নূপুর পায়ে বর্ষা
নূপুর পায়ে বর্ষা এসে বাইরে করে নৃত্য
সুরের ছিটায জাগিয়ে তোলে সব বয়সী চিত্ত।
লতাকুঞ্জ, গাছের সারি নড়েচড়ে ওঠে
উঁচু থেকে জল গড়িয়ে খিলখিলিয়ে ছোটে।
ঘরের পাশে ফুলরা জাগে একটু দূরে মাঠ
উঠোনে বেরিয়ে রুপু করে বৃষ্টি পাঠ।
রং-বেরঙের পোশাক পরে দাড়িকানা পুঁটি
এ-পাড়া ও-পাড়ায় যেতে করে ছোটাছুটি।
কচিকাঁচার হুল্লোড়ে মন টিকে কি আর ঘরে
দু’ তিন দফায় দিনকে মাতায় হুটোপুটি করে।
বৃষ্টি এলো ধূলি-ময়লা ভেসে গেলো জলে,
খরার যতো তৎপরতা কাটলো তলে তলে।
সবজি তাজা হয়ে ওঠে দেখতে বাড়িঘর
শিশুর মুখের হাসি নরোম সাজে ঘাসের চর।
রংধনুর সাত ফিতায় বাঁধে আকাশ আপন চুল
ফুরফুরে দিন, গানে মজে টিয়ে ও বুলবুল।
মন উড়ে যায়
বাবুই ফুড়ুৎ মন উড়ে যায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে মাঠ
দূরের আকাশ ঘুরে দেখি শিখতে মুক্ত পাঠ।
নদীনালা, গাছেরডালা দৃষ্টি কাড়া ফুল
কাছে পেয়ে উঠতে গেয়ে মন সাজে বুলবুল।
রঙধনু রঙ, নীলের শোভা দিঘির জলে মাছ
দেখতে উঁকি – হয়ে রবির এক পায়ে তালগাছ।
ফলের দিনে খোঁজে কবির আমকাঁঠালের সুখ
দু’খ তাড়িয়ে রাঙা করতে সব মানুষের মুখ।
ঢেউয়েরমালা গলায় দিতে সাঁতার কাটে মন
রঙ-বেরঙের পৃষ্ঠা ভেবে পড়ে পাশের বন।
গাছরা থাকে মিলেমিশে ফুলে পাখি সই
এ সব দেখে মান ভেঙে দিই–খুলি কথার বই।
শৈশব
আকাশ ছোঁয়া বনকে দেখি হাত নেড়ে ডাক দিচ্ছে
তখন পাখির মিষ্টি ভাষা শিখতে জাগে ইচ্ছে।
বুনোহাঁসের পাখনা মেলে ইচ্ছে অনেক উড়তে
পাহাড়, নদী, সবুজসিঁড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরতে ;
মেঘের ঢেউয়ে কাটতে সাঁতার, সুখের শিকেয় দুলতে
রংধনু রং মেখে মুখে দুঃখকে চাই ভুলতে।
পঙ্খীরাজে, নাগর দোলায় চড়ে খুঁজি শৈশব
আম কুড়ানো, কুল কুড়ানোর মন মাতানো ঐ সব।
বকের সারির মতো ওড়া পাল তোলা নাও ডাকতে
নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াই, ব্যস্ত থাকি আঁকতে।
গরু-মোষের গাড়ি চড়ে প্রকৃতিকে বুঝতে
কমর কষে নেমে পড়ি হারানো দিন খুঁজতে।
লাঠি খেলা, জারিগানের হারিয়ে যাওয়া তাল কি
পাবো খুঁজে – আর পাবো কি বউ চড়া সেই পালকি ?
সুঁইয়ের ফুড়ের নকশি কাঁথা, আরো এমন গল্প
মাঝে মাঝেই ভাবিয়ে তোলে বেশি কিংবা অল্প।
এই দেশ
টুনটুনি খেলে যায়
ডালিমের ডালে
রোদ উঠে চুমো খায়
জারুলের গালে।
কোকিলেও গান ধরে
সাথে অলিকুল
এই সব দেখে ফোটে
বনে নানা ফুল।
আম আতা কাঁঠালের
মিঠা মিঠা ঘ্রাণ
মৌসুমী স্বাদসহ
জিভে মারে টান।
শ্রাবণের জলে চাঁদ
খায় গড়াগড়ি
কদমের ফোটা ফুল
কয় সরাসরি।
সর্ষের খোলে খোঁপা
সুতিয়ার পাড়ে
দুর্ভাগা ছাড়া এই
দেশ কেবা ছাড়ে?
