[পর্ব-১০]
অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে—
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে॥
… … … … … … …
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ।
সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
মূল সড়কের পাশেই একটি রাস্তা বাঁক নিয়ে এগিয়েছে। আমাদের গাড়ি মিনিট দু’য়েক সামনে গিয়ে পাঁচতলা ভবনের সামনে দাঁড়ায়। চারপাশে প্রাইভেট কারের ভিড় যে কারও চোখে পড়বে। ড্রাইভার বললেন, ‘আপনারা মার্কেটের ভেতরে ঘুরে আসুন। কিছু কিনতেই হবে—এরকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’
নাহ এটা বড় কোনো শপিংমল নয়। বাইরে বড় অক্ষরে লেখা ‘দিল্লি হাট’ বা ‘ইন্ডিয়ান হ্যান্ডিক্রাফটস অ্যাম্পোরিয়াম’ জাতীয় কিছু। আমাদের দেশের ‘আড়ং’-এর মতো বড় কোনো আউটলেট হবে হয়তো। প্রবেশমুখে দরজার দু’পাশে কেশরওয়ালা দুটি সিংহের মূর্তি। পেতলের তৈরি। মানুষের বিলাসিতা দেখানোর নানা উপকরণের বিপুল সমাহার। অর্থসম্পন্ন ‘মালদার’ কেউ ভুলবশত প্রবেশ করলেও খালি হাতে বের হওয়া অসম্ভব। কারণ চোখধাঁধানো লোভনীয় এতসব সৌখিন জিনিস এখানে থরেবিথরে সাজানো আছে। আমি এই ছোট্টজীবনে এরকম জৌলুসপূর্ণ বাহারি দোকান কমই দেখেছি।
প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় দেশি-বিদেশি পোশাক। আছে নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ-সামগ্রীর সমাহার। আমরা কেবল নেড়েচেড়ে দেখি। আকাশস্পর্শী দাম হওয়ায় কেনার সাহস পাচ্ছি না। বিক্রয়কর্মীদের মধুর সম্ভাষণ শুনে কেবল হাসি। এই হাসি ছাড়া বিনিময়ে তাদের আমরা আর কিছুই দিতে পারি না। কারণ আমাদের পকেটে ডলার, ইয়োরো, দিনার কিছুই নেই। সামান্য রুপি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
তবে গেটে এসে সিংহের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে তবেই গাড়িতে চড়ে বসলাম। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম। এটাও একরকম প্রতিশোধ বৈকি।
সিঁড়িপথ বেয়ে তৃতীয় তলায় ওঠা মাত্রই চক্ষু চড়কগাছ। কী দেখছি এসব! যেদিকে চোখ যায় শিল্পীর নিপুণ হাতে তৈরি এন্টিকের নানারকমের ভাস্কর্য এবং প্রত্নসম্ভার। এগুলো মূল্যবান পাথর, তামা, পেতল, ব্রোঞ্জ, ইত্যাদি দিয়ে তৈরি। সবচে বেশি আছে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন দেবদেবী এবং গৌতম বুদ্ধের মূর্তি। এছাড়া বাঘ, সিংহ, ঘোড়া, হরিণ, গরুসহ ইত্যাদি নানাধরনের পশুপাখির ভাস্কর্য তো আছেই। এগুলোর দাম লাখ রুপির মতো। দরিদ্র সনাতনধর্মী মানুষের পক্ষে এসব কিনে পুজো দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে মাটির তৈরি মূর্তিই তাদের নির্ভরতা। তৃতীয় তলার এক কর্নারে নকশা করা দামি কার্পেট। এগুলোর মধ্যে কিছু এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
