ভাবনা-সুতোয় আটকানো মাছ
আধমরা রোদ নিকেল করা মিষ্টি বিকেলবেলা
পুকুর ভরা কচুরি ফুল একটা কলার ভেলা
ঠায় দাঁড়িয়ে—বকটা হঠাৎ তুলল ঠোঁটে পুঁটি
বড়শি ফেলে বসে আছি পাশে ফড়িং দুটি।
কারও মুখে রা মোটে নেই হা করা মুখপানে
তাকিয়ে ফড়িং উড়াল দিলো ফিরলো মনের টানে।
দেয়নি ধরা একটা মাছও, যায়নি খাবার গলে!
চালাক হলো মাছরা কবে আবার তলে-তলে;
ভাবতে গিয়ে মনের কোণে ঘাই দিলো এক বোয়াল
মুখটা খুলে বললো ভায়া—দেখলে আমার চোয়াল!
শক্ত ভীষণ; পেটটাতে ভাই অনেক লাগে খাবার
নাস্তা সারি টাকি খেয়ে—লাঞ্চেতে রুই আবার
বিকাল হতেই পেটের ভেতর লাফায় খিদে জোরে
শিং-মাগুরের ঝোল খেলে ফের মাথাটা বেশ ঘোরে!
জানো না তো, রাতে আমার ঘোরাফেরা বারণ
বললে কথা বাড়বে শুধু হাজারটা তার কারণ।
ডিনার সারি সন্ধেবেলায় তপসে, চিতল কৈ-এ
জানবে সবই, দেখবে লেখা আছে তোমার বইয়ে।
হঠাৎ ছিপে টান!
মাগরিবের আজান
ভাবনা-সুতোয় আটকানো মাছ ফসকালো হাত থেকে
কচুরিতে আটকে গিয়ে বড়শি গেছে বেঁকে!
বোকা চিলের কাণ্ড
ওই যে সুনীল আকাশ মেঘের ইশকুলেরই খাতা
সেই খাতাতে হচ্ছে আঁকা ব্যাঙের বিশাল ছাতা।
ছাতার তলে বসবে গিয়ে কোলা ব্যাঙের ছানা
হচ্ছে আঁকা বক হাতি বাঘ—বাঘের মাসির নানা।
আঁকাআঁকি শেষ হলো কী? ঘাই দিলো এক চিলে
চিলের বাড়ি খুব দূরে নয়—থাকে হাতির ঝিলে।
উড়তে গিয়ে চিলের চোখে পড়লো ব্যাঙের ছানা
ছানা তখন হাত-পা ছুড়ে গাইছে মেঘের গানা।
তুলতুলে ব্যাঙ দেখেই চিলের লোল ওঠে মুখজুড়ে
ধরতে হবে, ধরবেই সে ব্যাঙটা যে কুড়মুড়ে!
মেঘের গায়ে কামড় দিলো ঠোঁটটা গেলো বেঁকে
ব্যাঙটা কি আর আস্ত থাকে রঙতুলিতে এঁকে?
এই শহরে
রোদের সাথে গল্প জমে বেশ।
গল্পটা হয় সকালবেলা, যখন থাকে স্নিগ্ধ পরিবেশ।
উড়ছে চড়ুই। কাকের সাথেও রইছে দারুণ ভাব।
উড়ে উড়ে ইচ্ছে হলে করে দৌড়-ঝাঁপ।
ওদের সাথে গল্প করি। আব্বু বলেন—বন্ধু বানাও ওদের।
যারা তোমার একলা একায় আনন্দ দেয়, খেলার সাথি রোদের।
রোদকে ভালো দেখতে পারি? মোটেও নয়।
দুচোখ জ্বলে; রোদের গায়ে আগুন জমে রয়!
তার ওপরে বাড়ির পরে বাড়ি।
যেন রোদের সাথে ভীষণ আড়ি!
জানলাগুলোর ফাঁক গলে যে রৌদ্র ভাসে
মুখ থাকে ভার। করুণ চোখে রয় তাকিয়ে আর—
ওদের সাথে যায় কী খেলা? যায় না পাওয়া ছায়া সারি-সারি।
চিলেকোঠায় যেতে মানা।
মনটা আমার কেউ বোঝে না, কেউ বোঝে না!