২.
সবুজের মোলায়েম মিহি শাড়ি পরে
এই দেশ সেজে আছে রূপে মনোহরে।
রূপালি নদীর পাশে হাঁটে বধূ বেশে
দেখে রুই মৃগেলেরা জলে ওঠে ভেসে।
বাতাসেরা ঢেউ তুলে কাশবনে হাঁটে
বুনোটিয়ে দল বেঁধে সুর ধরে মাঠে।
সেই সুরে ডুবে যেতে মনে মারে জোশ
এইভাবে কাটে দিন এতে কোনো দোষ ?
অবসরে ঝরনায় হলে উপনীত
কলকলে রাগিনীর হাতে হই ধৃত।
দূরে গাছে দেখা যায় পাখি সাজে বউ
তার পাশে মৌমাছি ফুলে খোঁজে মৌ।
খোলা মাঠ নদী বিল পাখি ফুলে ভরা
দেশটাই মনে হয় তুলি কাজে গড়া।
ইয়া বড় দুই ডিম
রাতের নিরব খোলসটাকে ভেঙে
বেরিয়ে পড়ে ফুটফুটে এক ভোর
আড়মোড়া দেয় খেলার সাথীর মনে
চুলের সমান আঁচ লাগেনি তোর।
রবি যখন লুকোচুরি খেলে
পাতায় পাতায় মুচকি হাসি ছড়ায়
বনের পাখি ছড়িয়ে পড়ে মাঠে
আমার তখন বইয়ে সময় গড়ায়।
শব্দে শব্দে, লাইনে লাইনে ডুবি
খুঁজে ফিরি বিষয় গভীরতা
বড় করতে জানার পুঁজিপাটা
সামনে রাখি গুরুজনের কথা।
বই টেবিলে গুনে চলছে প্রহর
মা সেই কখন ডাকলো খেতে নাস্তা
অথচ তুই একবারও তাকাসনি
বাড়ির সবাই হারিয়েছে আস্থা।
পরীক্ষা যেই টোকা দেবে দ্বারে
বেণী পুড়ে হাতে আগুন লাগবে
সর্ষে ফুলে দেখবে ভুতের খেলা
কুলুকুলু চোখে তখন জাগবে ?
ফল বেরুনোর বিদ্যালয়ের মাঠে
টগবগিযে আসবে দু’টি ঘোড়া
ইয়া বড় দুই ডিম দেবে তোর হাতে
অশ্রুতে রূপ নেবে সে ডিম জোড়া।
দেশের কাছে
টিয়ে ঠোঁটে রঙ ছড়িয়ে সূর্য দেখি উঠতে
এমন সময় তুলি কর্মে মুনকে দেখি ছুটতে।
মনের কোণে লুকিয়ে আছে কতো রঙিন শখ যে,
তুলির টানে আঁকতে পারে কাস্তে গলা বক যে।
আঁকতে পারে শাপলা-শালুক, পদ্মফুলের হাসি
পানকৌড়িদের ডোবাভাসা দেখতে থাকা চাষী।
রঙপেন্সিলে ফুটিয়ে তোলে বিড়াল ছানা পুষি,
লালসবুজের পতাকাকে এঁকে বেজায় খুশি।
পরেই ছোটে রবিশস্য, সোনালি শীষ আঁকতে
নদীর জলে ভাসতে থাকা হাঁসগুলোকে ডাকতে।
কৃষ্ণচূড়ায় লাল হরফের লেখা কি তা জানতে
এই ছুটে যায় ইতিহাসের খবর পেড়ে আনতে।
এই ছুটে যায় পাহাড় ছোঁয়া দেখতে দূরের বনকে
সমব্যথী কাতর চোখে আঁকতে পাখির মনকে।
এমনভাবে ছোটাছুটি মুনের সারাদিন যে
কারণটা তার দেশের কাছে আছে অনেক ঋণ যে!
শফির শপথ
কোটি কোটি রুপোর বুটি ঐ আকাশের নীল জামায়
জোনাকিরা ঝোপের কাছে, রাতপরী কি নাচ থামায় ?
পুকুরপাড়ে, ফুলবাগানে ঝিঁঝির সুরে মুগ্ধ হয়
কাঁচরাফুলে চোখ পড়াতে কলমিফুলে গল্প কয়।
শফি তখন বইয়ের পাঠায় ধীরে গভীর মন ভোলায়
ছায়াপথের গ্রহতারা রহস্যে তার বুক ফোলায়।
মনের কোণে একটু ভাবের জ্বলজ্বলা মুখ দেয় উঁকি,
ঐ যে আকাশ-শিলিং ঝোলা চাঁদ-সেতারার ভার ঝুঁকি
কাঁধে করে দাঁড়ালো কে এমন মহা দেও-দানব?
