গেলো। আর ঢুকে পড়লো আধচাপা মিঠেকড়া কোলাহল। দৃশ্যমান হলো মেহগনির সারি। পেরিয়ে ফসলকাটা মাঠ, ওখানে নাড়া শুকিয়ে কালো। গ্রামের ছেলেরা খেলছে দুদ্দাড়, কোলাহলের উৎস ওটাই। বিকেল শেষের সোনালি আলো সবার চোখে মুখে। সোনার মতো ঝিকিয়ে উঠছে ত্বক। এবার খোলা হলো পশ্চিমের জানালা। এবার পালিয়ে বাঁচল বিষণ্নতা। বাঁশ ঝাড়ের পেছনে আকাশের পটে সাঁটা শীতের কোমল সূর্য। নিচে রেখায়িত কুয়াশা, বনবন্ধু গ্রাম। মনের ওপর জোর খাটিয়ে চোখ ফেরাল মারুফ। কাচ বসানো টেবিলের ওপর ধুলোর মসলিনরূপী স্তর। উত্তরের জানালাটা আগেই ছিল খোলা, নিচে কোরের বিশাল গুদামঘর। জানালা যত, বন্ধ গুদামঘরের। ওঠার আগে জ্বালিয়ে দেওয়া একটামাত্র হলুদ আলো রহস্যময় বিশৃঙ্খলাকে নগ্ন করেছে। চেয়ারে বসার আগে চোখে পড়ল পায়ার কাছে একটা শূন্য সবুজ কাচের বোতল। হাতে তুলে আলমারির পেছন দিকের দেয়াল ঘেঁষে ওটাকে নামিয়ে রাখা হলো। চাপ প্রযুক্ত হতে কথা কয়ে উঠলো চেয়ার। টেবিলের দক্ষিণ পাশে সৃদুশ্য কাচপাথরে চাপা এক তাড়া দাপ্তরিক হলদেটে কাগজ।
দরজায় টোকা পড়ল এসময়। অনুচ্চ কণ্ঠে মারুফের অনুমোদন ভেসে গেলো, এসো!
ট্রে হাতে নিয়ে এক কাঁধে কপাট ঠেলে ভেতরে এলো রবি। ভাঙা কণ্ঠে জানালো সম্ভাষণ। এগোতে গিয়েই গোল। থমকালো মাদুরপাতা মেঝের দিকে তাকিয়ে। সেখানে আঁকা জানালার চৌকো কাঠামোর ভেতর নড়ছে বাঁশপাতার ছায়া। পাশ কাটিয়ে এগোতে গিয়ে সংকোচে তাকালো একবার মারুফের চোখে। সেখানে কোনো বিরূপতা নেই দেখতে পেয়ে তা-ই করলো এরপর, যা করে এসেছে সবসময়। টেবিলের ওপর ট্রে নামিয়ে রাখার পর আমুদে চোখে তাকে জিজ্ঞেস করল মারুফ, ওভাবে এলে কেন রবি?
প্রশ্ন শুনে রবি বিব্রত মুখে হাসলো। কথা হারালো শুরুতেই। এরপর আঙুল তুলে ছায়াটা দেখিয়ে জড়ানো গলায় কী যে বললো, তা উদ্ধারে মুখের ভাষায় ভরসার উপায় নেই। শরীরী ভাষাতেও ছিল মারুফের চোখ। উদ্দেশটুকু বুঝতে ভুল হয়নি। বলল, ছায়া মাড়ালে না কেন?
রবি চোখ নামিয়ে নিলো আবার। এরপর বারকয়েক চেষ্টায় সসংকোচে উচ্চারণ করল একটাই মোটে শব্দ, সুন্দর।
শুনে মারুফ হৃদপিণ্ড যেন স্পন্দন হারালো একবার। সুন্দর! একেবারেই অনভিপ্রেত উত্তর।
সুন্দর তাই মাড়ালে না! মারুফের কণ্ঠে বিস্ময়। রবির অন্দর তখন থরথর। একবার কেবল ওপরনিচ করল মাথা। দারুণ! তুমি তো দারুণ ছেলে রবি! তুমি তো কবি!
রবি বুঝতে পারলো না তার কী বলা উচিত। ধড়াস বুক। দমিত হাসি। হঠাৎ বোধ ফিরে পেয়ে ঝুঁকে পড়ল ট্রের ওপর। চা আর বিস্কিটের কাপটা নামিয়ে রেখে হাতে তুলে নিলো রুপালি পাত। মারুফ বললো, এই দাঁড়া ছেলে! তোর সঙ্গে কথা আছে আমার। আমি বুঝে গেছি, তোকেই আমার চাই!
(শেষ)