সকালবেলা। পাখির খেলা।
চলছে যখন ছাদে, দুচোখ শুধুই কাঁদে।
আব্বু ছোটেন অফিস—ঘরে আম্মু মহাবিজি
এই শহুরে জীবনযাপন দারুণ হিজিবিজি!
জানলা ধরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রৌদ্র-সকাল দেখি
এই শহরের জীবনকথা কলাপাতায় লেখি।
চল, বাড়ি যাই
ও জয়িতা, চল বাড়ি যাই; দত্তবাড়ি।
মেঘের গায়ে ঝুলছে রে মা গাছের সারি।
চিনবি এবার আল-মেঠোপথ শাপলা ও জুঁই
দেখবি খেলা দাদির হাতে কাঁথা ও সুই।
ও জয়িতা, মেহদিমাখা ছোট্ট দুহাত
কপালে টিপ খেলার সাথি রাঙা প্রভাত
কিচির মিচির পাখির ডাক আর কচুরিফুল
সাঁঝের মায়া সন্ধ্যাবাতি নদীর দুকূল…
চল বাড়ি যাই, ও জয়িতা ডাকছে দাদি
চালের পিঠার জন্য রে মা মনটা বাঁধি
আধাআধি ভাগ করে তুই আমি খাব
চল তো রে মা, আমরা বাড়ি আজই যাব।
চোখ খুলিনি, হা হা
মিষ্টি বিকেল জানলা খোলা
আসছে বাতাস দিচ্ছে দোলা
উড়ছে ফড়িং উড়ছে পাখি
এই বিকেলে মনটা রাখি
ওদের পাখার ওপর;
মাথায় দিয়ে টোপর—
একটা বুড়ো দুইটা খোঁড়া
বানিয়ে ওদের পাগলা ঘোড়া
চাপর দিলেই উড়ে উড়ে
চারদিকেতে ঘুরে ঘুরে
দেখায় পশুপাখি;
মেলে মনের আঁখি—
হাতির পিঠে বসি চেপে
বাঘটা ভয়ে মরছে কেঁপে
জারুল গাছের পাতায় পোকা
কাঠঠোকরার বেহুঁশ ঠোঁকা
কৃষক জমির আলে
হাতটা রেখে গালে
ঠাঁস ঠাঁসা ঠাঁস মারছে মশা;
অতিষ্ঠ মোষ—চালে শশা
গাভী-বাছুর ছুটোছুটি
পুকুরে মাছ কাতলা দুটি—
উঠল জালে, আহা!
চোখ খুলিনি—হা হা
দেখতে দেখতে নামলো আঁধার
তবু পিঠে এখন গাধার
হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছি দূরে
মেঘের দেশে অচিনপুরে!
মা, ওগো মা
হাওয়ায় ভাসার স্বপ্ন নিয়ে
বলছি মাকে—উড়ি
দূরের আকাশ;
ঢেউ তুলেছে রোদসমুদ্দুর;
ঘুড়ি!
উড়তে উড়তে সূর্যমামার বাড়ির কাছে যাই
হাতের নাগাল পেলে তাকে বলব কথাটাই—
এত্ত কেন গরম ছড়াও ঝরছে মাথার ঘাম
মেঘের শিকল দাও না খুলে ঘুরুক ডান ও বাম
আহ্লাদী মন খানিক হাসুক
কাঁদুক পুরো দিন
পরে না হয় দিও ছড়িয়ে
কড়া রোদের পিন।
মা, ওগো মা, যাই?
ভাঙব শিকল মেঘ বাঁধানো
করছি প্রতিজ্ঞাই
সূর্যমামার কড়কড়ে রোদ
ভাল্লাগে না—ছাই!
মায়ের ভাষা আমার ভাষা
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা এই ভাষাটা মায়ের
এই ভাষাটা প্রতিবেশির এই ভাষাটা ভায়ের
এই ভাষাটা বোনের এবং গাঁয়ের সকল লোকের
বাংলা আমার সুখের ভাষা দুখের এবং শোকের।
এই ভাষাতেই বলছি কথা হাজার বছর ধরে
ইতিহাসের পাতায় লেখা সোনালি অক্ষরে—
কবিতা, গান এবং নানান রীতিনীতির বাণী
ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সেসব কথা জানি।
বদ্বীপের এই দেশে—
একেক সময় একেক রাজা দখল নিতে এসে
নিপীড়ন আর বঞ্চনাতে করত জীবন নাশ
সেসব বাধা ভাঙতে সবার কাটত বারোমাস!