কবি কামরুল হাসান মুগ্ধতার আতিশয্যে ভাস্কর্যের ছবি তুলতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে বিক্রয়কর্মী নিষেধ করলেন। ফলে ঐকান্তিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ছবি তোলা গেলো না। এই শিল্পরাজ্যের ছবি তুলতে না পারার বেদনা নিয়েই আমাদের বেরুতে হলো। তবে গেটে এসে সিংহের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে তবেই গাড়িতে চড়ে বসলাম। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম। এটাও একরকম প্রতিশোধ বৈকি।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। ক্রমশ জ্বলে উঠেছে অগণন ইলেক্ট্রিক বাতি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোও জ্বলে উঠেছে সময় মতো। দিনের আলোয় দিল্লির যে মনোহর রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সেটাই এখন আরও বেশি বর্ণিল। দিন এবং রাতের এই এক অদ্ভুত স্বাতন্ত্র্য। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ আমরা ‘কোনাট প্লেস’ গিয়ে পৌঁছাই। বেশ ব্যস্ত এলাকা। কিন্তু পরিপাটি, গোছানো। মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। প্রচুর পর্যটক কেনাকাটায় ব্যস্ত। ব্যস্ত হবে না কেন। ‘কোনাট প্লেস’ নতুন দিল্লির অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক এবং ব্যবসায়িক কেন্দ্র। স্থানীয় মানুষের কাছে এটি সংক্ষেপে ‘সিপি’ নামে পরিচিত। ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও এখানে কয়েকটি ভারতীয় সংস্থার সদর দপ্তর রয়েছে।
ট্যাক্সি থেকে নামার মুহূর্তে দূরত্বের অজুহাত দেখিয়ে ড্রাইভার বাড়তি টাকা চাইলেও তার আবদার ধোপে টেকেনি। কামরুল ভাই হিন্দি ভাষায় শক্তভাবে ব্যাপারটি সামাল দিলেন। আমরা এবার হেঁটে রাস্তা পার হলাম। দুপুরের আহারের পর ‘লোটাস ট্যাম্পল’-এর সামনে সামান্য নিম্বু পানি এবং পিঠা ছাড়া পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি। ফলে খেতে হবে কিছু। কামরুল ভাই হনহন করে হাঁটা দিলেন ঝলমলে কেএফসির দিকে। আমরা তাকে অনুসরণ করলাম। বিদেশবিভূঁইয়ে এসে সবাই বোধোদয় কিছুটা হিসেবী হয়ে যায়। হওয়াটা দোষের কিছু নয়। কেএফসিতে এসে আমরা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং ড্রিংকস নিলাম। ভাতের বিকল্প হিসেবে বাঙালিদের কাছে আলুর কদর সবার আগে। ফলে আলুভাজা খেয়ে বের হলাম।
সেঁজুতি এবং কামরুল ভাইও কিনলেন নিজেদের সন্তান এবং পরিবারের জন্য। ইতোমধ্যে প্রায় দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। কামরুল ভাই বললেন, ‘আর দেরি নয়। এবার হোটেলে ফিরতে হবে।’
আমার শ্যালক তাবির বছরখানেক আগে দিল্লি বেড়িয়ে গেছে। তার কাছে শুনেছি ‘কোনাট প্লেস’-এর প্রশংসা। এখানে নাকি লেদারের ব্যাগ সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। খুঁজে খুঁজে গেলাম মাটির নিচে অবস্থিত ‘পালিকা বাজার’। ৮টা বাজতে বেশি সময় বাকি নেই। দোকানিরা দোকান বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেঁজুতি এবং কামরুল ভাই ডলার ভাঙাতে মানি এক্সেঞ্জ দোকানে ঢুকলেন। আমি এই ফাঁকে অন্য দোকানে কয়েকটা ব্যাগ দেখলাম। কিন্তু দোকানি লেদারের ব্যাগ বলে আমাকে নিশ্চিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও আমার বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া লেদারের ব্যাগ এতো পানির দরে বিক্রি করা কিভাবে সম্ভব! ফিরে আসি মানি এক্সেঞ্জে। আমারও কিছু ডলার ভাঙাতে হবে। ডলার দিয়ে রুপি নিলাম।