সৌরবাসী শান্ত সবাই নেই ওখানে ঘেউ-মানব?
রেষারেষি ঘেষাঘেষির ঘেরাও মিছিল সভা নেই
গ্রহ-তারার তাই বিচরণ কক্ষপথে অবাধেই?
অথচ এই পৃথিবীতে একটু লাভের টের পেলে
প্রতারণা সময় বুঝে ঘাড় উঁচিয়ে চোখ মেলে
ছোবল মেরে দেশের দেহ নীল করে দেয় মুহূর্তে,
জ্বালিয়ে দেয় পুড়িয়ে দেয় ঘড়ির কাঁটা না-ঘুরতে।
শফি এসব ভাবতে হঠাৎ কষ্টে হামাগুড়ি দেয়
লাউয়ের ডগায় বাড়ন্ত জিভ কেটে ফেলতে শপথ নেয়।
অনির্বাণ
যে আমাকে বাঁ-হাত দেখায়
চুপটি হাঁটে পুকুর পাড়ে,
পাখি দেখতে নেয় না সাথে
বললে বরং আছাড় মারে।
ফুল কুড়িয়ে আনে একা
সূর্যি সোনা জাগতে বাকি,
বুলবুলিকে জাম দিতে কয়
পড়ার ঘন্টা দিয়ে ফাঁকি !
তুমিই বলো, সে কখনো
হতে পারে আমার সাথী
ঘরে ঘরে জ্বালিয়ে দিতে
অনির্বাণ এক জ্ঞানের বাতি ?
কতো ছবি ভাসে
মনের কোণে ঢেউয়ের তালে কতো ছবি ভাসে
কিন্তু দেশের দৃশ্যপটই চোখ জুড়াতে বেস্ট
বাজনাসহ কতো গানের সুরই হলো শোনা
লবণ ছাড়াই স্বদেশের গান রুইয়ের পেটি টেস্ট।
সবুজ সারি আঁকা পথে স্বপ্নে হাঁটাহাঁটি
ঢুকলো মুখে চিবুক ছোয়া সুরসালো ফল
আঁকাবাঁকা মেঠো পথের নেই কোনো তুলনা
আরো ভালো বাড়ির কাছের ক্ষীরো নদীর জল।
কক্ষ শোভা জাজিম বলো কিংবা সোফাসেট
একটু মানে বেশি লাগে আমন-বোরো খড়
তাক লাগানো দালান-কোঠার যেটুক অহংকার
সেটুক ধরে ধাক্কা মারে আমার মাটির ঘর।
কলের বোতাম টিপে যারা করে ঘোরাঘুরি
ইচ্ছে হলেই দর্শনীয় জা’গায় পড়ে নেমে
জলে ভাসা নৌকা আমার তাদের প্রতিযোগী
ঢের আনন্দ পেয়ে থাকি বৈঠা মেরে ঘেমে।
প্রতীক
বর্ষা ছাড়াই মায়ের চোখে
এত্তো কেনো জল
বুকের পাহাড় গড়িয়ে নামে
কোন আষাঢে্র ঢল ?
এমন কেনো – কী হয়েছে
কে ছিঁড়েছে মন
কোন সাগরের ঢেউয়ের কুমির
গিলেছে তাঁর ধন ?
ডিসেম্বরে বেশি ভিজে
কেনো মায়ের গাল
কা’দের শোকের প্রতীক হয়ে
সূর্য ওঠে লাল ?