ব্রিটিশেরই শিকল ভেঙে পাকশাসকের গ্রাসে
বাঙালি এই জাতির মনে দুঃখ নেমে আসে।
মানুষ নামে দানব ছিল শোষণ ও শাসনে—
পাকি ছিল এই দেশেরই ক্ষমতার আসনে।
মায়ের ভাষা কাড়তে ওরা হিংস্র হয়ে ওঠে
দখল নিতে ছুড়ল গুলি কত্ত বোমা ফোটে!
‘উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা’ করলে হুকুম জারি
দাবির মিছিল বীরছেলেদের রক্তে হলো ভারী।
দাঁতভাঙা তার জবাব পেয়ে পেছাল ফের ওরা
বাংলা আমার প্রাণের ভাষা ভালোবাসায় মোড়া।
বাংলা মায়ের ভাষা আমার বাংলা সবার সেরা
হাজার যুগের আশার আলো স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা।
মেঘডুবো চাঁদ
নদীটার পাশ দিয়ে মেঘডুবো চাঁদ
হেঁটে যায় ধীরলয়ে সন্ধেবেলায়
তবু রুচি মেলে দিল তার দুটো হাত
চাঁদটার সাথে সে যে মাতবে খেলায়।
নদীটাও চুপচাপ, আছে মাছ ডুবে
হেঁটে হেঁটে চাঁদ বুঝি মেঘে দিয়ে ডুব—
যাচ্ছে দখিন থেকে; রোজ যায় পুবে
শরতের সাথে তার আছে ভাব খুব।
রুচির দুহাতে আলো—আঁধারির ঢেউ
খেলা করে কাশফুল দুই চোখজুড়ে
রাত বাড়ে, টর্চ হাতে নদীটায় কেউ
আঁধার কাটতে দেয় তোড়াজাল ছুঁড়ে।
নদীটার পাশ দিয়ে চাঁদ যায় বাড়ি
রুচিও ঘুমাতে যায় খুব তাড়াতাড়ি!
ইচ্ছে করে
ইচ্ছে করে অনেক দূরে যেতে
ইচ্ছে করে পাহাড় নদী ছুঁতে
উড়িয়ে যদি দেওয়া যেত ফুঁতে
তোমার বারণ এবং তাড়া খেতে—
তাকিয়ে দেখো আকাশ মেঘে ঢাকা
কোথাও কোথাও পাহাড়-নদী আঁকা
মেঘটা যেন আছে ভীষণ তেতে
বুঝিয়ে দিতাম ছাত্র হলে বেতে!
ইচ্ছে করে নদীর পেটে ঢুকি
পেটটা কত গহিন জলাশয়ে
ভাসিয়ে পাড়া নিচ্ছে মাটি ক্ষয়ে
দারুণ হতো পারলে দিতে উঁকি।
নদীর পেটে আমার ঘর ও বাড়ি
পাই না খুঁজে নদীর আহাজারি!
ইচ্ছে করে পাখির সাথে উড়ি
উড়ে উড়ে দূরের কোনো বনে
বাউণ্ডুলে—মেঘের ইস্টিশনে
পেটাই ঢোলক; করি বাহাদুরি।
ইচ্ছেগুলো অদ্ভুতুড়ে জাতক
খুলনা থেকে মুহূর্তে যায় ছাতক!
কুপোকাত
এই যে আকাশ তারায় ঢাকা
জোছনামাখা রাত
জানলা দিয়ে আসছে গলে
একটু হয়ে কাত।
চিকন আলো, ধূসর সাদা
ফিনফিনে এক হাত—
ধরতে গিয়ে ভাঙল গো মা
তক্ষকেরই দাঁত!
পাশেই ছিল আরশোলাটা
খাচ্ছিল দুধভাত
মাছি কী আর বসে থাকে
জাগল মনে সাধ
ভন ভনা ভন গাইলো গানা
ঝিঁঝিপোকার সাথ।
প্রজাপতি পাখনা মেলে
ধরতে গেল ছাদ—
অমনি ধপাস টিকটিকিটা
হলো কুপোকাত!