কামরুল ভাইসহ আবার আসি ব্যাগের দোকানে। লেদারের তৈরি ব্যাগ, এটা প্রমাণ করার জন্য দোকানি এবার ম্যাচের কাঠির আগুন ব্যাগে ধরিয়ে দিলেন। অবাক হলাম। রেক্সিন হলে পুড়ে যেতো। দোকানির ভাষ্য, যেহেতু লেদার সেহেতু আগুনে পুড়ে যায়নি। এদিকে দোকান সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঝটপট পানির দরে দুটি বড় সাইজের ট্রাভেল ব্যাগ কিনলাম মাত্র তেরোশ রুপি দিয়ে। কামরুল ভাই বললেন, ‘ব্যাগ কিনে জিতেছ সুমন’।
ফিরতে গিয়ে সেঁজুতি ঢুকে পড়ে এক রাজস্থানি পোশাকের দোকানে। রাজস্থানি সেলোয়ার-কামিজ, শাল, শাড়িসহ মেয়েদের নানান পোশাকের দারুণ সমাহার। আমি আমার কন্যা, ভাগ্নি এবং শ্যালিকাদের জন্য পাঁচটি রাজস্থানি থ্রিপিচ কিনলাম। সেঁজুতি এবং কামরুল ভাইও কিনলেন নিজেদের সন্তান এবং পরিবারের জন্য। ইতোমধ্যে প্রায় দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। কামরুল ভাই বললেন, ‘আর দেরি নয়। এবার হোটেলে ফিরতে হবে।’
টিম লিডার যেহেতু কামরুল ভাই। সেহেতু তার আদেশই শিরোধার্য। যদিও ‘শ্রী লেদার্স’ থেকে জুতা কিনতে না পারার আক্ষেপ সেঁজুতির মনে। কলকাতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দর থেকেই ‘শ্রী লেদার্স’-এর প্রশংসা শুনে এসেছি সেঁজুতির মুখে। কামরুল ভাই আমাদের নিয়ে ছুটলেন এবার নতুন বিস্ময়ের দিকে। অন্তত আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা তো বটেই। ‘কোনাট প্লেস’ থেকে ‘মহীপালপুর’-এর ‘হোটেল কিয়ান’ আমাদের গন্তব্য। বাস কিংবা ট্যাক্সিতে যেতে পারি। কিন্তু কামরুল ভাই আমাদের নিয়ে আবার ঢুকে পড়লেন ভূগর্ভে।
এই তবে মেট্রোরেল! ঝকঝকে নতুন। উপরে লেখা আছে ‘শিবাজী স্টেডিয়াম’। ‘কোনাট প্লেস’-এর কাছেই এই মেট্রোরেল স্টেশন। মাটির নিচে কী সুন্দর ব্যবস্থা। মানুষ তার প্রয়োজনে পাহাড় কেটে তৈরি করেছে পথ। এখন দেখি মাটি খুঁড়ে পাতালেও বসিয়েছে রেলপথ। তাও ভীষণ বৈজ্ঞানিক ছোঁয়ায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমেত এই ব্যবস্থা। দিল্লি মেট্রোরেল দিল্লির পার্শ্ববর্তী গুরগাঁও ও নয়ডা অঞ্চলের দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা।
পাঁচটি লাইনের সম্মিলিত দূরত্ব ২০৩ মাইল। স্টেশনের সংখ্যা ২৩৬টি। তবে এর মধ্যে ৬৮টি মাটির নিচে। পরিস্থিতি ভেদে উড়াল, ভূপৃষ্ঠস্থ এবং ভূগর্ভস্থ– তিন প্রকার লাইনই রয়েছে। দিল্লি শহরের লোকজন যখন যানজটের কবলে পড়ে নাকাল অবস্থায় নিপতিত। তখন দিল্লির রাজ্যসরকারের এই মেট্রোরেল ব্যবস্থা যানজটের করুণ দশা থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিরতিহীন ভাবে চলে। প্রতিদিন ১০০টি ট্রেন মাত্র ৩ থেকে ৪.৫ মিনিট ব্যবধানে যাত্রীদের পৌঁছে দেয় কাঙ্ক্ষিত স্টেশনে।