গ্রাম্য মেয়ে
ঝিঁঝি সুরের মিহিসুতো বাঁধে খুকির মন
শীতের পিঠার চেয়েও ভালো ভ্রমরের গুঞ্জন।
রাতের ফিতা রেকর্ড করে কোলা ব্যাঙের ডাক
যে ডাক শুনে শ্রোতার মনে জাগে অনুরাগ।
দোয়েল শিসের সোনাদানায় ভরে যায় উঠোন
ভোরের হওয়ায় ভেসে বেড়ায় লালমোরগের ফোন।
প্রয়োজনের দেনা-পাওনা করতে পরিশোধ
ঘাড় উঁচিয়ে সূর্য উঠে ছড়ায় সোনা রোদ।
কামার-কুমার ব্যস্ত সবাই আপন আপন কাজে
গ্রাম্য মেয়ে হাসিখুশি ডুবে এদের মাঝে।
আদর পেয়ে
আদর পেয়ে এক রোখা মন বানর সেজে গেছে
সুযোগ পেলেই সময় কাটায় গাছে নেচে নেচে।
পেয়ারা খায়, পটল ছিঁড়ে কলা কাড়ে পথে
খেলনা কাড়ে ঝুড়ি থেকে রুপুর উলটা রথে।
ডালে বসে ভ্যাংচি কাটে ফেরত দিতে বললে
রুটি বা ডাল হাতিয়ে নেয় কেউ একাকী চললে।
মুড়ি চিড়ে বিস্কুট নিয়ে করে কাড়াকাড়ি
খামচিয়ে দেয়, চুল ছিঁড়ে নেয় করলে বাড়াবাড়ি।
চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে করে টানাটানি
বক দেখিয়ে, ফোড়ন কেটে লাগায় হানাহানি।
ঢিল দিলেই মন এমন ভাবে মাত্রা ছেড়ে যায়
এদিক সেদিক খেতে খেতে নিজের কপাল খায়।
হারিয়ে গেছে
হারিয়ে গেছে খেলনা ঘোড়া, সাথে সেদিনগুলিও
ছোঁয়াছুঁয়ি, ধূলি খেলা, ফোকলা হাসির বুলিও।
পুতুল বিয়ের আয়োজনে ভাই-বেরাদর ডেকে
লালমাটিতে রঙ বানিয়ে গায়ে গায়ে মেখে
মিছেমিছির রান্না শেষে মিছেই খাবার খাওয়া
কাগজের নীল নৌকা দিয়ে বউকে নিয়ে যাওয়া
সে নৌকাতেই বৈঠা মেরে মাঝি-মাল্লা ঘামে
স্রোতের টানে পারি দিয়ে বাড়ির ঘাটে থামে,
সেই খুশিতে মা-ও মেতে বউ নিয়ে যায় ঘরে
তুর্কি নাচ আর কলাপাতার বাঁশির স্বরে স্বরে।
বলো কেনো সেদিনগুলো ফিরতে দেখি না
বৈশাখে বা ঈদে ডাকলে ফিরে আসবে কিনা ?
হারিয়ে গেছে ডাংগুলি আর গোল্লাছুটের গোল
হা-ঢু-ঢুতে জেতলে যেমন বাজতো বাংলা-ঢোল।
চলতো মেলায় মোরগ লড়াই বা লাঠিয়াবারি
চাচা আপন জান বাঁচিয়ে ভাঙতো কতো হাঁড়ি ;
ঘোড়ার খুড়ের শব্দ হতো, চলতো গরুর নাড়াই
ঐ কাঁচাকাল ফিরে পেতে কার কাছে হাত বাড়াই ?
খুকি খেলতো এক্কা-দোক্কা আমরা মার্বেল দিয়ে,
বৃষ্টি-রোদে চলতো তখন খেকশিয়ালের বিয়ে।
এরই মাঝে হাওয়া হলে প্রতিযোগী মেঘ
কেটে যেতো শিশু মনের অজানা উদ্বেগ ;
পাল্লা দিয়ে উড়তো ঘুড়ি সাপের ফণা তুলে
তুমিই বলো সেদিনগুলো কীভাবে যাই ভুলে ?
বারুদ-ঝড়
পাখিটাকেও মারতে হলে ভিতর একটু কাঁপে
জেল বা জরিমানায় গড়ায় শোধরাতে সে ভুল
খেসারতের ক্ষোভে কেউবা ছিঁড়ে আপন চুল –
কিন্তু ওরা কী ভায়ানক এইটুকুন নেই চাপে !
বিজলি চমক দিয়ে নামে বোমা আকাশ থেকে
গুঁড়িয়ে দেয়, মিশিয়ে দেয় দাঁড়িয়ে থাকা ঘর
নিদ্রা ও জান ছিনিযে নেয় সেজে বারুদ-ঝড়
পেশী-বলের পাহাড় হয়ে গাজায় বসে ঝেঁকে।
ট্যাঙ্কগুলোকে নামায় পথে জ্যান্ত খিদের কুমির
হামলে পড়ে লেজ বিঁধিয়ে নিরাপত্তা গিলে
নৃশংসতায় নাড়িয়ে দিয়ে অধিবাসীর পিলে
শিকড় তুলে, শিকড় গাড়ে স্থায়ী হতে ভূমির।
মানবতার ধ্বজাধারী, কুলুপ কেনো মুখে
ফিনকি কেনো দেয় না এখন প্রতিবাদী রক্ত
রসুন কোয়ার ঐক্যে এরাও নাকি নিরব ভক্ত
তা না হলে আগুন কেনো জ্বলছে গাজার বুকে?