ইতোমধ্যে কেনাকাটা করে আমাদের ব্যাগের ওজন বেড়েছে। ফলে ক্লান্তি নিয়েক আর হাঁটতে চাইছিলাম না। ১০০ রুপি দিয়ে মুহূর্তে পৌঁছে যাই ‘কিয়ান’ হোটেল।
আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্টেশন ‘দিল্লি এরোসিটি’। ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে ‘শিবাজী স্টেডিয়াম থেকে ‘দিল্লি এরোসিটি’র দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। ‘দিল্লি এরোসিটি’ স্টেশনটি নতুন দিল্লি এয়ারপোর্ট এবং মহীপালপুরের মাঝামাঝি অবস্থিত। মেট্রোরেলে গিয়ে ‘দিল্লি এরোসিটি’ নেমে সহজেই মহীপালপুর যাওয়া যায়। কাউন্টার থেকে রুপির বিনিময়ে আমরা নির্ধারিত কয়েন পেলাম। এই কয়েনের সাহায্যে প্রবেশ ও প্রস্থান সম্ভব। এর অন্যথা সম্ভব নয়। নির্দেশিত বিভিন্ন সাইন অনুসরণ করে আমরা ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়ালাম। কোথাও কোনো কোলাহল নেই। যাত্রীদের মধ্যে কোনোরকম তাড়াহুড়ো নেই। ধাক্কাধাক্কি নেই।
আমি বেশ রোমাঞ্চিত। মাটির নিচে আমরা অপেক্ষায় আছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশের জন্য মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। আমাদের দেশে হলে এখানে কী কী ধরনের দোকান বসার সম্ভাবনা ছিল তাই ভাবছি। উপর থেকে পাতালে নামার সিঁড়িপথে হকাররা ছোট ছোট দোকান সাজিয়ে বসতো। বুট-বাদাম, সিদ্ধডিম এবং বাচ্চাদের খেলনা বিক্রেতার হাঁকডাক শোনা যেতো। স্ট্রেশন চত্বরের কোনো এক ফাঁকা জায়গায় রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় বসে যেতো কলা-পাউরুটি এবং চা-সিগারেট-পানের দোকান। নাহ, এখানে এসবের কিছুই চোখে পড়েনি।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মেট্রোরেল এসে গেছে। সময়ানুবর্তী বাহন। অটোমেটিক দরজা খুলতেই যারা নামার যাত্রী তারা দ্রুততার সাথে নেমে গেছেন। আমরাও দ্রুততার সাথে উঠে গেলাম। দরজার পাশেই ব্যাগ কিংবা লাগেজ রাখার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। কষ্ট করে ভেতরে টেনে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ইতোমধ্যে বেশ ক্ষিপ্র গতিতে গাড়ি চলছে। মেট্রোরেলের ছন্দময় চলন দেখে বোঝার উপায় নেই কী পরিমাণ দ্রুততার সাথে ছুটছে। আমরা ব্যাগ রেখে সিটে গিয়ে বসি। খুব একটা ভিড় নেই বলে সিট পেতে কষ্ট হলো না। মাঝখানে ‘দৌলা কুয়ান’ নামে একটি বড় স্টেশনে থেমেছে। পরের স্টেশন ‘দিল্লি এরোসিটি’। আমরা তৈরি হচ্ছি নামবো।
মেট্রোরেল যেহেতু খুবই সামান্য সময়ের জন্য থামে। সেহেতু আগে থেকে নামার জন্য তৈরি হতে হয়। ২০-২৫ মিনিট সময়ের মধ্যে আমরা ‘দিল্লি এরোসিটি’ পৌছে গেছি। নির্ধারিত বক্সে কয়েন ফেলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। এখান থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই ‘মহীপালপুর’ কিয়ান হোটেল। কিন্তু আমরা একটা ট্যাক্সি নিলাম। ইতোমধ্যে কেনাকাটা করে আমাদের ব্যাগের ওজন বেড়েছে। ফলে ক্লান্তি নিয়েক আর হাঁটতে চাইছিলাম না। ১০০ রুপি দিয়ে মুহূর্তে পৌঁছে যাই ‘কিয়ান’ হোটেল।
চলবে…